‘সাহিত্যসৃষ্টি’ প্রবন্ধের স্বরূপ আলোচনা কর।
- রামায়ণকে অবলমম্বন করিয়া আমি একথাটা দেখাইবার চেষ্টা করিয়াছি, মানুষের সাহিত্যে যে একটা ভাবের সৃষ্টি চলিতেছে তাহার স্থিতিগতির ক্ষেত্র অতি বৃহৎ। ‘সাহিত্যসৃষ্টি’ প্রবন্ধ অবলম্বনে মন্তব্যটি বিচার কর।
বস্তু জগতে অণু-পরমাণু নিয়মের অধীন। তাদের মধ্যে প্রকাশের এক দুর্নিবার আবেগ লক্ষ করা যায়। সাহিত্য সৃষ্টিকেও এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে হবে। দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা ভাব বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘুরে বেড়ায়। হর-পার্বতীর জীবনের অনেক কথা, রাম-সীতার নানা কাহিনী লোকমুখে পল্লীর গীতিসভার আসরে, কথকদের মুখে কতকাল ধরে যে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার কোনও ঠিক নেই। যখন কোন মহৎ কবির আবির্ভাব ঘটে, তখন তাঁর প্রতিভাগুণে ঐ সমস্ত লোকাহিনী সংহত হয়ে কাব্যে বাণীরূপ ধারণ করে। মহৎ কবি পুরানো কাহিনীকে নতুন রূপে প্রকাশ করেন। তখন সমগ্র দেশ আপন হৃদয়কে স্পষ্ট করে উপলব্ধি করতে পারে। এর ফলে জীবনবোধের গভীরতা ব্যাপ্তি লাভ করে। পুরানো গ্রাম্যগাথাকাহিনীকে কবি আত্মসাৎ করে, মার্জিত ছন্দে ও অলংকৃত ভাষায় তাদের নতুন রূপ দান করেন। কবিকঙ্কন মুকুন্দের ‘চণ্ডীমঙ্গল’, ঘনরামের ‘ধর্মমঙ্গল’, ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ প্রভৃতি এই শ্রেণীর কাব্য। কবিগণ লোকমুখের কাহিনীগুলিকে ঐক্যদান করে কাব্যে সংহত রূপ দান করেছেন। এইভাবেই পঞ্চতন্ত্র, আরব্য উপন্যাস, ইংলণ্ডের রাজা আর্থারের উপাখ্যান এবং স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ার সাগা সাহিত্য গড়ে উঠেছে। ঐ জাতীয় ঘটনা আমরা প্রাচীন গ্রীসের কবি হোমার রচিত দুটি মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’, ‘ওডিসি’ এবং ভারতবর্ষে ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারতে’ও দেখতে পাই। কবিদের কৃতিত্ব হল যে, বিচ্ছিন্ন কাহিনী ও খণ্ডগীতিগুলি সমাজজীবনে ছড়িয়ে ছিল, তাঁরা সেগুলিকে সংহত করে কাব্যরূপ দান করেছেন। যা ছিল নিতান্ত স্থূল গ্রাম্য কাহিনী, কবি প্রতিভার গুণে তাই কাব্যে সুষমা ও শিল্পরূপ ধারণ করেছে। লোকমুখে প্রচলিত খণ্ড গীতিগুলি লোকমানসের অনুভূতিতে সমৃদ্ধ হয়েছে। তাই তারা সেই দেশের সম্পদ হয়ে উঠেছে। মহকবি এসে সেই খণ্ড কাহিনী ও গীতিগুলির মধ্যে পারম্পর্য দান করেন। তাঁর সৃজনী প্রতিভাগুণে তারা সর্বকালের উপযোগী হয়ে ওঠে।
রামচন্দ্রের কাহিনী রামায়ণ রচনার আগে দেশের মধ্যে ছড়িয়ে ছিল। তাঁর পিতৃসত্য পালনের জন্য বনবাসগমন এবং পত্নী অপহরণকারীর বিনাশ সাধনের ঘটনা আগেই প্রচলিত ছিল। কবি এই সমস্ত গ্রহণ করে তাদের মধ্যে রামচরিত্রে মহত্ব আরোপ করেছেন। দাক্ষিণাত্যে দ্রাবিড় জাতীয় রাজবংশ একদা পরাক্রান্ত হয়ে উঠে আর্যদের সন্ত্রস্ত করেছিল। রামচন্দ্র বানর সৈন্য অর্থাৎ আদিম অধিবাসীগণকে সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে অনার্যদের পরাজিত করেন। আর্যরা কৃষিবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। তাঁরা আরণ্য অঞ্চলের অনুর্বরতা অপসারিত করে চাষের ক্ষেত্রকে ব্যাপ্তি দান করেছিলেন। যেহেতু রাক্ষসগণ ছিল এ ব্যাপ্তির অন্তরায়, সেইজন্য আর্যদের হাতে তাদের পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছিল। হালচষার মুখে উত্থিতা জানকীকে বিবাহ করে নবদুর্বার্দলশ্যাম শ্রীরামচন্দ্র অনার্যদের পরাজিত করার ব্রত গ্রহণ করেছিলেন। রামচন্দ্র বালি ও সুগ্রীব এই প্রতিদ্বন্দ্বী দু’ভাইয়ের মধ্যে একজনকে বধ করে অন্যজনকে নিজের দলভুক্ত করে নিলেন। তিনি বানর সৈন্যদের যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী করে, লঙ্কায় শত্রুপক্ষের মধ্যে অকারণ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে সেই দেশ ধ্বংস করেন।
রাক্ষসেরা স্থাপত্যবিদ্যায় পারদর্শী ছিল। স্বর্ণলঙ্কার খ্যাতি সে কথাই প্রমাণ করে। রামচন্দ্র শত্রুকে পরাজিত করেন, কিন্তু কিষ্কিন্ধ্যা বা লঙ্কার রাজ্যভার অনার্যদের উপর অর্পণ করেন। এর ফলে ভারতবর্ষে আর্য ও অনার্য ধারা মিলনে নতুন সভ্যতা গড়ে ওঠে। রামচন্দ্রের পূণ্যস্মৃতি কালক্রমে সাধারণ মানুষের ভক্তির অর্ঘ লাভ করল। রামায়ণে আর্যসভ্যতার ত্যাগ, ক্ষমা ও সমষ্টি কল্যাণের আদর্শ প্রকাশিত হয়েছে। এতে রামায়ণ ভারতীয় সমাজের মহাকাব্য হয়ে উঠেছে। রামচন্দ্র গার্হস্থ্য জীবনের আদর্শরূপে, আর্যধর্মের ত্রাণকতারূপে এবং প্রজানুরঞ্জনকারী রাজারূপে লোকপূজ্য হয়েছেন। বাল্মীকির কাব্যে রামচরিত্রে অৰ্তিপ্রাকৃতের প্রভাব কিছু থাকলেও তিনি আদর্শ মানবরূপে অঙ্কিত হয়েছেন।
পরবর্তীকালে দেখা গেল যে, জনসমাজে নতুন ভাবধারার সংঘাতে রামচরিত্রে ও রামায়ণী কথায় পরিবর্তন ঘটেছে। জনসমাজে এই সত্য অনুভূত হয়েছিল যে, ঈশ্বর দীনহীনের পরম আশ্রয়। সরলভক্তির সাহায্যে তাঁকে লাভ করা যায়। বৃত্তিবাসী রামায়ণে এই নতুন ভাব চৈত্যনোত্তর কালের ভাবধারা প্রক্ষেপ জন্য পরিপুষ্ট হয়েছিল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, কৃত্তিবাসের প্রচলিত রামায়ণে ভক্তবৎসল শ্রীরামচন্দ্রের কাহিনী প্রাধান্য লাভ করেছে। এমন কি লক্ষাধিপতি রাবণও শত্রুভাবে তাঁর ভজনা করে মুক্তি পেলেন। ভক্তির এই অনাবিল প্রবাহ কৃত্তিবাসী রামায়ণে এক নতুন সুর এনে ছিল। কৃত্তিবাসের কাব্যে ভক্তির এই ভাবটি ভাগীরথীর ধারার মত মূল প্রবাহের সঙ্গে সংগতি রক্ষা করে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছে।
পরবর্তীকালের ইউরোপ থেকে নতুন ভাবের প্রবাহ এসে আমাদের দেশের মনকে আলোড়িত করেছে। ভাবের সংঘাতে সাহিত্যে নতুন সৃষ্টির পথ উন্মুক্ত হয়ে থাকে। সাহিত্যে যদি ভাবগত কোন পরিবর্তন না আসে তবে পুরনো ধারা অনুসরণ করে সার্থক সৃষ্টি আর হয় না। মধুসূদন তাঁর ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ রামায়ণী কথাকে এক নতুন ভাবমূর্তি দান করেছেন। এই ভাব রসমূর্তি লাভ করেছে। পাশ্চাত্য দেশে শক্তির যে বিচিত্র লীলা লক্ষ করা যায়, যে প্রচণ্ড জীবনোল্লাস অনুভূত হয়, মধুসূদন তাকে পুরনো রামায়ণ কাহিনীর মধ্যে সঞ্চরিত করে নতুন প্রবাহ সৃষ্টি করেছেন। তাঁর রাবণ ধর্মভীরু নন। তাঁর চরিত্রে দৈন্য ও আত্মনিগ্রহ কোথাও নেই। তাঁর শক্তির চারদিকে প্রভূত ঐশ্বর্য। এই শক্তি কোন শাসন মানতে চায় না, শাস্ত্র শাসনকেও স্বীকার করে না। এই যে অটল শক্তি তা প্রভূত মানসিক ঐশ্বর্যেরই প্রকাশ। ভয়ংকর সর্বনাশের মাঝখানে বসেও এই শক্তি হার মানতে চায় না। যে শক্তি অতি সাবধানে সমস্তই মানিয়া চলে তাহাকে যেন মনে মনে অবজ্ঞা করিয়া, যে শক্তি স্পর্ধাভরে কিছুই মানিতে চায়, বিদায় কালে কাব্যলক্ষ্মী নিজের অশ্রুসিক্ত মালাখানি তাহারই গলায় পরাইয়া দিল। সুতরাং দেখা যায় যে, সাহিত্যে ভাবসৃষ্টির একটি বৃহৎ ভূমিকা আছে। মানুষের মন নিজেকে নানারূপে কেবলই প্রকাশ করে চলেছে। তার রূপ ও রসের বৈচিত্র্যের সীমা নেই। এবং তার আবেদনও সুদূরপ্রসারী।
Leave a Reply