‘সাহিত্যের বিচারক’ প্রবন্ধের ভাববস্তু লেখ।
- অন্তরের জিনিসকে বাহিরের, ভাবের জিনিসকে ভাষার, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের এবং ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলা সাহিত্যের কাজ। ‘সাহিত্যের বিচারক’ প্রবন্ধ অবলম্বনে মন্তব্যটি বিচার কর।
সমালোচক বলেছেন— ‘‘Artist makes his state of mind clear to others, when it carries the thought-content expressed over the threshhold of somebody else’s Consciousness. Expression for the artist is Communication.’’ —এই যে প্রকাশ করার ক্ষমতা তার উদ্দেশ্য হল শিল্পীমানসের ভাব ও অভিজ্ঞতা অপরের মনে সঞ্চারিত করে দেওয়া। শিল্পী তাঁর অনুভূতিকে বাইরে রূপসৃষ্টির মাধ্যমে রসাস্বাদনের উপযোগী করে তোলেন। কবি তাঁর কবিতায় বিশেষ রূপকল্পের মধ্যে দিয়ে তা সার্থক করেন আর যিনি চিত্রকর তিনি চিত্রে প্রকাশ করে থাকেন। কাব্যের সঙ্গে চিত্তের এখানে সাদৃশ্য যে, উভয়ে বাস্তবের অনুকরণনা করে শিল্পীর মানস জগতের অনুভূতি ও চিন্তাকে বাস্তবজগতের উপরে প্রতিফলিত করে। চিত্রে যখন একটি মুহূর্তের পরিচয় আমরা পাই, তখন তা ফটোগ্রাফের মত একটি বিশেষ ক্ষণকে আবদ্ধ করে না, গতিকে আভাসিত করে। কাব্যে ও চিত্রে মানুষের যে পরিচয় থাকে, তার সমগ্র রূপের ব্যঞ্জনা প্রকাশের দিকে শিল্পীর দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে। তথাপি প্রসঙ্গ ক্রমে একথা বলা যায় যে, সংগীত অথবা চিত্রকলার সৌন্দর্য বিদেশীগণও উপভোগ করতে পারেন। কিন্তু কবিতার সৌন্দর্য যেন বিশেষ ভৌগোলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ। এ প্রসঙ্গে কবি এলিয়ট বলেছেন— ‘‘no art is more stubbornly national than poetry.’’
কবি যা অন্তরে উপলব্ধি করেন, তা তিনি বাইরে প্রকাশ করেন। এই প্রকাশ করার উপায় হল তার ভাষা। কিন্তু যেহতু এই ভাষার মাধ্যমে ভাবকে সংবেদনশীল পাঠকমনে সঞ্চারিত করে দিতে হবে, সেজন্য এই ভাষা হয়ে ওঠে কবিভাষা। ইংরেজ কবি ওয়ার্ডওয়ার্থ বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন যে, প্রাত্যহিক জীবনের ভাষার সংগে কাব্যের ভাষার কোন পার্থক্য নেই। তথাপি তিনি এই প্রাত্যহিক ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে নির্বাচন করার কথা বলেছেন। যে কবিভাষা কবির অন্তরের প্রগাঢ় অনুভূতিকে ব্যক্ত করবে তা তাঁর অন্তরের ভাষা। এই ভাষাকে রূপের ও সুরের ভাষা নামে অভিহিত করা যায়। অধ্যাত্ম-জীবনে সাধক যা উপলব্ধি করেন তা তাঁর অন্তরের ঐশ্বর্য। এই উপলব্ধিকে তিনি প্রকাশ করতে চান না। কিন্তু কবি যা উপলব্ধি করেন, তাকে তিনি সকলের জন্য, সকল মানুষের অন্তরের স্বীকৃতির জন্য প্রকাশ করেন। বাল্মীকি যেদিন ক্রৌঞ্চীর দুঃখ হৃদয়ে অনুভব করেছিলেন সেদিন তাঁর সেই শোকতন্ত্রীলয়সমন্বিত, সমাক্ষরবিশিষ্ট শ্লোকে উৎসারিত হয়েছিল। এই-ই আদি কবিতারূপে পরিচিত। অপর একটি দিকও আছে। সাধারণ একজন মানুষ যা উপলদ্ধি করে তা প্রকাশ করতে পারে না। এই অপ্রকাশের দৈন্য তার হৃদয়কে মথিত করে। কবি তার অব্যক্ত ভাব ও ভাবনার প্রতিনিধি কবির ভাষায়—
না পারে বুঝাতে, আপনি না বুঝে
মানুষ ফিরিছে কথা খুঁজে খুঁজে
কোকিল যেমন পঞ্চমে কূজে
মাগিছে তেমনি সুর।
কিছু ঘুচাইব সেই ব্যাকুলতা,
কিছু মিটাইব প্রকাশের ব্যথা,
বিদায়ের আগে দুচারিটা কথা
রেখে যাব সুমধুর।
যে ভাবকে কবি ভাষায় লিপিবদ্ধ করেন, তা তাঁর অন্তরের উপলদ্ধ গভীর সত্য। যা সত্য তাই সৌন্দর্য। অন্য দিকে, যে সৌন্দর্য কবি হৃদয়ে উপলদ্ধি করে থাকেন তার সঙ্গে সত্যের গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। এই হৃদয়ের ভাব বা অনুভূতি অন্তরের জিনিষ, এ লৌকিক জ্ঞানের মত প্রমাণ সাপেক্ষ নয়। ভাব এক অন্তর থেকে অন্য অন্তরে সঞ্চারিত করার অভিপ্রায়ে কবি কাব্যসৃষ্টি করে থাকেন। এর উদ্দেশ্য হল পাঠকগণকে আনন্দ দান করা। এই আনন্দ অহৈতুকী ও অলৌকিক। কবি অলৌকিক আনন্দের অধিকারী বলে তাঁকে কঠিন সাধনায় ব্রতী হতে হয়। সংসারের অনায়াস লভ্য সুখ ও সম্ভোগ পরিহার করে তাঁকে তপস্যা করতে হয়—
অলৌকিক আনন্দের ভার
বিধাতা যাহারে দেয় বক্ষে তার বেদনা অপার
তার নিত্য জাগরণ।
ভাষাকে আশ্রয় করে ভাব প্রকাশিত হয়। আবার এই ভাষা ভাবকে মুক্তি দান করে থাকে। ভাব যেখানে যথার্থ ভাষায় রূপকল্প খুঁজে না পায়, সেখানে তা অসার্থক। ভাষার মাধ্যমে ভাব সর্বত্র স্পষ্ট করে প্রকাশিত হতে পারে না, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাবে অস্পষ্টতা ও কুয়াশা আছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—সীতার স্পর্শসুখে আকুল রামচন্দ্র বলেছিলেন, সুখমিতি বা দুখমিতি বা এ সুখ না দুঃখ তা তিনি জানেন না। এখানে ভাবের আবেগহেতু ভাষা স্বাভাবিকভাবে অস্পষ্ট হয়েছে। বৈষ্ণব কবি বলরাম দাস লিখেছেন—‘‘আধ চরণে আধ চলনি আধ মধুর হাস’’ সেখানে ভাবুকের মনে চলন সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভাষা এখানে আরও স্পষ্ট হলে এ সম্ভব হত না। এই কারণে কবিতার অর্থ সর্বত্র পরিস্ফুট হলে তা ভাবের চরণে সীমা চিহ্নিত করে। যেখানে অর্থ অত্যন্ত স্পষ্ট সেখানে ব্যঞ্জনা লুপ্ত হয়। ‘চণ্ডীমঙ্গলকাব্যে’ ছদ্মবেশিনী দেবী চণ্ডীকে ফুল্লরা বারমাস্যা বর্ণনা প্রসংগে বলেছে—
দুঃখ করো অবধান, দুঃখ করো অবধান।
আমানি খাবার গর্ত দেখো বিদ্যমান।।
এই বর্ণনায় নাটকীয় নৈপুণ্য আছে, কিন্তু কাব্যরস অতিস্পষ্টতার জন্য পরিস্ফুট হয়নি। ‘সাহিত্যের আদিম সত্য হচ্ছে প্রকাশ মাত্র, কিন্তু তার পরিণাম সত্য হচ্ছে ইন্দ্রিয়মন এবং আত্মার সমষ্টিগত মানুষকে প্রকাশ।’ যা কবির নিতান্ত একলার বস্তু, যে অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা তিনি উপলদ্ধি করেছেন তা আপন হৃদয়ে অবরুদ্ধ না রেখে সকলের জন্য তিনি প্রকাশ করে থাকেন—
বলেছি যে কথা করেছি যে কাজ
আমার সে নয়, সবার সে আজ
ফিরিছে ভ্রমিয়া সংসার মাঝ বিবিধ সাজে।
যা ক্ষণকালের জিনিস তাকে কবি বা সাহিত্যিক চিরকালের সামগ্রী করে তোলেন। সাহিত্যস্রষ্টা যা রচনা করেন তা নিছক বর্তমান কালের জন্য নয়। চিরকালের মানবসমাজকে লক্ষ্য করেই তিনি সৃষ্টি করে থাকেন। প্রসঙ্গটি কবি টি.এস. এলিয়ট সুন্দরভাবে ব্যক্ত করে বলেছেন—‘‘What matters is that there should always be at least a small audience for him in every generation.’’ কাল নিরবধি পৃথিবীও বিপুলা, ভবিষ্যতে তাঁর সৃষ্টি ক্ষুদ্র গণ্ডী অতিক্রম করে শিক্ষিত জনমানবের চিত্তে আবেদন সৃষ্টি করবে। যে নাগরিক আবহাওয়ায় ভারতচন্দ্রের কবিতা শব্দ, সংগীত ও ছন্দের গুণে লোকমনে জনপ্রিয় হয়েছিল, কিন্তু কালের পরিবর্তনের সংগে সংগে এই জনপ্রিয়তা হারিয়ে যায়।
ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ একদা শস্য কাটার কাজে রতা একটি মেয়ের গান শুনে মুগ্ধ হলেন তা ছিল নিতান্ত ক্ষণকালীন অনুভূতি। কিন্তু তাকেই কবি চিরকালের ভাষায় ব্যক্ত করে গেলেন—
The music in my heart I bore,
Long after it was heard no more
জীবনের এই স্বল্পকালীন অনুভূতি, দেখার টুকরো, চলতি মুহূর্তের ছবি মিলিয়ে যায়। তাই কবির আকাঙ্ক্ষা হল—
তারমধ্যে দুটি একটি কুঁড়েমির দিনকে
পিছনে রেখে যাব।
ছন্দে গাঁথা কুঁড়েমির কারুকাজে,
তারা জানিয়ে দেবে আশ্চর্য কথাটি,
একদিন আমি দেখেছিলেম এই সব কিছু।
Leave a Reply