//
//

সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন জ্ঞানের বিষয় নহে, ভাবের বিষয়।

  • সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন জ্ঞানের বিষয় নহে, ভাবের বিষয়।
  • জ্ঞানের কথাকে প্রমাণ করিতে হয়, আর ভাবের কথাকে সঞ্চার করিয়া দিতে হয়। ‘সাহিত্যের সামগ্রী’ প্রবন্ধ অবলম্বনে মন্তব্যটি বিচার করো।

নিছক নিজের আনন্দকে নিজের জন্য লিপিবদ্ধ করা সাহিত্য নয়। সাহিত্যে আত্মগত। ভাবোচ্ছ্বাসের কোনো তাৎপর্য নেই। পাখির গান হয়তো তার স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের প্রকাশ, এর সঙ্গে পক্ষী সমাজের কোন সম্পর্ক নাও থাকতে পারে, কিন্তু লেখকের লক্ষ্য হল পাঠকসমাজ। অদৃশ্য পাঠক সমাজকে মনের সামনে রেখে লেখক রচনা করে চলেন। সুতরাং সৃষ্টির কৃতিত্ব যুগপৎ লেখক ও পাঠক সমাজের। তাই বলে এ যে কৃত্রিম তা বলা যাবে না। মাতার স্তন্যধারা সন্তানের জন্য বিগলিত হয়, তাকে স্বতঃস্ফূর্ত বলতে কোন বাধা নেই। সুতরাং নীরব কৃতিত্ব ও আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাসকে সাহিত্য বলা চলে না। সাহিত্যের ধর্ম হল প্রকাশ এবং তার ভাব পাঠকহৃদয়ে সঞ্চারিত হয়ে যায়। সুতরাং কোন রচনা রচয়িতার নিজের জন্য নয়। মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হল যে, সে অপরের হৃদয়ে আপন অস্তিত্বের স্বীকৃতি পেতে চায়। প্রকৃতি জগতে প্রাণীগণ সন্তান-সন্ততির বহুলতার মাধ্যমে তাদের জীবনের অধিকার বিস্তৃত করে। কিন্তু মানুষ আপন সৃষ্টির মাধ্যমে অপরের প্রাণে চিরকালীন অধিকার বিস্তার করতে চায়। সুতরাং মানুষের মনোভাবের চেষ্টা হল বহুমনকে জয় করা। সুপ্রাচীন কাল থেকেই মানুষ চেয়েছে নিজেকে বহুধা ব্যাপ্ত ও বিকীর্ণ করতে।

সম্রাট অশোক পর্বতগায়ে অনুশাসন উৎকীর্ণ করেছেন। এই পর্বত কোনকালে সরবে না, মরবে না, অনন্তকাল পথের পাশে থেকে পথচারীদের কাছে তার হৃদয়ের ভাবকে অনির্বচনীয় ভাষায় প্রকাশ করবে। সুদীর্ঘকাল সম্রাট অশোকের মহাবাণী মানব হৃদয়ে অব্যক্ত ছিল। তার পরে সমুদ্রপারের পণ্ডিত এসে তার অর্থ ব্যাখ্যা করলেন। তাঁর অনুশাসনগুলি যে সাহিত্য তা নয়। তবে এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মানব হৃদয়ের প্রধান আকাঙ্ক্ষা হল, বহু মানুষের হৃদয়ে অমরত্ব লাভ করা। মানুষের সকল প্রয়াস, ভাস্কর্য, চিত্র, সাহিত্য ও অন্যান্য শিল্পকৃতির উদ্দেশ্য হল অন্য মানুষের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকা। এই চিরস্থায়িত্ব লাভের প্রয়াসই সাহিত্যকে সার্থক করে। সাহিত্যের দুটি ভাগ—একটি মনন সাহিত্য এবং অপরটি রসসাহিত্য। সাহিত্য আমাদের জ্ঞানের পিপাসা চরিতার্থ করে, মানসিক অসম্পূর্ণতাকে ভরিয়ে তোলে, কিন্তু যা রসসাহিত্য তা অহৈতুকী আনন্দের সৃষ্টি বলে মানবমনে চিরস্থায়িত্ব লাভ করে। দর্শন, বিজ্ঞান হল মননসাহিত্য। এই সাহিত্য জ্ঞানপিপাসা চরিতার্থ করে, কিন্তু হৃদয়ে রস বর্ষণ করার জন্য অপ্রয়োজনীয় সাহিত্যের প্রয়োজন সর্বাধিক। যে কারণে পোপ মনন সাহিত্যকে Literature of knowledge এবং রস সাহিত্যকে Literature of power বলেছেন— ‘‘The function of the first is to teach, the function of the second is to move. The first speaks to the more discursive understanding; the second sympathy.’’

যা জ্ঞানের কথা তা মানুষ একবার জানলে আর জানতে চায় না। যে জ্ঞান আগে পণ্ডিতদের কাছে অগম্য ছিল, তা হয়ত আজ শিক্ষার্থী বালকদের কাছে অপরিচিত নয়। যে জ্ঞান আগে বিস্ময়ের সঞ্চার করেছিল, তা যদি আবার প্রকাশতি হয় তবে তার মধ্যে বিস্ময়ের কিছু থাকে না। তাই জ্ঞানের কথা একবার জানলে আর জানতে হয় না। সূর্য পূর্বদিকে ওঠে এই পরিচিত তত্ত্ব আর আমাদের মন আকর্ষণ করে না। কিন্তু সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য ও আনন্দ জীবসৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত মানবমনে অম্লান আছে। সুতরাং হৃদয়ভাবের কথা বারবার জানলেও তা পুরনো হয় না। যে অনুভূতি দীর্ঘকাল ধরে লোক-মানসের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসছে, কালক্রমে তার গভীরতা বৃদ্ধি পায়। জ্ঞানের বিষয় একভাষা থেকে অন্যভাষায় অনায়াসেই রূপান্তরিত করা যায়। তাতে তার উদ্দেশ্য যথার্থভাবে প্রকাশ হয়ে থাকে। কিন্তু ভাবকে তার মূল আশ্রয় থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। জ্ঞানের বিষয় প্রমাণসাপেক্ষ, আর ভাবের বিষয়কে নানা আভাস-ইঙ্গিত, নানা ছলা কলার মাধ্যমে অর্থবহ ও সঞ্চারধর্মী করে তুলতে হয়। ভাবের কথাকে শুধু প্রকাশ করলে চলে না, তাকে সৃষ্টি করতে হয়। এই যে কলাকৌশলপূর্ণ রচনা তাই ভাবের আশ্রয়। ভাবকে যথার্থ রূপে ভাবশরীরের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করা সাহিত্যস্রষ্টার কৃতিত্বের পরিচায়ক।

প্রাণের জিনিষ ভাবদেহকে আশ্রয় করে থাকে। এই দেহ ও প্রাণ পরস্পর যুক্ত ও একাত্ম। এদের বিচ্ছিন্ন করা যায় না। ভাব ও তত্ত্ব মানুষের সম্পদ। যদি কেউ ভাব প্রকাশ করতে পারেন, তবে কালক্রমে আর একজন এসে তা করবেন। তবে রচনারীতি একেবারে লেখকের নিজস্ব বস্তু। এবং এই রচনারীতির মধ্যে লেখক বেঁচে থাকেন। ভাব অথবা বিষয়ের গৌরব। তাঁকে অমরত্ব দান করে না। এই যে রচনারীতি তা যুগপৎ ভাব ও ভাব প্রকাশের উপায়কে বোঝায়। জলাশয় বলতে জল ও খনন কার্য এই দুটিকে আমরা বুঝি। কিন্তু জল যেহেতু প্রকৃতির দান সেজন্য তাকে সুদীর্ঘকাল ধরে জলাধারে পানযোগ্য করে রাখা মানুষের কীর্তিকে প্রকাশ করে। লেখকের ধর্ম হল ভাবকে আত্মসাৎ করে তাকে সাধারণীকৃত করা। এর ফলে ভাব লেখকের নিজস্ব হয়েও সর্বসাধারণের উপভোগ্য হয়ে ওঠে। গাছপালা অঙ্গারকে প্রথমত; নিজের করে, পরে সেই অঙ্গারের সাহায্যে নিজেদের দানকে সর্বসাধারনের করে তোলে। লেখকও ভাবকে আত্মস্থ করে সর্বসাধারণের উপযোগী করে তোলেন। সুতরাং যে ভাব সর্বসাধারণের সুপরিচিত, তাকে আত্মস্থ করে নিয়ে সাধারণীকৃত করা সাহিত্যের কাজ। সাহিত্য বাস্তব জগৎ থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে। সাহিত্যস্রষ্টা এই উপকরণসমূহকে আপন চিন্তায়, কল্পনায় ও অনুভূতির প্রগাঢ়তায় নিজের করে নেন।

সুতরাং যেভাৰ সুপরিচিত ও সমস্ত মানুষের নিজস্বতা লেখক আত্মস্থ করে নিয়ে অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার আলোকে তাকে নতুনভাবে প্রকাশ করেন। তখন তা সর্বসাধারণের আনন্দের বস্ত হয়ে ওঠে। এইভাবে সাধারণ থেকে বিশেষ বিশেষ থেকে সাধারণে রূপান্তর সাধন সাহিত্যের ধর্ম। আনন্দবর্ধন লিখেছেন—ক্রৌঞ্চদ্বন্দ্ব বিয়োগথঃ শোকঃ শ্লোকমাগতঃ অর্থাৎ ক্রৌঞ্চীর শোকহেতু বাল্মীকির মনের শোক শ্লোকরূপে প্রকাশিত হয়েছিল। এ লৌকিক শোক থেকে ভিন্ন। কবির হৃদয়ে শোকের বীজ ছিল। ক্রৌঞ্চীর আনন্দের মধ্যে তাঁর শোকভাব উদ্দীপিত হয়ে সর্বসাধারণের মধ্যে সঞ্চারিত হল। রসের অনুভূতি সন্তানবৃত্তি বিশিষ্ট। এর ধর্ম হচ্ছে বিস্তার লাভ করা। জ্ঞানের বিষয় সাহিত্য নয়। বিজ্ঞানের বিষয় ব্যক্তিস্বভাব বর্জিত অথচ সাহিত্যের বাণী স্বয়ংবরা। বিজ্ঞানের তত্ত্ব শুভ্র নিরঞ্জন মূর্তিতে সকলের কাছে প্রকাশিত হয়। কিন্তু সাহিত্যের বিষয় যুগে যুগে বিভিন্ন রচয়িতার হৃদয়ের আবেগে ও কল্পনায় রঞ্জিত হয়ে ওঠে। স্বভাবতঃ এই উপায়ে সাহিত্য অপরের হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়। এ তাই বৈজ্ঞানিক কোন তত্ত্বের মত আবিষ্কার নয়, বাস্তব জগতের অনুকরণ নয়, বাস্তবের উপাদান নিয়ে এক নতুন সৃষ্টি। সাহিত্যের প্রত্যেক অংশের উপর এর সমগ্রতা নির্ভর করে। এর রূপান্তর তাই সম্ভব নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!