সংযমের সঙ্গে সৌন্দর্যবোধের সম্পর্ক।
- সংযমের সঙ্গে সৌন্দর্যবোধের সম্পর্ক।
- সৌন্দর্যবোধ ঠিকমত উদ্বোধনের জন্য ব্রহ্মচর্যের সাধনই আবশ্যক।
- যথার্থ সৌন্দর্য সমাহিত সাধকের কাছেই প্রত্যক্ষ, লোলুপ ভোগীর কাছে নহে।
- সৌন্দর্য যেমন আমাদিগকে ক্রমে ক্রমে শোভনতার দিক, সংযমের দিকে আকর্ষণ করিয়া আনিতেছে, সংযমও তেমনি আমাদের সৌন্দর্যভোগের গভীরতা বাড়াইয়া দিতেছে। ‘সৌন্দর্যবোধ’ প্রবন্ধ অবলম্বনে মন্তব্যগুলির যৌক্তিকতা বিচার কর।
ব্রহ্মচর্য পালনের কঠিন নিয়ম সংযম শুষ্কতার সাধনা নয়, রসের পূর্ণতার জন্য অপরিহার্য প্রস্তুতি। যে কৃষক জমি প্রস্তুত করে, তার উদ্দেশ্য জমিকে মরুভূমিতে পরিণত করা নয়, তাকে শস্যপূর্ণ করে তোলার জন্যই তার এই আয়োজন। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় যে, সংযমের শুষ্কতা উদ্দেশ্য না হয়ে লক্ষ্য হয়ে বসে। তখন নিয়ম লোলুপতা হয় ষড়রিপুর মত আরও একটি নতুন রিপু। একে জড়ত্বের লক্ষণ রূপে অভিহিত করা চলে। এই জাতীয় নিয়ম সাধনার দুঃখ ও অপব্যয়ের মাত্রা যত বেড়ে চলে ততই একশ্রেণির লোক আনন্দ পায়। তাদের কাছে নিবৃত্তির সাধনা চরম প্রবৃত্তি হয়ে দেখা দেয়। তেমনি জ্ঞান লাভের জন্য, আনন্দলাভের জন্য প্রাথমিক ভিত্তি দৃঢ় হওয়া প্রয়োজন। এই যে সংযম তার দৃঢ়তা আছে, শক্তির কাঠিন্য আছে, কিন্তু পরিণামে তা মানুষকে সৌন্দর্যভোগের অধিকারী করে তোলে। প্রবৃত্তিকে উদ্দাম করে তুললে সৌন্দর্য লাভ করা যায় না। তখন প্রকৃতি চারদিকে তার উন্মত্ত লালসার আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ফল আমাদের ক্ষুধা প্রবৃত্তি চরিতার্থ করে, কিন্তু এ ছাড়াও তার প্রয়োজনের অতীত একটি সৌন্দর্যের দিক আছে। এই সৌন্দর্য আমাদের মনকে জৈবিক প্রবৃত্তির উর্ধে আকর্ষণ করছে। তাই দেখা যায় যে, ক্ষুধাতুর মানুষ আহার গ্রহণ কালে শোভনতা প্রকাশ করে, বর্বরগণের মত লালসা উদ্ঘাটিত করতে সংকোচ বোধ করে থাকে। সৌন্দর্য আমাদের মনকে সংযম ও শোভনতার দিকে আকৃষ্ট করছে। সৌন্দর্য এমন এক অমৃত যা বাস্তবজীবনের দৈন্য ও কুশ্রীতার ঊর্ধ্বে মনকে আকর্ষণ করে। জৈবিক প্রবৃত্তি অসুন্দর বলে নিন্দিত হয়।
সৌন্দর্য শুধু মনকে সংযত ও শোভন করে না, আমাদের মনে সৌন্দর্য ভোগের গভীরতাও বাড়িয়ে দেয়। সংযত চিত্তে ধ্যান করতে না পারলে সৌন্দর্যের অন্তর্লীন মাহাত্ম অনুভব করা যায়না। সতী স্ত্রী প্রেমের মাহাত্ম্য উপলদ্ধি করতে পারেন, স্বৈরিণী তা পারে না। সতী স্ত্রীর মন ভাবরসে স্বামীর মনের সংগে যুক্ত, সেখানে কন্দর্পের সকল ছলাকলা ব্যর্থ হয়ে পরাজয় মেনে নেয়। সতীর সৌন্দর্যভোগ লাঞ্ছিত নয়, তা অঞ্চল ও নিষ্কলুষ। তাই তাঁর কাছে মদন পরাভূত—
পরক্ষণে ভূমি পরে—’
জানুপাতি বসি, নির্বাক বিস্ময়ভরে
নতশিরে পুষ্পধনু পুষ্পশরভার
সমর্পিল পদপ্রান্তে পূজা উপচার
তৃণ শূন্য করি। নিরস্ত্র মদন পানে
চাহিলা সুন্দরী শান্ত প্রশান্ত বয়ানে।।
পৌষ্যরাজা ঋষিকুমার উতঙ্ককে রাজঅন্তঃপুরে গিয়ে মহিষীকে দেখার জন্য বললে, তিনি তাঁকে চিনতে পারলেন না। উতঙ্ক অশুচি ছিলেন বলে রাজমহিষীকে দেখতে পাননি। বিশ্বের মধ্যে যে নিষ্কলুষ সৌন্দর্য বিরাজমান, তাকে ভোগ পঙ্কিল দৃষ্টি নিয়ে উপলদ্ধি করা যায় না। তা হল আত্মার সম্পদ, আকাঙ্ক্ষার সামগ্রী নয়। শাস্ত্রে বলেছে—ধর্মের জন্য নয়, সুখের জন্যও সংযত হবে। তাই সৌন্দর্য ভোগের জন্য নিয়ম পালন অত্যাবশ্যক। সমালোচকের ভাষায় এই সৌন্দর্য— ‘‘transmutes all that it touches and every form moving within its radiance of its presence is changed by wondrous sympathy to an incarnation of the spirit which it breathes.’’
সৌন্দর্যসৃষ্টিও অসংযমের মাধ্যমে হয় না। সেখানে চিত্তের সাধনা ও সংযম অপরিহার্য। জীবনে কোন স্থায়ী জিনিষ গড়ে তুলতে হলে অন্তরের ধর্মবুদ্ধির সাহায্যে তা ঘটে, অসংযমের দ্বারা নয়। কলাবান গুণী মাত্রই অন্তরে তপস্বী। কোনকিছু সম্যকভাবে ধারণা করতে, গড়ে তুলতে সংযম প্রয়োজন। অসংযম শুধু ধ্বংস করতে পারে। সুতরাং দেখা যায় যে, সৌন্দর্যবোধ ও প্রবৃত্তির বিক্ষোভ এক ক্ষেত্রে থাকতে পারে না। তারা পরস্পর বিরোধী। বিশ্বামিত্র যে জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন তা ছিল দম্ভ ও ক্রোধের সৃষ্টি। তাই তা চরাচরের সংগে সঙ্গতি রক্ষা করতে না পেরে টিকল না। মানুষের ক্রোধ, লাভ, কামনা প্রভৃতি প্রবৃত্তিগুলি উগ্র ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠলে তারা পরিণামে সুষমা ও সংযমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সৃষ্টির প্রয়োজনে তারা স্থান পায় না। প্রবৃত্তি মানুষের মধ্যে উন্মত্ত হয়ে উঠলে তা নিখিল প্রবাহ হতে তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এতে ঘটে মহতী বিনষ্টি। পানসভায় মাতাল তার ক্ষুদ্র পরিধিকে বৈকুণ্ঠ মনে করতে পারে, কিন্তু সংযত দর্শক তার চিন্তা ও কার্যকে অসুন্দর বলে তার নিন্দা করে। আবার প্রবৃত্তি অস্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য লাভ করলে তা আপন কুশ্রীতাকে নগ্নভাবে প্রকাশ করে, এ অত্যন্ত বেদনাদায়ক। প্রবৃত্তির তাড়নায় রাজ অতিথিকে হত্যা করে ম্যাকবেথের সিংহাসন লাভ এবং তার পরবর্তী নিষ্ঠুর কার্যাবলী জগতের বিধানের সংগে সামঞ্জস্য লাভ করতে না পারার ফলে তিনি পরাজিত হলেন।
সংযমের মধ্যে দিয়ে সৌন্দর্যবোধের গভীরতাও বৃদ্ধি পায়। চিত্রকথা সম্বন্ধে যে ব্যক্তি অনভিজ্ঞ, সে চিত্রপটে রং-এর ঐশ্বর্য দেখলে সুখী হয়। ইন্দ্রিয়কে সংযত করে মন দিয়ে সৌন্দর্য উপলদ্ধির শিক্ষা তার হয়নি। সংগীতের ক্ষেত্রেও যা নিছক মিষ্টি সুর তাই তাকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু যিনি চিত্রকলার সমঝদার তিনি দেখেন যে, সেখানে রূপ সৃষ্টি হয়েছে কি না, সামঞ্জস্যের সুষমা আছে কি না। তিনি গভীরভাবে দেখতে পারেন বলে তাঁর সৌন্দর্যভোগের পরিধি বিস্তৃততর ও গভীরতর। সংগীতের ক্ষেত্রেও ইন্দ্রিয়ের লালিত্য সমঝদারের কাছে প্রশংসিত হয় না। তিনি সংগীতের রসকে মাহাত্ম্য দিয়ে থাকেন। শুধু চোখের দেখার উপরে নির্ভর না করে সমঝদার ব্যক্তি মনের সৃষ্টিকে যোগ করে দেন। এটাই হল কল্পনার রস সৃষ্টি। এতে সৌন্দর্যভোগ সম্পূর্ণতা লাভ করে। এই প্রসংগে ইংরেজ কবি শেলির একটি উক্তি এখানে বিশেষভাবে স্মরণ করা যেতে পারে— ‘‘Reason is the enumeration of quantities already known; imagination is the perception of the value of those quantities, both seperately and as a whole’’. যে দেখাতে মন বড় অংশ অধিকার করতে পারে সেখানে তৃপ্তি বেশি, পরিপূর্ণতাও সার্থক। ফুলের চেয়ে মানুষের সৌন্দর্য আমাদের বেশি মুগ্ধ করে, কারণ মানুষের মধ্যে প্রকাশ পায় চেতনার দীপ্তি ও লাবণ্যের শোভা।
Leave a Reply