বাংলা গদ্যের ইতিহাসে প্যারীচাঁদ মিত্রের অবদান আলোচনা কর।
প্যারীচাঁদ মিত্র
(১৮১৪-১৮৮৩)
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে হিন্দু কলেজের অন্যতম ছাত্র এবং ‘ইয়ংবেঙ্গল’ অন্যতম নেতা প্যারীচাঁদ (১৮১৪-১৮৮৩) বাংলা গদ্যে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় রেখে গেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্বে বাংলা গদ্যে যে পালাবদল হয়েছে তার পেছনে ছিল বাংলা ভাষা সাহিত্যের দীপ্ত ব্যক্তিত্ব—প্যারীচাঁদ মিত্র, যিনি টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামেই বেশি প্রসিদ্ধ ছিলেন। প্যারীচাঁদ জনকল্যাণের জন্যই কলম ধরেছিলেন, স্ত্রীসমাজের সর্বাঙ্গীন উন্নতি ছিল তাঁর একমাত্র আকাঙ্ক্ষা। তবুও তার গ্রন্থগুলিতে সাহিত্যবোধের অভাব ঘটেনি। প্যারীচাদ প্রধানত জ্ঞানসাধনার পথিকৃৎ ছিলেন। এছাড়া কৃষিবিজ্ঞান, প্রেততত্ত্ব, ও ‘থিয়োসফি’তে ছিল তাঁর বিশেষ অনুরাগ। তিনি রাধানাথ শিকদারের সহযোগিতায় ১৮৫৪ খ্রি. মাসিক-পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন।
প্যারীচাঁদের প্রবন্ধ গ্রন্থগুলি হল— ‘কৃষিপাঠ’ (১৮৬১), ‘যৎ কিঞ্চিৎ’ (১৮৬৫), ‘ডেভিড হেয়ারের জীবনচরিত’ (১৮৭৮)। কথোপকথন ও গল্পমূলক রচনা হল— ‘রামারঞ্জিকা’ (১৮৬০), ‘অভেদী’ (১৮৭১), ‘আধ্যাত্মিকা’ (১৮৮০), ‘বামাতোষিণী’ (১৮৮১)। ব্যঙ্গাত্মক গদ্যরচনা হল—‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮), ‘মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায়’ (১৮৫৯)। প্যারীচাঁদের খ্যাতি মূলত ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর জন্য।
প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ নামক ব্যঙ্গ আখ্যান তাঁকে সমকালে ও পরবর্তীযুগে বিখ্যাত করেছে। এই গ্রন্থকে প্রথম উপন্যাস বলা হলেও এটি আসলে বাংলা সাহিত্যের একটি সার্থক সামাজিক নকশা। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে নগরজীবনের উশৃঙ্খলতা ও অধঃপতিত সমাজের চিত্ৰই প্যারীচাঁদ এই গ্রন্থে অঙ্কন করেছে। বৈদ্যবাটীর জমিদার রামরাম বাবুর পুত্র মতিলাল কীভাবে অতিরিক্ত আদরে ও কুসঙ্গে মিশে অধঃপাতে যায় এবং পরে আবার দুঃখদুর্দশার মধ্যে দিয়ে কীভাবে মতিলালের স্বভাবের পরিবর্তন হয় তাও লেখক দেখিয়েছেন। নীতিকথা প্রচার করতে লেখক বরদাবাবু, রামলাল, বেণীবাবু প্রভৃতি প্রতীকী চরিত্রগুলির অবতারণা করেছে। নীতিধর্মী চরিত্রগুলির থেকে ঠকচাচা, রামরামবাবু, মতিলাল ও তার সঙ্গীরা অনেক বেশি সার্থক চরিত্র হয়ে উঠেছে। ঠকচাচা টেকচাঁদের এক উজ্জ্বল সৃষ্টি। ঠকচাচা কবিকঙ্কণের ভঁড় দত্ত বা মুরারি শীলের উত্তরসূরি। মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের অভাবে গ্রন্থটি উপন্যাস পদবাচ্য হতে পারেনি। তবে তৎকালীন কলকাতার নগরজীবনের ব্যভিচার ও শিক্ষাদীক্ষার সজীব চিত্র এই উপন্যাসে লেখক নৈপুণ্যের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন। কলকাতার সমকালীন শিক্ষাবিভ্রাটের পরিচয় প্যারীচাঁদ এভাবে দিয়েছেন— “প্রত্যেক ক্লাসের প্রত্যেক বালকের প্রতি সমান তদারক হইত না—ভারি ভারি বহি পড়িবার অগ্রে সহজ সহজ বহি ভাল রূপে বুঝিতে পারে কি না, তাহার অনুসন্ধান হইত না_ অধিক বহি ও অনেক করিয়া পড়া দিলেই স্কুলের গৌরব হইবে—এই দৃঢ় সংস্কার ছিল—ছেলেরা মুখস্থ বলে গেলেই হইল, বুঝুক বা না বুঝুক, জানা আবশ্যক বোধ হইত না এবং কি কি শিক্ষা করাইলে উত্তরকালে কর্মে লাগিতে পারিবে, তাহারও বিচার হইত না।”
প্যারীচাঁদ সমকালীন সমাজজীবনের বাস্তবচিত্র রূপায়িত করতে গিয়ে গুরুগম্ভীর সংস্কৃতবহুল ভাষার পরিবর্তে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন। কলকাতার প্রাত্যহিক সংস্কৃত জীবনের বর্ণনায় চলতি ভাষার ব্যবহার চরিত্রগুলিকে বাস্তবানুগ করে তুলেছে। বাংলা গদ্যের প্রথম যুগে ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর ভাষা একটি বিশিষ্ট ঐতিহ্যসৃষ্টির পথ প্রস্তুত করেছিল। প্যারীচাঁদের ভাষা সহজ ও সরল। অযথা সংস্কৃতাড়ম্বর থেকে বাংলা গদ্যকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছেন তিনি। তদ্ভব ও দেশি শব্দের বেশি ব্যবহারে এবং ভক্তির মধ্যে প্রাণরস সঞ্চার করায় এ ভাষা সমকালীন অনেক লেখকের সাধুভাষা থেকে উন্নত বলে মনে হয়। যেমন— ‘‘ঠকচাচা চৌকির উপর থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়িয়া বলিলেন—মোর উপর এত না টিটকারী দিয়া বাত হচ্ছে কেন? মুই তো এ সাদি করতে বলি—একটা নামজাদা লোকের বেটি না আসলে আদমির কাছে বহু শরমের বাত…।”
তাঁর ‘কৃষিপাঠ’ কৃষি বিষয়ক রচনা। ‘অভেদী’ ও ‘আধ্যাত্মিকা’তে মানবাত্মার স্বরূপ ও ঈশ্বর মহিমা ব্যাখ্যাত হয়েছে। ‘অভেদী’তে রূপকের ছলে নিষ্কাম প্রেম ও আধ্যাত্মিক সাধনার উচ্চ আদর্শ তুলে ধরা হয়েছে। ‘আধ্যাত্মিকা’তে বারাণসী প্রবাসী সম্পন্ন গৃহস্থ হরদেব তর্কালঙ্কারের কন্যার জীবনকাহিনি নিয়ে রচিত। অন্যদিকে ‘রামারঞ্জিকা’ গ্রন্থটি সংলাপাত্মক ভঙ্গিতে কুড়িটি অধ্যায়ে বিভক্ত। এই গ্রন্থে পতি-পত্নীর কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে নারীজাতির সাংসারিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার উৎকর্ষ সাধন প্রসঙ্গ দৃষ্টান্তসহ বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে। স্ত্রীলোকদের নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার উদ্দেশ্যে প্যারীচাঁদ মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতি থেকে সংস্কৃত বচন উদ্ধার করে তার বক্তব্য বিষয় বহুল পরিমাণে তথ্যনিষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য করেছেন। তাঁর ‘যৎ কিঞ্চিৎ’ দশটি অধ্যায়ে বিভক্ত ঈশ্বরতত্ত্বমূলক একটি দার্শনিক প্রবন্ধগ্রন্থ। আখ্যানের আবরণে প্যারীচাঁদ ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্ব অর্থাৎ ঈশ্বরের অস্তিত্ব, আত্মার অবিনাশিত্ব, পরওক ও উপাসনাদি সম্পর্কে আওচনা করেছে। তাঁর ‘মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায়’ মদ্যপানের নিন্দাসূচক ব্যঙ্গ রচনা।
বাংলা গদ্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের অবদান
- সংস্কৃতবহুল গুরুগম্ভীর সাধুভাষার বিরুদ্ধাচরণ করে বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম চলিত অর্থাৎ কথ্য ভাষা প্রবর্তনার জন্য প্যারীচাঁদ বেশি পরিচিতি লাভ করেছেন। গুরুগম্ভীর সাধুভাষাকে কিছুটা নমনীয় করার প্রয়াসের জন্য প্যারীচাঁদ স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
- বাংলা সাহিত্যে চলিত অর্থাৎ কথ্যভাষার প্রবর্তক হলেও প্যারীচাঁদ তার সব প্রবন্ধই সংস্কৃত শব্দবহুল সাধু ভাষায় রচনা করেছেন।
- যদি কথ্যরীতিতে গ্রন্থ লেখা প্যারীচাদের দ্বারা প্রবর্তিত না হত, তাহলে বাংলা গদ্যের নতুন সম্ভাবনার পথ এত তাড়াতাড়ি তৈরি হত না।
- ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বাংলা সাহিত্যের সার্থক সামাজিক নকশা।
- প্যারীচাঁদ মিত্রের কৃতিত্বের ঐতিহাসিক গুরুত্ব নির্দেশ করতে গিয়ে বা লিখেছেন— “সংস্কৃতপ্রিয়তা এবং সংস্কৃতানুকারিতাহেতু বাঙ্গালা সাহিত্য অত্যন্ত না দুর্বল এবং বাঙ্গালা সমাজে অপরিচিত হইয়া রহিল। টেকচাঁদ ঠাকুর প্রথমে বিষবৃক্ষের মূলে কুঠারাঘাত করিলেন। তিনি ইংরেজীতে সুশিক্ষিত, ইংরেজীতে প্রাণ ভাষার মহিমা দেখিয়াছিলেন এবং বুঝিয়াছিলেন। তিনি ভাবিলেন, বাঙ্গালার প্রচলিত ভাষাতেই বা কেন গদ্যগ্রন্থ বিবৃত হইবে না। যে ভাষায় সকলে কথোপকথন করে, তিনি সেই ভাষায় ‘আলালের ঘরের দুলাল’ প্রণয়ন করিলেন। সেইদিন হইতে বাঙ্গালা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি, সেইদিন হইতে শুষ্ক তরুর মূলে জীবনবারি নিষিক্ত হইল।” বঙ্কিমচন্দ্রের এই উক্তি অত্যুক্তি নয়।
Leave a Reply