বাংলা গদ্যের বিকাশে কালীপ্রসন্ন সিংহের অবদান আলোচনা কর।
কালীপ্রসন্ন সিংহ
(১৮৪০-১৮৭০)
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কালীপ্রসন্ন সিংহ (১৮৪০-১৮৭০) বাংলা চলিত গদ্যরীতির সার্থক উদগাতা হিসাবে বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। শুধু ভাষারীতির ক্ষেত্রেই নয়, বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিতে তার অবদান যথেষ্ট। ‘বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা’, ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’, ‘বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ’ প্রতিষ্ঠা তাঁর অন্যতম কীর্তি। শুধু গদ্য রচনা নয়, নাট্যমঞ্চের প্রয়োজনে তাঁর নাট্যরচনাও সমকালীন মঞ্চকে সমৃদ্ধ করেছিল। বিশেষ করে তাঁর মহাভারতের অনুবাদ বিশেষ কীর্তি। তাঁর অনুদিত মহাভারত ‘কালীসিংহী মহাভারত’ নামে প্রচারিত। এমনকি দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদের প্রকাশক রেভাঃ লঙ সাহেব অভিযুক্ত হয়ে কারারুদ্ধ হন ও তাঁর অর্থদণ্ড হয়। সেক্ষেত্রেও কালীপ্রসন্ন নিজে অর্থদণ্ডের টাকা নিয়ে আদালতে উপস্থিত ছিলেন। এভাবে তাঁর স্বল্পায়ু জীবনে নানা কীর্তি স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
কালীপ্রসন্নের খ্যাতি মূলত ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’র জন্য। তিনি ‘হুতোম’ ছদ্মনামে এই নশা জাতীয় গ্রন্থ রচনা করেন। অভিজাত বংশের সন্তান হয়েও কালীপ্রসন্ন ধনী সমাজের কুৎসিৎ ব্যভিচারকে ক্ষমা করতে পারেননি। তাঁর উদার প্রগতিশীল দৃষ্টির আলোকে তিনি সমকালীন প্রগতিবাদী আন্দোলনগুলির বিচার করেছেন। ‘হুতোম প্যাচার নকশা’র প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয় ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে এবং পরে সম্পূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে। উনিশ শতকের মধ্যভাগের কলকাতার নাগরিক জীবনের নানা উচ্ছৃঙ্খল কদাচার, কলকাতার বিভিন্ন উৎসব, পালাপার্বণ, বারোয়ারি পূজা, ঠনঠনের হঠাৎ অবতারগণের বিচিত্র লীলা, মাহেশের রথযাত্রা ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ এই নকশায় বর্ণিত হয়েছে। বাঙালি সমাজের সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নের একটি প্রসন্ন প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গিরই পরিচয় এর মধ্য দিয়ে লেখক দিয়েছেন।
‘হুতোমে’র ছদ্মবেশে যে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ তিনি করেছে, তার মধ্যে দিয়ে বলিষ্ঠ মতবাদের যেরূপ পরিচয় মেলে, সে ধরনের সুকঠোর বাক-কৌশলের প্রমাণও পাওয়া যায়। বাঙালি সমাজের নীচতার বা অধঃপতনের পরিচয় দিতে গিয়ে তাঁর ভাষা ও প্রকাশভঙ্গির মধ্যে উগ্রতা, পরমত অসহিষ্ণুতা অনেক সময় রুচির পরিমিতিকে অতিক্রম করেছে। কালীপ্রসন্নের জীবনীকার মন্মথনাথ ঘোষ এই নকশা সম্বন্ধে লিখেছেন— “ইহা কেবল নক্স বলিয়াই তৎকালে আদৃত হয় নাই, অনেক ভণ্ড সমাজদ্রোহীর পৃষ্ঠে ইহা যে তীব্র কশাঘাতপূর্বক তাহাদিগকে সৎপথে প্রবৃত্ত করিয়া সমাজসংস্কার সাধন করিয়াছিল, তজ্জন্যও ইহা কম প্রশংসা লাভ করে নাই।” (মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ)।
‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ বাংলা সাহিত্যে প্রথম সামাজিক ব্যঙ্গ নকশা—একথা স্বয়ং লেখক জানিয়েছেন গ্রন্থের ভূমিকা অংশে— “আজকাল বাংলাভাষা আমাদের মত মূৰ্ত্তিমান কবিদলের অনেকেরই উপজীব্য হয়েছে। বেওয়ারিশ লুচীর ময়দা। চইরি কাদা পেলে যেমন নিষ্কর্মা ছেলেমাত্রেই একটা না একটা পুতুল তইরি করে । তেমনি বেওয়ারিশ বাঙালি ভাষাতে অনেকে যা মনে চায় কচ্ছেন; …সুতরাং এই নজিরেই আমাদের বাংলাভাষা দখল করা হয়।”
বাংলা গদ্যে কালীপ্রসন্ন সিংহের অবদান
‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ গ্রন্থ তাঁকে এনে দিয়েছে প্রভূততর খ্যাতি ও অখ্যাতি দুই-ই। এই গ্রন্থে গদ্যভাষা রীতিতে কালীপ্রসন্ন এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেন। গ্রন্থটি আদ্যন্ত চলিত ভাষায় রচিত। কলকাতার কথ্যভাষাকে অবিকৃতভাবে এক দ্বিধাহীনচিত্তে তিনি বাংলা সাহিত্যের আসরে স্থান দিলেন। একটু উদাহরণ নিলে দেখ যাবে এ-ভাষার চলিত রূপ কত অবিমিশ্র ও প্রাণবন্ত। যেমন— “অমাবস্যার রাত্তির—অন্ধকার ঘুরঘুট্টী–গুরগুর করে মেঘ ডাকছে—থেকে থেকে বিদ্যুৎ নলপাচ্চে–গাছের পাতাটি নড়ছে না—মাটি থেকে যেন আগুনের ভাপ বেরুচ্চে—পথিকেরা এক একবার আকাশের পানে চাচ্ছেন, আর হনহন করে চলেছেন। কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ কচ্চে—দোকানীরা ঝাঁপতাড়া বন্ধ করে যাবার উজ্জ্বগ কচ্চে—গুড়ুম করে নটার তোপ পড়ে গ্যালো।”
প্যারীচাঁদের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ কথ্যরীতিতে সহজ ভাষায় লেখা হলেও এর কাঠামোটি সাধুরীতির, ক্রিয়াপদ বা সর্বনামগুলি সাধু তো বটেই, চলিত ভাষার উচ্চারণ ভঙ্গিও ভাষায় বজায় রাখা হয়নি। প্রয়োজনে কলকাতার মুখের বুলি এবং গ্রাম্য ভাষা ব্যবহার করলেও তিনি সাধু ও চলিত রীতির সংমিশ্রণ করে ফেলেছেন। এবিষয়ে কালীপ্রসন্নের কৃতিত্ব অসাধারণ। হুতোম অবিমিশ্র চলিত ভাষায় লেখা। তিনি এমন ঘনিষ্ঠভাবে মুখের ভাষাকে অনুসরণ করেছিলেন যে, ব্যক্তিগত উচ্চারণরীতি, উচ্চারণের মুদ্রাদোষ এ সমস্তকেই তিনি ধ্বনি অনুসারে বানান করেছিলেন, ব্যাকরণের বানান অনেক সময় গ্রাহ্য করেননি। পরবর্তীকালে প্রমথ চৌধুরী চলিত ভাষাকে সর্বক্ষেত্রে ব্যবহারের চেষ্টা করলেও, বীরবলী ভাষা বিশুদ্ধ কথ্য ভাষা নয়; তা অতিশয় মার্জিত, এতই ভদ্র যে প্রায়ই সাধু ভাষার মতো অল্পাধিক কৃত্রিম ও গুরুভার। বিংশ শতক শুরু হবার প্রায় চল্লিশ বছর আগে কালীপ্রসন্ন গদ্যরীতির ক্ষেত্রে পরবর্তী শতকের জন্য মহামূল্য ঐতিহ্য রেখে গেলেন। ক্রিয়াপদ বা সর্বনাম, উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য (স্বরসঙ্গতি, অভিশ্রুতি, শ্বাসাঘাতের নির্দিষ্টতা প্রভৃতি), প্রবাদ-প্রবচনের সাবলীল ব্যবহার সব দিক থেকেই তিনি চলিত রীতিটিকে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করেছিলেন।
বাংলা গদ্যে নতুন রীতি প্রবর্তনের ক্ষেত্রে কালীপ্রসন্নের কৃতিত্ব যথেষ্ট। প্যারীচাঁদ মূলত সাধু ভাষা ব্যবহার করলেও প্রয়োজনে ভাষারীতির মধ্যে চলিত ভাষায় অবিমিশ্র মিলিতরূপের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। কিন্তু কালীপ্রসন্ন সাধু ভাষায় পণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর নকশায় পূর্বাপর কলকাতার চলিত বুলির নিপুণ সুপ্রয়োগে তীক্ষ্ণ ভাষাজ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন। উনিশ শতকের আর কোন গ্রন্থে চলিত ভাষারীতির এ জাতীয় মানদণ্ড অনুসৃত হয়নি। মৌখিক ভাষাকে অবিকৃত রেখে সাহিত্যে তার প্রয়োগের সাহস এবং অসামান্য কীর্তির পরিচয়ে হুতোম বাংলা সাহিত্যে অনন্য।
হুতোম সামাজিক ব্যাধির মূলচ্ছেদ করতে গিয়ে নকশা রচনা করেছিলেন। অন্যদিকে প্যারীচাঁদ রঙ্গরসের আশ্রয়ে উদারতার পটভূমিকায় মানবজীবন কাহিনিকেই রঙ্গরসে বিধৃত করেছিলেন। বাঙালির সমাজ ও নৈতিক জীবনের সর্বতোমুখী কল্যাণসাধনের কারণেই ‘হুতোম পাচার নকশা’য় নিমর্ম ব্যঙ্গের কশাঘাত সুতীব্র হয়ে উঠেছে।
Leave a Reply