//
//

যুগসন্ধির কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কৃতিত্ব আলোচনা কর।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত

ভারতচন্দ্রের মৃত্যুর পর বাংলা কাব্য জগতে যখন ‘গোধুলি আকাশের পতঙ্গের মত’ কবিওয়ালা তাদের আসর জমিয়ে রেখেছিল সেইসময় কাব্য জগতে নতুন প্রাণ সঞ্চারের প্রধান পুরোহিত হলেন ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার সম্পাদক, দীনবন্ধু, বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখের সাহিত্যগুরু ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯)। সাংবাদিক ঈশ্বর গুপ্তের আবির্ভাব বাংলা কাব্য জগতে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। বাংলা কাব্যে আধুনিকতার প্রথম সার্থক মুক্তি যদিও মধুসূদনের হাতে তবুও কবি ঈশ্বর গুপ্ত বাংলা কবিতায় নিয়ে এলেন এক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, যা তাঁর পূর্বের কবিদের কাব্যে ছিল না। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাই যথার্থই বলেছেন—“বাংলা কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁহার স্থান অনন্যসাধারণ, নূতন ও পুরাতনের সন্ধিস্থলে দণ্ডায়মান থাকিয়া পুরাতন প্রবাহকে অব্যাহত রাখিয়াই তিনি নূতনের জন্য খাত খনন করিয়া তাহাতে নব নব ধারা প্রবাহিত করিয়াছেন।…কাব্য সাহিত্যে পুরাতন ধারার তিনি শেষ কবি এবং নূতন ধারার তিনি উদ্বোদ্ধা।”

১৮১২ খ্রিস্টাব্দে কাঁচড়াপাড়ায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জন্ম। পিতার নাম হরি নারায়ণ গুপ্ত, মাতা শ্রীমতী দেবী। মায়ের মৃত্যুর পরে তিনি মামার বাড়িতে চলে আসেন। আবাল্য দুঃখের সঙ্গে লড়াই করা কবির বৈবাহিক জীবনও সুখের হয়নি। কৌলিন্যরক্ষা এবং আর্থিক সাশ্রয়েইর জন্য পিতার আদেশে তিনি এক প্রতিবন্ধী মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন। এসমস্ত কিছুই তাঁর কাব্যভাবনায় প্রভাব ফেলেছে।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের রচনাবলী— ‘কালীকীর্তন’ (১৮৮৩), ‘ভারতচন্দ্র রায়ের জীবনবৃত্তান্ত’ (১২৬৩ বঙ্গাব্দ) ‘প্রবোধ প্রভাকর’ (১২৬৪ বঙ্গাব্দ), ‘হিতপ্রভাকর’ (১২৬৭ বঙ্গাব্দ), ‘বোধেন্দুবিকাশ’ (১২৭০ বঙ্গাব্দ)

‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ নাটকের অনুবাদ। এছাড়াও কবিগানও তিনি রচনা করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সাংবাদিক হিসাবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। প্রথম শ্রেণির দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের গৌরব তাঁর প্রাপ্য। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জানুয়ারি তাঁর সম্পাদনায় ‘সংবাদ প্রভাকর’ প্রকাশিত হয়। প্রথমে পত্রিকাটি সাপ্তাহিক, পরে সপ্তাহে তিনবার এবং শেষে তা প্রতিদিন প্রকাশিত হতো। এটিই বাংলা তথা ভারতীয় ভাষায় প্রথম দৈনিক। এই প্রভাকরের পাতাতেই প্রাচীন কবিওয়ালাদের জীবনী ও গান সংগ্রহ করে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত মধ্য ও আধুনিক যুগের কাব্যধারার যে ‘মিসিং লিঙ্ক’ খুঁজে বার করেছিলেন, তা এক অবিস্মরণীয় কীর্তি। প্রভাকর ছিল তার পাঠশালা। এই সংবাদপত্রের পাতায় পরবর্তী যুগের খ্যাতিমান বহু লেখক প্রথম শিক্ষানবিশি করেছেন। এঁদের মধ্যে দীনবন্ধু মিত্র, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্ত ইত্যাদি প্রধান। বাংলা সাহিত্যে এভাবে সাহিত্যগোষ্ঠী তৈরি করাই কবির প্রধান কীর্তি।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কাব্য-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য

গুপ্তকবির কবিতায় আধুনিকতার কয়েকটি লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়। যেমন—(এক) সমাজচেতনা, (দুই) যুক্তিপ্রধান মনোভাব, (তিন) ইতিহাসচেতনা, (চার) কৌলীন্য প্রথার বিরুদ্ধাচরণ, (পাঁচ) কবিতাকে সঙ্গীতধর্ম থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা, (ছয়) উনিশ শতকের নবজাগ্রত যুগচেতনাকে সমর্থন, (সাত) মিশনারীদের অত্যাচারের প্রতিবাদ, আট) কবিতার বিষয় নির্বাচন, (নয়) স্বাদেশিকতা, (দশ) কবিগোষ্ঠী তৈরির প্রচেষ্টা।

সমাজচেতনা

সাংবাদিক হিসেবে সমকালীন সমাজজীবন সম্পর্কে যে তীক্ষ সচেতনতার পরিচয় তিনি দিয়েছেন, তা মধ্য যুগের কাব্যে স্থান পায়নি। সমাজভাবনা তাঁর ব্যক্তিত্বেরই সচেতন অংশ। সমকালীন যুগ সমস্যার তিনি বাস্তব রূপকার। কিন্তু যুগ সমস্যার সমাধান তিনি দেখাতে পারেননি বলে কোন কোন সমালোচক সমালোচনা করেন। আসলে ‘সমাধান যেকালে ইতিহাসেই প্রায় দৃশ্য ছিল না, সেকালে একজন কবির মধ্যে সে দিব্যদৃষ্টি আশা করা অন্যায়’ (বিষ্ণু দে—ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত)। তবে সমাজচেতনার প্রকাশে তাঁর দ্বৈততা ছিল। যেমন, ভিক্টোরিরার ভক্ত মীর্শম্যানকে ব্যঙ্গের কশাঘাতে যেমন নাস্তানাবুদ করেছেন তেমনি আবার বিধবা-বিবাহকেও তিনি সমর্থন জানাতে পারেননি। তাই ভিক্টোরিয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর ভক্ত মার্শম্যানকে ব্যঙ্গ করে বলেছেন—

শুনিতেছি বাবাজান এই তব পণ।

সাক্ষ্য দিতে করিতেছ বিলাতে গমন।।

জোড় করে পশুপতি করি নিবেদন।

সেখানে কোরো না গিয়ে প্রজার পীড়ন।।

সমকালীন সমাজের পরস্পর বিরোধী রূপ যেমন তার কাব্যে চিত্রিত হয়েছে তেমনি ভাবী সমাজের চিত্রের কথা ভেবেও তিনি স্বস্তি পান না। তাই সমকালীন সমাজের ছবি আঁকেন এভাবে—

পিতা দেয় গলে সুত্র পুত্র দেয় কেটে।

বাপ পুজে ভগবতী বেটা দেয় পেটে।।

যুক্তিপ্রধান মনোভাব

সাংবাদিকসুলভ যুক্তিধর্মিতা তাঁর ঈশ্বরবিষয়ক কবিতাগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়। সাধারণ ঈশ্বরভক্তের মতো তিনি ঈশ্বরভক্ত বা ঈশ্বরবাদী ছিলেন না। ঈশ্বরের প্রতি ঈশ্বর গুপ্তের অভিমান ব্যক্ত হয়েছে যুক্তির আশ্রয়ে—

তোমার বদনে যদি, না সরে বচন।

কেমনে হইবে তবে, কথোপকথন।।

ইতিহাসচেতনা

কাব্যজগতে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের আগমন যেমন ঐতিহাসিক, তেমনি তাঁর ইতিহাসচেতনাও কাব্যে প্রকাশিত হয়েছে। দুর্ভিক্ষ, নীলকর, শিখযুদ্ধ, বর্মাযুদ্ধ কোনো বিষয়ই তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। গুপ্তকবির সাহিত্যচর্চার ঐতিহাসিক পাঁচটি লক্ষণ—

  • পুরাতন পদসঙ্গীতের জায়গায় খণ্ড কবিতার আবির্ভাব ঘটলো।
  • ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কবিতাকে সম্পূর্ণ ধর্মভাব মুক্ত করলেন। মধ্যযুগের রাধা-কৃষ্ণ, উমা-শ্যামা-শিব সংক্রান্ত বিষয়ের পরিবর্তে ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায় পার্থিব বিষয় প্রাধান্য পেল।
  • সমকালীন জীবন তাঁর কাব্যে তীক্ষ্ণ সচেতনতারর সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে।
  • ঈশ্বর গুপ্তের কবিতাতেই প্রথম জাতীয় জীবন ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে।

কৌলীন্য প্রথার বিরুদ্ধাচরণ

কৌলীন্য প্রথাকে কবি সমর্থন জানাননি। তাই কৌলিন্য কবিতায় হিন্দু সমাজের বহু বিবাহ কুলপ্রথার বিরুদ্ধে কবির শাণিত উক্তি—

মিছে কেন কুল নিয়ে কর আঁটা-আঁটি।

এ যে কুল কুল নয় সারামাত্র আঁটি।।

কবিতাকে সঙ্গীতধর্ম থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা

বিষ্ণু দে ঈশ্বর গুপ্তের দুটি গুণের প্রশংসা করেছেন— ১. বাক্য বিন্যাসের দেশজ রীতি, ২. বস্তুনির্ভর সাধারণ সুস্থবুদ্ধির সরসতা। এই দুটি গুণ কবিতায় নিয়ে এসেছে নতুন প্রাণ। যেমন গুরুদেবের ভণ্ডামি নিয়ে কবিতায় লিখেছে—

গুরু গুরু গুরু গুরু, সকলেই কয়।

গুরু রব গুরু বটে, ফলে গুরু নয়।।

উনিশ শতকের নবজাগ্রত যুগচেতনাকে সমর্থন

ঈশ্বর গুপ্ত সমকালীন যুগ-সমস্যার যে রূপকার ছিলেন তার উল্লেখ করে বিষ্ণু দে বলেছেন—‘তিনি মুখ ফিরিয়ে কাব্য সাধনা করেননি এইটাই বড় কথা।’ দেশের সমকালীন চিত্র তার কলমে চিত্রিত হয়েছে। যেমন সমকালীন দেশের দুরবস্থা দেখে ভিক্টোরিয়ার কাছে আবেদন—

ওগো মা ভিক্টোরিয়া,

কর গো মানা, যত তোর রাঙা ছেলে আর যেন মা

চোখ রাঙে না চোখ রাঙে না।

মিশনারীদের অত্যাচারের প্রতিবাদ

মিশনারীদের ধর্মান্তরিতকরণ ও ইংরেজি শিক্ষা সম্পর্কে কবির মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে কবিতায়। যেমন—

কহিতে মনের খেদ বুক ফেটে যায়।

মিশনারী ছেলেধরা ছেলে ধরে খায়।

কবিতার বিষয় নির্বাচন

ঈশ্বরগুপ্তই প্রথম দেখালেন অতি তুচ্ছ, নগণ্য উপেক্ষিত অথচ সুপরিচিত বস্তুকে নিয়ে কাব্য রচনা করা যায়। পাঠা, তপসে মাছ আনারসকে নিয়েও তিনি কবিতা লিখেছেন। তাই পাঁঠা-কে নিয়ে কবিতায় লিখেছেন—

রসভরা রসময় রসের ছাগল।

তোমার কারণে আমি হয়েছি পাগল।।

তুমি যার পেটে যাও সেই পুণ্যবান।

তুমি সাধু সাধু তুমি ছাগীর সন্তান।।

স্বাদেশিকতা

গুপ্তকবির স্বাদেশিকতা তার সমাজচেতনা তথা ইতিহাসবোধেরই ফলশ্রতি। দেশবাসীর দুঃখের কথা ভেবে তিনি ভিক্টোরিয়ার উদ্দেশ্যে লেখেন—

কিছুদিন মা! দয়া করি রপ্তানিটি বন্ধ রাখো,

ধনে প্রাণে হল কাঙালী

ভাত বিনে বাঁচিনে, আমরা ভেতো বাঙালী,

চাল দিয়ে মা বাঁচাও প্রাণে চালের জাহাজ চেলো নাকো।

কবিগোষ্ঠী তৈরির প্রচেষ্টা

পরবতীকালের প্রভাবে এবং কবিগোষ্ঠী তৈরির ক্ষেত্রে ঈশ্বর গুপ্ত ছিলেন আধুনিক চেতনার অগ্রদূত। ‘সংবাদ প্রভাকরে’র সম্পাদকরূপে ঈশ্বর গুপ্ত পরবর্তী কবিদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র, মধুসূদন, দীনবন্ধু, মনোমোহন বসু প্রভৃতি সাহিত্যিক ঈশ্বর গুপ্তকে গুরু হিসাবে গ্রহণ করেছেন। রঙ্গলালের ‘কাঞ্চী-কাবেরী’ ছাড়া অন্যান্য রচনায় ঈশ্বর গুপ্তের প্রভাব বর্তমান। তাছাড়া হেমচন্দ্রের ‘চিন্তাতরঙ্গিনী’ ও ‘বীরবাহু’ কাব্যে গুপ্তকবির প্রভাব লক্ষ করা যায়।

তবুও ঈশ্বর গুপ্তকে আধুনিক কবি হিসেবে পুরোপুরি গ্রহণ করা যায় না। তিনি যে পরিমাণে কবিওয়ালাদের উত্তরসূরি, সেই পরিমাণে আধুনিক কবিদের পূর্বসূরিত্ব দাবি করতে পারেন না। তাঁর কাব্যে আধুনিকতার লক্ষণগুলি প্রকাশিত হলেও তার মধ্যে রক্ষণশীলতাও ছিল। তিনি যে যে বিষয়ে রক্ষণশীলতার পরিচয় দিয়েছেন সেগুলি হল—

  • কবিগানের প্রভাব,
  • রচনারীতিতে প্রাচীনতা,
  • স্ত্রীশিক্ষার বিরোধিতা,
  • বিধবা বিবাহের অসমর্থন এবং
  • সিপাহী বিদ্রোহের অসমর্থন। তা সত্ত্বেও বলা যায় যে, ঈশ্বরচন্দ্র যুগেরই সৃষ্টি, তিনি যুগদ্রষ্টা নন। তাঁর মধ্যে আধুনিকতার যে লক্ষণগুলি প্রকাশ পেয়েছে, তা এ যুগেরই লক্ষণ, ঈশ্বরচন্দ্রের নিজস্ব সৃষ্টি নয়।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের প্রতিভায় মধুসূদন বা দীনবন্ধুর প্রতিভা খোঁজা ন্যায়সংগত নয়। কবির ব্যক্তিগত দুর্ভাগ্য এবং যুগের প্রভাব ও চাহিদার মধ্যে কবির সীমাবদ্ধতা লুকিয়ে রয়েছে। তবুও ঈশ্বর গুপ্তের কবিপ্রতিভায় ছিল স্বাতন্ত্র্য। সেই স্বাতন্ত্র্য বিষয়বস্তুতে ও আঙ্গিক রীতিতে। সেজন্য বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন—“যাহা আছে ঈশ্বর গুপ্ত তাহার কবি। তিনি এই বাঙ্গালা সমাজের কবি। তিনি কলিকাতা শহরের কবি। তিনি বাঙ্গালার গ্রাম্যদেশের কবি। এই সমাজ, এই শহর, এই দেশ বড় কাব্যময়। অন্য তাহাতে বড় রস পান না। তোমরা পৌষ পার্বণে পিটাপুলি খাইয়া অজীর্ণে দুঃখ পাও, তিনি তাহার কাব্যরসটুকু সংগ্রহ করেন।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!