আধুনিক কবিতার ইতিহাসে মধুসূদন দত্তের অবদান আলোচনা কর।
মধুসূদন দত্ত
‘একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ পাঠাইলাম, দেখিও যেন ইহা বাতাসে উড়িয়া না যায়।’ ১৮৬০ সালে কোচবিহারের মহারাজার কাছে মধুসূদনের চাকরির দরখাস্তে এই কথাগুলি লিখে সুপারিশ করে পাঠিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সত্যিই উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা নবজাগরণের ইতিহাসে মাইকেলের প্রতিভা ও চরিত্র দুই-ই যেন অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতো বাঙালির ভাবীকালের সাহিত্য ও জীবনে পথরেখা চিহিত করে দিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। সত্যই সংঘাতমুখর নবজাগরণের যুগে ঊর্ধ্বলোক থেকে এই পৃথিবীতে নেমে এসেছিল অগ্নিস্ফুলিঙ্গ রূপ মধুসূদন (১৮২৪-১৮৭৩)। দৈবী প্রতিভা নিয়েই এসেছিল সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। মধুসূদন যে সময়ে জন্মেছিলেন, সে সময়টা বুদ্ধিজীবী বাঙালি মানসে এক ঝড়-তুফানের কাল। প্রাচীন ও নবীনের সংঘর্ষে এই সামাজিক বিপ্লবের সূচনা । এই বিপ্লব থেকে সৃষ্টি হল রেনেসাঁস—চিন্তায় ও চেতনায় নবজাগরণ। সমকালীন যুগজীবনের চারটি বৈশিষ্ট্য তাঁর কাব্যকে প্রভাবিত করেছিল। সেগুলি হল— (ক) মানবতাবাদ, (খ) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, (গ) শাণিত বুদ্ধির নিরিখে অতীতের পুনর্মূল্যায়ন এবং (ঘ) স্বাজাত্যপ্রীতি। শুধু যুগজীবনের প্রভাব নয় ব্যক্তিজীবনের প্রভাবও তার উপর যথেষ্ট।
প্রথম বয়সে মধুসূদনের কবি হিসাবে আত্মপ্রকাশ ইংরেজি কবিতা লিখে। যৌবনে ইংরেজি কবিতার রচনার নেশায় বুঁদ হয়ে উঠেছিলেন। ১৮৪৮-৪৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মাদ্রাজ থেকে ‘Madras Circulator’ পত্রিকায় তিনি ‘Timothy Penpoem’ ছদ্মনামে ‘A Vision Captive Ladie’ শীর্ষক ইংরেজি কাব্যে পৃথীরাজ সংযুক্তার কাহিনি বর্ণনা করেন। পরে তা ১৮৪৯ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য
মধুসূদনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ ১৮৬০ খ্রিস্টাবে প্রকাশিত হয়। মাইকেলের উদ্ভাবিত নূতন অমিত্রাক্ষর ছন্দে এই কাব্য রচিত। সংস্কৃত পুরাণ ও মহাভারতের আদি পর্বের কাহিনি অবলম্বনে চার সর্গে মধুসূদন ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ রচনা করেন। হিরণ্যকশিপুর বংশে নিশুম্ভ নামক দৈত্যের দুই পুত্র সুন্দ ও উপসুন্দ ধার্মিক হয়েও ছিলেন দেবদ্রোহী। ত্রিভুবন জয় করার জন্য তারা কঠোর তপস্যায় অমরত্ব লাভ না করতে পারলেও ব্রহ্মার কাছ থেকে বিপুল শক্তি লাভ করেছিলেন। তবে ব্রহ্মার বরের শর্ত ছিল দুই ভাই একত্রে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে থাকলে তাঁরা অমর হয়ে থাকবে, নতুবা উভয়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হলে দু ভাই-এর মৃত্যু ঘটবে। এরপর দেববলে বলীয়ান হয়ে তারা চারিদিকে অত্যাচার শুরু করল। দেবতারা তাদের অত্যাচারে ব্রহ্মালোকে আশ্রয় নিল। দুইভাই মহানন্দে রাজত্ব করতে থাকল। এদিকে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত দেবতাগণ ব্রহ্মার কাছে প্রতিকারের জন্য প্রার্থনা জানানোয় তিনি তার উপায় বলে দিলেন। বহ্মার
আদেশে বিশ্বকর্মা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে তিল তিল করে সৌন্দর্য আহরণ করে তিলোত্তমা সৃষ্টি করলেন। তিলোত্তমার রূপ দেখে সুন্দ ও উপসুন্দ কামোন্মন্ত হয়ে তাকে পাওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠলেন এবং পরস্পরকে আঘাত করে দুজন নিহত হলেন। ফলে দেবরাজ্য রাহুমুক্ত হল ও সকলে স্বস্তি পেল। ‘তিলোত্তমাসম্তব কাব্যে’ মধুসুদনের সৃষ্টিনৈপুণ্যের প্রকাশ তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। তবুও প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রয়োগের দিক থেকে এই গ্রন্থের গুরুত্ব যথেষ্ট। মধুসুদনের চরিত্র সৃষ্টির সাফল্যও লক্ষ করা যায় সুন্দ-উপসুন্দ চরির সৃষ্টিতে। আধুনিক বাংলা কাব্যের সূচনা এই গ্রন্থ থেকেই। কাব্যটি পৌরাণিক আখ্যানকাব্য হলেও এতে পাশ্চাত্য রোমান্টিক কাব্যের রচনা প্রকরণগত অনেক সাদৃশ্য ও প্রভাব রয়েছে। কবির সৌন্দর্যচেতনার প্রকাশও ঘটেছে এই কাব্যে। এই কাব্যের আলোচনাসূত্রে অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন—“এর ধ্যানগম্ভীর শব্দযোজনা এবং রজতগিরিনিভ ধূর্জটির তপঃসাগরে নিমগ্ন যোগস্থ স্তব্ধতা বাংলা কাব্যে ভারতচন্দ্রীয় আদিরসের নূপুরনিকণ, গুপ্তকবির রঙ্গ-ব্যঙ্গ এবং রঙ্গলালের পয়ার-ত্রিপদী মালঝাঁপের বাচালতাকে লজ্জা দিল।…এর প্রথম কয়েক ছত্রেই সে যুগের রসিক ও নবীন পাঠক বুঝতে পেরেছিলেন, বাংলা কাব্যে নতুন প্রতিভার উদয় হয়েছে, যা দলছাড়া, কুলহারা-একক মহিমায় আসীন।” (বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত)।
মেঘনাদবধ কাব্য
মধুসূদনের অমর সৃষ্টি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’। এই কাব্যের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালের জানুয়ারী মাসে। প্রথম খণ্ডে ছিল প্রথম থেকে পঞ্চম সর্গ। এরপর দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ওই বছরের জুন মাসে। ষষ্ঠ থেকে নবম সর্গ এই খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পরে হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় দুখণ্ড একত্রে সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে। এই কাব্য প্রকাশে কবি নিন্দা ও খ্যাতি উভয়ই গ্রহণ করেছেন। যুগজীবনের সামগ্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষা, সাফল্য-বার্থতাকে বাণীবদ্ধ করতে পেরেছেন। এজন্য এই মহাকাব্য তাঁর আত্ম-আবিষ্কারের কাব্য, আত্মার কাহিনি। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ বাংলা মহাকাব্যধারার প্রথম ও প্রধান সৃষ্টি। এই কাব্যে কাহিনির ঘটনাকাল তিন দিন দু’রাত্রি মাত্র। প্রথম সর্গ আরম্ভ হয়েছে রাবণের অন্যতম বীরপুত্র বীরবাহুর মৃত্যু ঘটনার বর্ণনা দিয়ে, শেষ হয়েছে মেঘনাদের সৈনাপত্যবরণে। নয়টি সর্গে বিভক্ত কাব্যের ঘটনা মধুসূদন বাল্মীকি রামায়ণ থেকে সংগ্রহ করলেও কাহিনি ও ভাবকল্পনার ক্ষেত্রে তিনি মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন।
‘মেঘনাদবধ কাব্য’ নয়টি সর্গে রচিত এক মহাকাব্য। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভাবধারাকে সাঙ্গীকৃত করে মধুসূদন মহাকাব্য রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। মহাকাব্যের বিশিষ্ট লক্ষণগুলি এই কাব্যে রয়েছে। এই কাব্যের মূল রস বীররস। কবি কাব্যের মূলরস সম্বন্ধে নিজেই লিখেছেন—‘‘গাইব মা, বীররসে ভাসি মহাগীত।” কবি একথা জানালেও কাব্যের বেশিরভাগ স্থান জুড়ে আছে করুণরস। এই কাব্যের নায়ক মেঘনাদ না রাবণ এই নিয়ে বিতর্ক থাকলেও নায়কের দিক থেকে রাবণ-ই কাব্যের নায়ক। কাব্যের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রাবণের-ই প্রাধান্য। ষষ্ঠ সর্গে মেঘনাদবধের পর কাহিনির সমাপ্তি ঘটেনি। কাব্যের মূল রসের বিভাব রাবণ। রাবণকে ঘিরে যেমন কাহিনি এগিয়েছে, রাবণের জন্যই লঙ্কার এবং তার বীরদের এই পরিণামও এসেছে। রাবণ কবির কল্পনাকেও উদ্দীপিত করেছে। বীরবাহুর মৃত্যুতে গৌরব ও শোকের প্রতিক্রিয়া রাবণের মধ্যেই দেখান হয়েছে তিনি রাক্ষসকুলের সূর্য। মেঘনাদবধ-এ রাবণ তাই সমস্ত ঘটনার মূল স্রষ্টাইই নয়, আত্মসৃষ্টির শ্রেষ্ঠ শিকারও বটে। তাই রাবণই মেঘনাদবধ কাব্যের নায়ক। চরিত্রচিত্রণের পাশাপাশি ওজস্বীপূর্ণ ভাষার ব্যবহার, ছন্দ অলংকারের সুপ্রয়োগ মহাকাব্যটিকে বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য মাত্রা দিয়েছে।
ব্রজাঙ্গনা
মধুসূদনের ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্য প্রকাশিত হয় ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে। প্রথমে কাব্যটির নাম ছিল ‘রাধাবিরহ’। এই রাধাবিরহ মধুসূদনের পরিকল্পিত ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্যের প্রথম সর্গ মাত্র। কবি ব্রজেন্দ্রনন্দনের বংশীধ্বনি করেছেন ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্যে। রাধাকৃষ্ণ সংক্রান্ত কাহিনি অবলম্বনে ইটালির ‘লিরিক্যাল ওডের’ অনুসরণে মধুসূদন ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্য রচনা করেন। তবে এই রাধা বৈষ্ণব মহাজনের রাধা নয়, এ মধুসূদনের ‘Poor Lady of Braja’। কবি এই কাব্যে শ্রীরাধার মনোবেদনাকে তুলে ধরেছেন ঊনবিংশ শতকের নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের আলোকে। ‘বজাঙ্গনা’ কাব্যের মূল কথা প্রেম এবং মূল উপকরণ প্রকৃতি। এই কাব্যের মোট আঠেরোটি কবিতার মধ্যে বারোটি প্রকৃতি বিষয়ক। ঋতু বিষয়ক কবিতা হল—জলধর, মলয়-মারুত, বসন্তে। কাল বিষয়ক কবিতা হল—উষা, গোধুলি। স্থান বিষয়ক কবিতা—যমুনাতটে, নিকুঞ্জবনে। ফুল বিষয়ক কবিতা—কুসুম, কৃষচূড়া এবং পাখি বিষয়ক কবিতা হল—ময়ুর, সারিকা। ‘বসন্ত’ কবিতায় বাসন্তী প্রকৃতির রূপে-গন্ধে-গানে-সৌন্দর্যসজ্জায় রাধার দুইচোখে আশার এক রূপ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে—
ফুটিল বকুল ফুল কেন লো গোকুলে আজি
কহ তা, সজনি?
আইলা ঋতুরাজ? ধরিলা কি ফুলসাজ
বিলাসে ধরণী?
মধুসূদনের ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্য পুরোপুরি লিরিক কবিতা হয়ে উঠতে পারেনি। তার কারণ কবির আত্মস্বরূপ রাধার বক্তব্যে ঢাকা পড়ে গেছে। রাধার অন্তর্বেদনা ও কবির অন্তর্লীনতা এক হয়ে কাব্যরূপ লাভ করেনি। বৈষ্ণব কবিতার মতো ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্যে পদলালিত্য ও ছন্দমাধুর্য থাকলেও বৈষ্ণব কবিদের অকুষ্ঠ বিশ্বাস ও নিরবকাশ তন্ময়তা ব্রজাঙ্গনায় নেই। এই কাব্যের আঙ্গিক রীতিও উল্লেখযোগ্য। অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই কাব্যের আঙ্গিক রীতির আলোচনা প্রসঙ্গে জানিয়েছেন— “অতি সরল এবং সরস মিত্রাক্ষর রীতির ছন্দে রচিত এই ক্ষুদ্র কাব্যে তিনি শ্রীরাধার বিরহ, বিলাপ, আক্ষেপ, হতাশা ফুটিয়েছেন, আবার বৈষ্ণব কবিদের মতো ব্যাকুলা রাধাকে সান্ত্বনাও দিয়েছেন।”
বীরাঙ্গনা কাব্য
১৮৬২ সালে প্রকাশিত ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম সার্থক পত্রকাব্য। এই পত্রে তিনি ওভিদের ঋণ স্বীকার করেছেন। গ্রন্থ প্রকাশের পরিকল্পনা মূলত নারীর বাক্স্বাতন্ত্র্যকে প্রকাশ করার জন্য। কারণ বইটি উৎসর্গ করেছেন ‘বঙ্গকুলচড়’ বিদ্যাসাগরকে, যিনি নারীমুক্তির ও নারীজাগৃতির বাণী পরোক্ষে প্রচার করেছেন। একদিকে নারীমুক্তির প্রেরণা এবং অন্যদিকে রোমান কবি ওভিদের ‘Heroides’-এর অনুসরণ—এই দুয়ের সমন্বয়ে ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের প্রকাশ। তবে ওভিদের কাব্যের সঙ্গে বীরাঙ্গনার মিল ও অমিল দুই-ই রয়েছে।
‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের নামকরণও অভিনব। বীরাঙ্গনা শব্দের দুটি অর্থ—বীরের অঙ্গনা অথবা বীর যে অঙ্গনা। কিন্তু এগারো জন নায়িকা সকলেই বীরের অঙ্গনা বা বীর যে অঙ্গনা নয়। তবুও এই নামকরণের কারণ হল বীরাঙ্গনার নায়িকারা তাদের মনোভাব প্রকাশে, কুণ্ঠাহীন আত্মঘোষণায় এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রকাশে বলিষ্ঠ ও স্বতস্ফূর্ত বলেই। আসলে মধুসুদন পৌরাণিক নারীচরিত্রগুলির নব রূপায়ণ ঘটিয়েছেন। নারীর প্রেম মনস্তত্ত্বকে রূপ দেবার জন্য মধুসুদন বীরাঙ্গনার নায়িকাদের আত্মমর্যাদাবোধে দীক্ষিত করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর মানবতাবোধের আলোকে মধুসুদন এই কাব্যের নারী চরিত্রগুলিকে উপস্থাপিত করেছেন।
‘বীরাঙ্গনা’ কাব্য একাধারে রোমান্টিক ও ক্লাসিক কাব্য। পুরাতনের নবরূপায়ণে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের প্রকাশে, নিসর্গের ব্যবহারে ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্য একটি রোমান্টিক কাব্য। প্রেমবুভুক্ষু তারা, সূর্ণনখার স্পষ্ট অভিব্যক্তিতে অপগত যৌবনা কেকয়ী বা সন্তানহীনা জনার দৃপ্ত ঘোষণায় চরিত্রগুলি হয়ে উঠেছে রোমান্টিক। ক্লাসিক কাব্যের বৈশিষ্ট্যও প্রকাশিত হয়েছে ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যে। রামায়ণ-মহাভারতের একই ঘটনার নানান ব্যাখ্যা আছে এ কাব্যে। আবার বিভিন্ন চরিত্রের নিজ নিজ দৃষ্টিসম্ভূত কবির আসক্তির রং এই কাব্যে একান্তই অনুপস্থিত। সরলতা ও প্রত্যক্ষতা যদি ক্লাসিক কাব্যের উদ্দেশ্য হয় তবে তার পরিচয় পাওয়া যাবে ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যে। চরিত্রচিত্রণের পাশাপাশি ক্লাসিক কাব্যের মতো এই কাব্যের ভাষা ঋজু, সংহত ও গাম্ভীর্যদ্যোতক। কাব্যের বর্ণনাভঙ্গিও ক্লাসিক রীতির মতো। কাহিনির বিচারে “বীরাঙ্গনা” কাব্যে প্রত্যেক পত্রের মধ্যে রয়েছে একটি আখ্যান বা কাহিনির ধারা। অতীতের সমস্ত বিষয় স্মৃতির গভীর থেকে স্তরে স্তরে উঠে এসেছে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে। তার ফলে গড়ে উঠেছে এক নির্দিষ্ট কাহিনির বলয়।
‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের রসবৈচিত্র্যও উল্লেখযোগ্য। এক-এক পত্রের বিষয়, ভাব ও এক রূপ। নায়িকারা কেউ প্রেমের বন্ধন ছিন্ন করতে উদ্যত, কেউ স্বামীর অদর্শনে ব্যাকুল হয়ে চিঠি লিখছে। প্রেম ও বীরত্ব, তেজ ও প্রণয় সমানভাবে প্রকাশিত হয়েছে। হৃদয়ভেদী আর্তনাদ, মর্মান্তিক ব্যঙ্গ এবং কঠোর তিরস্কারে ‘নীলধবজের প্রতি জনা’ ও ‘দশরথের প্রতি কেকয়ী’ এই পত্রকাব্যের সেরা দুটি পত্র। জীবনের বাস্তব সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নারী কীভাবে অন্তরের স্বরূপকে মেলে ধরতে পারে, ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যে সেই জীবনসত্য নিষ্ঠার সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে।
চতুর্দশপদী কবিতাবলী
মধুসূদনের প্রবাস জীবনের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ রচনা। বাংলা ভাষায় ‘চতুর্দশপদী কবিতা’র প্রথম জন্ম ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে মধুসূদনের হাতে। রাজনারায়ণের কাছে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন— “I want to introduce the sonnet into our language.” তবে তার এই সংকল্প সুদূর বিদেশে বসে রূপায়িত করেন। মধুসূদনের সনেটগুলির জন্ম ১৮৬৫ সালে, কিন্তু তা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে।
সুদূর ফ্রান্সের ভার্সাই নগরে বসে মধুসুদন যখন সনেটগুলি রচনা করেছিলেন তখন তিনি পুরোপুরি বাঙালি। তিনি যে অন্তরে বাঙালি ছিলেন তার প্রমাণ মিলবে এই সেগুলির মধ্যে। বাংলার জয়দেব, কাশীদাস, যুরোপের দান্তে, ভিক্টর হুগো, টেনিসন প্রভৃতি কবিদের উদ্দেশ্যেই মাইকেল তাঁর সনেটে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। বিদেশে থেকে তার নিজের দেশের কথা কীভাবে কবিকে আকর্ষণ করত তার সেই ভাবের রূপ সনেটগুলিকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। এজন্য মধুসূদনের সনেটগুলি একাধারে কবিতা ও কবির কবিচেতনার ইতিহাস।
মধুসূদনের কাব্য-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য
- বাংলা কাব্যজগতে মধুসূদন বিভিন্ন রীতির প্রবর্তক এবং পরবর্তীকালের সাহিত্যিকদের উপর তিনি তাঁর প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেন।
- ব্যক্তিগত জীবনে যন্ত্রণা পেলেও তার কাব্য হয়ে উঠেছে সৃষ্টিধর্মী। নিজের জীবনের ব্যথা-বেদনা কাব্য সৃষ্টির অন্তরালে ঢাকা পড়ে গিয়েছে।
- নবজাগরণের পুরোহিত মধুসূদন বাংলা কাব্যে সচেতনভাবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আঙ্গিকের সমন্বয় সাধন করেছেন। যার দ্বারা বাংলা কাব্য যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল এবং বাংলা কাব্যে যথার্থ আধুনিকতার সঞ্চার হয়েছিল।
- বাংলা কাব্য প্রথম সাহিত্যিক মহাকাব্য, পত্রকাব্য ও সনেট রচনার কৃতিত্ব মধুসূদনের প্রাপ্য, তাছাড়া বাংলা কাব্যে ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র মতো যথার্থ সাহিত্যিক মহাকাব্য কিংবা ‘বীরাঙ্গনা’র মতো পত্রকাব্য আর রচিত হয়নি। এমনকি বাংলা সাহিত্যে পাশ্চাত্য সনেটের আদর্শে প্রথম চতুর্দশপদী কবিতাবলীর প্রকাশ মধুসূদনের অবিস্মরণীয় প্রতিভার সাক্ষ্য বহন করে।
- বাংলা কাব্যে নতুন আঙ্গিক-রীতির প্রবর্তনের ক্ষেত্রেও তাঁর কৃতিত্ব সমধিক। যেমন, পত্ররীতিতে রচিত কাব্যের মধ্যে আখ্যানধর্মিতা, গীতিকাব্যসুলভ আমেজ, নাটকীয়তা বিশেষভাবে উল্লেখ্য।
- বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন এবং এই ছন্দকে পূর্ণতা দানের ক্ষেত্রে মধুসূদনের বিচিত্রধর্মী প্রতিভার পরিচর সুস্পষ্ট হয়ে রয়েছে।
- শুধু ছন্দের ক্ষেত্রে নয়, পরিচ্ছন্ন ও সাবলীল বাক্রীতির প্রয়োগে, চিত্রকল্প ও অলংকারের প্রয়োগে তাঁর কাব্য মহনীয় হয়ে রয়েছে। বিশেষ করে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ ও ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যে ভাষারীতির পরিচ্ছন্নতা বাংলা কাব্যকে ঐশ্বর্যময় করে তুলেছে। বাংলা কাব্যে নবসৃষ্টির ক্ষেত্রে মধুসূদনের ভূমিকা সম্বন্ধে শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায় জানিয়েছেন—“তিনি কলম্বসের ন্যায় দুস্তর সমুদ্রপথ অতিক্রম করিয়া নূতন মহাদেশের আবিষ্কার না করিলে সেই নবাবিষ্কৃত ভূমিখণ্ডে নানা বিচিত্র ছাঁদের উপনিবেশ-পরম্পরা এত দ্রুত গতিতে গড়িয়া উঠিত না। বাংলা সাহিত্যে সেই আধুনিকতা—মহাদেশের আবিষ্কারকের জয়মাল্য চিরদিন তাঁহার কণ্ঠে অম্লান হইয়া থাকিবে।” (বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা)
Leave a Reply