আধুনিক কবিতায় হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান আলোচনা কর।
হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
‘বৃত্রসংহার’ কাব্যের কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৯০৩) মধুসূদনের উত্তরসূরি রূপে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। মূলত মধুসৃদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রকাশের পর তাঁর মহাকাব্য রচনার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে হেমচন্দ্র বাংলা কাব্যজগতে অবতীর্ণ হন। বাংলা কাব্যজগতে রঙ্গলাল-মধুসূদন-হেমচন্দ্রের আবির্ভাব প্রায় একই সময়ে হলেও এঁদের, প্রতিভা ছিল ভিন্নধর্মী। রঙ্গলাল বাংলা কাব্যে স্বদেশ চেতনাকে আনয়ন করেছিলেন, মধুসুদন বাংলা কাব্যকে আধুনিকতার ঐশ্বর্যে ভরিয়ে দিলেন, আর হেমচন্দ্র বাংলা কাব্যে হিন্দু-সংস্কৃতির ভাব তথা জাতীয়তার বিকাশে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে নবজাগরণের উন্মাদনার সময়ে কবির কৈশোর-যৌবন অতিবাহিত হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজের খ্যাতনামা ছাত্র হেমচন্দ্র পেশায় ছিলেন আইনজীবী। তাঁর সময়ে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও সাহিত্যে যে সংস্কারমুখী আন্দোলন চলছিল তার উত্তাপে হেমচন্দ্র সঞ্জীবিত হন। পরাধীনতার মর্মযন্ত্রণা ছিল সে যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য—একথা কবি অন্তরে উপলব্ধি করেছিলেন বলেই জাতীয়তাবোধে উদ্দীপিত হয়েছিলেন।
চিন্তাতরঙ্গিণী
হেমচন্দ্রের প্রথম কাব্য ‘চিন্তাতরঙ্গিণী’ ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। কবির প্রতিবেশী বাল্যবন্ধু রামকমল ভট্টাচার্যের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে কবি এই কাব্য রচনা করেন। এই কাব্যে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ও রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগামী। একসময়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে ছিওল বলেই এই কাব্যের প্রচার হয়। নতুবা এর রচনারীতি সাধারণ মানের।
বীরবাহু
হিন্দু জাতীয়তাবোধের পুনরুত্থানের যুগে দেশানুরাগবশত হেমচন্দ্র ‘বীরবাহু’ কাব্য রচনা করেন এবং তা প্রকাশিত হয় ১৮৬৪ সালে। দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে যুগাদর্শের প্রেরণায় হেমচন্দ্র ‘বীরবাহু’ কাব্য রচনা করেন। এটি মূলত স্বদেশপ্রেমের উজ্জীবনমূলক কাব্য। কাব্যের কাহিনি কাল্পনিক। ইতিহাসের যেটুকু সূত্র আছে তাও অতি ক্ষীণ। আসলে এই কাব্য কাল্পনিক ইতিহাসের পটে আঁকা স্বদেশপ্রেমের কাব্য। যেমন—
মাগো ওমা জন্মভূমি আরো কতকাল তুমি
এ বয়সে পরাধীনা হয়ে কাল যাপিবে।
পাষণ্ড যবন দল বল আর কত কাল
নির্দয়, নিষ্ঠুর মনে নিপীড়ন করিবে।
ছায়াময়ী
‘বীরবাহু’ কাব্য ছাড়া হেমচন্দ্র কয়েকটি গীতিকবিতা রচনা করেছিলেন। তাঁর ‘ছায়াময়ী’ কাব্য রচিত হয়েছিল দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’-র অনুসরণে। কাব্যটি ছয়টি পল্পব বা পরিচ্ছেদে বিভক্ত। ‘বীরবাহু’ কাব্যটি বর্ণনামূলক। বর্ণনায় মাধুর্যও রয়েছে। এই কাব্যের স্বদেশপ্রীতির আলোচনা প্রসঙ্গে সুকুমার সেন বলেছেন—“বীরবাহুতে হেমচন্দ্র যে সক্রিয় দেশপ্রিয়তা মুখরিত করিলেন তাহা অবিলম্বে প্রথমে চৈত্রমেলা হিন্দুমেলায় ও পরে জাতীয় আন্দোলনে প্রতিধ্বনিত হইল এবং প্রাণনাথ দত্ত, হরলাল রায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতির নাট্যরচনায় বিশেষভাবে প্রতিমূর্ত হইল।” (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস)।
বৃত্রসংহার
হেমচন্দ্রের শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘বৃত্রসংহার’ কাব্য। এই কাব্য দু’খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল (প্রথম থেকে একাদশ সর্গ-১৮৭৫, দ্বাদশ থেকে পঞ্চবিংশ সর্গ-১৮৭৭)। কবি স্বয়ং এই কাব্যকে মহাকাব্য অভিধায় অভিহিত করেননি, শুধুমাত্র ‘কাব্য’ বলেছেন। এই কাব্যের মূল বিষয়বস্তু পৌরাণিক হলেও এতে হেমচন্দ্রের মৌলিকতা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে কিছুটা ইংরেজি কাব্যের অনুসরণ।
শিবভক্ত বৃত্রাসুর কর্তৃক স্বর্গরাজ্য জয়, স্বর্গ থেকে দেবতাদের বিতাড়ন, বজ্র নির্মাণের জন্য দধীচির আত্মত্যাগ, সেই বজ্রের আঘাতে ইন্দ্রের বৃত্র নিধনান্তে দেবতাদের স্বর্গরাজ্য পুনরুদ্ধার—এই পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে হেমচন্দ্র চল্লিশটি সর্গে বিশাল পটভূমিতে দেবাসুরের সংগ্রামকে জাতীয় সংগ্রামরূপে বর্ণনা করে ‘বৃত্রসংহার’ মহাকাব্যের ভাবগৌরব সঞ্চারে প্রয়াসী হন। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র অনুসরণে হেমচন্দ্র এই কাব্য রচনা করেন। কাহিনির বিশালতা এই কাব্যের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও সুকুমার সেন এই কাব্যকে মহাকাব্য আখ্যা দিতে চাননি। কারণ— ১. কাহিনির বিসালতা কাব্যের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। ২. বৃত্রের অপরাধ খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যার জন্য তাঁকে সংহারের জন্য বিশাল আয়োজন করতে হবে। ৩. পৌরাণিক বৃত্রাসুরের মহিমা হেমচন্দ্রের কাব্যে নেই। ৪. ঐন্দ্রিলার ভূমিকায় অসুরমহিষীর দৃপ্ত তেজ ফোটেনি, ফুটেছে রূপকথার সুয়োরাণীর হিংসা ও অভিমান। এন্দ্রিলা ছাড়া এই কাব্যের অন্য কোনো চরিত্র জীবন্ত নয়। ৫. হেমচন্দ্রের অমিত্রাক্ষর ছন্দ আসলে মিলহীন পয়ার এবং তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চার ছত্রের স্তবকে গড়া। ৬. কাব্যের ছন্দে বিষয়োচিত গাম্ভীর্য ও উদারতা পরিস্ফূট হয়নি।
‘বৃত্রসংহারে’র চরিত্র পরিকল্পনায়, ভাবাদর্শে, উপমা-রূপক-উৎপ্রেক্ষার ব্যবহারে, দৃশ্য বর্ণনায় এবং ছন্দে ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র প্রভাব লক্ষ করা যায়। তবে সেই প্রভাব নিতান্তই বাহ্যিক। কারণ আধুনিক যুগের যে নতুন জীবনবোধ মেঘনাদবধ-এর প্রধান চরিত্র সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছিল তার একান্ত অভাব ‘বৃত্রসংহারে’র মধ্যে লক্ষ করা যায়। এমনকি সমকালীন যুগ ‘বৃত্রসংহারে’ কিছুমাত্র ছায়া ফেলেনি। বৃত্রের উত্থান-পতনে প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনির সুপরিচিত নীতির পুনরাবৃত্তিই দেখি। আধুনিক যুগের নতুন জীবন অভীজ্ঞার কোন তাৎপর্যপূর্ণ ছবি পাই না। ‘বৃত্রসংহারে’র আঙ্গিক রীতি মহাকাব্যের উপযুক্ত নয়। এই কাব্যে গার্হস্থ্য পরিবেশ ও কোমলতার প্রাধান্য। বৃত্রের প্রধান পরিচয় পরিবারের কর্তারপে, প্রশ্রয়শীল স্বামী ও স্নেহশীল পিতারূপে। তবে ‘বৃত্রসংহারে’ বক্তব্য বিষয়ের সারল্য, রস ও রুচি সমসাময়িক সমাজে পাঠকদের কাছে উপাদেয় হয়ে উঠেছিল। যেমন ‘বৃত্রসংহারে’র আরম্ভ হয়েছে এভাবে—
বসিয়া পাতালপুরে ক্ষুব্ধ দেবগণ
নিস্তব্ধ, বিমর্ষভাব, চিন্তিত আকুল,
নিবিড় ধুমান্ধ ঘোর পুরী সে পাতাল,
নিবিড় মেঘাড়ম্বরে যথা অমানিশি।
শশিভৃষণ দাশগুপ্ত যথার্থই বলেছেন— “নানাপ্রকার বিশিষ্টতা সত্ত্বেও যে ‘বৃত্রসংহার’ ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র তুল্য হইয়া উঠিতে পারে নাই, তাহার কারণ হেমচন্দ্রের রচনায় কবিত্ব, সরসতা এবং প্রাঞ্জলতার অভাব।”(বাঙলা সাহিত্যের নবযুগ)।
হেমচন্দ্র ‘বৃত্রসংহার’ কাব্যের পর আরো কয়েকটি কাব্য রচনা করেছিলেন, যেগুলি গুণমানে উৎকৃষ্ট নয়। ১৮৭৬ সালে ‘আশাকানন’ নামে একটি কাব্য প্রকাশিত হয়। এটি সাঙ্গরূপক কাব্য। এই কাব্যে মানবজাতির প্রকৃতিগত প্রবৃত্তিগুলির কথা বর্ণিত হয়েছে। এই কাব্যের রচনায় কোনো বিশেষত্ব নেই। তাঁর ‘ছায়াময়ী’ কাব্যটি রচিত হয় ১৮৮০ সালে। কাব্যটি সাতটি পল্লপবে বিভক্ত। এটি দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’ অবলম্বনে রচিত। এখানে পাশ্চাত্য আদর্শে পাপ-পুণ্য, নরক প্রায়শ্চিত্ত প্রভৃতি বর্ণিত হয়েছে। এই কাব্যেরও শিল্পমূল্য ক্ষীণ।
দশমহাবিদ্যা
হেমচন্দ্রের ‘দশমহাবিদ্যা’ কাব্যটি প্রকাশিত হয় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে। এই কাব্যের বিষয় হিন্দু পুরাণ ও তন্ত্রের দেবী-মাহাত্য বিষয়ক পৌরাণিক ঘটনা। দেবীর দশটি প্রকৃতির মধ্যে দশটি বিভিন্ন স্তরের কল্পনারাপ পেয়েছে। এই কাব্যের বর্ণনাভঙ্গিও উল্লেখযোগ্য। যেমন সতীহীন কৈলাসের বর্ণনা—
শুষ্ক কল্পতরু সারি শুষ্ক মন্দাকিনী-বারি
শূন্যকোলে সতী সিংহাসন
নিস্তদ্ধ জগৎ-প্রাণ, নিরুদ্ধ সৌরভ ঘ্রাণ,
কন্ঠে বদ্ধ বিহঙ্গকূজন।।
হেমচন্দ্রের প্রতিভার পরিচয় রয়েছে তাঁর খণ্ড কবিতাগুলিতে। তিনি যদি মহাকাব্য রচনা না করে আরো কিছু খণ্ড কবিতা বা গীতিকবিতা রচনা করতেন তাহলে বাংলা সাহিত্য অধিক সমৃদ্ধ হতো। যদিও খণ্ড কবিতাগুলি ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত ইংরেজ কবিদের কাব্য অবলম্বনে রচিত। এই কবিতাগুলিতে কবির জাতীয়তাবোধ ও নিসর্গপ্রীতির প্রকাশ লক্ষ করা যায়। তাঁর দেশপ্রেমমূলক কবিতাগুলি একসময় মানুষের কাছে প্রচণ্ড আকর্ষণীয় ছিল। যেমন ‘ভারত সংগীত’ কবিতাটি—
বাজরে শিঙা বাজ এই রবে,
শুনিয়া ভারত জাগুক সবে,
সবাই স্বাধীন এ বিপুল ভবে
সবাই জাগ্রত মানের গৌরবে
ভারত শুধু কি ঘুমায়ে রবে?
এছাড়াও তাঁর ‘অশোকতরু’, ‘যমুনাতটে’, ‘লজ্জাবতী লতা’ প্রভৃতি নিসর্গমূলক কবিতাগুলিতে কবিপ্রতিভার পরিচয় রয়েছে।
হেমচন্দ্রের কাব্য-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য
- মধুসূদন বাংলা কাব্যে মহাকাব্য রচনা করে যে বীরযুগের সূচনা করেছিলেন, সেইযুগের উত্তরাধিকারী ছিলেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
- তিনি ভাষা ও ছন্দে প্রথম শ্রেণির কবি ছিলেন না। তাঁর কাব্যের কোনো অন্তর্নিহিত প্রেরণা ছিল না। তিনি কাব্যের উপকরণ সংগ্রহ করেছিলনে বৈদেশিক সাহিত্য থেকে।
- তিনি বাংলা কাব্যে যে স্বাজাত্যবোধ ও স্বদেশপ্রেমের সূচনা করেছিলেন, সেজন্য তিনি বাংলা কবিতার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
- তাঁর খণ্ড কবিতার স্বদেশপ্রেম, ছন্দোলালিত্যের জন্য সুকুমার সেন তাঁকে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জ্যেষ্ঠ উত্তরাধিকারী বলেছেন।
Leave a Reply