আধুনিক কবিতার ইতিহাসে নবীনচন্দ্র সেনের অবদান আলোচনা কর।
নবীনচন্দ্র সেন
“একটা পার্বত্য পাগলাঝোরার ধারার ন্যায় অনিয়ন্ত্রিত কল্পনা এবং হৃদয়াবেগের প্রাচুর্য লইয়া বাঙলা-সাহিত্যে আবির্ভাব হইয়াছিল কবি নবীনচন্দ্রের।” নবীনচন্দ্র (১৮৪৭-১৯০৯) সম্পর্কে শশিভূষণ দাশগুপ্তের এই মন্তব্যটি যথাযথ এই কারণে যে, নবীনচন্দ্রের প্রতিভা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বতন্ত্র এবং তিনি কোন কবির মন্ত্রশিষ্য ছিলেন না। মহাকাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করলেও নবীনচন্দ্রের কবিপ্রতিভা ছিল গীতিকবির। যদিও তিনি আখ্যান কাব্য, মহাকাব্য, খণ্ডকাব্য প্রভৃতি রীতির কাব্য রচনা করেছিলেন, তবুও তার প্রতিভার মধ্যে ছিল উচ্ছ্বাস ও ভাবুকতাসুলভ এক কবি মন।
নবীনচন্দ্র চট্টগ্রাম জেলার নওয়াপাড়া গ্রামে জন্মেছিলেন। পরে কলকাতায় এসে পড়াশোনা করেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হয়ে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদে কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। কলেজে পড়ার সময় তাঁর কিছু কিছু কবিতা ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘এডুকেশন গেজেট’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তিনি স্পষ্টবাদী ছিলেন। ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র সম্পাদক মতিলাল ঘোষের সংস্পর্শে এসে তিনি স্বাদেশিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন।
তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলি হল— ‘অবকাশরঞ্জিনী’ (প্রথম-১৮৭১, দ্বিতীয়-১৮৭৮), ‘পলাশীর যুদ্ধ’ (১৮৭৫), ‘ক্লিওপেট্রা’ (১৮৭৭), ‘রঙ্গমতী’ ৫১৮৮০), ‘খ্রীষ্ট’ (১৮৯১), ‘অমিতাভ’ (১৮৯৫), ‘অমৃতাভ’ (১৯০৯), ‘ত্রয়ী’ (‘রৈবতক’-১৮৮৭, ‘কুরুক্ষেত্র’-১৮৯৩, ‘প্রভাস’-১৮৯৬)।
অবকাশরঞ্জিনী
নবীনচন্দ্রের প্রথম কাব্য ‘অবকাশরঞ্জিনী’। এর প্রথম ভাগে বাইশটি এবং দ্বিতীয় ভাগে তেতাল্লিশটি কবিতা রয়েছে। বেশিরভাগ কবিতায় রোমান্টিক প্রেমের হতাশার সুর ধ্বনিত হয়েছে। প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ, গৃহজীবন এই বিষয়গুলি হল কাব্যের প্রধান বিষয়। এগুলি মূলত গীতিকবিতা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিহারীলালের প্রভাবও রয়েছে। গীতিকবিসুলভ রোমান্টিক প্রেমের যন্ত্রণা প্রতিফলিত হয়েছে কোনো কোনো কবিতায়—
নিবুক নিবুক প্রিয়ে দাও তারে নিবিবারে
আশার প্রদীপ।
এই তো নিবিতেছিল কেন তারে উজলিলে;
নিবুক সে আলো, আমি
ডুবি এই পারাবারে
এই কাব্যের কবিতাগুলিতে কোথাও কোথাও ভাবের শিথিলতা ও ভাষার অসংযম লক্ষ করা যায়।
পলাশীর যুদ্ধ
নবীনচন্দ্র সেনের ‘পলাশীর যুদ্ধ’ কাব্য উল্লেখযোগ্য। এটি পাঁচসর্গে রচিত দেশপ্রেমমূলক আখ্যান কাব্য। বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলার ভাগ্য বিপর্যয়ের কাহিনি অবলম্বনে পরাধীনতার বেদনাকে কবি এই কাব্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। স্বদেশ বাবনার পরিচয়ে এই কাব্য মহনীয় রূপ লাভ করেছে। বঙ্কিমচন্দ্র এই কাব্যের ভূয়সী প্রশংসা করে লিখেছিলেন—“পলাশীর যুদ্ধে উপাখ্যান এবং নাটকের ভাগ অতি অল্প, গীত অতি প্রবল। নবীনবাবু বর্ণনায় এবং গীতিতে একপ্রকার সিদ্ধহস্ত। সেইজন্য ‘পলাশীর যুদ্ধ’ এত মনোহর হইয়েছে।’’
বাঙালির মধ্যে জাতীয়তাবোধের সঞ্চারে ‘পলাশীর যুদ্ধ’ বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। পলাশীর ব্যর্থতা সম্বন্ধে কবি বলেছেন—
পাণিপথে যেই রবি গেলা অস্তাচলে,
ভারতে উদয় নাহি হইল আবার;
পঞ্চশত বর্ষ পরে দূর নীলাচলে,
ঈষদে হাসিতেছিল কটাক্ষ তাহার।
ক্লিওপেট্রা
পলাশীর যুদ্ধের পর ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে ‘ক্লিওপেট্রা’ প্রকাশিত হয়। এটি একটি প্রেমমূলক রোমান্টিক কাব্য।
রঙ্গমতী
১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘রঙ্গমতী’। এটি এক কাল্পনিক স্বদেশপ্রেমমূলক রোমান্টিক কাব্য। কাব্যের নায়ক বীরেন্দ্রের জন্মভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, তাই এই নামকরণ। এই কাব্যের কল্পনা সংযত নয়, স্বদেশপ্রেমও উচ্ছ্বাসমাত্র। বীরেন-কুসুমিকার প্রণয়কাহিনি খুব একটা জীবন্ত হয়নি। কাব্যটি অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা।
রৈবতক-কুরুক্ষেত্র-প্রভাস
ঊনবিংশ শতাব্দীর মহাকাব্যের ধারায় নবীনচন্দ্রের শেষ কাব্য ‘ত্রয়ী’ (‘রৈবতক’ – ১৮৮৭, ‘কুরুক্ষেত্র’ – ১৮৯৩, ‘প্রভাস’ – ১৮৯৬)। রৈবতক ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদিলীলা, কুরুক্ষেত্র মধ্যলীলা এবং প্রভাস কাব্য অন্ত্যলীলা লিয়ে রচিত। রৈবতকে কাব্যের উন্মেষ, কুরুক্ষেত্রে বিকাশ এবং প্রভাসে শেষ। প্রধানত কৃষ্ণের জীবনকথাই এই কাব্যের বিষয়বস্তু। ‘রৈবতক’ কুড়িটি সর্গে, ‘কুরুক্ষেত্র’ সতেরোটি সর্গে এবং ‘প্রভাস’ তেরোটি সর্গে রচিত। নবীনচন্দ্র বিভিন্ন পুরাণ ও মহাকাব্য থেকে উপাদান সংগ্রহ করে সেই উপাদানগুলির মাধ্যমে সমকালীন যুগজীবনের প্রেক্ষিতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে কাব্যরচনা করেছেন। বাংলার রেনেসাঁসের জাতীয়তাবাদের প্রেরণা এর পেছনে ছিল এবং মহাকাব্যোচিত মহিমা ও বিশালতা কাব্যত্রয়ীতে ছিল কিন্তু মহাকাব্যোচিত মননশক্তি ও উচ্চাঙ্গের কবিকল্পনার অভাব কবির মধ্যে ছিল। আসলে কবি আবেগ ও ভাষার তরল উচ্ছ্বাসে এবং অসংযত প্রগলভ্ কাল্পনিকতার আতিশয্যে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন বলেই ‘ত্রয়ী’ মহাকাব্য হয়ে উঠতে পারেনি। এপ্রসঙ্গে অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন—‘‘আসলে তিনি ছিলেন রোমান্টিক ও লিরিক ঐতিহোর উত্তরাধিকারী; এই তিনখানি কাব্যের কোনো কোনো অংশে রোমান্টিক ও লিরিক বৈশিষ্ট্য বেশ চমৎকার ফুটেছে, কিন্তু মহাকাব্যের বিশাল রস ও বিস্ময় তাঁর কবিচরিত্রেও ছিল না, কাব্যেও তার প্রমাণ নেই। (বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত)
নবীনচন্দ্র মহাপুরুষের জীবন অবলম্বনে কয়েকটি জীবনীকাব্য রচনা করেছিলেন। যীশুখ্রিস্ট্রের জীবনী নিয়ে ‘খ্রীষ্ট’ (১৮৯১), বুদ্ধের জীবনকথা নিয়ে ‘অমিতাভ’ (১৮৯৫), এবং চৈতন্যজীবনী নিয়ে ‘অমৃতাভ’ (১৯০৯) কাব্য রচনা করেছিলেন। এরমধ্যে বুদ্ধের জীবন নিয়ে রচিত ‘অমিতাভ’ কিছুটা জনপ্রিয় হয়েছিল। তাছাড়া ‘ভগবদ্গীতা’ এবং ‘মার্কণ্ডেয় চণ্ডী’র কিছুটা অনুবাদও তিনি করেছিলেন।
নবীনচন্দ্র সেনের কাব্য-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য
- কবি হিসেবে নবীনচন্দ্র মূলত ছিলেন কোমল প্রকৃতির ও আবেগপ্রবণ। তাই তাঁর প্রতিভা মূলত গীতিকবির প্রতিভা। তাঁর ‘ত্রয়ী’ মহাকাব্যেও রয়েছে গীতিকবিতাসুলভ উচ্ছ্বাস ও গার্হস্থ্য।
- ‘অবকাশরঞ্জিনী’ ও ‘পলাশীর যুদ্ধ’ কাব্যে নবীনচন্দ্রের স্বদেশচেতনার পরিচয় বেশ স্পষ্ট। ‘পলাশীর যুদ্ধ’-এ কবির প্রাণ স্পন্দন বেশ নিবিড় রূপ লাভ করেছে। এই কাব্যে কবির আশা-আকাঙ্ক্ষা, শৌর্য-বীর্য, আনন্দ-বিষাদ অনবদ্য রূপ লাভ করেছে।
- শশিভূষণ দাশগুপ্ত কবির কবিকৃতিত্ব আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছেন—“সকল ক্রটি-বিচ্যুতি, সকল অসংযম, অসাবধানতা সত্ত্বেও যে কবি নবীনচন্দ্র আমাদের নিকট এত বড় হইয়া উঠিয়াছেন, তাহার আর একটা প্রধান কারণ তাহার সমগ্র কাব্যের একটা স্পন্দন” (বাঙলা সাহিত্যের নবধুগ)।
- সুকুমার সেনও যথার্থই বলেছেন—“নবীনচন্দ্রের কাব্যে ও কবিতায় ভালোমন্দ প্রায় সমভাবে মিশাইয়া আছে। ইমোশনের প্রশ্রয় কম হইলে এবং রচনায় সংযম ও প্রযত্ন থাকিলে নবীনচন্দ্রের কাব্যকলা আরও শ্রীমণ্ডিত হইত” (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস দ্বিতীয় খণ্ড)
- মধুসূদনের উত্তরসাধক রূপে তিনি কাব্যজগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং সমকালীন জীবনের শৌর্য-বীর্যময় ভাবধারাকে নিজের অন্তরে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই আখ্যানকাব্য ও মহাকাব্য রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। শিল্পসৃষ্টির বিচারে সেই প্রয়াস ব্যর্থ হলেও তাঁর কবিপ্রতিভা যে ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
Leave a Reply