//
//

বাংলা কবিতায় বিহারীলাল চক্রবর্তীর অবদান আলোচনা কর।

বিহারীলাল চক্রবর্তী

রোমান্টিক গীতিকবিতার যৌবনমুক্তি বিহারীলালের (১৮৩৫-১৮৯৪) হাতেই। জনাকীর্ণ জীবনের সংগ্রামরত বাংলার কাব্যভাবনার জগতে মন্ময় কল্পনার প্রথম সংবাদ বিহারীলাল মৃদুকণ্ঠে বহন করেছিলেন বলেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যগুরু বিহারীলালকে ‘ভোরের পাখি’ আখ্যায় ভূষিত করেছিলেন। আধুনিক বাংলা কাব্যজগতে রঙ্গলাল থেকে মধুসূদন, হেমচন্দ্র থেকে নবীনচন্দ্র পর্যন্ত সমস্ত কবিই পরাধীন ভারতবর্ষে স্বদেশানুরাগমূলক কাব্য রচনায় নিমগ্ন ছিলেন। এদের কাব্যচর্চায় গীতিকবিতার যে সুর প্রচ্ছন্নভাবে ঢাকা পড়েছিল, তাঁর উচ্ছ্বাসময় প্রকাশ ঘটলো বিহারীলাল চক্রবর্তীর কাব্যে।

স্বপ্নদর্শন

বিহারীলালের প্রথম রচনা ‘স্বপ্নদর্শন’ (১৮৫৮) নামক গদ্যগ্রন্থ। সংস্কৃত কলেজে পাঠরত অবস্থায় কবি এই গ্রন্থ রচনা করেন ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকায়।

সঙ্গীত শতক

বিহারীলালের রচিত দ্বিতীয়গ্রন্থ ‘সঙ্গীত শতক’ প্রকাশিত হয় ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে। গ্রন্থটি একশোটি বাংলা কাব্যের সমষ্টি এই ‘সঙ্গীত শতক’ গ্রন্থটি। এই কাব্যে কবিওয়ালাদের প্রভাব রয়েছে। দৃষ্টান্ত—

আকাশে কেমন ওই

নব ঘন যার

যেন কত কু-বলয়

শোভে সব গায়!

মধুর গম্ভীর স্বরে

ধীরে ধীরে গান করে,

সুধা ধারা বরষিয়ে

রসায় বসায়। (গীত সংখ্যা-৫৫)

বঙ্গসুন্দরী

বিহারীলালের ‘বঙ্গসুন্দরী’ কাব্য প্রকাশিত হয় ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে। এটি দশটি সর্গে বিন্যস্ত। এই দশটি সর্গ হল যথাক্রমে ‘উপহার’, ‘নারীবন্দনা’, ‘সুরবালা’, ‘চিরপরাধিনী’, ‘করুণা সুন্দরী’, ‘বিষাদিনী’, ‘প্রিয়সখী’, ‘বিরহিনী’, ‘প্রিয়তমা’ এবং ‘অভাগিনী’। প্রত্যেকটি সর্গের প্রারম্ভে একটি করে উদ্ধৃতি রয়েছে। তৃতীয় সর্গে সুরবালার অভিমানিনী মূর্তির বর্ণনা বেশ প্রাণবন্ত—

মধুর তোমার ললিত আকার,

মধুর তোমার চাঁচর কেশ,

মধুর তোমার পারিজাত হার,

মধুর তোমার মানের বেশ!

বন্ধুবিয়োগ

‘বন্ধুবিয়োগ’ (১৮৭০) প্রথমে পূর্ণিমা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। চারটি সর্গে কবি বিহারীলাল তাঁর চারজন বন্ধু পূর্ণচন্দ্র, কৈলাস, বিজয় ও রামচন্দ্র এবং প্রথমা স্ত্রী অভয়ার বিয়োগব্যথা ব্যক্ত করেছেন। চারটি সর্গের নাম হল—পূর্ণ-বিজয়, কৈলাস, সরলা, এবং রামচন্দ্র। কাব্যটি সম্পর্কে সুকুমার সেন লিখেছেন—“কাব্যটি পয়ার ছন্দে লেখা চার সর্গে গাঁথা। সর্গগুলির বিষয় যথাক্রমে কবির প্রথম পত্নী ও তিন বাল্যবন্ধুর স্মৃতি বেদনা। রচনারীতিও ঈশ্বরগুপ্তীয়। কাব্যটিতে দেশের ও সাহিত্যের প্রতি কবির গভীর অনুরাগের প্রকাশ আছে।”

নিসর্গ-সন্দর্শন

বিহারীলালের ‘নিসর্গ-সন্দর্শন’-এর প্রকাশকালও ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ। কাব্যটি ধারাবাহিকভাবে ‘অবোধবন্ধু’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই কাব্য সাতটি সর্গে রচিত। সর্গগুলি হল যথাক্রমে—চিন্তা, সমুদ্রদর্শন, বীরাঙ্গনা, নভোমগুল, ঝটিকার রজনী, ঝটিকা সম্ভোগ এবং প্রভাত। নিসর্গের নানা চিত্র, সমুদ্রদর্শন, নভোমগুল, ঝটিকার রজনী, ঝটিকা সম্ভোগ প্রভৃতি প্রকৃতি বর্ণনা বেশ চমকপ্রদ। ‘সুদর্শন’ নামক দ্বিতীয় সর্গে কবি সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে রামায়ণে কাহিনি স্মরণ করে দেশের পরাধীনতার বেদনা অনুভব করেছেন—

তোমারি হাদয়ে রাজে ইংলন্ড দ্বীপ,

হয়েছে জগত—মন যাহার মাধুরী,

শোভে যেন রক্ষ কুল উজ্জ্বল প্রদীপ,

রাবণের মোহিনী কনক-লঙ্কাপুরী।

এদেশেতে রঘুবীর বেঁচে নাই আর,

তার তেজোলক্ষ্মী তার সঙ্গে তিরোহিতা।

কপটে অনাসে এসে রাক্ষস দুর্বার,

হরিয়াছে আমাদের স্বাধীনতা-সীতা।

(স্তবক ২৪-২৫)

প্রেমপ্রবাহিনী

পাঁচটি সর্গে রচিত ‘প্রেমপ্রবাহিনী’ ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ‘অবোধবন্ধু’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। পতন, বিরাগ, বিষাদ, অন্বেষণ, নির্বাণ—এই পাঁচটি সর্গে কাব্যটি সমাপ্ত। সুকুমার সেন এই কাব্য সম্পর্কে জানিয়েছেন—“কাব্যের মর্মকথা, সংসারে আসল প্রেমের মর্যাদা নাই বুঝিয়া কবি যখন হতাশায় নিমগ্ন, তখন অকস্মাৎ তাহার চিত্তে দৈবী আনন্দের স্ফুরণ হইয়াছিল। …প্রেমপ্রবাহিনী কবিচিত্তের প্রথম জাগরণের ইতিহাস।”

সারদামঙ্গল

‘সারদামঙ্গল’ (১৮৭৯) পাঁচ সর্গে গ্রথিত অন্তরঙ্গ কাব্য। তাই অন্তরবাসিনী কাব্যলক্ষ্মীকে অন্তরে বাইরে বিচিত্র কল্পনায় যেভাবে ও যেরূপে উপলব্ধি করেছিলেন তাকেই রূপ দিয়েছেন ‘সারদামঙ্গলে’। এই কাব্যের বিষয়বস্তুতে মৈত্রী, প্রীতি ও সরস্বতী বিরহের সুর ধ্বনিত হয়েছে, শেষপর্যন্ত বিরহের সুর মিলনের প্রাপ্তিতে সৌন্দর্যময় রূপ লাভ করেছে। বিষাদময়ী সারদারূপের সঙ্গে মৈত্রী-প্রীতির করুণামূর্তি মিশ্রিত হয়ে একাকার হয়ে গিয়েছে। মধ্য যুগে বাংলা মঙ্গলকাব্যের ধারায় রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র যেমন ‘নূতন মঙ্গল’রচনা করেছিলেন, তেমনি বাংলা কাব্য সাহিত্যে বিহারীলাল নতুন রোমান্টিক গীতিকবিতা লিখে সারদাবন্দনা কাব্য ‘নূতনমঙ্গল’ রচনা করেন।

সাধের আসন

‘সারদামঙ্গলে’র পর বিহারীলালের ‘সাধের আসন’ কাব্যটি ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয়। কাব্যটি দশটি সর্গে বিভক্ত। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে কবির বিশেষ আদর ছিল। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে পুত্রজ্ঞানে স্নেহ করতেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর ভাতৃভাব ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী কবিকে স্বহস্তে রচিত একখানি আসন উপহার দিয়েছিলেন। সেই উপলক্ষ্যে কবি কাব্যটি রচনা করেছিলেন। কাদম্বরী দেবী, বিহারীলালকে যে আসন বুনে দিয়েছিলেন সেখানে কয়েকটি ছত্র তোলা ছিল—

হে যোগেন্দ্র! যোগাসনে

ঢুলুঢুলু দুনয়নে

বিভোর বিহ্বল মনে কাঁহারে ধেয়াও?

সাধের আসন দশটি সর্গে রচিত। বিশুদ্ধ আনন্দরস উপলব্ধিকে এই কাব্যে তত্ত্বরূপ দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়াও কবির জোষ্ঠপুত্র অবিনাশচন্দ্র চক্রবর্তী কর্তৃক সম্পাদিত কয়েকটি অপ্রকাশিত রচনা কবির নামে পাওয়া যায়। সেগুলি হল—‘মায়াদেবী’, ‘শরৎকাল’, ‘ধুমকেতু’, ‘দেবরাণী’, ‘বাউল বিংশতি’, ‘কবিতা ও সংগীত।

বাংলা কাব্যে বিহারীলালের অভিনবত্বের অন্যতম কারণ এই কবির স্বভাব একেবারেই লিরিক। বাংলা গীতিকবিতার ইতিহাসে দেখা যায়, একই সঙ্গে ক্লাসিক মহাকাব্য, রোমান্টিক আখ্যানকাব্য এবং ব্যক্তিপ্রধান গীতিকাব্যের ধারা প্রবাহিত হয়ে চলছিল কিন্তু শেষপর্যন্ত বাঙালির স্বভাবধর্ম অনুযায়ী গীতিকবিতারই জয় হল। এই জয় সূচিত করলেন বিহারীলাল। যে গীতিপ্রাণতা বাঙালির স্বভাবসিদ্ধ এবং যা পুরাতনকাল থেকে নানা ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যেই সাধনভজনের গানের মধ্যে দিয়ে প্রবহমান ছিল তাতে কবির ব্যক্তি পুরুষের সত্তা মিলিত হয়ে মধ্যযুগের গীতিকাব্য থেকে স্বতন্ত্র এক আধুনিক নীতিকবিতার ধারার মুক্তি ঘটল। সমালোচক অসিতকুমার বন্যোপাধ্যায যথার্থই নীতিকবিরা তাঁদের ব্যন্তিগত আবেগ-অনুভূতিকে পাঠকের অন্তরে সঞ্চারিত করলেন।

বিহারীলাল চক্রবর্তীর কাব্য-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য

  • বিহারীলাল আধুনিক রোমান্টিক গীতিকবিতার পথিকৃৎ। সুকুমার সেনের মতে— “আধুনিক বাঙ্গালা অন্তরঙ্গ গীতিকাব্যের প্রবর্তক তিনিই।’’
  • বিহারীলালের পূর্ববর্তী কাব্যধারা থেকে তিনি স্বতন্ত্র।
  • রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বিহারীলাল’ প্রবন্ধে বিহারী৫৫লালকে কাব্যগুরুর আসন দিয়ে তাঁকে গীতিকবিতার ইতিহাসে ‘ভোরের পাখি’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন—‘‘যে প্রত্যুষে অধিক লোক জাগে নাই এবং সাহিত্যকুঞ্জে বিচিত্র কলগীত কূজিত হইয়া উঠে নাই। সেই ঊষালোকে কেবল একটি ভোরের পাখি সুমিষ্ট সুরে গান ধরিয়াছিল। সে সুর তাহার নিজের।
  • ‘সারদামঙ্গলের’ মতো অসামান্য কাব্য রচনার জন্য তিনি বাংলা কাব্যজগতে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বিহারীলালের সারদা ভিন্ন ভিন্ন মূর্তিতে বিচিত্ররূপিণীরূপে তাঁর কাব্যে চিত্রিত। এই সারদা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বিভিন্ন উপাদানে সৃষ্ট হলেও তিনি কবির নিজস্ব কল্পনাজাত এক গভীর উপলব্ধিগত অদ্বয় সত্য।
  • বিহারীলালের গীতিকাব্যের প্রধান উপাদান—প্রেম ও প্রকৃতি। এক্ষেত্রে কালিদাস তাঁর স্বগোত্র।
  • কবি হিসেবে বিহারীলালের অন্যতম কৃতিত্ব এই যে, তিনি তার কবিতার অনুসারী এক গোষ্ঠী তৈরি করতে পেরেছিলেন। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, প্রিয়নাথ সেন, অক্ষয়কুমার বড়াল, রাজকৃষ্ণ রায়, অধরলাল সেন, নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, নগেন্দ্রনাথ প্রভৃতি কবিগণ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। একথা ঠিকই যে, বিহারীলাল যত বড় ভাবুক, তত বড় কবি ছিলেন না। তাঁর কবিপ্রতিভা সম্বন্ধে শশিভূষণ দাশগুপ্ত বলেছেন—“বিহারীলাল যদি ভাবের নেশায় মশগুল হইয়া নিজেকে বিশ্বজগৎ হইতে একেবারে একান্ত নিভূতে আপনার ভিতরেই গুটাইয়া না লইয়া কাব্যের এই ভাষা এই কলাকৌশল সম্বন্ধে আর একটু অবহিত হইতে পারিতেন, তবে তাহার বিরাট কবিমন লইয়া তিনি বাঙলা সাহিত্যের গগনে হয়ত আরও উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় দীপ্তি পাইতে পারিতেন।” (বাঙলা সাহিত্যের নবযুগ)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!