//
//

স্বভাবকবি গোবিন্দচন্দ্র দাসের কৃতিত্ব আলোচনা কর।

গোবিন্দচন্দ্র দাস

গোবিন্দচন্দ্র দাস (১৮৫৬-১৯১৮) স্বভাবকবি। ১৮৫৫ সালের ১৬ জানুয়ারি  ঢাকা জেলার ভাওয়ালের জয়দেবপুরে এক দরিদ্র পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তাঁর পিতা রামনাথ দাসের মৃত্যু হলে দুঃখ-দৈন্যের কারণে গোবিন্দচন্দ্র উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। ভাওয়ালরাজ প্রতিষ্ঠিত জয়দেবপুর মাইনর স্কুল থেকে ছাত্রবৃত্তি পাস করে তিনি ঢাকা নর্মাল স্কুলে ভর্তি হন, কিন্তু নবম শ্রেণি পাঠের পর স্কুল ত্যাগ করে ভাওয়ালের ব্রাহ্মণগ্রাম বঙ্গ বিদ্যালয়ে হেড পন্ডিত হিসেবে যোগদান করেন। পরে তিনি পর্যায়ক্রমে ভাওয়াল এস্টেটের রাজকুমারের প্রাইভেট সেক্রেটারি (১৮৭৭), সুসঙ্গ দুর্গাপুরের জমিদারির খাজাঞ্চি (১৮৮০), মুক্তাগাছার জমিদারির সেরেস্তাদার (১৮৮০-৮২), ময়মনসিংহ এন্ট্রান্স স্কুলের পন্ডিত, ময়মনসিংহ সাহিত্য-সমিতির অধ্যক্ষ (১৮৮২-৮৪) এবং শেরপুরের জমিদার প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক চারুবার্তার কর্মাধ্যক্ষরূপে (১৮৮৪-৯৪) দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৮৭-৮৮ সালে কলকাতায় অবস্থানকালে তিনি মাসিক পত্রিকা বিভা প্রকাশ করেন।

গোবিন্দচন্দ্রের মধ্যে এক ধরনের প্রতিবাদী চেতনা কাজ করত। এজন্য তিনি অনেক সময় বিপদগ্রস্তও হয়েছেন। তিনি যখন ভাওয়াল স্টেটে চাকরি করতেন তখন রাজাদের অত্যাচার ও দীউয়ান কালীপ্রসন্ন ঘোষের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করায় সেখান থেকে তিনি বিতাড়িত হন। পরবর্তীকালে তিনি যখন কলকাতায় অবস্থান করছিলেন তখন নব্যভারত-এর সম্পাদক দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয় এবং তাঁর আশ্রয়ে থেকেই তিনি মগের মুলুক নামক সুপ্রসিদ্ধ কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। অপরিসীম দারিদ্রের মধ্যে গোবিন্দচন্দ্রের সমগ্র জীবন অবিবাহিত হয়, যার ছায়াপাত ঘটেছে তাঁর কবিতায়।

রবীন্দ্রনাথের সমকালে আধুনিক গীতিকবিতার ধারায় কবিতা রচনা করেই গোবিন্দচন্দ্র খ্যাত হন। মধুসূদন,  হেমচন্দ্র ও  বন্দ্যোপাধ্যায়, রঙ্গলাল রচিত মহাকাব্যের যুগে রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পর্যন্ত প্রধানত  চক্রবর্তী, বিহারীলাল, গোবিন্দচন্দ্র দাস,  কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ কবি বাংলা গীতিকবিতার ধারাকে বজায় রেখেছিলেন। নরনারীর ইন্দ্রিয়জ প্রেম গোবিন্দচন্দ্রের কাব্যের মুখ্য বিষয়বস্তু; তবে স্বদেশপ্রেম, পল্লিপ্রকৃতি ও মানবজীবনের কথাও তাঁর কাব্যে বর্ণিত হয়েছে। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হলো—প্রসূন (১৮৭০), প্রেম ও ফুল (১৮৮৮), কুঙ্কুম (১৮৯২), মগের মুলুক (ব্যঙ্গকাব্য, ১৮৯৩), কস্তুরী (১৮৯৫), চন্দন (১৮৯৬), ফুলরেণু (সনেট, ১৮৯৬), বৈজয়ন্তী (১৯০৫), শোক ও সান্ত্বনা (১৯০৯), শোকোচ্ছ্বাস (১৯১০) ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি অ্যালেন হিউমের অ্যায়োত্রক কবিতা এবং ভগবদ্গীতার কাব্যানুবাদ করেন। তাঁর কবিতায় স্বদেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত—

স্বদেশ স্বদেশ করছ কারে? এদেশ তোমার নয়,_

এই যমুনা গঙ্গা নদী, তোমার ইহা হত যদি,

পরের পণ্যে, গোরা সৈন্যে জাহাজ কেন বয়?

গোবিন্দ দাস ছিলেন স্বভাব কবি। সমসাময়িক কবিগণের ন্যায় তিনি শিক্ষিত ছিলেন না, ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গেও তার কোন যোগাযোগ ছিল না। নিজের স্বাভাবিক প্রতিভাবলে তিনি কবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। প্রেমের কবি হিসেবে কবি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তার কিছুটা সামঞ্জস্য আছে। তাঁর কবিত্ব উৎসারিত হয়েছিল তাঁর যৌবনসঙ্গিনী পত্নীর প্রেমে এবং তা প্রবাহিত হয়েছিল এই যৌবন প্রেমস্বপ্নের স্মৃতিপথেই। তবু তাঁর কবিতায় প্রেমের প্রকাশ পুরাপুরি পত্নীনিষ্ট নয় এবং তাতে আছে প্রেমের স্থূল দিক তথা দেহের আকর্ষণের বেশি ঝোঁক। এ দিক থেকে গোবিন্দ দাস সমসাময়িক কবিদের থেকে স্বতন্ত্র। প্রেমের মহিমা সম্পর্কে কবি লিখেছেন—

প্রেমে পাপ হয় পুণ্য কর্ম সে কামনাশূন্য,

অধর্ম হইয়ে ধর্ম করে সে উদ্ধার;

রজকিনী চণ্ডীদাসে সে প্রেমে বৈকুণ্ঠ ভাসে,

সে কি গো কুণ্ঠিত প্রেম পাপ কুলটার?

বাংলাদেশের প্রকৃতি পরিবেশ তাঁর কাব্যে সার্থকভাবে রূপায়িত হয়েছে। সহজ সরল মনোভাব প্রকাশের বিশিষ্টতা তাঁর মধ্যে বর্তমান থাকলেও কাব্যের সর্বত্র সংযম এবং ভাষার সার্থক বাঁধুনি ছিল না। প্রকৃতির স্বাভাবিক পরিবেশে রচিত তাঁর কাব্যের মধ্যে ছন্দ-শব্দযোজনা প্রভৃতি দিক থেকে যথেষ্ট কৃতিত্বের প্রকাশ না থাকলেও সর্বত্র আন্তরিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। গোবিন্দ দাসের ‘মগের মুলুক’ নামক ব্যঙ্গকাব্যে ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকাতে তার প্রচার বন্ধ করা হয়েছিল। কবির দেহাত্মবাদের বিদ্রোহী সত্তা পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতার জন্য পরিস্ফূট হতে পারেনি। হলে আধুনিক বাংলা কাব্যে আধুনিক মনস্কতার পরিচয় অধিকতর স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারত। ১৯১৮ সালের ১ অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!