ওড়িয়া সাহিত্যের বিকাশে ফকিরমোহন সেনাপতির কৃতিত্ব ব্যাখ্যা কর।
ফকিরমোহন সেনাপতি
আধুনিক ওড়িয়া সাহিত্যের বিকাশে যে ত্রয়ী ব্যক্তিত্বের কথা ওড়িয়া সাহিত্যের ইতিহাসে উল্লিখিত হয়, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ফকিরমোহন সেনাপতি। আর অন্য দুজন ছিলেন রাধানাথ রায় ও মধুসূদন রাও। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময় থেকে এঁরা ওড়িয়া সাহিত্যে নবদিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন। ফকিরমোহন ছিলেন এই ত্রয়ীর প্রধান অনুপ্রেরণাকারী ব্যক্তি। তাঁর নিজের সাহিত্যিক বা কবি হয়ে ওঠবার কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা কিন্তু ছিল না। এমন কি, প্রথাগত শিক্ষালাভের সুযোগও তিনি লাভ করেন নি। কিন্তু তিনি ছিলেন অন্তর্গতভাবেই দেশপ্রেমিক ও মানবতাবাদী। তাঁর সাহিত্যজগতে প্রবেশের ক্ষেত্রে এই গুণগুলিই সহায়ক হয়েছিল। ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে বালাসোরে তাঁর জন্ম। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক,প্রশাসক, বিদ্বান, সমাজ সংস্কারক-সাংবাদিক ও দেশপ্রেমিক। দুই বছরের বেশি তিনি প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ পাননি, কিন্তু তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। নিজের প্রচেষ্টায় কেবল ওড়িয়া নয়, আরও চার-পাঁচটি ভারতীয় ভাষা শিখেছিলেন তার অন্যতম ছিল সংস্কৃত ভাষাও। এছাড়া তিনি ইংরাজী ভাষাও শিক্ষা করেছিলেন। তিনি ব্রিটিশ আমলে ওড়িশার দেশীয় রাজ্যগুলির দেওয়ান রূপে কাজ করতেন। তিনি ওড়িশার সমবায় আন্দোলন ও সমবায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ছিলেন অগ্রপথিক।
তাছাড়া ওড়িশায় প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার গৌরব তাঁরই প্রাপ্য। তিনি ওড়িশা বিভাগের ব্রিটিশ কমিশনারকে শেয়ার হোল্ডার রূপে সঙ্গে নিয়ে এই ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর কৃতী জীবনের সমাপন ঘটে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে।
ফকিরমোহন সেনাপতির সাহিত্য প্রতিভা ছিল বহুমুখী। অনুবাদক রূপে তিনি সংস্কৃত ভাষা থেকে ওড়িয়া ভাষায় রামায়ণ ও মহাভারতের অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর অনূদিত রামায়ণ ও মহাভারতের আঠারো খণ্ডের মধ্যে চারটি খণ্ড প্রকাশ করা হয়েছিল। তাঁর অনুবাদ ওড়িশার শিক্ষিত মানুষেদের মধ্যে অত্যন্ত সমাদর লাভ করেছিল। এছাড়াও তিনি ছান্দোগ্য ও অন্যান্য উপনিষদ, ভগব্দগীতা, হরিবংশ পুরাণ প্রভৃতিরও অনুবাদ করেছিলেন। প্রশাসক রূপে তিনি সমবায় আন্দোলনের মূল নীতিগুলির বিষয়েও বই লিখেছিলেন।
তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘উৎকল ভ্রমণ’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে। এটি কিন্তু কোনো ভ্রমণকাহিনী নয়। কার্যোপলক্ষ্যে তাঁকে ওড়িশার বিভিন্ন স্থানে যেতে হত। ওড়িশার সাধারণ মানুষের জীবন ও তাদের জীবনযাত্রার বিবিধ দিক তিনি কবিতার আঙ্গিকে বাণীবদ্ধ করেছিলেন। লেখাগুলি, বিষয়ের সুস্পষ্ট প্রকাশ, তাদের অন্তর্নিহিত ভাব, বিষয়গত শ্লেষ ও উপভোগ্যতার কারণে পাঠকের মনোরঞ্জন করেছিল। তিনি নিজের নাম গোপন করেই বইটি লিখেছিলেন, কিন্তু তাঁর পাঠকদের কাছে তাঁর পরিচয় গোপন থাকেনি।
তাঁর রচিত কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ হল— পুষ্পমালা, উপহার, অবসারাবসরে, পূজাফুল, প্রার্থনা, ধূলি। তাঁর এই কাব্যগ্রন্থগুলিকে শিল্পের বিচারে খুব উঁচু মানের বলা চলে না। কিন্তু কবিতার বিষয়বস্তু, তাদের বর্ণনায় কবির সারল্য, বস্তুসমূহের নিবিড় পরিচয় কবিতাগুলিকে মনোগ্রাহী করে তুলেছে। তাঁর কবিতায় বিষয়রূপে এসেছে প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী, সমাজের বিবিধ প্রাচীন সংস্কার, জীবন দর্শন, প্রার্থনা, বিখ্যাত মানুষদের জীবন প্রভৃতি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিষয়ও তাঁর রচনার উপজীব্য হয়েছে,— জোসেফিন, যীশু খ্রীস্ট, ক্লিওপেট্রা, তুকারাম, ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের রুশ–জাপান যুদ্ধ ইত্যাদি। তাঁর কাব্যের এই বিষয় বৈচিত্র্য দ্বারা বোঝা যায় যে, প্রথাগত শিক্ষা থেকে ফকিরমোহন বঞ্চিত হলেও, তাঁর মনন ছিল বহুদূরগামী। তাঁর বন্ধুদ্বয় রাধানাথ রায়, মধুসূদন রাও প্রমুখেরা পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও ফকিরমোহনের মত আন্তর্জাতিক ভাবধারায় তাঁর মতো উদ্বুদ্ধ হতে পারেননি। তাঁরা পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও কেবল নির্দিষ্ট কাব্যিক বিষয়েই নিজেদের চিন্তাধারাকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন, ফকিরমোহন তাঁর স্বশিক্ষার দ্বারা সেই মননগত সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী কৃষ্ণকুমারীর বিয়োগের পর, স্ত্রীর স্মৃতিতে লেখা তাঁর একটি কবিতার অনূদিত রূপ এইরকম—
সুন্দরী কৃষ্ণকুমারী, আমার গৃহের শোভা
আমার চিরপ্রিয়া, আমার জীবন, আমার চিরকালের সঙ্গিনী তুমি!
তুমি আমার প্রিয়তমা, আজ তুমি আমার থেকে দূরে বহুদূরে
কিন্তু তোমার অস্তিত্ব রয়ে গেছে এখনো আমার হৃদয়ের শিরায়, উপশিরায়…
আমি গোলাপের উপর মুক্তোর দানার মত শিশিরবিন্দুকে দেখেছি, দেখেছি স্ফুট পদ্মের সৌন্দর্য
তবু তা কি উপাসনাকালে তোমার চোখ থেকে ঝরে পড়া অশ্রুবিন্দুর মতো পবিত্রতর?…
( কৃষ্ণকুমারী)
কবিতাটি, কবির অনুভূতির অকপট প্রকাশেই পাঠকের মনকে স্পর্শ করবে। এই, অকপটতাই ফকিরমোহনের কবিতা তথা সাহিত্যের সম্পদ।
ফকিরমোহনের লেখা বেশ কিছু ছোটগল্পের সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি সেগুলি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। সংখ্যায় সেগুলি এমন কিছু বেশি নয়, তবে বিষয়গত বৈচিত্র্যে অভিনব। তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘লছমনিয়া’কে ভারতীয় ছোটগল্পধারায় প্রথমতম ভারতীয় ভাষায় লিখিত ছোটগল্প বলে কেউ, কেউ অনুমান করে থাকেন। এটি ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে বালাসোরের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর অপর একটি ছোটগল্প ‘পেটেন্ট মেডিসিন’-এর বিষয় ছিল এক মহিলা কিভাবে ঝাঁটাপেটা করে তার অবাধ্য ও পথভ্রষ্ট স্বামীকে পথে আনল। এটি একটি মজার গল্প। ‘অনন্ত, এক বিধবার বখাটে ছেলে’ গল্পে এক বিধবার দুরন্ত, অবাধ্য বখাটে ছেলে কীভাবে একদিন গ্রামের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ল, সেই কাহিনী বিবৃত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কাহিনীতে ছেলেটি এবং তার মা দুজনেই মারা যায়। কিন্তু গ্রামের সকলের মনে ছেলেটি তার শেষ এই কাজের, আত্মদানের ছাপ রেখে গেল, যা কিনা তার বখাটে পরিচয়কে মুছে দিতে সমর্থ হল। দুটি গল্পে ফকিরমোহন সমুদ্রব্যবসার ইতিবৃত্তও বর্ণনা করেছেন। তাঁর নিজের দেখা জগৎ থেকেই এই গল্পগুলির আখ্যানবৃত্ত পরিকল্পিত হয়েছিল। কোনো কোনো গল্পে তিনি, তৎকালীন যুবকদের অন্ধভাবে পাশ্চাত্য অনুকরণ ও তার বিষাদান্তক পরিণাম বর্ণনা করেছেন। ফকিরমোহনের গল্পগুলি উঠে এসেছিল তাঁর নৈমিত্তিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই। জীবনের ঘনিষ্ঠ উত্তাপেই গল্পগুলি মূল্যবান হয়ে উঠেছে।
ফকিরমোহনের উপন্যাস রচনার প্রয়াসকে তাঁর গল্পরচনার পরিণত পর্যায় রূপে গণ্য করা যেতে পারে। তাঁর উপন্যাস ‘ছমানা আটগুন্থা’ সামন্ততান্ত্রিক ভারতবর্ষের একটি করুণচিত্রকে উঘাটিত করে। এই গল্প রামচন্দ্র মাঙ্গারাজা নামে এক ব্যক্তির। সে ছিল এক দরিদ্র অনাথ বালক। কিন্তু তার মনে ছিল ধনী হয়ে ওঠার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা। ক্রমে সে স্থানীয় জমিদারের ইজারাদার হল, ধনীও হল ধীরে ধীরে, এলাকার জমিদারীও নিলামে কিনে নিল। কিন্তু জমির লালসা তাকে নেশার মতো চেপে বসল। যেখানে যা জমি সে পায়, ন্যায় বা অন্যায় ভাবে সে তা গ্রাস করে। শেষে তার নজর পড়ল ভাঙিয়া ও সারিয়া নামে এক নিঃসন্তান দম্পতির ছয় একর আট কাঠা জমির উপর। ছলে–বলে তাদের সেই জমি সে আদায়ও করল। কিন্তু তার পরিণাম ভালো হল না। ঘটনা পরম্পরায় সারিয়া মারা গেল, ভাঙিয়া উন্মাদ হয়ে গেল; মাঙ্গারাজার জেল হল এবং পরে মারা গেল। তার পরিচারিকা চম্পা তার সঞ্চিত সব টাকা-অলঙ্কার নিয়ে গোবিন্দ নামে এক নাপিতের সঙ্গে পালালো। লুঠের সম্পত্তির বিবাদে গোবিন্দ চম্পাকে হত্যা করল এবং পালাতে গিয়ে নিজেও সব সমেত জলে ডুবে মারা গেল। পাপের ধন কারুর ভোগেই এল না। তাঁর অন্যান্য উপন্যাসর মধ্যে ‘প্রায়শ্চিত্ত’ এক ইংরেজি শিক্ষিত যুবার বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি মোহ, স্বদেশী ভাবধারাকে ঘৃণা ও তার ভুল ধারণার প্রায়শ্চিত্তের কাহিনী। ‘মামু’ উপন্যাসটি ভালো ও মন্দের দ্বন্দ্ব এবং শেষে ভ্রান্তিজনিত অনুশোচনার কাহিনী। ‘লছমা’ মারাঠা আক্রমণের প্রেক্ষাপটে লেখা একটি ইতিহাস নির্ভর রোমান্টিক কাহিনী।
এছাড়াও ফকিরমোহন তাঁর একটি মূল্যবান আত্মজীবনীও লিখেছিলেন, তার নাম ‘আত্মচরিত’। এই গ্রন্থে তিনি তাঁর বালাসোরে ফেলে আসা সময়ের কথা লিখেছেন, লিখেছেন ভারতবর্ষের সোনালী অতীতের কথা, মহাত্মা গান্ধীর চরকা আন্দোলন, ওড়িশার গ্রামে গ্রামে সেই সত্যাগ্রহ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার কথা, সেই আন্দোলনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের কথা। ভারতীয় ভাষায় লিখিত আত্মজীবনীগুলির মধ্যে এটি অন্যতম স্মরণীয় ও মূল্যবান আত্মজীবনী রূপে স্বীকৃত হতে পারে।
ওড়িয়া তথা সমগ্র ভারতীয় কথাসাহিত্যে ফকিরমোহন সেনাপতি একটি শ্রদ্ধার্হ নাম। তাঁর সাহিত্যকর্মের দ্বারা তিনি ওড়িশার জনজীবন ও ইতিহাসকে জীবন্তও সাহিত্যের পাতায় স্থায়ী আসন দান করেছিলেন। তাঁর দেখা জগৎ তাঁর কলমে অবিস্মরণীয় রূপে দেখা দিয়েছিল। প্রথাগত শিক্ষালাভের সুযোগ ঘটেনি তাঁর। কিন্তু জীবন তাঁকে যা শিখিয়েছিল তাই দিয়েই তিনি ওড়িশার সাহিত্যে নবজীবন সঞ্চার করেছিলেন। তাঁর ভাষা ছিল সহজ, সরল, অনাড়ম্বর। ফলত, তাঁর সাহিত্য সহজেই সাধারণ মানুষের মন জয় করে নিয়েছিল। তিনি সংস্কৃত গন্ধী সাহিত্যিক ভাষাকে বর্জন করে, ওড়িশার সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকে সাহিত্যে স্থান করেদিয়েছিলেন। এর প্রভাব হয়েছিল সুদূর প্রসারী। তাঁর বিষয় ও রচনাশৈলীতে ওড়িশার মাটির গন্ধ এত সহজেই মিশেছিল বলে তাঁকে সমালোচক ওড়িশার ‘টমাস হার্ডি’ রূপেও অভিহিত করেছেন— “with his masterly handling of rustic speech, his dealing mostly with the common folk, closely attached to nature and the soil, but making the universal real to us even through these illiterate ragamuffins, Senapati reminds us, among western novelists of Thomas Hardy whose part – contemporary he was. Like Hardy Senapati was both a poet and a novelist and like hardy he wrote masterpieces of fictions using genuine low characters from the rural and urban areas. But the big difference between Senapati and any other important literary hero is that here was a man who both saved a language and enriched it like a master- craftsman, although he at no time in his life entertained any ambition for fame as a great writer.” (a History of Oriya literature, Mayadhar Mansinha)।
Leave a Reply