অসমীয়া সাহিত্যের ধারায় ঔপন্যাসিক রজনীকান্ত বরদলৈর কৃতিত্ব লেখ।
রজনীকান্ত বরদলৈ
রজনীকান্ত বরদলৈ (১৮৬৯-১৯৩৯) আধুনিক অসমীয়া সাহিত্যধারার একজন বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক। অসমীয়া জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে তিনি গভীর শ্রদ্ধাবান ছিলেন। তাই দেশীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে দেশের বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মকে তিনি সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করার দায়িত্ব পালন করেছিলেন তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির দ্বারা। তিনি ছিলেন উদার হৃদয় ব্যক্তি। সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য তাঁর মনের দরজা খোলা ছিল। তাঁর সাহিত্যের বিচিত্র পথে সেই সব মানুষের নিয়মিত আনাগোনা ছিল। তিনি ক্ষুদ্র-বৃহৎ, মহৎ-সামান্য–মানুষের সকল অস্তিত্বকেই ভাললোবেসেছেন এবং আপন সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে তাদের ব্যথিত, পীড়িত জীবনের উপশম ঘটানোর কথা ভেবেছেন। তিনি ক্ষুদ্রতা, বিভেদের উর্ধ্বে জীবনের যে গূঢ় সত্যের অবস্থান, সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষকে সেই সত্যেই উপনীত করে দিতে চেয়েছিলেন।
সাহিত্যরচনায় তিনি ওয়াল্টার স্কটের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। ওয়াল্টার স্কট ছাড়াও বাঙালি ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিও তাঁর ছিল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। এই দুই লেখকের জীবনবোধের সঙ্গেই তিনি মানসিক নৈকট্যবোধ করতেন। আসামের জাতীয় অস্তিত্বরক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে রজনীকান্ত বরদলৈ অসমীয়া কথাসাহিত্যে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাঁর উপন্যাসে সাহিত্যগুণ যেমন দৃষ্ট হয়েছে, তেমনি দার্শনিকতা ও সৃজনশীলতার প্রকাশও লক্ষ্য করা যায়। তিনি মূলত ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছিলেন। এই প্রকরণের রচনা ও রচনাকারদের জনপ্রিয়তা সাধারণত দীর্ঘজীবী হয় না। কিন্তু, রজনীকান্ত বরদলৈ ও তাঁর রচিত উপন্যাসগুলির জনপ্রিয়তা অদ্যাবধি অক্ষুণ্ন আছে। অসমীয়া উপন্যাস সাহিত্যে তিনি আজও স্পৃহণীয় ব্যক্তিত্ব রূপে স্বীকৃত।
তাঁর রচিত উপন্যাসগুলির পরিচয় নেওয়া যেতে পারে, ১৮৯৫ সালে লিখিত ‘মিরিজিয়ারী’ তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস। তাঁর লেখা উপন্যাসগুলির মধ্যে এটিই কেবলমাত্র ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়। মিরি উপজাতির দুই তরুণ–তরুণীর প্রেমকাহিনীকে অবলম্বন করে উপন্যাসটি রচিত। উপন্যাসের পরিণতি বিষাদান্তক। উপজাতি চরিত্রকে অবলম্বন করে অসমীয়া সাহিত্যে এর আগে এইভাবে এর আগে সাহিত্য রচিত হয় নি। ‘মনোমতী’ (১৯০০) তাঁর লেখা একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। এই রচনাটিকে রজনীকান্ত বরদলৈ এর শ্রেষ্ঠ উপন্যাসরূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অহোমরাজাদের রাজত্বের শেষ দিকে, বর্মী আক্রমণের পরিবেশে উপন্যাসটি লিখিত হয়। আসামের এক সামাজিক-রাজনৈতিক বিপর্যয়ের দিনে একটি প্রেমকাহিনীকে ঔপন্যাসিক এই উপন্যাসে নির্মাণ করেছেন। এই উপন্যাসের নায়ক লক্ষ্মীকান্ত ও নায়িকা মনোমতী। তাদেই প্রেমকাহিনী বর্ণিত হয়েছে; কিন্তু এরই পাশাপাশি লেখক লক্ষ্মীকান্তের বীরত্ব , মননামতীর মননামুগ্ধকর মাধুর্যকে ফুটিয়ে তুলেছেন। বিঘ্নিত জনজীবনে লক্ষ্মীকান্ত ও মনোমতীর প্রেমের আখ্যান রাষ্ট্রনৈতিকতার ঊর্ধ্বে জীবনের জয়গাথাই রচনা করেছে। ‘রঙ্গিলী’ (১৯২৫) উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে আসামের রাষ্ট্রনৈতিক বিপর্যয়ের ইতিবৃত্তই ব্যবহৃত হয়েছে। বর্মীরা দেশ আক্রমণ করেছে, সামাজিক-রাষ্ট্রনৈতিক নৈরাজ্য, রাজপুরুষেরা প্রায়শই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত–নেতিবাচকতার প্রেক্ষাপটে এখানে এক মহিলার আদর্শমণ্ডিত জীবনের উপাখ্যান এটি। এই নারী তার প্রেমের ঐকান্তিকতায় ব্যক্তিগত প্রেমকে প্রায় ভগবৎ প্রেমের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। সেই যুগের একটি নারীর কথা নয় এ যেন, বিপর্যয়ের কালে সেই দেশের গৃহলক্ষ্মীদের সহিষ্ণুতার প্রতিভূ যেন ‘রঙ্গিলী’ র নায়িকা। ‘রহদাই লিগিরি’ও আসামের রাজপরিবারের প্রেক্ষাপটে লিখিত একটি প্রেমের আখ্যান। রহদাই এক সাধারণ তরুণী, দয়ারামের সঙ্গে তার প্রেম, এই দয়ারামও অতি সাধারণ এক যুবক। রাজপরিবারের অত্যাচার ও প্রললোভন সত্ত্বেও রহদাই কেবল নিজের প্রেমের প্রতিই বিশ্বস্ত থাকে তাই নয়, যোগাভ্যাসের দ্বারা নিজেকে রক্ষা করে, দয়ারামের মানসিক পরিবর্তন ঘটাতেও সক্ষম হয়। এও এক আদর্শায়িত প্রেমোপাখ্যান। ‘নির্মল ভকত’ (১৯২৫) উপন্যাসে নায়ক নির্মল ব্রহ্মদেশীয়দের সঙ্গে যুদ্ধে বন্দী হল। ঘটনাক্রমে সে যখন বন্দিজীবন থেকে পালিয়ে এসে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হয়, দেখে, স্বদেশ এমন কি তার পরিবারেরও অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। তার স্ত্রী অন্যপুরুষের অঙ্কশায়িনী। নির্মল পারিবারিক জীবনের এই বিপর্যয়ে হতাশ না হয়ে, নিজের জীবনকে অন্য খাতে প্রবাহিত করল। সে পরিণত হল একজন বৈষ্ণবভক্তে। ভগবৎ ভক্তিতেই তার জীবনের নিরাশা থেকে সে উদ্ধার পায়। ইহজাগতিক নশ্বরতার ঊর্ধ্বে সে নিজেকে স্থাপন করতে পারে। তামেশ্বরীর মন্দির ও একটি ইতিহাস নির্ভর প্রেমকাহিনী। ধনেশ্বর ও অঘোনী নামক প্রেমিক-প্রেমিকার পরস্পর মিলনে বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায় মন্দিরের তান্ত্রিক গোষ্ঠী। শেষপর্যন্ত তান্ত্রিকেরা হার স্বীকার করেন, বৈষ্ণবদের কাছে। ব্রহ্মদেশীয় কর্তৃক আসাম আক্রমণের সময়কালই এই উপন্যাসের কাল পটভূমি রূপে ব্যবহৃত হয়েছিল। ‘দন্দু দ্রোহ’ (১৯১৯) উপন্যাসে আহোম শাসনের বিরুদ্ধে কামরূপ জনগণের বিদ্রোহের উপাখ্যান বিবৃত হয়েছে। ১৮৮০ সালের আসামের রাজনৈতিক–সামাজিক প্রেক্ষাপট এই উপন্যাসে ব্যবহৃত হয়েছে। আহোম রাজার প্রতিনিধি বদনদত্তের অপশাসনে কামরূপবাসীরা হরদত্ত ও বীরদত্ত—দুইভাইয়ের নেতৃত্বে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। যুদ্ধক্ষেত্রে বীরদত্ত মৃত্যুবরণ করে। হরদত্ত ধরা পড়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত হন। হরদত্তের কন্যা বন্দি হয়ে সম্মানহানি ঘটার ভয়ে, ব্রহ্মপুত্রের জলে আত্মবিসর্জন দেয়। ‘রাধা রুক্মিণী’ রজনীকান্ত বরদলৈ এর আর একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু মোরামারিয়া বিদ্রোহ। তারা ধর্মে বৈষ্ণবপন্থী এবং রাধা ও রুক্মিণী নামে সেই দলের দুই বীর নারীর আখ্যান এই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে।
রজনীকান্তের রচনাশৈলীর বৈশিষ্ট্য
রজনীকান্ত বরদলৈ-এর উপন্যাস পাঠে তাঁর উপন্যাস রচনার বিশিষ্টতাকে অনুধাবন করা যায়। সেই বিশিষ্টতাগুলি এইরূপ—
- রজনীকান্ত বরদলৈ-এর উপন্যাসগুলিতে আসামের রাষ্ট্রনৈতিক ইতিহাস অত্যন্ত গুরুত্ব পেয়েছে। বস্তুতপক্ষে, রাষ্ট্রনৈতিক ও সামাজিক আলোড়নের প্রেক্ষিতেই তিনি সাধারণ মানুষের জীবন বীক্ষা করেছেন তাঁর উপন্যাসগুলিতে।
- আসামের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ইতিহাস ও রজনীকান্ত বরদলৈ এর উপন্যাসের উপজীব্য হয়েছে। তান্ত্রিক ধর্ম ও বৈষ্ণবধর্মের সংঘাত, মোরামারিয়া বিদ্রোহ তাঁর উপন্যাসে বিধৃত হয়ে, আসামের সাংস্কৃতিক জীবনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে অমরত্ব দান করেছে।
- রজনীকান্ত বরদলৈ এর উপন্যাসে নারী চরিত্রগুলি তাদের প্রেম, ত্যাগ, আত্মনিবেদন ও আত্মশক্তির বিকাশে অনন্য হয়ে উঠেছে। পুরুষ চরিত্রেও ঔপন্যাসিক বীরত্ব, শৌর্য, ত্যাগ, ভগবৎ প্রীতির পরাকাষ্ঠাকে দেখিয়েছেন।
- রজনীকান্ত বরদলৈ তাঁর উপন্যাসে কাহিনীবস্তুর বর্ণনার মাধ্যমে জীবনে সত্য, শিব, সুন্দরের প্রতিষ্ঠাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর লেখায় আদর্শ ও নীতিরই জয় ঘোষণা করেছেন।
- রজনীকান্ত বরদলৈ তাঁর উপন্যাসের কাহিনীকে শিল্পিত করে তোলার দিকেই অধিকতর মনোযোগী ছিলেন। পূর্ণাঙ্গ জীবনের রূপানুসন্ধান অপেক্ষা আদর্শায়িত জীবনের রূপায়ণেই যেন তাঁর অধিকতর আগ্রহ দৃষ্ট হয়।
অসমীয়া সংস্কৃতি ও তার ঐতিহ্যের প্রতি অটল শ্রদ্ধা ও তার সাহিত্যিক রূপায়ণের মাধ্যমে দেশের মানুষের মনে উচ্চ আদর্শ প্রতিষ্ঠায় রজনীকান্ত বরদলৈ এর সাহিত্য অসমীয়া সাহিত্যে স্বতন্ত্র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে।
Leave a Reply