রবীন্দ্রানুসারী কবি হিসেবে কুমুদরঞ্জন মল্লিকের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
কুমুদরঞ্জন মল্লিক
রবীন্দ্র-যুগের কবি হলেও কুমুদরঞ্জন মল্লিকের (১৮৮৩-১৯৭০) কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বোধ হয় সবচেয়ে কম। যে পল্লীগ্রামে তাঁর আজীবন বসবাস, মনে-প্রাণে তিনি সেই পল্লীজীবনেরই কবি। অজয় নদীর সঙ্গে তাঁর জন্ম-জন্মান্তরের সৌহার্দ্য। একদিকে কুমুদরঞ্জন পুরোপুরি ভক্ত ও বৈষ্ণব কবি, লোচনদাসের উত্তরাধিকার বহন করছেন, অন্যদিকে গ্রামে মঙ্গলচণ্ডীর সেবক হিসেবে ‘শাক্ত’—বিশ্বময় তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন ঐশী শক্তিরই লীলা। ‘উজানী’ (১৯১১), ‘বনতুলসী’ (১৯১১), ‘শতদল’ (১৯১১), ‘একতারা’ (১৯১৪), ‘বীথি’ (১৯১৫), ‘বনমল্লিকা’ (১৯১৮), ‘নূপুর’ (১৯২০), ‘রজনীগন্ধা’ (১৯২১), ‘অজয়’ (১৯২৭), ‘তুনীর’ (১৯২৮), ‘স্বর্ণসন্ধ্যা’ (১৯৪৮) প্রভৃতি কুমুদরঞ্জনের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। কবিতা রচনা তাঁর কাছে ছিল পূজার্চনার মতো, ব্যক্তিগত অনেক অভিজ্ঞতাই তাঁর কবিতার উৎস। ভাবে-ভাষায়-ছন্দে তাঁর কবিতায় একেবারে দেশজ ভঙ্গি-খাঁটি বাঙালি কবি কুমুদরঞ্জন। বাংলা দেশের পরিচিত প্রান্তরেই তাঁর স্বচ্ছন্দ পদচারণা—
চল্ গা’বি গান উদাস বাতাসে
তোর চেনা মাঠে সেখানে
নদী কল্কল্ মিলাইবে সুর যেখানে।
উঠানে সূর্যমুখীটি উঠিবে আকুলি,
সোহাগে ঘাসেতে গড়াগড়ি দিবে শেফালি,
তুই কবি তোর পল্লীবাণীর
শ্যামল মাধবী বিতানে
চল্ গা’বি গান উদাস বাতাসে
তোর চেনা মাঠে সেখানে।
(শেষ/উজানি)
কুমুদরঞ্জন মূলত গ্রাম বাংলার কবি। গ্রাম প্রকৃতির সহজ সরল নিরাভরণ উদাস সৌন্দর্যের স্বরূপ কবি এঁকেছেন অনায়াস নৈপুণ্যে। উদাসী বাউলের প্রেমে তিনি গ্রামকে গ্রহণ করেছেন। আর এই প্রেমসাধনার পথে যে ফুল ফুটেছে, তা-ই তিনি কাব্যে গ্রহণ করেছেন। গ্রামের মাটির গন্ধ ও ফুলের সুবাস তাঁর কবিতায় একান্ত সহজভাবেই এসেছে। এর ফলে কুমুদরঞ্জনের কবিতা একটি অনন্যসুলভ স্বাতন্ত্র্য লাভ করেছে। কুমুদরঞ্জনকে শাক্ত কবি, বাউল কবি, বৈষ্ণব কবি, পল্লী কবি ইত্যাদি নানা আখ্যায় ভূষিত করা হয়। কবিশেখর কালিদাস রায় যথার্থই বলেছেন—“কুমুদরঞ্জনের কবিতা রচনা দেবার্চনার মতো।”
Leave a Reply