দোনা গাজী চৌধুরীর সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জামাল সম্পর্কে আলোচনা কর
দোনা গাজী চৌধুরী: সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জামাল
বাংলা রোমান্টিক কাব্য ধারার সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জামাল অন্যতম বিশিষ্ট কাব্য। দোনা গাজী চৌধুরী, আলাওল, ইব্রাহিম ও মালে মুহম্মদ এই প্রেমকাহিনি অবলম্বনে কাব্য রচনা করেছিলেন। তন্মধ্যে আলাওলের কাবাই সম্মধিক পরিচিত। দোনা গাজীর কাব্যের একটিমাত্র পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে এবং তাও খণ্ডিত। এ থেকে কবির ব্যক্তিপরিচয় উদ্ধার করা সম্ভবপর হয়নি। কবি একটি ভণিতায় উল্লেখ করেছেন—
দোনা গাজী চৌধুরী দোল্লাই নামে দেস।
রছিল বিরহে পুঁতি চিত্তের য়াবেস॥
দোনা গাজী আলাওলের পূর্ববর্তী কবি। কবির বাসস্থান চাঁদপুর জেলার কোন এক গ্রামে ছিল বলে অনুমান করা হয়। ড. মুহম্মদ এনামুল হক কবির কাল নির্ণয় করতে গিয়ে লিখেছেন—“আমাদের ধারণা, কবি দোনাগাজী ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে আর্বিভূত হইয়াছিলেন। তাহার ভাষায় প্রাকৃতভাব, ছন্দের শিথিলতা, অন্ত্যানুপ্রাসের শৈথিল্য এবং প্রাচীন শব্দপ্রয়োগের বাহুল্য সমস্তই এক সঙ্গে মিলিয়া তাহাকে স্বাধীনতার যুগের মুসলিম কবিদের সমপর্যায়ভুক্ত করিয়া তুলিয়াছে।’’
সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল কাব্যের কাহিনির আদি উৎস আলেফ লায়লা বা আরব্য উপন্যাস। এই কাহিনি অবলম্বনে ফারসিতে কাব্য রচিত হয়েছিল। দোনা গাজী ফারসি কাব্য অনুসরণেই এ কাব্য রচনা করেন। প্রেমমূলক কাহিনি কাব্য হিসেবে এর পরিচয়। পরীরাজকন্যা বদিউজ্জামালের ছবি দেখে মিশর রাজপুত্র সয়ফুলমুলুক তার প্রতি প্রেমাসক্ত হয়ে পড়ে। মন্ত্রীপুত্র সায়েদের সহায়তায় বহু বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে সয়ফুলমুলুক, বদিউজ্জামালের সাক্ষাৎ পায় এবং বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। সায়েদ পরীরাজকন্যার সখী মল্লিকাকে বিয়ে করে। কাব্যের এই কাহিনি রূপকথার লক্ষণাক্রান্ত এবং সে কারণেই রোমান্সের দিক থেকে নতুনত্বহীন। রূপকথাধর্মী অলৌকিক ঘটনা ও চরিত্রের সমাবেশে কবি প্রেমকাহিনি বর্ণনা করেছেন। প্রেমের সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য দুর্বার প্রচেষ্টা কাহিনিকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। কবি মূলকাহিনির প্রতি অন্ধ আনুগত্য দেখাননি; কোথাও কোথাও নিজের সংযোজন বা রূপান্তর ঘটিয়েছেন। এই কাব্যের শিল্পমূল্যের পরিচয় পাওয়া যায় রোমাঞ্চকর ঘটনামিশ্রিত প্রেমের কাহিনির রসাত্মক উপস্থাপনায়। মধুর গল্পরস সৃষ্টির দিকে কবির বিশেষ লক্ষ ছিল—চরিত্র চিত্রণের দিকে তার তত মনোযোগ ছিল না। কাব্যটি কিছু কিছু অলৌকিক ঘটনা সমৃদ্ধ অভিযাত্রার কথা বলা হয়েছে; কিন্তু সে সব অপ্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত হতে পারে এবং তাতে কাহিনির গতি ও সৌন্দর্য ব্যাহত হয়েছে। কবি দোনা গাজীর নায়িকার রূপের বর্ণনা—
তার বর্ণ উদ্দেসিয়া কাজল জন্মিল।
এ লাগি সুন্দরী সবে নয়ানে ধরিল॥
নিশি নিয়াছিল কিছু বর্ণ করি চুরি।
নিশিনাথে হিয়ায় রাখিল যত্ন করি॥
কস্তুরী-হরিণী কিছু তাহার বরণ।
অদ্যাবধি সুগন্ধে বেষ্টিত এ কারণ॥
মুনি তপস্বীরা সে বর্ণেত মজিল।
কোরাল পুরাণ বেদ কালি দি লিখিল॥
কাব্যটি আদিরসাত্মক এবং অনেক স্থানে অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট। কবির বর্ণ নগ্ন, স্থূল এবং কামোদ্দীপক। ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মতে—‘‘দোনা গাজী সাধারণ কবি; তাহার ভাষা ও সাধারণ।’’ একই নামে আলাওল যে কাব্য রচনা করেছিলেন দোনা গাজী তার সমকক্ষতা লাভ করতে সক্ষম হননি।
Leave a Reply