//
//

মুহম্মদ কবীরের মধুমালতী কাব্য সম্পর্কে আলোচনা কর।

মুহম্মদ কবীর: মধুমালতী 

মুহম্মদ কবীরের রচনা হিসেবে কেবল ‘মধুমালতী’ কাব্যের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে। এখন পর্যন্ত তার অন্য কোন কাব্যের সন্ধান পাওয়া যায়নি। মধুমালতীর কাহিনি দিয়ে মুহম্মদ কবীরই প্রথম কাব্য রচনা করেন এবং তিনি ‘মধুমালতী’ কাব্য রচনাকারীগণের মধ্যে প্রধান কবি হিসেবে বিবেচনার যোগ্য। প্রাপ্ত পুঁথিতে কবির ব্যক্তিপরিচয় নেই, রচনায় কালজ্ঞাপক উক্তি অনুপস্থিত, কোন পৃষ্ঠপোষকের কথাও তাতে অনুল্লেখিত। এসব কারণে কবি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানার সুযোগ নেই। প্রাপ্ত পাণ্ডুলিপিটি চট্টগ্রাম থেকে সংগৃহীত। চট্টগ্রামের কতিপয় আঞ্চলিক শব্দ কাব্যে ব্যবহৃত হয়েছে। এসব দিক বিবেচনা করে ড. আহমদ শরীফ কবিকে চট্টগ্রামের অধিবাসী বলে অনুমান করেছেন। ড. মুহম্মদ এনামুল হক একবার মনে করেন যে, ১৫৮৮ সালে কাব্যটি রচিত। অন্য এক উৎস থেকে তিনি কাব্যের রচনাকাল ১৪৮৫ সাল বলে ধারণা করেছেন। কাব্যের ভাষায় প্রাচীনতার নিদর্শন আছে বলে তাঁর এই অনুমান।

‘মধুমালতী’ কাব্যে বর্ণিত কাহিনির উৎস ভারতীয় উপাখ্যান। তবে সংস্কৃত ভাষায় এ নামে কোন কাব্যের অস্তিত্বের কথা জানা যায়নি। হিন্দি ও ফারসিতে কয়েকজন কবি মধুমালতী কাব্য রচনা করেছিলেন। এই পর্যায়ের প্রাচীন ও শ্রেষ্ঠ কবি মনঝন সম্ভবত কোন লোকগাথা অবলম্বনে হিন্দিতে ‘মধুমালতী’ কাব্যের রূপ দেন। মধুমালতী কাব্য রচনা করতে গিয়ে মুহম্মদ কবীর তার একমাত্র পূর্ববর্তী কবি মনঝনের অনুসরণ করেছেন বলে অনুমান করা হয়। ড. ওয়াকিল আহমদ লিখেছেন—‘‘বাংলা মধুমালতী রচনায় মুহম্মদ কবীর কার কোন গ্রন্থের অনুবাদ বা অনুসরণ করেছিলেন তার স্পষ্ট স্বীকৃতি পাওয়া যায় না, তবে তিনি কোন এক হিন্দি কবি অথবা ফারসি কবির কাব্যের সহিত পরিচিত ছিলেন তা সুনিশ্চিত। একটি পাণ্ডুলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে—

মনোহর মালতীর অকুল পিরীত।

গাহিব সকল লোক মন হরষিত॥

এহি সে সুন্দর কিচ্ছা হিন্দীতে আছিল। 

দেশী ভাষায় মুঞি পঞ্চালি ভণিল॥ 

বাংলা ভাষায় রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানগুলো রচনার বেলায় ভাবানুবাদের যে বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে তাতে মূল উৎস-কাব্যের ধর্মীয় ভাব বর্জন করে নিছক মানবীয় প্রেমোপাখ্যানে রূপ দেওয়া হয়েছে। মধুমালতী কাব্যও এর ব্যতিক্রম নয়। এ ধরনের কাহিনি বিন্যাসে কবির ‘মানবীয়তাবোধ ও উন্নত শিল্পজ্ঞান সমৃদ্ধ মানসিকতা কাজ করেছে।

মধুমালতী কাব্যে বাস্তব অবাস্তব উভয় শ্রেণির কাহিনি স্থান পেয়েছে। কঙ্গিরা রাজ্যের রাজা সূর্যভান ও রানী কমলাসুন্দরীর পুত্র মনোহর মহারঙ্গরাজ্যের অপূর্ব সুন্দরী রাজকন্যা মধুমালতীর প্রতি পরীজাদীদের ষড়যন্ত্রে প্রণয়াসক্ত হয়। ক্ষণিক মিলনের অবসানে তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তারপর দীর্ঘ দুঃখময় সাধনার শেষে তাদের মধুর মিলন ঘটে। কাব্যে অসংখ্য অলৌকিক ঘটনার সমাবেশ করা যায়। প্রকৃতপক্ষে কবি মুহম্মদ কবীর রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাব্যের রূপদান করেছেন। সে কারণে বাস্তবের সঙ্গে অলৌকিকতার সংযোগ ঘটেছে। কবি প্রেমচিত্র অঙ্কনে সার্থকতা লাভ করেছেন। প্রেম ও রূপের বর্ণনায় কবি যে সংযমের পরিচয় দিয়েছেন তা মধ্য যুগের কাব্যে খুব বেশি পাওয়া যায় না। প্রেম ও সৌন্দর্য বর্ণনায় কবির কৃতিত্ব বিদ্যমান সংযত ও মার্জিত রুচির পরিচয় কবির বর্ণনায় লক্ষণীয়। নারীদেহের রূপ বর্ণনায় কবির সৌন্দর্যবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। মধুমালতীর রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি লিখেছেন—

রূপে গুণে কুলে শীলে চন্দ্রিমা সমান। 

একন্যা মানবী নএ অপসরা জন॥  

পূর্ণ শশী নিন্দে মুখে নিষ্পে অরবিন্দ।

চক্ষে ধরএ জুতি সে রূপের চন্দ॥

কুন্তল চিত্রল ছাঁচে বিশেষ লক্ষিত।

অলকে মণির খোপা ত্রিলোক মোহিত॥

চটক চিকন কেশ শীষেত সিন্দুর।

কাজল উঝল অক্ষি অধরে নিন্দে সুর॥

কাণড় কুন্তল দোলে শ্রবণে রাতুল।

পাবন-বাহন ভুরু জিনিছে ধনুকুল॥

নাগ-অরি জিনি চঞ্চু নাসিকা বিশিখ। 

সোনার বেসর দোলে নাসিকা উপাধিক॥

দশন বিদ্যুৎ জিনি মুকুতা গুনিছে। 

সপ্তছড়ি মুক্তাছড়া হৃদএ পরিছে॥

কবি যে উৎস থেকে তাঁর কাব্যের রূপ দান করুন না কেন, তিনি নিজের প্রতিভার যথার্থ পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন। অন্ধ অনুকরণ বা অনুবাদ নয়, নিজের কল্পনার রঙে পূর্ববর্তী কাহিনি সুমধুর করে পরিবেশন করেছেন। হিন্দি অথবা ফারসি গ্রন্থের অনুবাদ করলেও কবি সংস্কৃত প্রভাব পুষ্ট বিশুদ্ধ বাংলা শব্দ ব্যবহার করেছেন। ধ্বনিসৌন্দর্য ও শব্দার্থ মহিমায় প্রসাদগুণবিশিষ্ট বাণীসৌন্দর্য কাব্যখানিকে উদ্ভাসিত করে রেখেছে। সে যুগে কবিত্বশক্তির পরিচয় ছিল আলংকারিক ভাষায়। মুহম্মদ কবীর সে কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। বড় ভাব, বড় চরিত্র নয়, প্রেমপূর্ণ একটি জমাট গল্প স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের ভাষায় প্রকাশ করার মধ্যে কবির সাফল্য অনুসন্ধান করতে হয়। উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষাদি আলংকারিক ভাষায় প্রেমাশ্রিত মধুমালতী কাব্য হয়েছে রূপরস সমৃদ্ধ।

মধুমালতীর কাহিনি অবলম্বনে আরও কয়েকজন কবি কাব্য রচনা করেছিলেন। তাদের মধ্যে দোভাষী পুঁথিকার সৈয়দ হামজা, মুহম্মদ চুহর, রংপুরের কবি শাকের মুহম্মদ, চট্টগ্রামের গোপীনাথ দাস, জোবেদ আলী ও নূর মুহম্মদ প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। মধুমালতী কাব্যরচনার চেষ্টা মধ্য যুগ ছাড়িয়ে বিশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত চলে এসেছিল। তবে তাদের অবদান খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!