নওয়াজিস খানের গুলে বকাওলী সম্পর্কে আলোচনা কর।
নওয়াজিস খান: গুলে বকাওলী
বাংলা রোমান্টিক প্রণয়কাব্যের ধারায় ‘গুলে বকাওলী’ কাব্যটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। গদ্যে ও পদ্যে ‘গুলে বকাওলী’র প্রেমকাহিনি বাংলায় পরিবেশিত হয়েছে এবং বিশ শতকেও সাহিত্যরূপ লাভ করায় এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা প্রমাণিত। বাংলা ভাষা ছাড়া হিন্দি ফারসি উর্দু ইত্যাদি ভাষায়ও এই কাব্য রচিত হয়েছিল।
বাংলায় ‘গুলে বকাওলী’ কাব্যের রচয়িতা হিসেবে নওয়াজিস খান খ্যাতিমান। কবি কাব্যে যে আত্মপরিচয় দান করেছেন তাতে তার বংশলতিকার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর এক পূর্বপুরুষ ছিলিম খান গৌড় থেকে চট্টগ্রাম এসে ছিলিমপুর গ্রামের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কবি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার অন্তর্গত সুখছড়ি গ্রামে বসবাস করতেন বলে জানা যায়। কবি নওয়াজিস খান ‘গুলে বকাওলী’ কাব্যের শেষাংশে লিখেছেন—
ধন্য ধন্য আজ্ঞা কর্তা হএ সেই জল।
জাহান আদেশ হৈল পুস্তক রচন॥
শ্ৰীযুক্ত বৈদ্যনাত মোহা নরপতি।
ধন্য হেতু সুকল্পনে করিল আরতি॥
হীন নোআজিসে কহে ভাবি নিজ মনে।
বকাঅলি পুস্তক রচিল তেকারণে॥
কবি বিদ্যাবত্তায় যথেষ্ট পারদর্শিতা লাভ করেছিলেন। কবি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক। নওয়াজিস খান চট্টগ্রামের বানীগ্রামের জমিদার বংশের আদি পুরুষ বৈদ্যনাথ রায়ের আদেশে গুলে বকাওলী রচনা করেন। তাঁর কাব্যে কালজ্ঞাপক কোনো বিবরণ না থাকায় তাঁর আবির্ভাবকাল নিয়ে ধন্দ তৈরি হয়েছে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে কাব্যটি অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রচিত।
শেখ ইজ্জতুল্লাহ নামে জনৈক বাঙ্গালি লেখক ১৭২২ সালে ফারসি ভাষায় ‘গুলে বকাওলী’ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এটি হিন্দি থেকে ভাষান্তরিত। গদ্যে রচিত এ গ্রন্থের কাহিনি নওয়াজিস খান কাব্য রূপ দিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। ঘটনা রূপায়ণের বৈশিষ্ট্য বিচার করলে নওয়াজিস খানকে মনে হয় ইজতুল্লাহর অনুসারী। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে কবি নওয়াজিস খান কাব্যটি ফারসি থেকে অনুবাদ করেছিলেন। কাব্যের কাহিনি প্রেমমূলক। শর্কিস্তানের রাজপুত্র তাজুলমুলুক পিতার অন্ধত্ব দূর করার জন্য পরীরাজকন্যা বকাওলীর উদ্যানে বকাওলী ফুলের সন্ধানে যায়। বহু দুঃখকষ্ট ও বাধাবিপত্তির শেষে ফুল সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। সেখানে রাজকন্যা বকাওলীর নিদ্রিতাবস্থায় তাজুলমুলুক অঙ্গুরীয় বিনিময় করে এবং প্রেমপত্র লিখে রেখে দেশে ফিরে আসে। বকাওলী তাজুলের প্রতি প্রেমাসক্ত হয়ে তার অনুসন্ধানে বহির্গত হয় এবং বহু দুঃখ অতিক্রমের পর তার সঙ্গে মিলনে সক্ষম হয়। এই মূলকাহিনির সঙ্গে আরও উপকাহিনির সংযোজন ঘটেছে। কাহিনিটি অলৌকিকতায় পরিপূর্ণ বলে তাতে রোমান্সের বৈশিষ্ট্য প্রকাশমান। কবি কাহিনি সাবলীল ভাবে বর্ণনা করতে সক্ষম হয়েছে। রূপ বর্ণনায় কবির দক্ষতার নিদর্শন আছে। কবি লিখেছেন—
সে কন্যার রূপের সাগর পরিমান।
অল্পমতি এক মুখে কি করি বাখান॥
শির স্বর্গ, মর্ত্য নাভি, পদ সে পাতাল।
ত্রিভুবনে কন্যারূপে মোহে সর্বকাল॥
রূপের সাগর ডুবে কন্যারূপ মাঝে।
সকলে আপনা ক্ষতি সেই রূপ লাজে॥
শিরের উপরে কেশ অতি শ্যাম ভার।
জলদে রোষে লাজে গর্জিলা অপার॥
অলি পিক চামরিকা গেল বনে বনে।
মহীতলে বাসা কৈল বাসুকী আপনে॥
কবি নওয়াজিস খান একাধিক কাব্য রচনা করে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তার প্রতিভার নিদর্শনের মধ্যে প্রখরতা ও গভীরতা না থাকলেও তাতে স্বচ্ছতা ও সাবলীলতা ফুটে উঠেছিল। তার কাব্য বিবৃতিধর্মী রচলা হলেও রচনাভঙ্গিতে স্বচ্ছলতা ছিল। কাব্যের প্রকাশভঙ্গিতে ছিল সযত্ন পরিচর্যার স্বাক্ষর। সুললিত ধ্বনিবিন্যাসে কবির লিপিকুশলতার পরিচয় পাওয়া যায়।
নওয়াজিস খান ‘গুলে বকাওলী’ কাব্য ব্যতীত আরও কতিপয় কাব্য রচনা করেছিলেন বলে জানা গেছে। তার ‘পাঠান-প্রশংসা’ প্রশস্তিবাচক ক্ষুদ্র কাব্য, ‘বয়ানাত’ ধর্মীয় বিষয়ের বিবরণ এবং গীতালী গানের সংগ্রহ।
‘গুলে বকাওলী’ কাব্যের অপরাপর রচয়িতাগণের মধ্যে চট্টগ্রামের কবি মুহম্মদ মীমের কাব্য শিল্পগুণে মণ্ডিত। সম্ভবত আঠার শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ১৭৬০ থেকে ১৭৭০ সালের মধ্যে কাব্যটি রচিত হয়েছিল। কাব্যরূপায়ণে কবির প্রতিভার পরিচয় বিদ্যমান।
Leave a Reply