//
//

সমাসের সংজ্ঞাসহ উদাহরণ আলোচনা কর।

সমাস

পরস্পর-অর্থ-সম্পর্কযুক্ত একাধিক পদের একপদে সংহতি লাভের নাম সমাস। যেমন: বীণা পাণিতে যার=বীণাপাণি, চরণ পদ্মের মতো=চরণপদ্ম, গাছে পাকা=গাছ-পাকা। প্রথম দৃষ্টান্তে ‘বীণা’ ও ‘পাণি’র মধ্যে, দ্বিতীয় দৃষ্টান্তে ‘চরণ’ ও ‘পদ্মে’র মধ্যে এবং তৃতীয় দৃষ্টান্তে ‘গাছ’ ও ‘পাকা’র মধ্যে একটি করে অর্থ-সম্বন্ধ রয়েছে। এরূপ অন্তর্নিহিত অর্থ-সম্পর্ক না থাকলে সমাস হয় না।

সমস্যমান পদ

যে সমস্ত পদ মিলিত হয়ে সমাস হয়, তাদের বলা হয় সমস্যমান পদ। বীণাপাণি’ পদে  ‘বীণা’ ও ‘পাণি’ পদগুলি এবং :চরণপদ্ম’ পদে ‘চরণ’ ও ‘পদ্ম’ পদগুলি কিংবা :গাছ-পাকা’ পদে ‘গাছ’ ও ‘পাকা’ পদগুলি সমস্যমান পদ।

সমস্ত পদ বা সমাসবদ্ধ পদ

সমস্যমান পদগুলি মিলিত হয়ে যে একপদে সংহতি লাভ করে, তাকে বলা হয় সমস্ত পদ বা সমাসবদ্ধ পদ। :বীণাপাণি’, ‘চরণপদ্ম’ ও ‘গাছ-পাকা’ পদগুলি সমস্ত পদ বা সমাসবদ্ধ পদ।

ব্যাসবাক্য বা বিগ্রহ-বাক্য

সমাসবদ্ধ পদটিকে বিশ্লেষ করবার জন্যে যে বাক্যের প্রয়োজন হয়, তাকে বলা হয় সমাস-বাক্য বা ব্যাসবাক্য বা বিগ্রহ-বাক্য। ‘বীণা পাণিতে যার’ কিংবা ‘চরণ পদ্মের মতো’— এই বাক্যগুলি সমাসবাক্য বা বিগ্রহবাক্য।

সমস্যমান পদগুলির প্রথম পদটিকে ‘পূর্বপদ’ এবং পরবর্তী পদটিকে [বা পদগুলিকে] উত্তর পদ বা ‘পরপদ’ বলা হয়। সমস্ত পদে কখনও পূর্বপদের প্রাধান্য, যেমন: ‘চরণ-কমল’। কখনও পরপদের প্রাধান্য, যেমন: উড়ো যে জাহাজ=উড়োজাহাজ; কখনও উভয়পদের প্রাধান্য, যেমন : ‘হরগৌরী’। আবার, কখনও বা পূর্বপদ ও পরপদের কোনটিকে না বুঝিয়ে তৃতীয় পদের প্রাধান্য বুঝিয়ে থাকে। যেমন: বীণাপাণি’।

সন্ধি ও সমাসের পার্থক্য

পরম্পর-সন্নিহিত দুটি বর্ণের মিলনকে সন্ধি বলা হয়। কিন্তু পরস্পর-অর্থ-সম্পর্কযুক্ত একাধিক পদের একপদে সংহতি লাভ করার নাম সমাস। যেমন: প্রতি+এক=প্রত্যেক [সন্ধি], এক+এক=প্রত্যেক [সমাস]; পীত+অম্বর=পীতাম্বর [সন্ধি]; পীত যে অম্বর বা পীত অম্বর যার [সমাস]।

সন্ধিতে সন্নিহিত দুটি বর্ণের মিলনের ফলে দুটি পদেরও মিলন হয়। বর্ণের এই মিলনের ভিত্তি হল উচ্চারণ। পদের মিলন সন্ধির লক্ষ্য নয়। তা সমাসের কাজ। সমাসে দুই বা ততোধিক পদের মিলন হয়ে থাকে এবং পদের এই মিলনের ভিত্তি হল অর্থ। অবশ্য, সমাস সংঘটিত হবার পর সম্ভব হলে সন্নিহিত দুটি বর্ণ সন্ধিসূত্রে মিলিত হতে পারে। আবার অর্থের যোগ না থাকলে সন্ধিও হয় না।

সন্ধিতে বিভক্তির লোপ হয় না। সমাসে অলুক সমাস ব্যতীত প্রতিটি পদে বিভক্তি লোপ হয়। সন্ধিতে বহু পদ বহুপদই থাকে। সমাসে বহু পদ একটিমাত্র পদে পরিণত হয়।

সমাসের প্রকারভেদ

সমাস প্রধানত ছয় প্রকার— অব্যয়ীভাব, কর্মধারয়, তৎপুরুষ, দ্বন্দ্ব, বহুব্রীহি ও দ্বিগু। এ ছাড়া [সংস্কৃতে] আরও দু’প্রকার সমাস আছে—সুপ্‌সুপা ও নিত্যসমাস। কিন্তু তারা কোন স্বতন্ত্র সমাস নয়। আচার্য সুনীতিকুমারের মতে, সমাস মুখ্যত তিন প্রকার—১. সংযোগমূলক— দ্বন্দ্ব, ২. বর্ণনামূলক—বহুব্রীহি এবং ৩. ব্যাখ্যানমূলক—তৎপুরুষ, কর্মধারয়, দ্বিগু ও অব্যয়ীভাব।

আবার, সংস্কৃতে বৈয়াকরণ পাণিনির মতে, সমাস প্রধানত চার প্রকার— বদ্ধ, তৎপুরুষ, বহুব্রীহি ও অব্যয়ীভাব। কর্মধারয় ও দ্বিগু সমাস, প্রকৃতপক্ষে তৎপুরুষ সমাসেরই অন্তর্গত।

সংস্কৃত ব্যাকরণে সমাস ছয় প্রকার— “দ্বিগুর্দ্বন্দ্বোহব্যয়ীভাবঃ কর্মধারয় এব চ। পঞ্চমস্তু বহুব্রীহিঃ ষষ্ঠস্তৎপুরুষঃ মৃতঃ॥” বাংলা ব্যাকরণেও সমাস ছয় প্রকার।

১. অব্যয়ীভাব সমাস

যে সমাসের পূর্বপদে অব্যয় থাকে এবং অব্যয়ের অর্থই প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয়, তাকে বলা হয় অব্যয়ীভাব সমাস। অব্যয়ীভাব সমাসে পূর্বপদ অর্থাৎ অব্যয় পদেরই অর্থের প্রাধান্য। যেমন: ভিক্ষার অভাব=দুর্ভিক্ষ, এখানে পূর্বপদ [দুর্] অব্যয়, তার অর্থ [অভাব]-ই প্রধানরূপে প্রতীয়মান।

অভাব, সামীপ্য, ব্যাপ্তি, [বীপ্সা, পুনঃপুনঃ], অনতিক্রম, পর্যন্ত [সীমা], সাদৃশ্য, যোগ্যতা, পশ্চাৎ, বৈপরীত্য, ক্ষুদ্রতা, সাকল্য ইত্যাদি অর্থে অব্যয়ীভাব সমাস হয়। যেমন—

অভাব

ভিক্ষার অভাব=দুর্ভিক্ষ, ভাতের অভাব=হা-ভাত ; ঘরের অভাব=হা-ঘর; বন্দোবস্তের অভাব=বে-বন্দোবস্ত; মিলের অভাব=অমিল বা গরমিল; বিঘ্নের অভাব=নির্বিঘ্ন; ব্যবস্থার অভাব=অব্যবস্থা; কায়দার অভাব= বেকায়দা; আমিষের অভাব=নিরামিষ; মক্ষিকার অভাব=নির্মক্ষিক। তেমনি—বেমানান, নিঝঞ্জাট, আলুনি, বেকসুর, বেজায় [জায় বা হিসাবের অভাব]।

সমীপ্য

কূলের সমীপে=উপকূল, নগরীর সমীপে=উপনগরী, কণ্ঠের সমীপে=উপকণ্ঠ। অক্ষীর সমীপে=সমক্ষ; সন্ধ্যার কাছাকাছি=সন্ধ্যা নাগাদ; গোদাবরীর সমীপে=অনুগোদ। তেমনি— অনুষঙ্গ, অনুবাত।

ব্যাপ্তি [অবধি, বীপ্সা, পুনঃপুনঃ]

জন্ম থেকে=আজন্ম; শৈশব থেকে=আশৈশব; বাল্য থেকে=আবাল্য; দিন দিন=প্রতিদিন; রোজ রোজ=হররোজ; বছর বছর=ফিবছর; সন সন=ফি-সন। তেমনি— প্রতিক্ষণ, অনুক্ষণ, প্রতিগৃহ, প্রতিমণ, জনপিছু, মাথাপিছু, জনপ্রতি, দিনভর, মাঠকে-মাঠ, জনকে-জন, গ্রামকে-গ্রাম, দিনকে-দিন, প্রত্যেক, প্রত্যহ, প্রত্যক্ষ, প্রতিবার, ফিবছর, প্রতিজন।

অনতিক্রম

শক্তিকে অতিক্রম না করে=যথাশক্তি; উচিতকে অতিক্রম না করে=যথোচিত; তেমনি— যথাবিধি, যথারীতি, যথেচ্ছ; অর্থকে অতিক্রম না কর=যথার্থ, সাধ্যকে অতিক্রম না করে=যথাসাধ্য ; ইষ্টকে অতিক্রম না করে=যথেষ্ট; তেমনি— যথাযোগ্য, যথাসত্য, যথাপূর্ব, যথাসর্বস্ব, সাধ্যমতে, রীতিমতো, নিয়মমাফিক।

পর্যন্ত

সমুদ্র পর্যন্ত=আসমুদ্র, সমুদ্র থেকে হিমাচল পর্যন্ত=আসমুদ্রহিমাচল; জীবন পর্যন্ত=আজীবন; ব্রহ্ম পর্যন্ত=আব্রহ্ম [ব্রহ্ম থেকে স্তম্ব পর্যন্ত=আব্রহ্মস্তম্ব]; কণ্ঠ পর্যন্ত=আকণ্ঠ; তেমনি— আজানু, আমরণ, আপাদমস্তক, আমূল, আকৰ্ণ, আগাগোড়া।

সাদৃশ্য

বনের সদৃশ=উপবন, নদীর সদৃশ=উপনদী; কথার সদৃশ=উপকথা; দেবতার সদৃশ=উপদেবতা; আচার্যের সদৃশ=উপাচার্য। তেমনি— উপাধ্যক্ষ, প্রতিমূর্তি, প্রতিধ্বনি, প্রতিরূপ, প্রতিলিপি, উপদ্বীপ, উপগ্রহ, উপসাগর, উপবিভাগ, উপমন্ত্রী, উপরাষ্ট্রপতি, বিমাতা।

যোগ্যতা

রূপের যোগ্য=অনুরূপ; কূলের যোগ্য=অনুকুল; প্রেরণার যোগ্য =অনুপ্রেরণা। তেমনি— অনুভাব, অনুধ্যান। পশ্চাৎগমনের পশ্চাৎ=অনুগমন; সরণের পশ্চাৎ=অনুসরণ ; ধাবনের পশ্চাৎ=অনুধাবন। তেমনি—অনুশোচনা, অনুতাপ, অনুক্রম, অনুরণন, অনুরাধা, অনুদৈর্ঘ্য, উপেন্দ্র, অনুপূর্ব, অনুনাদ, অনুস্বর।

বৈপরীত্য

দানের বিপরীত=প্রতিদান; ফলের বিপরীত=প্রতিফল; কূলের বিপরীত প্রতিকূল। তেমনি— প্রতিবাদ, প্রতিহিংসা, প্রতিপক্ষ, প্রতিশোধ।

ক্ষুদ্রতা

ক্ষুদ্র গ্রহ=উপগ্রহ; ক্ষুদ্র অঙ্গ=প্রত্যঙ্গ।

সাকল্য

বাল, বৃদ্ধ ও বনিতা সকলে=আবালবৃদ্ধবনিতা; পামর জনসাধারণ সকলেই=আপামর-জনসাধারণ; দ্বিজ চণ্ডাল সকলেই=আদ্বিজচণ্ডল। বিভক্তির অর্থে

ঊষায়=প্রত্যুষ; অক্ষির সমীপে=প্রত্যক্ষ; আত্মাকে অধি=অধ্যাত্ম; দৈবকে অধি=অধিদৈব; ভূতকে অধি=অধিভূত; দক্ষিণকে প্রগত=প্রদক্ষিণ; অক্ষির অগোচরে=পরোক্ষ।

বিশিষ্ট প্রয়োগ: ‘দূর হবে দুর্ভিক্ষের ক্ষুধা।’ ‘শুভকার্য নির্বিঘ্নে সমাধা হল।’ ‘আশৈশব যিনি পরম সুখে প্রতিপালিত, তিনি এ দুঃখ কেমন করে সহ্য করবেন?’ ‘নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ।’ ‘সে তার কৃতকার্যের যথোচিত পারিশ্রমিক পেয়েছিল।’ ‘প্রতিকার না হলে তিনি আমরণ অনশন করবেন।’ ‘সাগর জলে সিনান করি সজল এলোচুলে, বসিয়াছিলে উপল-উপকূলে। ‘চলিলে সাথে, হাসিলে অনুকূলে।’ ‘সহসা বায়ু বহিল প্রতিকূলে।’ ‘ভারতের মৃত্তিকা আমার শৈশবের শিশুশয্যা, যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী।’ ‘নমি আমি প্রতিজনে আদ্বিজচণ্ডাল।’ ‘ধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি সদা ব্যঙ্গ করে।’

২. কর্মধারয় সমাস

যে সমাসে পূর্বপদ ও পরপদ যথাক্রমে বিশেষণে ও বিশেষ্যে বা বিশেষ্যে ও বিশেষ্যে বা বিশেষণে ও বিশেষণে গঠিত হয় এবং পরপদের অর্থ-প্রাধান্য প্রতীয়মান হয়, তাকে কর্মধারয় সমাস বলা হয়। যেমন: রক্ত যে পদ্ম=রক্তপদ্ম; যিনি রাজা তিনিই বাহাদুর=রাজাবাহাদুর; লাল ও নীল=লাল-নীল। প্রথম দৃষ্টান্তে—পূর্বপদ বিশেষণ [রক্ত] ও পরপদ বিশেষ্য [পদ্ম], দ্বিতীয় দৃষ্টান্তে—পূর্বপদ বিশেষ্য [রাজা] ও পরপদ বিশেষ্য [বাহাদুর] এবং তৃতীয় দৃষ্টান্তে—পূর্বপদ বিশেষণ [লাল] ও পরপদ বিশেষণ [নীল]।

কর্মধারয় সমাস মূলত তৎপুরুষ সমাসেরই প্রকারভেদ; এতে পরপদেরই প্রাধান্য। কর্মধারয়, প্রকৃতপক্ষে, কর্তৃ-তৎপুরুষেরই নামান্তর।

বিশেষণে ও বিশেষ্যে কর্মধারয়

সু [ভাল] যে পুরুষ=সুপুরুষ; মহৎ যে জন =মহাজন। তেমনি—সদুপায়, নীলোৎপল, হারাধন, চলচ্চিত্র, স্বায়ত্তশাসন, ভাঙাহাট, পুণ্যাহ, শুভ কৃষ্ণপক্ষ, শ্বেতপদ্ম, পূর্ণচন্দ্র, সদগুরু, কুমন্ত্রণা, মহারাজ, মহানদী, মহাবীর, মহাষ্টমী [মহতী যে অষ্টমী], মহর্ষি, মহাপুরুষ, মহাবিদ্যা, মহাজ্ঞান, মহারণ, মহাকুল, শুচিব, কাপুরুষ [কু যে পুরুষ]=কুপুরুষ [বাংলা], পাণ্ডুলিপি [পাণ্ডু যে লিপি], শ্বেতচন্দন, মিষ্টবাক্য, রক্তাম্বর, ছিন্নপত্র, বীরাঙ্গনা, সজ্জন, অন্ত্যেষ্টি [অন্ত্য যে ইষ্টি], মহাসমারোহ, নীলাকাশ, শ্বেতপদ্ম, লাল-কমল, ছিন্নবস্ত্র, ভগ্ন-সৌধ, বিশ্ব [সকল]-মানব, রুদ্রবীণা, মহাসভা, হেড-পণ্ডিত, ফুল [full] বাবু, ফুল-মোজা, পোড়ামাটি, হলুপাখী, কালোমাণিক, নীলমণি, চোরাবালি, ঝরাপাতা, কালোবাজার, খাসমহল, কেনাগোলাম, কালপেঁচা, কাচকলা, হেডমাস্টার, উড়োজাহাজ, ডুবোজাহাজ, উড়োচিঠি, রামধনু রাম [বৃহৎ] যে ধনু; *বিকচকেতকী [বিকচ (প্রস্ফুটিত) যে কেতকী]।

কতকগুলি শব্দে সমস্তপদে পূর্বপদ ও পরপদের অবস্থান পরিবর্তিত হয়ে যায়। একে ‘পূর্বনিপাত’ বলা হয়। যেমন: অধম যে রাজা=রাজাধম; অধম যে নর=নরাধম; উত্তম যে নর=নরোত্তম। বাংলায় এরূপ দৃষ্টান্ত অনেক আছে। যেমন: বাটা এমন হলুদ=হলুদবাটা; ভাজা এমন চাল=চাল-ভাজা; সিদ্ধ এমন আল=আলুসিদ্ধ। তেমনি—মাছ-ভাজা, বেগুন-পোড়া।

বিশেষ্যে ও বিশেষ্যে কর্মধারয়

যে খোকা সেই বাবু=খোকাবাবু; যিনি রাজা তিনিই ঋষি=রাজর্ষি; যা গঙ্গা তাই নদী=গঙ্গানদী, যা কলকাতা তাই শহর=কলকাতা-শহর; যিনি পিতা তিনিই ঠাকুর=পিতাঠাকুর; যিনি কর্তা তিনিই ব্যক্তি=কর্তাব্যক্তি ইত্যাদি। তেমনি— রাজ-সন্ন্যাসী, দেবর্ষি, লাটসাহেব, দ্যুলোক, ভূলোক, দাদুভাই, গিন্নীমা, দিদিভাই, দাদাবাবু, গুরুদেব, মাতৃদেব, পিতৃদেব, ঠাকুরমহাশয়, ঠাকুরদা, শুকতারা, সম্রাট-কবি, নৃপশিষ্য, ডাক্তারবাবু, সর্দার-পড়ুয়া, বউঠাকুরাণী, বটগাছ, ডাক্তার-সাহেব, পণ্ডিতমহাশয়, [পণ্ডিত-মশাই] শিক্ষকমহাশয়, কথকঠাকুর, মাতাঠাকুরাণী।

বিশেষণে ও বিশেষণে কর্মধারয়

যা কাচা তাই মিঠা=কাচামিঠা; যা মৃদু তাই মন্দ=মৃদুমন্দ; *যে চালাক সেই চতুর=চালাক-চতুর, যা লাল তাই নীল=লাল নীল; যা ভীষণ তাই সুন্দর=ভীষণ-সুন্দর; তেমনি— গাঢ়নীল, নীললোহিত, সহজ-সরল, দীনদুঃখী, ক্লান্তক্লিষ্ট, পণ্ডিতমূৰ্থ, জীবন্ত, অম্লমধুর, শীতোষ্ণ, ন্যূনাধিক, গণ্যমান্য, হৃষ্টপুষ্ট, সুস্থ-সবল, হিংস্র-কুটিল, মিঠাকড়া, কঠোর-কোমল, মধুর-ললিত, কান্ত-কোমল, বাধা-ধরা, শান্ত-শিষ্ট, কানাখোড়া, সুপ্তোথিত, দীনহীন, স্নিগ্ধ-সজল, স্নিগ্ধোজ্জ্বল।

বি দ্র: যা লাল ই নীল=নাল-নীল [জামা বা জার্সি]।

কর্মধারয় সমাস সম্পর্কে কতকগুলি বিশেষ সংস্কৃত-বিধি

১. প্র, পূর্ব, মধ্য, অপর, সায়ম্ প্রভৃতি শব্দের পর ‘অহন’ শব্দের ‘অহ্ন’ আদেশ হয়।  যেমন: পূর্ব যে অহ=পূর্বাহ্ন [দিনের পূর্বভাগ], পূর্বাহ্ন [পূর্বদিন], প্র [পূর্ব] যে অহ=প্রাহ্ন। তেমনি— মধ্যাহ্ন, পরাহ্ন, অপরাহ্ন, সায়াহ্ন।

২. স্বরবর্ণ পরে থাকলে ‘কু’ স্থানে ‘কৎ’ [কদ্] আদেশ হয়। যেমন: কু যে আচার=কদাচার; কু যে আকার=কদাকার; কু যে অর্থ=কদর্থ; কু যে অভ্যাস=কদভ্যাস। তেমনি— কদক্ষর, কদুক্তি, কদুত্তর, কদন্ন, কদুষ্ণ [কবোষ্ণ]।

৩. পূর্বপদে ‘মহৎ’ স্থানে ‘মহা’ এবং পরপদে ‘সখি’ স্থানে ‘সখ’, ‘রাজন’ স্থানে ‘রাজ’ ও ‘রাত্রি’ স্থানে ‘রাত্র’ আদেশ হয়। যেমন: মহৎ যে জন =মহাজন, মহৎ যে রাজা=মহারাজ [বাংলায় ‘মহারাজা’ শব্দও প্রচলিত]। যেমন: বর্ধমানের মহারাজা। মহৎ যে আশয়=মহাশয়। প্রিয় যে সখা=প্রিয়সখ; পূর্ব যে রাত্রি=পূর্বরাত্র। তেমনি— অর্ধরাত্র, দীর্ঘরাত্র।

কর্মধারয় সমাসের প্রকারভেদ

কর্মধারয় সমাস প্রধানত তিন প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন—

২.ক. সাধারণ কর্মধারয় সমাস, ২.খ. মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস ও ২.গ. উপমামূলক কর্মধারয় সমাস।

২.ক. সাধারণ কর্মধারয় সমাস

বিশেষণে-বিশেষ্যে বা বিশেষ্যে-বিশেষ্যে বা বিশেষণে-বিশেষণে যে কর্মধারয় সমাস হয়, তাকে সাধারণ কর্মধারয় সমাস বলে। পূর্বে এর দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে।

২.খ. মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস

যে কর্মধারয় সমাসে ব্যাসবাক্যের মধ্যস্থিত ব্যাখ্যানমূলক পদের লোপ হয়, তাকে মধ্যপদলোপী কর্মধারয় বলা হয়। যেমন: *সিংহ ‘চিহ্নিত আসন=সিংহাসন; ছায়া ‘প্রধান’ তরু=ছায়াতরু; তেল ‘মাখবার’ ধুতি=তেলধুতি; ঘি, ‘মেশানো’ ভাত=ঘি-ভাত; জল মিশ্রিত সাগু=জলসাগু; সিদুর ‘রাখবার’ কৌটা=সিঁদুর-কৌটা; হাতে ‘পরবার’ ঘড়ি=হাতঘড়ি; পঞ্চ ‘অধিক’ দর্শ=পঞ্চদশ। উল্লিখিত দৃষ্টান্তগুলিতে সমস্যমান পদে ব্যাখ্যানমূলক পদের [যথা ‘চিহ্নিত’, ‘প্রধান’, ‘মিশ্রিত’, ‘রাখবার’, ‘পরবার’, ‘অধিক’ ইত্যাদির] আবির্ভাব ঘটেছে; কিন্তু সমস্ত পদগুলিতে তারা লুপ্ত হয়েছে। তাই এরা মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস। তেমনি—জাহাজ-ঘাট, জেলে-নৌকা, ভিক্ষান্ন, একাদশ, ষোড়শ, প্রীতি-ভোজ, প্রীতি-উপহার, নবান্ন-উৎসব, বৌভাত [বৌ-পরিবেশিত ভাত], জামাই-ষষ্ঠী [জামাইদের কল্যাণার্থে ষষ্ঠী], ভ্রাতৃ-দ্বিতীয়া, শিক্ষাব্যবস্থা, বরফ-জল, কজি-ঘড়ি, ফুলদানি, বার্ধক্যরেখা, শরশয্যা, সংসর্গ-দোষ, কেশ-তৈল, গন্ধতেল, ছাইদান, বাতিদান, রজত-মুদ্রা, তালপাটালি, অগ্নিবাণ, হাঁটুজল, উপবাসকৃশ, হাসিমুখ, জীবনবীমা [জীবন-আশঙ্কায় বীমা], স্বর্ণাক্ষর, লক্ষ্মীশ্রী [লক্ষ্মীযুক্ত শ্ৰী], স্বর্ণাভরণ, রৌপ্যমুদ্রা, রজতচক্র, বিজয়-শঙ্খ (বিজয়সূচক শঙ্খ], অন্ত্যেষ্টি-সূচক ক্রিয়া=অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া; কীর্তি-মন্দির, শোক-সভা [শোক-প্রকাশিকা সভা], পদ্মবেদী [পদ্ম চিহ্নিত বেদী], মধ্যাহ্নভোজন, সিন্দুর-কৌটা, মনিব্যাগ, জল-চৌকি, আলোকচিত্র [আলোকের দ্বারা গৃহীত চিত্র], মরুভূমি [মরুময় ভূমি], মরূদ্যান [মরু-মধ্যস্থিত উদ্যান), জন্মদিবস, জন্মোৎসব, স্মৃতিসৌধ, সূচীশিল্প, পাদটীকা, মৌমাছি, দুধ-বার্লি, ধর্মঘট [ধর্মরক্ষার্থে ঘট], সাম্যবাদ [সাম্য-বিষয়ক বাদ], রাষ্ট্রনীতি, বরযাত্রী, সিংহদ্বার, যাদুঘর ডযাদু বা পুরাকীর্তি-শোভিত ঘর], ভাইফোটা, স্বাধীনতা-দিবস [স্বাধীনতার স্মরণে পালনীয় দিবস], শহীদ-দিবস, বিশ্ববিদ্যালয়, আইনজ্ঞান, বাড়বাগ্নি।

২.গ. উপমামূলক কর্মধারয় সমাস

যে কর্মধারয় সমাসে দুটি অসম জাতীয় বস্তু বা ব্যক্তির মধ্যে তুলনা বা উপমার মাধ্যমে সাদৃশ্য কল্পনা করা হয়, তাকে উপমামূলক কর্মধারয় বলা হয়। উপমার চারটি অঙ্গ— ক. উপমান, খ. উপমেয়, গ. সাধারণ ধর্ম ও ঘ. তুলনাবাচক শব্দ।

ক. উপমান— যার সঙ্গে তুলনা করা হয় বা সাদৃশ্য কল্পনা করা হয়, তাকে উপমান বলা হয় খ. উপমেয়— যাকে, তুলনা করা হয় বা যার সাদৃশ্য কল্পনা করা হয়, তাকে উপমেয় বলা হয়। গ. সাধারণ ধর্ম— দুটি অসম জাতীয় বস্তু বা ব্যক্তির মধ্যে তুলনা করতে যে একটি বিশেষ বিষয়ে সাদৃশ্য কল্পনা করা হয়, তাকে সাধারণ ধর্ম বলা হয়। চাঁদের মত সুন্দর মুখ দৃষ্টান্তটিতে ‘চাঁদ’ [উপমান] ও ‘মুখে’র [উপমেয়] মধ্যে একটি বিষয়ে মিল আছে। বস্তু-যুগলের মধ্যে সেই মিল হলো ‘সুন্দর’। ‘সুন্দর’ সাধারণ ধর্মবাচক শব্দ। ঘ. তুলনাবাচক শব্দ— এই ধরনের উপমা বা তুলনায় উপমা ৰা তুর্লনাটিকে স্পষ্ট করে তোলার জন্যে একটি অব্যয় পদ ব্যবহার করা হয়। উল্লিখিত দৃষ্টান্তের ‘মতো’ শব্দটি তুলনাবাচক শব্দ। ন্যায়, মততা, মতন, সদৃশ, ইত্যাদি তুলনাবাচক শব্দরূপে ব্যবহৃত হয়।

উপমান, উপমেয় ও সাধারণ ধর্মের ভিত্তিতে উপমামূলক কর্মধারয় তিন প্রকারের— উপমান কর্মধারয়, উপমিত কর্মধারয় ও রূপক কর্মধারয়।

উপমান কর্মধারয়

উপমান পদের সঙ্গে সাধারণ ধর্মবাচক শব্দের যে সমাস হয়, তাকে বলা হয় উপমান কর্মধারয়। যেমন: কুসুমের মতো কোমল=কুসুমকোমল। এখানে ‘কুসুম’ উপমান, ‘কোমল’ সাধারণ ধর্মবাচক শব্দ; কাজেই, এটি উপমান কর্মধারয়। তেমনি— ঘনের এ [ মেঘের] ন্যায় শ্যাম=ঘনশ্যাম; শশের ন্যায় ব্যস্ত=শশব্যস্ত; তুষারের ন্যায় ধবল=তুষারধবল; কাজলের ন্যায় কালো=কাজলকালো; বজ্রের ন্যায় কঠিন=বজ্রকঠিন; হস্তীর ন্যায় মূর্খ=হস্তী-মূর্খ।

অতিরিক্ত দৃষ্টান্ত: জলদ-গম্ভীর, বক ধার্মিক, মসীকৃষ্ণ, ইস্পাত-কঠিন, বিড়াল-তপস্বী, ভ্রমরকৃষ্ণ, তুষার-শুভ্র, কুন্দশুভ্র, হিমশীতল, তুষারশীতল, শিশির-স্নিগ্ধ, শৈলোন্নত, জ্যোৎস্না-ধবল, মেঘ-নীল, ঘনকালো, শোণিত-রাঙা, মেঘ-মেদুর, ভ্রূকুটি-কুটিল, স্বপ্নমধুর, অরুণ-রাঙা, দূর্বাদলশ্যাম, বজ্রগম্ভীর, শঙ্খ-ধবল, নবনীতকোমল, নিমতিতা, মিশ্‌কালো, গোবেচারা, ফুটিফাটা, দুধ-শাদা, সিঁদুর-রাঙা।

উপমিত কর্মধারয়

উপমান পদের সঙ্গে উপমেয় পদের সমাসকে উপমিত কর্মধারয় বলা হয়। যেমন: ‘মুখ’ চাঁদের মতো=চাঁদমুখ। এখানে ‘চাঁদ’ উপমান, ‘মুখ’ উপমেয়; উপমান ও উপমেয়ের সমাস হয়েছে। কাজেই, এটি উপমিত কর্মধারয়। তেমনি— পুরুষ সিংহের ন্যায়=পুরুষসিংহ; কর পল্লবের ন্যায় =করপল্লব; আঁখি পদ্মের মতো=পদ্ম-আঁখি; লোচন পলাশের ন্যায়=পলাশলোচন; চরণ কমলের ন্যায়=চরণকমল; মুখ চন্দ্রের ন্যায়=মুখচন্দ্র [চন্দ্রমুখ]।

অতিরিক্ত দৃষ্টান্ত: পাদপদ্ম, বাহুলতা, তনুলতা, নরশার্দূল, নরসিংহ, পুরুষব্যাঘ্র, ফুলকুমারী, কর-কিশলয়, অধর-কিশলয়, অধর-বিম্ব [বিম্বাধর]; বাহু-বল্লরী, ফটিক-জল, অধর-কমল, মুখ-চম্পক, সোনামুখ, হাঁড়িমুখ, চরণপল্লব, পদপল্লব, কদমছাট, ফুলবাবু (ফুলের মতো বাবু), চন্দ্রপুলি, ওলকপি, চাঁদবদন, অধর-পল্লব, চরণ-পদ্ম, জটাজাল।

রূপক কর্মধারয়

যে সমাসে উপমান ও উপমেয়ের সাদৃশ্য এত নিবিড় হয় যে, উপমান ও উপমেয়ের মধ্যে অভেদ কল্পনা করা হয়; অর্থাৎ উপমান ও উপমেয়ের ভেদাভেদ করা যায়, তাকে রূপক কর্মধারয় সমাস বলা হয়। যেমন: মন রূপ মাঝি=মনমাঝি। এখানে ‘মন’ উপমেয় ও ‘মাঝি’ উপমান। মন ও মাঝির মধ্যে সাদৃশ্য এত নিবিড় হয়েছে যে, দুটি বস্তুকে পৃথক কল্পনা করা যায় না। মনে হয়, দুই-ই এক; অর্থাৎ, অভিন্ন। উপমান ও উপমেয়ের মধ্যে এই অভেদকল্পনার জন্যে রূপক কর্মধারয় সমাস হয়েছে। তেমন—বিদ্যা রূপ আলোক=বিদ্যালোক; ক্রোধ রূপ বহ্নি=ক্রোধবহ্নি; ভব রূপ নদী=ভবনদী; মন রূপ মাঝি=মনমাঝি; প্রাণ রূপ পাখি=প্রাণপাখি; ক্ষুধা রূপ অনল=ক্ষুধানল।

অতিরিক্ত দৃষ্টান্ত: ভবসিন্ধু, ভবসাগর, দেহ-মন্দির, শোকাগ্নি, শোকসিন্ধু, শোক-সাগর, দেহ-পিঞ্জর, বিষাদ-সিন্ধু, জীবনস্রোত, মন-বিহঙ্গ, শক্তি-সাগর, স্নেহ-সুধা, জীবনতরু, আকাশ-পট, জীবন-প্রবাহ, আকাশ-গঙ্গা, স্নেহপাশ, মরণশ্যেন, বিরহ-আঁধার, পাদপদ্ম, হৃদয়-পদ্ম, মনোরথ, মন-ময়ূরী, জ্ঞানবৃক্ষ, হৃদয়-আকাশ, বিদ্যাধন, কীর্তিধ্বজা, প্রেমসুধা, চরিতামৃত, কথামৃত, স্বেচ্ছাবল, শান্তিবারি, যৌবনকুসুম, বাণী-মঞ্জরী, কল্পলতা, আশালতা, হৃদয় কুসুম, মাৎসর্য-বিষ, স্নেহসমুদ্র, প্রাণ-প্রবাহিনী, মায়াডোর, দেহ-আকাশ, জীবন-উদ্যান, হৃদয়-অরণ্য, রূপসাগর, চিত্তচকোর, মন-মধুকর, মনোরাজ্য, দুঃখানল, মন-পবন, আখি-পাখি, যৌবনবাউল, দিল-দরিয়া, মানুষ-কোকিল, জ্ঞানবহ্নি, ধনবহ্নি, রূপবহ্নি, ধর্মবহ্নি, ইন্দ্রিয়বহ্নি, সংসারকানন, জ্ঞানালোক, সংসার-সাগর, কালস্রোত, কালচক্র, পঙ্কজ রবি, জীবন-তরী, হৃৎপদ্ম, সভ্যতা-নাগিনী, জ্ঞানবর্তিকা, সমাজ-সৌধ, ভাব-বিগ্রহ, দেশ-মাতৃকা, বাদল বাউল, কাল-বৈশাখী, উত্তেজনা-প্রবাহ, জীবন-পথ।

বিশিষ্ট প্রয়োগ: ‘জনগণে যারা জোঁকসম শোষে তারে মহাজন কয়।’ ‘পাখতুনরা আজ স্বায়ত্ত-শাসন লাভের জন্যে সংগ্রাম করছে।’ ‘তাঁর উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি হারিয়ে গেছে।’ ‘রাজর্ষি জনক রামচন্দ্রের হাতে সীতাকে সম্প্রদান করলেন।’ ‘কেতকী-কেশরে কেশপাশ করো সুরভি।’ ‘নৃপশিষ্য নতশিরে বসি রহে নদীতীরে।’ ‘স্নিগ্ধোজ্জল শ্যামকান্তি তবু তব অমৃত-পরশা।’ ‘বাংলার রবি জয়দেব কবি কান্ত-কোমল পদে করেছে সুরভি সংস্কৃতের কাঞ্চন-কোকনদে।’ ‘তিনি শশব্যস্ত হয়ে স্থানটি পরিত্যাগ করলেন।’ ‘হে মহামানব, একবার এসো ফিরে।’ ‘বৌভাতে, প্রীতিভোজে শুধু প্রীতি-উপহারেরই ভিড়।’ ‘আলোক-চিত্রের প্রদর্শনী ছিল মেলার একটি আকর্ষণ।’ ‘পনেরোই আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা-দিবস।’ ‘শহীদ-দিবসে আমরা সেই অমর আত্মাগুলিকে অন্তরে স্মরণ করি।’
‘তুষার-ধবল আকাশে যেন জ্যোৎস্নার বান ডেকেছে।’ ‘জলদ-গম্ভীর স্বরে কহিলা সৌমিত্রি।’ ‘গায়ে নামাবলী দেখে ভুলে যেও না, আসলে উনি একটি বক-ধার্মিক।’ ‘তার হৃদয় ছিল যেমন ইস্পাত-কঠিন, অন্যদিকে তেমনি কুসুম-কোমল।’ ‘জীবন-প্রবাহ বহি কালসিন্ধু পানে ধায়, ফিরাব কেমনে?’ ‘মন-মাঝি তোর বৈঠা নে রে।’ ‘দেখিবারে আঁখি-পাখি ধায়।’

৩. তৎপুরুষ সমাস

যে সমাসে পূর্বপদের কারক বা সম্বন্ধ-বোধক বিভক্তি লুপ্ত হয়ে পরপদের অর্থ-প্রাধান্য প্রতীয়মান হয়, তাকে তৎপুরুষ সমাস বলা হয়। যেমন: শরণকে আগত=শরণাগত। মধুর দ্বারা মাখা=মধুমাখা। ‘শরণ’কে এবং ‘মধুর দ্বারা’ এই পূর্বপদ দুটির প্রথমটিতে ‘কে’ বিভক্তি এবং দ্বিতীয়টিতে ‘দ্বারা’ বিভক্তি হয়েছে; কিন্তু সমস্তপদে বিভক্তি লুপ্ত হয়ে পরপদ দুটি অর্থের প্রাধান্য প্রতীয়মান হচ্ছে। তৎপুরুষ সমাসে সমস্ত বিভক্তি [কর্তৃকারকের শূন্যবিভঙ্গি ছাড়া] লোপ পায়। কারক-অনুযায়ী [কর্তৃকারক ছাড়া (ওটা কর্মধারয় সমাস)] তৎপুরুষ সমাসের নামকরণ হয়। যেমন: কর্ম-তৎপুরুষ, করণ-তৎপুরুষ, নিমিত্ত-তৎপুরুষ অপাদান-তৎপুরুষ, সম্বন্ধ-তৎপুরুষ, অধিকরণ-তৎপুরুষ। সম্বন্ধপদ কারক নয়; তবু ‘র” বা ‘এর’ বিভক্তির জন্যে সম্বন্ধ-তৎপুরুষ হয়।

তৎপুরুষ সমাসের প্রকারভেদ

তৎপুরুষ সমাসকে ছয়ভাগে ভাগ করা যায়—

৩.ক. কর্ম-তৎপুরুষ সমাস

যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদস্থিত কর্মকারকের বিভক্তি [কে, রে ইত্যাদি। লুপ্ত হয়ে পরপদের অর্থ-প্রাধান্য প্রতীয়মান হয়, তাকে কর্ম-তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন—

১. গত, আগত, প্রাপ্ত, আপন্ন, আশ্রিত, আরূঢ়, অতীত, সংক্রান্ত প্রভৃতি শব্দযোগে কর্ম-তৎপুরুষ হয়। যেমন: শরণকে আগত=শরণাগত; স্বঃ [স্বর্গ]-কে গত=স্বৰ্গত; বিপদকে আপন্ন=বিপদাপন্ন; দেবকে আশ্রিত= দেবাশ্রিত; সংখ্যাকে অতীত=সংখ্যাতীত; অশ্বকে আরূঢ়=অশ্বারূঢ়; বয়ঃকে প্রাপ্ত=বয়ঃপ্রাপ্ত; স্বকে গত=স্বগত; ব্যক্তিকে গত=ব্যক্তিগত। তেমনি—আকারগত, হস্তগত, মজ্জাগত, মর্মগত, পুঁথিগত, জাতিগত, স্মরণাতীত, সাহায্যপ্রাপ্ত, চরণাশ্রিত, আলোকপ্রাপ্ত, বৃত্তিপ্রাপ্ত, গা-ঢাকা, নথনাড়া, রথ-দেখা, কলাবেচা, বাসন-মাজা, ঘর-ধোয়া, জলতোলা, কাপড় কাচা, হাত-দেখা, লুচি-ভাজা, বধূবরণ, নবীনবরণ।

২. ব্যাপ্তি বোঝালে কালবাচক পদের সঙ্গে কর্ম-তৎপুরুষ সমাস হয়ে থাকে। যেমন: চিরকাল ব্যাপ্ত করে সুখী=চিরসুখী; চিরকাল ব্যাপ্ত করে স্থায়ী=চিরস্থায়ী ; চিরকাল ব্যাপ্ত করে বসন্ত=চিরবসন্ত; ক্ষণকাল ব্যাপ্ত করে স্থায়ী=ক্ষণস্থায়ী। তেমনি— চিরহরিৎ, দীর্ঘস্থায়ী, চিরস্মরণীয়, চিরদুঃখিনী, চিরবঞ্চিত, চিরকৃতজ্ঞ, চিরশত্রু, চির-রুগ্‌ণ, নিত্যানন্দ, পক্ষাশৌচ, চির-চঞ্চল।

৩. পূর্বপদটি বিশেষণের বিশেষণ বা ক্রিয়াবিশেষণ হলে পরবর্তী কৃদন্তপদের সঙ্গে কর্ম-তৎপুরুষ সমাস হয়ে থাকে। যেমন: দ্রুত যথা তথা গামী=দ্রুতগামী; ধীর যথা তথা গামী=ধীরগামী; মৃদু রূপে ভাষিণী=মৃদুভাষিণী; অবশ্য যথা তথা কর্তব্য=অবশ্যকর্তব্য; ঘনভাবে সন্নিবিষ্ট=ঘনসন্নিবিষ্ট; নিম [অর্ধ] ভাবে রাজী=নিমরাজী, নিম [অর্ধ] ভাবে খুন=নিমখুন; দৃঢ়রূপে বদ্ধ=দৃঢ়বদ্ধ। তেমনি নিমদাগী, আধ-পাকা, অর্ধ-সমাপ্ত, অর্ধ-ফুট, আধ-পোড়া, অর্ধ-দগ্ধ।

অতিরিক্ত বাংলা দৃষ্টান্ত: চুল-চেরা, ধানকাটা, ছেলে-ভুলানো, ঘর-বদলানো।

৩.খ. করণ-তৎপুরুষ সমাস

যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদস্থিত করণ কারকের বিভক্তি দ্বারা, দিয়া, দিয়ে, সাহায্যে ইত্যাদি লুপ্ত হয়ে পরপদের অর্থ-প্রাধান্য প্রতীয়মান হয়, তাকে করণ তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন: মধুর দ্বারা মাখা=মখুমাখা; শ্রীর দ্বারা হীন=শ্রীহীন; শ্রীর দ্বারা যুক্ত=শ্রীযুক্ত; একের দ্বারা উন বিংশতি=উনবিংশতি; শোকের দ্বারা আকুল=শোকাকুল; বিজ্ঞান দ্বারা সম্মত=বিজ্ঞানসম্মত; ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গ্রাহ্য=ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য; বাক্যের দ্বারা দত্তা=বাগদত্তা; বাণের দ্বারা বিদ্ধ=বাণবিদ্ধ; অস্ত্রের দ্বারা উপচার=অস্ত্রোপচার; তেমনি— স্নায়ুবিহীন, বিদ্যাহীন, দৃষ্টিহীন, গুণহীন, গৃহহীন, দৈন্যপীড়িত, বজ্রাহত, রৌদ্রদগ্ধ, তমসাবৃত, আইনসঙ্গত, কীটদষ্ট, দুগ্ধপোষ্য, ঋণগ্রস্ত, মেঘাচ্ছন্ন, মোহাচ্ছন্ন, স্নেহ, ভ্ৰমান্ধ, মোহান্ধ, গুণমুগ্ধ, শ্রম-সাধ্য, ঘৃতপক, পদদলিত, মসীলিপ্ত, পুত্রহীন, বাহুত, শক্তিসম্পন্ন, রত্নখচিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ, হস্ত-চালিত, বায়ু-চালিত, বিদ্যুৎ-চালিত, জরাজীর্ণ, কণ্টকাকীর্ণ, বাল্মীকি-প্রণীত, আশ্চর্যান্বিত, তৈলনিষিক্ত, মাতৃহীন, অস্ত্রহীন, রোগাক্রান্ত, সর্পদষ্ট, গুরুদত্ত, যন্ত্রচালিত, লিপিবদ্ধ, শোণিতলিপ্ত, সুবর্ণমণ্ডিত, রক্তাক্ত, জনশূন্য, বিপদসঙ্কুল, কৌতূহলাক্রান্ত, নজরবন্দী। অতিরিক্ত বাংলা দৃষ্টান্ত: দাকাটা, হাত-ছানি, টেকি ছাঁটা, মধুমাখা, মনগড়া, ঝাটা-পেটা, লেপ-মুড়ি, চুন-মাখা, শান-বাঁধানো, তাস-খেলা, লাঠি-খেলা, ধামাচাপা, হাত-ছানি, পোয়া-কম, সিকি-কম, বাদুড়-চোষা, কালি-মাখা।

৩.গ. নিমিত্ত-তৎপুরুষ সমাস

যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদস্থিত নিমিত্ত, উদ্দেশে ইত্যাদি বিভক্তি লুপ্ত হয়ে পরপদের অর্থ-প্রাধান্য প্রতীয়মান হয়, তাকে নিমিত্ত-তৎপুরুষ সমাস বলে। উদ্দেশ বোঝাতে বা নিমিত্তার্থে নিমিত্ত-তৎপুরুষ সমাস হয়। যেমন: দেবের উদ্দেশে দত্ত=দেবদত্ত; তপের নিমিত্ত বন=তপোবন; যুপের নিমিত্ত কাষ্ঠ=যুপকাষ্ঠ; শয়নের নিমিত্ত কক্ষ=শয়নকক্ষ; রান্নার নিমিত্ত ঘর=রান্নাঘর; তেমনি— দেবভূমি, পুত্রশোক, আরামকেদারা, বালিকাবিদ্যালয়, অতিথিশালা, শান্তিনিকেতন, শিশু-বিভাগ, কিশোর-পত্রিকা, শিশু-সাহিত্য, জপমালা, মালগুদাম, অনাথাশ্রম, বিশ্রামঘর, নাটমন্দির, স্মৃতিমন্দির, দেবমন্দির, ছাত্রাবাস, বিদ্যাভবন, পাঠভবন, পান্থনিবাস, তীর্থযাত্রা, সভামঞ্চ, ভোজনাগার, বিজয়-উল্লাস, চণ্ডীমণ্ডপ, ফাসিকাষ্ঠ, যজ্ঞশালা, যজ্ঞাগার, যজ্ঞবেদী, খাদ্য-আন্দোলন, দূতাবাস, ভিক্ষাপাত্র, জিয়নকাঠি। অতিরিক্ত বাংলা দৃষ্টান্ত: পাগলাগারদ, রেল-ভাড়া, যজ্ঞ-ঘোড়া, খেয়াঘাট, বিয়ে-পাগলা, ডাক-মাশুল, ধান-জমি, বসতবাড়ি, মড়াকান্না, ঠাকুর-ঘর, ভিক্ষাপাত্র।

৩.ঘ. অপাদান তৎপুরুষ সমাস

যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদস্থিত অপাদান কারকের বিভক্তি [হতে, থেকে, চেয়ে, অপেক্ষা ইত্যাদি] লুপ্ত হয়ে পরপদের অর্থ প্রাধান্য প্রতীয়মান হয়, তাকে অপাদান-তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন: শাপ থেকে মুক্ত=শাপমুক্ত; আদি থেকে অন্ত=আদ্যন্ত ; যূথ থেকে ভ্রষ্ট=যূথভ্রষ্ট; জন্ম থেকে অন্ধ=জন্মান্ধ; সর্প হতে ভয়=সর্পভয়; মানব হতে ইতর=মানবেতর, বিলেত থেকে ফেরত=বিলেতফেরত, ইত্যাদি। তেমনি—বামেতর, বিদেশাগত, বহিরাগত, ব্যাভীতি, ধর্মচ্যুত, কক্ষচ্যত, আকাশবাণী, মৃত্যুভয়, লোকলজ্জা, সত্যভ্রষ্ট, লোকক্ষয়, চৌরভয়, পদচ্যুত, বৃন্তচ্যুত, পদচ্যুত, বন্যাত্ৰাণ, মুখংশজাত, প্রাণাধিক, দেবোত্তর, কারামুক্ত, ঋণমুক্তি, পণমুক্তি, প্রাণপ্রিয়, পাঠশালা-পলায়ন, যুদ্ধোত্তর, অষ্টোত্তর, তজ্জাত, তদ্ভব। অতিরিক্ত বাংলা দৃষ্টান্ত: গাঁ-তাড়ানো, জেল-খালাস, জেল-পালানো, ইস্কুল-পালানো, অফিস-ফেরত।

৩.ঙ. সম্বন্ধ-তৎপুরুষ

যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদস্থিত সম্বন্ধ পদের বিভক্তি [র, এর ইত্যাদি] লুপ্ত হয়ে পরপদের অর্থ-প্রাধান্য প্রতীয়মান হয়, তাকে সম্বন্ধ-তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন: গঙ্গার জল গঙ্গাজল; রত্নের আকর=রত্নাকর; ছাত্রদের সমাজ=ছাত্রসমাজ; বৌদ্ধদেব ধর্ম=বৌদ্ধধর্ম; স্ব-র [নিজের] পত্না=স্বপত্নী [কিন্তু সমান বা একই পতি যাদের=সপত্নীবহুব্রীহি]; সূর্যের অস্ত=সূর্যাস্ত; পথের রাজা=রাজপথ; হংসের রাজা=রাজহংস; কবিদের রাজা=রাজকবি বা কবিরাজ ইত্যাদি। তেমনি— বনস্পতি, পিত্রালয়, তরুচ্ছায়া, দেশবন্ধু, রাষ্ট্রপতি, কবিগুরু, বোধোদয়, গিরীশ, সূর্যোদয়, রাজ্যেশ্বর, রাজপুত্র, ব্রাহ্মণতনয়, শ্রেষ্ঠীপুত্র, যক্ষপতিত্রাস, রাক্ষস-কুলভরসা, বিশ্বকবি, বিশ্বভারতী, সূর্যালোক, দীনবন্ধু, নদীতীর, রাজাজ্ঞা, গোদুগ্ধ, মৃগশাবক, সিংহ-শিশু, সাধুসঙ্গ, অশোক-কানন, সাগরতীর, জাতিসংঘ, গোষ্পদ, মূলোচ্ছেদ, দাবাগ্নি; শকুন্তের (পাখীর) লাবণ্য =শকুম্ভলাবণ্য; গুষ্ঠির(গোষ্ঠীর) সুখ=গুষ্ঠিসুখ ।

কতকগুলি ঈ-কারান্ত স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ পূর্বপদ হলে সমস্ত পদে ঈ-কার ইকার হয়। যেমন: কালীর দাস=কালিদাস, দেবীর দাস=দেবিদাস, ষষ্ঠীর দাস=ষষ্ঠিদাস ইত্যাদি। কিন্তু চণ্ডীর দাস=চণ্ডিদাস ও চণ্ডীদাস দুই-ই হয়।

স্মরণীয় ও রাজপথ, রাজকবি, কবিরাজ, রাজহংস, রাজমিস্ত্রী, রাজরোগ— সমস্ত পদগুলিতে পূর্বপদগুলির পরনিপাত হয়। যেমন: মিস্ত্রীদের রাজা=রাজমিস্ত্রী।

৩.চ. অধিকরণ-তৎপুরুষ

যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদস্থিত অধিকরণ কারকের বিভক্তি [এ, তে, এতে, য়, মধ্যে ইত্যাদি] লুপ্ত হয়ে পরপদের অর্থ-প্রাধান্য প্রতীয়মান হয়, তাকে অধিকরণ-তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন: কর্মে নিপুণ=কর্মনিপুণ; শিল্পে পটু=শিল্পপটু; জলে মগ্ন=জলমগ্ন; পূর্বে ভূত=ভূতপূর্ব; পূর্বে শ্রুত =শ্রুতপূর্ব; সত্যে নিষ্ঠ=সত্যনিষ্ঠ; গৃহে বাসগৃহবাস; সংখ্যায় গরিষ্ঠ=সংখ্যাগরিষ্ঠ। তেমনি— অরণ্যবাস, বনবাস, পাপাসক্ত, ক্রীড়াকুশল, রণনিপুণ, বিশ্ববিখ্যাত, গৃহাগত, তীরলগ্ন, উত্তরায়ণ, ধ্যানমগ্ন, জলমগ্ন, অকালপক্ক, অকালমৃত্যু, কাশীবাস, পুরুষোত্তম, নরোত্তম, নরাধম, সরোবর, সর্ববিদ্যাবিশারদ, কর্মকুশল, মহাকাশ-ভ্রমণ, কবি-শ্রেষ্ঠ, বনভোজন অকালবার্ধক্য, পাঠরত, অধ্যয়নরত, গৃহকর্ম-নিপুণা, সত্যাগ্রহ, অকালবোধন। অতিরিক্ত বাংলা দৃষ্টান্ত: গাছপাকা, ইংরেজি-শিক্ষিত, রাতকানা, তালকানা। স্মরণীয়: পূর্বে ভূত=ভূতপূর্ব; পূর্বে শ্রুত=শ্রুতপূর্ব; পূর্বে দৃষ্ট=দৃষ্টপূর্ব; পূর্বে আস্বাদিত=আস্বাদিত-পূর্ব— সমস্তপদগুলিতে পূর্বপদগুলির পরনিপাত হয়েছে।

তৎপুরুষ সমাসের অতিরিক্ত প্রকারভেদ

তৎপুরুষ সমাস আরও কয়েক প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন: উপপদ তৎপুরুষ, অলুক তৎপুরুষ, ন-তৎপুরুষ ইত্যাদি।

উপপদ তৎপুরুষ

সমাসবদ্ধ কৃদন্ত পদের পূর্বপদকে উপপদ বলা হয়; অর্থাৎ, যে-সব পদের পরস্থিত ধাতুর কৃৎ-প্রত্যয় হয়, তাদের উপপদ বলা হয়। যেমন: গৃহস্থ, জলচর, খেচর, উদ্ভিদ, জলজ— এই সমাসবদ্ধ কৃদন্ত পদগুলির পূর্বপদ— যথাক্রমে—গৃহ, জল, খ, উৎ, জল—এরা উপপদ।

উপপদের সঙ্গে কৃদন্ত পদের যে সমাস হয়, তাকে বলা হয় উপপদ-তৎপুরুষ সমাস। যেমন: জলে চরে যে=জলচর; গৃহে থাকে যে=গৃহস্থ; পঙ্কে জন্মে যা=পঙ্কজ; জল দেয় যে=জলদ; শত্রুকে হত্যা করে যে=শত্ৰুঘ্ন; সত্য বলে যে=সত্যবাদী; ইন্দ্রকে জয় করে যে=ইন্দ্রজিৎ; খ-এ [আকাশে] চরে যে=খেচর; অগ্রে জন্মে যে=অগ্রজ; দুঃখে থাকে যে=দুঃস্থ, গোরুকে পালন করে যে=গোপ; পরম্ [শত্রুকে] তপ [দমন] করে যে=পরন্তপ; কুম্ভ করে যে=কুম্ভকার; অপ্ বা জলে জন্মে যা=অব্জ। তেমনি—খনিজ, পাদপ, অপ্সরা, নীরদ, অভ্রভেদী, দিগ্বিজয়ী, মৃত্যুঞ্জয়, ধনঞ্জয়, ভূধর, সহচর, ধনুর্ধর, জলজ, অন্ত্যজ, কুজ, হিতকর, মধুপ, নরকগামী, মনোজ, মনসিজ, সরোজ, যাদুকর, দিবাকর, ধর্মপত্নী-পরিত্যাগী, ছত্রধর, মিথ্যাবাদী, বনবাসী, বিশ্ববাসী, অন্তেবাসী (অন্তে অর্থাৎ গুরুগৃহে বাস করে যে, উচ্ছিষ্টভোজী, গৈরিকবসন-পরিহিতা, অরিন্দম, দীপঙ্কর, ভুজগ, করদ, চিত্রকর, পথিকৃৎ, সূত্রধর, মদ্যপ, গুণগ্রাহী, শ্রীশ, গিরিশ [গিরিতে শয়ন করেন যিনি], উদ্ভিদ, পারদর্শী, ভূয়োদর্শী, দূরদর্শী, শাস্ত্রজ্ঞ, গন্ধবহ, নিশাচর, সর্বংসহা, সর্বনাশী, তটস্থ, মুখস্থ, হিমম, পাপ, শ্রুতিধর, রাজ্যপাল, বসুধা, বসুন্ধরা, আত্মজ, অনুজ, ভূমিষ্ঠ, গঙ্গাধর, নভশ্চর, কলাধর, সব্যসাচী [সব্য অর্থাৎ উভয় হস্তেই সচন করেন যিনি], প্রকৃতিস্থ, কর্মশা, শ্রমজীবী, সবহারা, দৈত্যকুলদল। অতিরিক্ত বাংলা দৃষ্টান্ত: পিলে-চমকানিয়া, ঘুম-ভাঙানিয়া, দিশাহারা, লক্ষ্মীছাড়া, বর্ণচোরা, গাঁটকাটা, পকেটমার, ছেলেধরা, ভুইফোড়, শোলোক বলা, সবজান্তা, বাস্তুহারা, দলছাড়া।

নঞ্-তৎপুরুষ সমাস

যে তৎপুরুষ সমাসের পূর্বপদ নঞর্থক বা নিষেধাৰ্থক অব্যয়, তাকে নঞ্-তৎপুরুষ সমাস বলে। সংস্কৃত ‘নঞ‌’ অব্যয়ের বাংলা প্রতিরূপ—অ, অন, অনা, আ, গর, ন, না, বি ও বে। অ—নেই মিল=অমিল; নয় সুখ=অসুখ; নয় সুস্থ=অসুস্থ; নয় শুভ=অশুভ; নয় গণ্য=অগণ্য [যা গণনা করার অযোগ্য]; নয় গণ্য=নগণ্য [যা গণ্য করার অযোগ্য-অর্থাৎ, তুচ্ছ]। অন্—নয় উচিত=অনুচিত; নয় এক=অনেক; নেই অন্ত=অনন্ত; নেই সীমা=অসীম; নেই আহার=অনাহার; নয় আহূত=অনাহূত; নয় আস্বাদিত=অনাস্বাদিত। অনা—নেই বৃষ্টি=অনাবৃষ্টি; নয় আঘ্রাত=অনাঘ্রাত। আ—নয় গাছা=আগাছা; নয় ঘাটা=আঘাটা; নয় কাল=আকাল; নয় কাঁড়া=আকাঁড়া; নয় লুনি=আলুনি; নয় কাট=আকাট; গর—নয় হাজির=গরহাজির; নয় রাজী=গররাজী। ন—নয় অতি দীর্ঘ=নাতিদীর্ঘ; নয় অতি দূর=নাতিদূর; নয় অতি শীত ও উষ্ণ=নাতিশীতোষ্ণ; নয় ধর=নধর। না—নয় রাজী=নারাজ; নয় মঞ্জুর=না-মঞ্জুর। নয় বালক=নাবালক; নেই দাবী=নাদাবী; নেই খেরাজ [খাজনা]=নাখেরাজ। নি, নির্—নেই ভরসা=নির্ভরসা; নেই আশা=নিরাশা; নয় ভেজাল=নির্ভেজাল; নেই খুঁত=নিখুঁত; নেই ভুল=নির্ভুল; নেই জন=নির্জন। বি—নয় দেশ=বিদেশ; নেই শৃঙ্খলা=বিশৃঙ্খলা; নয় সদৃশ=বিসদৃশ; নয় জোড়=বিজোড়। বে—নয় গতিক=বেগতিক; নয় মানান=বেমানান। তেমনি— অনির্বচনীয় [নয় বচনীয়;-অনৃত [নয় ঋত], অমৃত [নয় মৃত], অম্লান, অনাবশ্যক, অবাধ্য, অনিবার্য, অভাব [নেই ভাব], অব্যক্ত, অনলস, অজ্ঞাত, অখ্যাত, অপবিত্র, অসৎ, অমঙ্গল, নাতিবৃহৎ, নাতিক্ষুদ্র, অনশন, অনভিপ্রেত, অনিচ্ছা, অনীহা [নয় ঈহা], অনভিজ্ঞ, অবিরাম, অপরিণত, অনিপুণ।

বিশিষ্ট প্রয়োগ: শরণাগতকে রক্ষা করা কর্তব্য। স্বগত উক্তি থেকে তার মনের কথা ও গেল। ‘পাড়ায় এসেছে এক নাড়ী-টেপা ডাক্তার।’ ছেলে-ভুলানো ছড়া, জামাই-ঠকানো প্রশ্ন, লোক-হাসানো কাজ, প্রাণ-মাতানো সংগীত, হাড়-কাঁপানো শীত, হাড়-জ্বালানো ছেলে, চোখ ঝলসানো বিদ্যুতের আলো, প্রাণ-জুড়ানো বাতাস, ঘুম-ভাঙনো ডাক। ‘আলস্য বাঙ্গালীর মজ্জাগত দোষ।’ পল্লী বাংলা আজ শ্রীহীন। বিজ্ঞান-সম্মত উপায়ে আজ রোগের চিকিৎসা হওয়া উচিত। বালকটি আসলে একটি ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নি।’ ‘ঋদ্ধিযুক্ত ব্যক্তিরা অন্যের প্রশংসা শুনিতে ভালোবাসেন না।’ ‘নর-পিশাচদের কবল থেকে দুগ্ধপোষ্য শিশুরাও নিষ্কৃতি পায়নি।’ ‘পুত্রশোকে চন্দ্রধর একেবারে ভেঙে পড়লেন না।’ আসলে, এই পৃথিবীটা একটা বড়ো রকমের পাগলা-গারদ। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ ছিলেন। যুদ্ধোত্তর-কালে শ্রমিক-বিক্ষোভ অত্যন্ত প্রবল আকার ধারণ করেছিল। ‘যৌবরাজ্যে বসিয়ে দে মা লক্ষ্মীছাড়ার সিংহাসনে।’

৪. দ্বন্দ্ব সমাস

এটি সংযোগমূলক সমাস। ‘দ্বন্দ্ব’ কথাটির দুটি অর্থ ও সংঘাত ও মিলন। ‘দ্বন্দ্ব সমাস’ কথাটিতে দ্বিতীয় অর্থ [‘মিলন’]-টিই গৃহীত হয়। ‘দ্বন্দ্ব সমাস’ অর্থাৎ মিলনের সমাস।

যে-সমাসে দুই বা তার অধিক পদের মিলন হয় এবং সমস্যমান প্রত্যেক পদের অর্থ প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয়, তাকে দ্বন্দ্ব সমাস বলে।

সমস্যমান পদগুলিকে সংযোজক অব্যয় যুক্ত করে। দ্বন্দ্ব সমাসে উভয় পদেরই প্রাধান্য।

দুই পদের মিলন

হর ও গৌরী=হরগৌরী; মশা ও মাছি=মশামাছি; বর ও কনে=বরকনে; পিতা ও মাতা=পিতামাতা; জায়া ও পতি=দম্পতি, দম্পতী; কুশ ও লব=কুশীলব; চোখ ও কান=চোখকান; মাথা ও মুণ্ড=মাথা-মুণ্ডু; ঝি ও চাকর=ঝি-চাকর; ঘাস ও বিচালি=ঘাস-বিচালি।

দুইয়ের অধিক পদের মিলন

স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল=স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল; তেল, নুন ও লকড়ি=তেল-নুন-লকড়ি; চৰ্য, চূষ্য, লেহ্য ও পেয়=চর্ব্য-চূষ্য-লেহ্য-পেয়; দুধ, দই, ক্ষীর ও সরপুরিয়া=দুধ-দই-ক্ষীর-সরপুরিয়া; রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ ও স্পর্শ=রূপ-রস-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শ; রোগ, শোক, জরা ও মৃত্যু=রোগ-শোক-জরা-মৃত্যু; ইট, কাঠ, চুন, বালি ও সুরকী=ইট-কাঠ-চুন বালি-সুরকী।

বাংলা সমাহার দ্বন্দ্ব

ডাল-ভাত, ডাল-ভাত-মাছ-তরকারি, মালা-চন্দন, আলু-পোস্ত, খানা-পিনা, দুধকলা, ঝি-জামাই, ডাল-রুটি, আনাগোনা, বেচাকেনা, বিকিকিনি, নদীনালা, খাল-বিল, মুড়ি-মুড়কি, কান্না-হাসি, পৌষ-ফাগুন ইত্যাদি।

দুই বা ততোধিক বিশেষ্য পদের দ্বন্দ্ব

দ্বন্দ্ব সমাস সাধারণত বিশেষ্য পদসমূহের মধ্যেই সংঘটিত হয়। ওপরের দৃষ্টান্তগুলি বিশেষ্যে-বিশেষ্যে দ্বন্দ্ব সমাসেরই দৃষ্টান্ত। তেমনি—দেনাপাওনা, জন্ম-মৃত্যু, জীবন-মরণ, কর্ণার্জুন, ধানদূর্বা, শিবদুর্গা, জাতি-ধর্ম-বর্ণ, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান, অসন-বসন, নদী-গিরিবন, মন্ত্রতন্ত্র, ধূপ-ধুনা-গঙ্গাজল, সত্য-শিব-সুন্দর, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, দেব-দেবী, নদ-নদী, শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম, চক্ষুকর্ণ, আলো-অন্ধকার, নিশিদিন, হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ, আচার-ব্যবহার, পূজা-পার্বণ, জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ, চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল, দেব-দানব-যক্ষ ব্রক্ষ ইত্যাদি।

দুই বিশেষণ পদের দ্বন্দ্ব

ভালোমন্দ, হিতাহিত, ক্ষুদ্ৰবৃহৎ, শাদাকালো, লঘু-গুরু, হতাহত, লাল-নীল, ইতর-ভদ্র, কাচাপাকা, উচ্চনীচ, ন্যায়-অন্যায়, চেনা-অচেনা, কাটা-ছেড়া, সহজ-সরল, দীন-দুঃখী, ধনী-গরীব, ছোটবড়, সিতাসিত, আকাবাঁকা, যাতায়াত, রুখাসখা, নামধাম, কসুর-সাজা, সুখী-অসুখী ইত্যাদি। কিন্তু স্মরণীয়, বিশেষণ দুটি একটি মাত্র বস্তু বা ব্যক্তিকে নির্দেশ করলে তখন এটি দ্বন্দ্ব সমাস না হয়ে কর্মধারয় সমাস হবে। যেমন: ‘লালনীল’ জামা, ‘কাঁচাপাকা’ ধান, ‘আঁকাবাঁকা’ পথ, ‘সহজ-সরল’ মানুষ ইত্যাদি।

দুই সর্বনাম পদের দ্বন্দ্ব

তুমি-আমি, যে-সে, যাকে-তাকে, যার-তার, যা-তা, এ-ও-তা, এর-তার, একে-তাকে, এটা-ওটা, কেউ-না-কেউ ইত্যাদি।

দুই ক্রিয়া পদের দ্বন্দ্ব

উঠ-বস, হেসে-খেলে, মেরে-ধরে, মরি-বাঁচি, উঠে-পড়ে, হেসে-কেঁদে, নেচে-কঁদে, শুয়ে-গড়িয়ে, কেঁদে-ককিয়ে, দেখে-শুনে, বলে-কয়ে, হারি-জিতি, হাঁটি-চলি, পড়ি-মরি, ভেঙে-চুরে, চেয়ে-চিন্তে, হানটান, র’সো (রও ও সও) ইত্যাদি।

দ্বন্দ্ব সমাসের কতকগুলি বিশিষ্ট ব্যবহার

ক. দ্বন্দ্ব সমাসের পরপদে রাত্রি ও নিশা শব্দের অন্ত্য স্বর লুপ্ত হয়। যেমন: অহঃ ও রাত্রি=অহোরাত্র, দিবা ও রাত্রি=দিবারাত্র, অহঃ ও নিশা =অহর্নিশ। কিন্তু, দিবা ও নিশি=দিবানিশি। অবশ্য বাংলায় দিনরাত, নিশিদিন, রাতদিন [রাদ্দিন] প্রচলিত।

খ. গোত্র-সম্বন্ধ ও বিদ্যা-সম্বন্ধ বোঝালে এবং ঋ-কারান্ত শব্দ পরে থাকলে পূর্ববর্তী ঋ-কারান্ত শব্দ আ-কারান্ত হয়। যেমন: মাতৃ ও পিতৃ=মাতাপিতা। সংস্কৃতে মাতৃপিতৃহীন=যার মাতার পিতা, অর্থাৎ মাতামহ নেই; পিতৃমাতৃহীন=যার পিতার মাতা, অর্থাৎ পিতামহী নেই। মাতাপিতৃহীন=যার মাতা ও পিতা নেই। সংস্কৃতে পিতামাতা অশুদ্ধ। বাংলায় কিন্তু পিতামাতা, মাতাপিতা—দুই-ই চলে।

গ. সংস্কৃতে জায়া ও পতি=দম্পতি, দম্পতী, জম্পতি, জায়াপতি। কিন্তু বাংলায় হয় শুধু দম্পতি বা দম্পতী।

ঘ. কুশ ও লব সংস্কৃতে কুশীলব। বাংলায়ও কুশীলব [নট] প্রচলিত।

অলুক দ্বন্দ্ব

অ [অর্থাৎ, না] লুক্ [অর্থাৎ, লোপ]—কথাটির অর্থ যাতে বিভক্তির লোপ হয় না ।

যে দ্বন্দ্ব সমাসে সমস্যমান পদগুলির বিভক্তি লোপ হয় না, তাকে অলুক দ্বন্দ্ব সমাস বলে। যেমন: মাঠে ও ময়দানে=মাঠে-ময়দানে; তেমনি— ঘরে-বাইরে, বনেবাদাড়ে, বনে-জঙ্গলে, জলে-জঙ্গলে, হাটে বাজারে, দুধে-ভাতে, জপে-তপে, দুঃখে-সুখে, পতনে-উত্থানে, বুকে-পিঠে, কোলে-পিঠে, ডাইনোয়ে, তেলে-বেগুনে, তেলে-জলে, আদায়-কাঁচকলায়, হাতে-পায়ে, হাতে-কলমে, মায়ে-ঝিয়ে, কাগজে-কলমে, ইস্কুলে-কলেজে, হাটে-মাঠে, গৃহে-গোঠে, ঝোপেঝাড়ে, গায়ে-গতরে, ক্ষেতে-খামারে, ট্রামে বাসে, দেশে-বিদেশে, জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে, বনে-উপবনে ইত্যাদি।

সমার্থক দ্বন্দ্ব সমাস

একই অর্থ-বিশিষ্ট পদসমূহ যে দ্বন্দ্ব সমাসে মিলিত হয়, তাকে সমার্থক দ্বন্দ্ব সমাস বলা হয়। যেমন: কাগজ ও পত্র=কাগজ-পত্র, রাজা ও বাদশা=রাজা বাদশা। তেমনি— কাজ-কর্ম, যাগ-যজ্ঞ, ভুল-ভ্রান্তি, জন্তু-জানোয়ার, মাঠ-ময়দান, জন-মানব, পাইক-বরকন্দাজ, শাক-সবজি, বাড়ি-ঘর, জমি-জমা, ভিটে-মাটি, মামলা-মোকদ্দমা, কোর্ট-কাছারি, ঠাট্টা-মস্করা, সভা-সমিতি, হাট-বাজার, ছাই-পাশ, ডাক্তারবদ্যি, কথা-বার্তা, মাথা-মুণ্ড, চিঠি-পত্র, রাজারাজড়া, সাজ-পোশাক, চোর-ডাকাত, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, কুলি-মজুর, লোক-লস্কর, হাসি-তামাসা ইত্যাদি।

ইত্যাদি-অর্থসূচক দ্বন্দ্ব সমাস

এক জাতীয় বোঝাতে ইত্যাদি-অর্থসূচক দ্বন্দ্ব সমাস হয়।

১ সহচর শব্দ-সংযোগে—যেমন: যুদ্ধ-বিগ্রহ, খল-কপটতা, ফুটোফাটা, ডাকহাক, খানাপিনা, ছেলেপিলে, ধর-পাকড়, থানা-পুলিশ, মারধর, বিলি-বিক্রি, ঘর-গেরস্থালি, খড়কুটো, গোঁফদাড়ি, হাত-পা, দেহ-মন, গান বাজনা, নাচ-গান, হৈ-হুল্লোড়, ডুগি-তবলা, খোল-করতাল, জলকল, জামা-কাপড়, ঝড়বৃষ্টি, বৃষ্টি বাদল, সর্দি-কাশি, দুঃখ-কষ্ট, ধুলোবালি, ঠেঙা-লাঠি, লাঠি-সোটা, গাছ-পালা, ঝোপ-জঙ্গল, ডাল-পালা, জলকাদা, জিনিসপত্র, ঘরবাড়ি।

২. অনুচর শব্দ-সংযোগে—যেমন: স্নানাহার, খেলাধুলো, পচা-পাতকো, চোর-ছ্যাঁচোড়, চেয়ার-টেবিল, ছল-চাতুরি, জাল-জোচ্চুরি, হাঁড়ি-হেঁসেল, আজকাল, কালপরশু, পাঁচ-সাত, চুরি-চামারি, ঘটি-বাটি, থালা-বাসন, গানবাজনা, দোকান-পাট, হাট-বাজার, হাতী-ঘোড়া, গোরু বাছুর, ঘর-দোর, খুন-খারাপি, ঢাল-তলোয়ার, গোলাবারুদ, লাঠি-সড়কি।

৩. প্রতিচর শব্দ-সংযোগে—যেমন: উত্থান-পতন, পতন-অভ্যুদয়, উচু-নীচু, জয়-পরাজয়, ক্রয়-বিক্রয়, বেচা-কেনা, উথাল-পাথাল, জোয়ার-ভাটা, জল-স্থল, স্বর্গ-নরক, পাপ-পূণ্য, ভালোমন্দ, হাসিকান্না, ক্ষুদ্র বৃহৎ, আকাশ-পাতাল, উপর-নীচ, দিনরাত, সকাল-সন্ধ্যা, পোকা-মাকড়, শেয়াল-কুকুর, কুকুর-বিড়াল, গোঁজামিল, ছেলে-মেয়ে, বৌ-বেটা, আলোছায়া, শাদাকালো, দিনরাত, ঝি-জামাই, ছেলে-পুলে, বাঙালী-অবাঙালী, লেনদেন, চাল-চুলো, চোর-ডাকাত।

৪. বিকার শব্দ-সংযোগে—যেমন: ধর্মকর্ম, ওলট-পালট, অদলবদল, তুকতাক, যা-তা, ফাঁক-ফোকর, আঁকিবুকি, কান্না-কাটি, যন্তর-মন্তর, ভাঙা-চোরা, খেলা-ধূলা, জারি-জুরি, কাঁদা-কাটা, যত্ন-আত্যি, ঝাড়-ফুক, গাল-গল্প।

৫. অনুকার শব্দ-সংযোগে—যেমন: কাজ-টাজ, চা-টা, ভাত-টাত, হাতে-নাতে, হাঁড়ি কুঁড়ি, প্রজাপত্তর, বিষয়-আশয়, গোলা-পালা, কাচ্চাবাচ্চা, ঝালাপালা, নাকানিচোবানি।

একশেষ দ্বন্দ্ব

যেমন: তুমি, সে ও আমি=আমরা; তুমি ও সে=তোমরা।

বিশিষ্ট প্রয়োগ: সেখানে আমি অহোরাত্র নদীর কুলুকুলু সংগীত শুনিতাম। দিবারাত্র তাহারা শুধু কলহ করে। কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ। ‘দিবানিশি ভাবনা কিসে ক্লেশ পাবো না।’ ‘নিশিদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।’ ‘তাহার মাতামহের পরলোকগমনে সে মাতৃপিতৃহীন [মাতামহহীন] হইল।’ ‘পিতামহীর মৃত্যুতে সে পিতৃমাতৃহীন [পিতামহীহীন] হইয়াছে। ‘পিতা ও মাতাকে হারাইয়া সে শৈশবেই মাতাপিতৃহীন [মাতাপিতাহীন] হইয়াছে। তিনি নবদম্পতীকে [দম্পতি] আশীর্বাদ করিলেন। নাটকের কুশীলবগণ একে একে আবির্ভূত হইলেন। ঘরে-বাইরে আজ আমাদের সমান দুর্গতি। :আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’ ‘ভিড় এখন কোথায় নেই? ইস্কুলে-কলেজে, হাটে-বাজারে, মাঠে-ময়দানে ভিড় এখন সবখানেই। বাবা একেবারে তেলে-বেগুনে উঠলেন জ্বলে। ‘ওপাড়া হইতে আয় মায়ে-ঝিয়ে। ‘হাটে-মাঠে-গৃহে-গোঠে সবাকার ধান।’ ‘পরে মাস দেড়ে ভিটে-মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে।’

৫. বহুব্রীহি সমাস

যে সমাসে পূর্বপদ ও পরপদের অর্থ প্রধানরূপে প্রতীয়মান না হয়ে তৃতীয় একটি অর্থ প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয়, তাকে বহুব্রীহি সমাস বলা হয়। যেমন: নীল কণ্ঠে যার=নীলকণ্ঠ। পূর্বপদ ‘নীল’ অর্থাৎ বিষ, পরপদটি ‘কণ্ঠ’। সমাসবদ্ধ পদটিতে ‘নীল’ বা ‘বিষ’ কিংবা ‘কণ্ঠ’ কাকেও বোঝাচ্ছে না; তৃতীয় ব্যক্তিকে ‘যার কণ্ঠে বিষ’ থাকে অর্থাৎ ‘শিব’কে বোঝাচ্ছে। অতএব দৃষ্টান্তটি বহুব্রীহি সমাসের।

বহুব্রীহি সমাসের প্রকারভেদ

বহুব্রীহি সমাস কয়েক প্রকারের হয়। যেমন—ক. সমানাধিকরণ বহুব্রীহি, খ. ব্যাধিকরণ বহুব্রীহি, গ. ব্যতিহার বহুব্রীহি, ঘ. মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি, ঙ. অলুক বহুব্রীহি, চ. নঞর্থক বহুব্রীহি ও ছ. সহার্থক বহুব্রীহি।

৫.ক. সমানাধিকরণ বহুব্রীহি

যে বহুব্রীহি সমাসে পূর্বপদ বিশেষণ ও পরপদ বিশেষ্য, তাকে সমানাধিকরণ বহুব্রীহি সমাস বলা হয়। যেমন: পীত অম্বর যার=পীতাম্বর; পুণ্য শ্লোক [যশঃ] যার=পুণ্যশ্লোক; পোড়া মুখ যার=মুখপোড়া; পক্ব কেশ যার=পক্বকেশ; প্রোষিত [প্রবাসী] ভর্তা (স্বামী] যার [স্ত্রী)= প্রোষিতভর্তৃকা ইত্যাদি। তেমনি—নীলাভ, বিনিদ্র, গৌরাঙ্গ, হর্যক্ষ [হরি অর্থাৎ পিঙ্গল বর্ণ অক্ষি যার], ছিন্নতন্ত্রী, মতিচ্ছন্ন, মধ্যবিত্ত, উর্ধ্ববাহু, আজানুলম্বিতবাহু, বিস্ৰস্তবসনা, শুদ্ধচিত্ত, চরিতার্থ [চরিত অর্থ যার], মন্দভাগ্য, হতভাগ্য, হতবুদ্ধি, কৃতাঞ্জলি, জিতেন্দ্রিয়, কৃতবিদ্য [কৃত বিদ্যা যার], মাতৃবৎসল [মাতা বৎসা যার], স্থিতপ্রজ্ঞ [স্থিত প্রজ্ঞা যার], বিগতশ্রী, শুদ্ধসত্ত্ব, সুহৃদ, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, বিশালাক্ষী, দশভুজা, ত্রিনয়নী, মহাশয় [মহান আশয় যার], প্রোষিতভার্য [প্রোষিতা ভার্যা যার], বিবিধ [বি অর্থাৎ বহু বিধা অর্থাৎ প্রকার যার], অপরূপ [অপ অর্থাৎ বিচিত্র], ছিন্নমূল, স্থিতধী, বিগত-যৌবন, স্বচ্ছসলিলা, কুবের [কু অর্থাৎ কুৎসিত বের অর্থাৎ দেহ যার], দ্বারলগ্ন কর্ণ যার=দ্বারলগ্নকর্ণ, নীলবসনা, নীলনয়না, প্রসন্ন-সলিলা, রক্ত-আঁখি, শ্যামাঙ্গী, লাল-পেড়ে, শান্তস্বভাব, মধ্যবয়সী, দশানন, দীর্ঘকায়, কৃতার্থ, নতশির, উচ্চশির, সিদ্ধকাম, সিদ্ধহস্ত, পঞ্চানন, ত্রিলোচন,  বদমেজাজী, খোসমেজাজী, কালোবরণ, অকৃতকার্য, সুধী, করিতকর্মা, তীক্ষ্ণবুদ্ধি, ছন্নমতি, কদাকার, [কু স্থানে ‘ক’ আদেশ], স্বল্পায়ু, বিধর্মী, লব্ধ-প্রতিষ্ঠ, সমবয়সী, দীর্ঘদেহী, নজপৃষ্ঠ, দুর্ভাগা, একরোখা, একগুঁয়ে, দোমনা, সর্বস্বান্ত [সর্বস্ব অন্ত যার], কালোপেড়ে। সমানাধিকার বহুব্রীহি সমাসে কখনও কখনও বিশেষ্য পদটি পূর্বে এবং বিশেষণ পদটি পরে বসে। যেমন: পেটমোটা, রাশভারি, বিলাসপ্রিয়, ভূষণ-প্রিয়া।

অনেক সময় সমানাধিকরণ বহুব্রীহি সমাসে পূর্বপদটি বিশেষ্য হয়েও বিশেষণ-স্থানীয়রূপে ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন: শশী ভূষণ যার=শশিভূষণ; ফণী ভূষণ যার=ফণিভূষণ; অহি ভূষণ যার=অহিভূষণ; কৃত্তি (বাঘের ছাল) বাস যার=কৃত্তিবাস; ভূতগণের নাথ যিনি=ভূতনাথ। মেঘ বাহন যার=মেঘবাহন; নদী মাতা যার=নদীমাতৃক; বিশ্ব মিত্র যাঁর=বিশ্বামিত্র। তেমনি— দিগম্বর, কৃষিমাতৃক [কৃষি মাতা যার], দিগ্বসনা, বিভূতিভূষণ, পদ্মাসনা, গাণ্ডীবধন্বা, পুষ্পধনু।

স্মরণীয়: ঈ-কারান্ত পুংলিঙ্গ শব্দ পূর্বপদ হলে সমাসবদ্ধ পদটিতে ঈ-কার ই-কার হয়। যেমন: শশী ভূষণ যার=শশিভূষণ; ফণী ভূষণ যার=ফণিভূষণ ইত্যাদি। এখানে ‘শশী’ ও ‘ফণী’ শব্দ দুটি ঈ-কারান্ত পুংলিঙ্গ শব্দ; এবং শব্দ দুটি দুটি ব্যাসবাক্যেরই পূর্বপদ হয়েছে। সমস্ত বা সমাসবদ্ধ পদ দুটিতে ‘শশী’ ও ‘ফণী’ শব্দ দুটির অন্তিম ঈ-কার ই-কারে পরিণত হওয়ায় শব্দ দুটির রূপ হয়েছে যথাক্রমে ‘শশিভূষণ’ ও ‘ফণিভূষণ’। তেমনি, শশী শেখার যার=শশিশেখর।

৫.খ. ব্যধিকরণ বহুব্রীহি

যে বহুব্রীহি সমাসে উভয় পদই বিশেষ্য, কিন্তু তাদের মধ্যে একটি পদ অধিকরণ কারকের বিভক্তিযুক্ত, তাকে ব্যধিকরণ বহুব্রীহি সমাস বলা হয়। যেমন: চন্দ্র শেখরে যার=চন্দ্রশেখর। এখানে পূর্বপদ ‘চন্দ্র’, পরপদ ‘শেখর’—উভয় পদই বিশেষ্য; কিন্তু পরপদে অধিকরণ কারকের চিহ্ন ‘এ’ যুক্ত এবং সমস্তপদে চন্দ্রশেখর ‘শিব’কে বোঝাচ্ছে। দৃষ্টান্তটি ব্যধিকরণ বহুব্রীহি সমাসের। তেমনি—খড়্গ হস্তে যার=খড়্গহস্ত; শূল পাণিতে যার=শূলপাণি; বীণা পাণিতে যার=বীণাপাণি; পদ্ম নাভিতে যার =পদ্মনাভ; ডম্বরু পাণিতে যার=উম্বরুপাণি; নীল কণ্ঠে যার=নীলকণ্ঠ ইত্যাদি। তেমনি—রত্নগর্ভা, মকরচূড়, চন্দ্রচূড়, শ্ৰীকণ্ঠ, শ্রীনিবাস, বজ্ৰপাণি, অস্ত্রপাণি, শশিশেখর, শশাঙ্ক, ঊর্ণনাভ [উর্ণ নাভিতে যার], আশীবিষ (আশীতে অর্থাৎ দাতে বিষ যার], ক্ষণজন্মা, পাপমতি, অন্যমনস্ক, অন্যমনা, কৃদন্ত, হিরণ্যগর্ভ, পিনাকপাণি, ধর্মবুদ্ধি, বিয়োগান্ত, সত্যসন্ধ, ণিজন্ত, সূর্যমুখী, উদগ্রীব, ধূমকেতু।

৫.গ. ব্যতিহার বহুব্রীহি

পরস্পর-সাপেক্ষ ক্রিয়া বা পরস্পর ক্রিয়া-বিনিময় বোঝাতে যে বহুব্রীহি সমাসে একই পদ দ্বিত্ব হয়ে পূর্বপদ ও পরপদরূপে বসে, তাকে ব্যতিহার বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন: লাঠিতে লাঠিতে যে যুদ্ধ= লাঠালাঠি; কানে কানে যে কথা=কানাকানি; ঘুষিতে ঘুষিতে যে যুদ্ধ=ঘুষাঘুষি। হাতে হাতে যে যুদ্ধ=হাতাহাতি, কোলে কোলে যে মিল =কোলাকুলি। তেমনি— ঝুললাঝুলি, গলাগলি, টানাটানি, মুখোমুখি, দলাদলি, গালাগালি, কেশাকেশি, চুলোচুলি, মারামারি, ধস্তাধস্তি, হাঁকাহাঁকি, বকাবকি, কষাকষি, রক্তারক্তি, রেষারেষি, ভাগাভাগি, দেখাদেখি, নখানখি, হানাহানি, চোখাচোখি, তর্কাতর্কি, ফাটাফাটি, খুনাখুনি, কড়াকড়ি, গুঁতাগুঁতি, ঘেষাঘেষি।

৫.ঘ. মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি

যে বহুব্রীহি সমাসে ব্যাসবাক্যের ব্যাখ্যানমূলক মধ্যবর্তী পদটির লোপ হয়, তাকে মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি সমাস বলা হয়। যেমন: পাপপূর্ণ আত্মা যার=পাপাত্মা। পূর্বপদ উপমাত্মক হলেও মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি বা উপমান-পূর্বপদ বহুব্রীহি বা উপমাত্মক বহুব্রীহি বলা হয়। যেমন: মৃগের নয়নের মতো নয়ন যার=মৃগনয়না। এখানে ব্যাসবাক্যের উপমাত্মক ব্যাখ্যানমূলক পদটির লোপ হয়েছে। কাজেই, এই দৃষ্টান্তটি মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি বা উপমান-পূর্বপদ বহুব্রীহি বা উপমাত্মক বহুব্রীহি সমাসের। স্বর্ণের আভার মতো আভা যার=স্বর্ণাভ; চন্দ্রের মতো বদন যার=চন্দ্রবদনা; এণ’র অক্ষির মতো অক্ষি যার=এণাক্ষী; মীনের অক্ষির [বা মীনের ] মতো অক্ষি যার=মীনাক্ষী; খঞ্জনের নয়নের [বা খঞ্জনের] মতো নয়ন যার=খঞ্জন-নয়না ইত্যাদি। তেমনি— পদ্মমুখী, বিড়ালাক্ষী, বিধুমুখী, কপোতাক্ষ, কমলাক্ষ, বিম্বাধরা, কস্তুকণ্ঠ, ক্ষুরধার, শ্বাপদ [শ্ব অর্থাৎ কুকুরের মতো পদ  যার], পদ্মগন্ধী, কুম্ভকর্ণ, শূর্পনখা, কর্ণামৃত [কর্ণে অমৃতের মতো যা], মেঘবরণ, তড়িত্বরণী, হরিনয়নী, গোমড়ামুখো, ডাকাবুকো [ডাকের বুকের মতো বুক যার]।

৫.ঙ. অলুক বহুব্রীহি

যে বহুব্রীহি সমাসে বিভক্তির লোপ হয় না, তাকে অলুক বহুব্রীহি সমার্স বলা হয়। যেমন: গায়ে হলুদ দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে=গায়ে-হলুদ। এখানে ‘গায়ে’ শব্দের ‘এ’ বিভক্তি সমস্তপদে লুপ্ত হয়নি। কাজেই, এটি অলুক বহুব্রীহি সমাসের দৃষ্টান্ত। মতান্তরে, এটি অনুষ্ঠানবাচক বহুব্রীহিও। হাতে খড়ি দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে=হাতেখড়ি; মুখে ভাত দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে=মুখেভাত, হরির উদ্দেশে লুট দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে=হরির লুট।

৫.চ. নঞর্থক বহুব্রীহি

যে বহুব্রীহি সমাসে পূর্বপদ নঞর্থক বা নিষেধাৰ্থক অব্যয়, তাকে নঞর্থক বহুব্রীহি সমাস বলা হয়। যেমন: নেই ভুল যাতে=নির্ভুল। এখানে পূর্বপদ নঞর্থক বা নিষেধাৰ্থক অব্যয় এবং সেই অব্যয়ের অর্থ বা পরপদের অর্থ প্রধান না হয়ে তৃতীয় একটি পদের অর্থ [নির্ভুল উত্তর] প্রধানরূপে প্রতীয়মান হচ্ছে। কাজেই, দৃষ্টান্তটি নর্থক বহুব্রীহি সমাসের। তেমনি—নেই পরোয়া যার=বেপরোয়া; নেই নাড়ীজ্ঞান যার=আনাড়ী; নেই ইমান যার=বেইমান; নেই জল যাতে=নির্জলা; নেই থই (জলতলের স্থল) যার=অথই। তেমনি— অবুঝ, নির্বোধ, নিরহঙ্কার, নিরপরাধ, বেকার, বেইজ্জত, নির্ভীক, নির্ধন, | বেহায়া [নেই হায়া অর্থাৎ লজ্জা যার], অজ্ঞান, অনাদি, নিরুপায়, নির্বাক, নিস্পাপ, নিস্তরঙ্গ, নির্মল, নিরুপদ্রব, নিরুপমা, নিঃসহায়, বেহুশ, বেসুরো, নিষ্কলুষ, নীরব, অপয়া [নেই পয় যার], নির্লজ্জ, নিরপেক্ষ, অসীম, অপদার্থ, নিঃশঙ্ক, অতল, নির্দয়, নির্মম [ নেই মমতা যার], বেতার, অমায়িক [নেই মায়া যার], বেয়াদপ, নীর, নিশ্চিন্ত, নীরস, বেকসুর, নির্দোষ, অপুত্রক।

৫.ছ. সহাৰ্থক বহুব্রীহি

সহাৰ্থক পদের সঙ্গে বিশেষ্য পদের যে বহুব্রীহি সমাস হয়, তাকে সহাৰ্থক বহুব্রীহি সমাস বলা হয়। যেমন: সস্ত্রীক [স্ত্রীর সঙ্গে বর্তমান], সপত্নীক, সপুত্র, সবান্ধব, সশিষ্য, সপরিবার, সযত্ন, সাবধান [অবধানের সঙ্গে বর্তমান], সাদর, সপ্রীতি, সবিনয়, সশ্রদ্ধ, সস্নেহ, সাড়ম্বর, সোৎসাহ, সদর্প, সাহংকার, সফল, সার্থক, সজল, সকরুণ, সাকার, সাগ্নিক, সকৌতুক, সলজ্জ, সসংকোচ, সনাথ, সবল, সতর্ক, সতেজ, সসাগরা, সবিরাম, সশস্ত্র, সশঙ্ক, সভয়, সক্রিয়, সদয়, সহর্ষ, সবাক, সধবা, সাবলীল, সফল, সসম্মান, সহৃদয়, সগোত্র, সত্বর, সশব্দ, সক্রিয়, সলীল, সতীর্থ [সমান বা একই তীর্থ বা গুরু যার], সপত্নী [সমান বা একই পতি যার], সখেদ, সবেগ, সমান [মানের সঙ্গে বর্তমান], সভক্তি, সজোর, সহিত, সভা, সকল, সশরীর, সার্ধ [অর্ধের সঙ্গে বর্তমান]।

বহুব্রীহি সমাসের অতিরিক্ত দৃষ্টান্ত: মৃতভর্তৃকা, বিপত্নীক [বিগত হয়েছে পত্নী যার), প্রোষিতপত্নীক, বিধবা [বিগত হয়েছে ধব অর্থাৎ স্বামী যার], বিয়োগান্ত, মিলনান্ত, সমকক্ষ, কান্যকুব্জ, অষ্টাবক্র, কৃষিপ্রধান, জনবিরল, রূপবাণী, প্রাপ্তবয়স্ক, বহুসংখ্যক, অন্তরীপ, দুরাচার, দ্বীপ, দেশবন্ধু, সোদর, সহোদর, অবাক, অদ্বিতীয়া, সমবয়সী, অল্পবয়স্ক, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, বীতশ্রদ্ধ, দ্বিরদ [রদ=দাঁত]।

বহুব্রীহি সমাসের কতকগুলি স্মরণীয় নিয়ম

১. ‘সহ’ শব্দের স্থানে ‘স’ হয়: বাক্যের সঙ্গে বর্তমান=সবাক। স্ত্রীর সঙ্গে বর্তমান=সস্ত্রীক। সহ [সমান] উদর যার=সোদর বা সহোদর; অঙ্গের সঙ্গে বর্তমান=সাঙ্গ।

২. ‘অক্ষি’ শব্দের স্থানে ‘অক্ষ’, ‘ধনুস্’ শব্দের স্থানে ‘ধন্বন্’ [ধ] এবং ‘নাভি’ শব্দের স্থানে ‘নাভ’ হয়। যেমন: বিশালাক্ষ, কমলাক্ষ, করঞ্জাক্ষ, গাণ্ডীবধ, ঊর্ণনাভ ইত্যাদি।

৩. ঈ-কারান্ত শব্দের উত্তর, নিত্য স্ত্রীলিঙ্গ শব্দের উত্তর এবং ‘উরস্’ শব্দের উত্তর ‘ক’ হয়। যেমন: নদীমাতৃক, সস্ত্রীক, বিশাল-উরস্ক ইত্যাদি।

৪. কতকগুলি শব্দের উত্তর বিকল্পে ‘ক’ হয়। যেমন: অল্পবয়স্ক, প্রাপ্তবয়স্ক, নিরর্থক, বহুসংখ্যক ইত্যাদি।

৫. ‘ধর্ম’ শব্দের উত্তর ‘অন’ [আ] হয়। যেমন: সমান ধর্ম যার =সমানধর্মা বা সধর্মা। তেমনি: বিধৰ্মা [বিধর্মী—বিকল্পে], সুধর্মা।

৬ ‘গন্ধ’ শব্দের উত্তর বিশেষ অর্থে ‘ই’ হয়। যেমন: স [ শোভন] গন্ধ যাহার=সুগন্ধি। তেমনি: পদ্মগন্ধি, চন্দনগন্ধি।

৭. ‘সম্’, ‘দ্বি’, ‘অন্তর’ শব্দের পর ‘অপ’ ‘ঈপ’ হয়। যেমন: সমীপ, দ্বীপ, অন্তরীপ।

বিশিষ্ট প্রয়োগ: ‘পুণ্যশ্লোক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম জানে না, এমন বাঙালী ক’জন আছে।’ ‘কোমলতাই নদীমাতৃক বাংলাদেশের স্বভাব-ধর্ম।’ ‘আজ বাঙালী মধ্যবিত্ত-সমাজ চরম অবক্ষয়ের সম্মুখীন।’ ‘আমার আকাঙ্ক্ষা কি চরিতার্থ হবে না?’ ‘ঠাকুর পরিবারের সকল সন্তানই ছিলেন কৃতবিদ্য, খ্যাতিমান।’ ‘তার মতো হতভাগ্য এ পৃথিবীতে আর কেউ নাই।’ ‘পল্লী বাংলা আজ দীনা, মলিনা, বিগত-শ্রী।’ ‘বর্ধমানের মিহিদানা বিখ্যাত।’ ‘বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান বহু মারণাস্ত্রের আবিষ্ক্রিয়ায় আজ সিদ্ধকাম।’ ‘সুভাষচন্দ্রের পিতা জানকীনাথ ছিলেন কটকের লব্ধ-প্রতিষ্ঠ আইন ব্যবসায়ী।’ ‘ভারত আজ তার সমস্ত কিছু হারিয়ে একেবারে সর্বস্বান্ত।’ ‘আয় রে পাখি লেজঝোলা।’ ‘কৃত্তিবাস কীর্তিবাস কবি।’ ‘নীলকণ্ঠ করেছেন পৃথ্বীরে নির্বিষ। কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে কভু আশীবিষে দংশেনি যারে?’ নেতাজী সুভাষচন্দ্র ছিলেন ক্ষণজন্মা মহানায়ক। ‘মাল-চেনাচেনি, দর-জানাজানি, কানাকড়ি নিয়ে কত টানাটানি, হানাহানি করে কেউ নিল ভরে, কেউ গেল খালি ফিরে।’ ‘লাগিবে না তাহে বাহুবল কিবা জাগিবে না দ্বেষাদ্বেষি।’ ‘বিড়ালাক্ষী বিধুমুখী মুখে গন্ধ ছুটে।’ ‘কিংবা বিম্বাধরা রমা অম্বুরাশি-তলে।’ ‘তার, মতো বেইমান, বেহায়া আর বেপরোয়া মানুষ আমি আর দেখিনি।’ ‘মেঘ প্রোষিতভর্তৃকা যক্ষপ্রিয়ার কাছে বিরহের বাণী বহন করে নিয়ে গিয়েছিল।’

৬. দ্বিগু সমাস

দ্বিগু সমাসও তৎপুরুষ সমাসেরই প্রকারভেদ মাত্র।

যে তৎপুরুষ সমাসের পূর্বপদে সংখ্যাবাচক বিশেষণ বসে সমাহার বা সমষ্টি বোঝায় এবং পরপদের অর্থ প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয়, তাকে দ্বিগু সমাস বলা হয়। দ্বিগু সমাসেও তৎপুরুষ সমাসের মতো পরপদেরই প্রাধান্য। যেমন: পঞ্চ বটের সমাহার=পঞ্চবটী। ‘পঞ্চ’—এই পূর্বপদটি সংখ্যাবাচক বিশেষণ। এর দ্বারা সমাহার বা সমষ্টি বোঝাচ্ছে এবং ‘বট’ এই পরপদের অর্থ প্রধানরূপে প্রতীয়মান হচ্ছে। অতএব এই দৃষ্টান্তটি সমাহার দ্বিগু সমাসের। তেমনি— সপ্ত অহের সমাহার=সপ্তাহ; শত অব্দের সমাহার=শতাব্দ, শতাব্দী; নব রত্নের সমাহার=নবরত্ন; পঞ্চ নদের নদীর সমাহার=পঞ্চনদ [পঞ্চনদী]; তিন [তে] প্রান্তরের [পান্তর] সমাহার=তেপান্তর। তেমনি— ত্রিকোণ, ত্রিজগৎ, ত্রিফলা, চতুষ্পদ, পঞ্চভূত, দ্বিপ্রহর, ত্রিসন্ধ্যা, ত্রিযামা, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, পঞ্চরাত্রি, পঞ্চদুর্গা, নবদুর্গা, সপ্তর্ষি, ত্রিবেণী, দশচক্র, ত্রিচক্র [যান], ত্রিভুবন, চতুষ্পর্ণা, পঞ্চপ্রদীপ, বারমাস্যা [বারমাসী], চৌপদী, ষড়রিপ, ষড়যন্ত্র, অষ্টধাতু, পঞ্চামৃত, পঞ্জাব, ষড়ঋতু, ষটপদী, অষ্টবসু, নবগ্রহ, চতুরঙ্গ, সপ্তসিন্ধু, দশদিগন্ত, চতুর্দশপদী, ত্রিমূর্তি, সপ্তরথী, শতবার্ষিকী, অষ্টাঙ্গ, ষোড়শোপচার। অতিরিক্ত বাংলা দৃষ্টান্ত: পাঁচকড়ি, তিনকড়ি, সাতকড়ি, সাতঘাট, পাঁচসালা, দশশালা, তেমাথা, চৌমাথা, চৌরঙ্গী, চৌরাস্তা, তেপায়া, পাঁচফোড়ন, দুয়ানি, দুবেলা, দোচালা, দোপাটা, দুপুর, ত্রিতাল, চৌতাল, চৌদিক, চৌপর, চারতলা, চারদিক, চৌপায়া, সাতসমুদ্র, তেরনদী, তে-মোহনা, তে-রাত্তির, সেতার, দোতারা, দোয়াব, দোটানা, দোনলা, দোহারা, সাতকাণ্ড, সাতখুন, সাতনরী, দুকূল।

বিশিষ্ট প্রয়োগ: ‘মোদের মাঝে মুক্তি কাঁদে বিংশ শতাব্দীর।’ ‘আমি যদি জন্ম নিতে কালিদাসের কালে, দৈবে হতেম দশম রত্ন নবরত্নের মালে।’ ‘পঞ্চনদীর তীরে বেণী পাকাইয়া শিরে দেখিতে দেখিতে গুরুর মন্ত্রে জাগিয়া উঠিল শিখ।’ ‘যামিনী ত্রিযামা; আকাশে দৈববাণী শ্রুত হল। ‘দশচক্রে ভগবান ভূত।’ ‘আমাদের সেনা যুদ্ধ করেছে সজ্জিত চতুরঙ্গে।’ ‘সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত মাতাও যে ঝংকারে।’ ‘১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্র-জন্ম-শতবার্ষিকী অনুষ্ঠিত হয়।’ ‘কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সপ্তরথী বালক অভিমন্যুকে বধ করে ক্ষাত্রবীর্যকে কলঙ্কিত করেছিল।’ ‘ছোট-রানীর গলায় ছিল সাতনরী হার।’ ‘হাটের দোচালা মুদিল নয়ান।’ ‘পিরাণ দোপাটা দিতে করে টানাটানি।’ ‘কটিতে ছিল নীল দুকূল মালতী-মালা মাথে।’ ‘শ্মশানের বুকে আমরা রোপণ করেছি পঞ্চবটী।’

সমাসান্ত প্রত্যয়

সমাস সংঘটিত হবার পর সমস্তপদে সমাসেরই অঙ্গ হিসাবে যে প্রত্যয়

অর্থের কোনরূপ রূপান্তর সাধন না করে তদ্ধিতের মতো যুক্ত হয়, তাকে সমাসান্ত প্রত্যয় বলে। যেমন: পথের রাজা=রাজপথ (অ); এক-রোখা (আ); সুগন্ধি (ই); শত অব্দেরসমাহার=শতাব্দী (ঈ); ঘরের অভাব যার=হা-ঘরে (এ); ঘরের দিকে মুখ যার=ঘরমুখো (ও); বিপত্নীক (ক)।

নিত্য সমাস

যে সমাসে সমস্যমান পদগুলির দ্বারা ব্যাসবাক্য হয় না, ব্যাসবাক্য গঠনের জন্যে অন্য পদের প্রয়োজন হয়, তাকে নিত্য সমাস বলে। যেমন: অন্য ভাষা=ভাষান্তর। অন্য মনু=মন্বন্তর। অন্য গতি=গত্যন্তর। অন্য গ্রাম=গ্রামান্তর। তেম—স্থানান্তর, দেশান্তর, উপায়ান্তর, দিগন্তর, মাসান্তর, ধর্মান্তর, দিনান্তর, দৃশ্যান্তর, লোকান্তর, জন্মান্তর, পাঠান্তর, প্রকারান্তর, বারান্তর, যুগান্তর, ভাবান্তর, মতান্তর, প্রসঙ্গান্তর, বিষয়ান্তর, জলমাত্র, দর্শনমাত্র, দেখামাত্র, নামমাত্র কেবল নাম ইত্যাদি।

অলুক তৎপুরুষ: যে সমাসে পূর্বপদের বিভক্তির লোপ হয় না, তাকে অলুক সমাস বলে। যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদের বিভক্তির লোপ হয় না, তাকে অলুক তৎপুরুষ সমাস বলা হয়। প্রায় সকল প্রকার তৎপুরুষ সমাসেই অলুক তৎপুরুষ হয়ে থাকে। যেমন: করণ-তৎপুরুষ—হাত দিয়ে কাটা=হাতে-কাটা, তেল দিয়ে ভাজা=তেলে-ভাজা, মা। তেমনি—মেঘে-ঢাকা, ঘিয়ে-ভাজা, হাতে-গড়া, কলে-ঘঁটা, হাতে-পোঁতা, বাঁশে বাঁধা, চোখে-দেখা, বানের-জলে-ভেসে-আসা, সবার-পরশে-পবিত্র করা। নিমিত্ত-তৎপুরুষ—পরের নিমিত্ত পদ=পরস্মৈপদ। তেমনি—আত্মনেপদ, ভাতের-চাল, মুড়ির-চাল, জামার কাপড়, খেলার-মাঠ, পেটের-ভাত, ভুলের-মাশুল, ঘানির বলদ, চায়ের কাপ, চায়ের-দুধ, পড়ার-ঘর, খাবার-ঘর। অপাদান-তৎপুরুষ—সার থেকেও সার=সারাৎসার; পর থেকেও পর=পরাৎপর ; ঘানি থেকে [জাত] তেল=ঘানির-তেল। তেমনি— নেবুর তেল, কলের-জল, বাপের বেটা, পুকুরের মাছ, ক্ষেতের-ধান, বিদেশ-থেকে-আনা, আকাশ-থেকে পড়া, কাছ-থেকে-দেখা, নদী-থেকে-আনা, বন-থেকে-আনা। সম্বন্ধ-তৎপুরুষ—

ভ্রাতুঃ [ভ্রাতার] পুত্র=ভ্রাতুস্পুত্র। তেমনি—বাচস্পতি, বাপের-বাড়ি, মামার বাড়ি, গোরুর-গাড়ী, কলের-গান, ভাগের-মা, মাটির-মানুষ, সোনার বাংলা, মোমের-পুতুল, ভোরের-পাখি, রাজার-মেয়ে, পরের-মা, অনুরোধের আসর, গল্প-দাদুর-আসর। অধিকরণ-তৎপুরুষ=যুধি [যুদ্ধে] স্থির=যুধিষ্ঠির; সরসি [সরোবরে] জাত=সরসিজ; মন [মনে] জাত =মনসিজ: সোনায় সোহাগা=সোনায়-সোহাগা। তেমিন—খেচর, ঘরে-পাত কলেজে-পড়া, হাতে-গরম, অন্তেবাসী, অরণ্যে-রোদন, দিনে-ডাকাতি, অঙ্কে কাচা, গোড়ায় গলদ।

নিত্য সমাসের মতো অলুক সমাসও কোন স্বতন্ত্র সমাস নয়।

সমাসজনিত অর্থ-পার্থক্য

অনর্থ [সর্বনাশ]=নেই অর্থনঞ তৎপুরুষ; অনর্থক [বৃথা]=নেই অর্থ যাতে—নঞর্থক বহুব্রীহি। পূর্বাহ=অহনের পূর্ব [দিনের প্রথম অংশ]—ষষ্ঠী তৎপুরুষ; পূর্বাহপূর্ব যে অহ [পূর্ব দিন]—কর্মধারয়। পূর্বরাত্রি=রাত্রির পূর্ব [রাত্রির প্রথম অংশ]—সম্বন্ধ-তৎপুরুষ< পূর্বরাত্র=পূর্বা রাত্রি [গতরাত্রি]—কর্মধারয়। জামাতা-পুত্র=জামাতা ও পুত্র—দ্বন্দ্ব; জামাতৃপুত্র=জামাতার পুত্র—সম্বন্ধ-তৎপুরুষ। মহাশয়=মহৎ যে আশয় [অভিপ্রায়]—কর্মধারয়; মহাশয়=মহৎ আশয় যার—বহুব্রীহি। মহাধন=মহৎ ধন যার—বহুব্রীহি; মহদধন=মহৎ যে ধন—কর্মধারয়। মহৎপ্রাণ=মহৎ যে প্রাণ—কর্মধারয়; মহাপ্রাণ=মহান্ প্রাণ যার—বহুব্রীহি। কুপুরুষ=কু যে পুরুষ [শ্রীহীন] কর্মধারয়; কাপুরুষ=কু যে পুরুষ [ভীরু]—কর্মধারয়। সপত্নী=সমান পতি যাদের—বহুব্রীহি; স্বপত্নী—স্বর [নিজের পত্নী]—সম্বন্ধ-তৎপুরুষ; সপত্নীক=পত্নীর সঙ্গে বর্তমান—বহুব্রীহি। প্রিয়সখা=প্রিয় সখা যার— বহুব্রীহি; প্রিয়সখ=প্রিয় যে সখা—কর্মধারয়। ছিন্নশাখা=ছিন্ন শাখা যার [বৃক্ষ]—বহুব্রীহি; ছিন্নশাখ=ছিন্ন যে শাখা—কর্মধারয়। হীনবল=হীন বল যার—বহুব্রীহি; বলহীন=বলের দ্বারা হীন—করণ-তৎপুরুষ। সাক্ষর=অক্ষরের সঙ্গে বর্তমান [অক্ষরজ্ঞান আছে যার]=বহুব্রীহি; স্বাক্ষর=স্বর [নিজের] অক্ষর [সহি–]—সম্বন্ধ-তৎপুরুষ। সশঙ্ক=শঙ্কার সঙ্গে বর্তমান—ব্ৰহুব্রীহি; শশাঙ্ক=শশ অঙ্কে যার [চন্দ্র]—বহুব্রীহি। মাতৃপিতৃহীন=মাতার পিতার দ্বারা হীনকরণ—তৎপুরুষ। পিতৃমাতৃহীন= পিতার মাতার দ্বারা হীন—করণ তৎপুরুষ।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!