সনেট রচনায় শেক্সপীয়ারের কৃতিত্ব আলচনা করো।
শেক্সপীয়ার (১৫৬৪-১৬১৬)
শেক্সপীয়ার প্রথম জীবনে ‘ভেনাস আ্যাণ্ড এডনিস’, এবং ‘দি রেপ অফ লিউক্রিস’ নামক দুটি কাব্য রচনা করেন। এছাড়া সনেট রচনাতেই শেক্সপীয়ারের কবিকৃতিত্ব লক্ষ্যণীয়।
ইতালিতেই সনেট কাব্যরূপের জন্ম। তার প্রসার ঘটে ইউরোপের প্রায় সর্বত্র এবং ইউরোপের বাইরে প্রায় সর্বত্র। ইতালির শ্টেষ্ঠ সনেট রচয়িতা দান্তে ও পেত্রার্ক। ইংল্যান্ডে যারা সনেট রচনা করে খ্যাতিলাভ করেছেন তাঁদের মধ্যে শেক্সপীয়ার, মিলটন ও ওয়ার্ডওয়ার্থের নাম উল্লেখযোগ্য।
ষোড়শ শতকের শেষ দশকে ইংল্যান্ডে বিশেষভাবে প্রচলিত হয়েছিল যে সনেট তার প্রাণ প্রতিষ্ঠাও শেক্সপীয়ারে হাতে। ১৫৯০ থেকে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তার সনেটগুলি লিখিত হয়েছিল এবং এগুলি কবির নিজস্ব লিখিত ব্যক্তিগত দলিলরূপে তার বন্ধুমণ্ডলীর বলয়ের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে জনৈক প্রকাশক এগুলিকে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে। এই প্রকাশনার উৎসর্গপত্রে বলা হয়েছে— ‘‘The only begetter of these ensuing Sonnets”
শেক্সপীয়ারে মোট ১৫৪টি সনেটকে সাধারণত দু”টি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম থেকে ১২৬-তম সনেট পর্যন্ত প্রথম ভাগ যেগুলি কোন এক সুঠাম যুবা বন্ধুর উদ্দেশ্য রচিত। অবশিষ্ট ২৮টি এক রহস্যময়ী কৃষ্ণবরণ নারীর প্রতি সমর্পিত। যুবাবন্ধুর প্রতি কবির অনুরাগ, সংশয় ও ঈর্ষা লাঞ্ছিত কবি মনের ব্যাকুলতা, বিরহ ও মৃত্যু চিন্তার ছায়াপাত, অমর প্রেম ও বিধ্বংসী সময়ের ছন্দ, কৃষ্ণবর্ণার প্রতি অপ্রতিরোধা আকর্ষণ, প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য এক কবির প্রসঙ্গ—সব মিলিয়ে এক আকর্ষণীয় আত্মজৈবনিক, জীবন-নাট্যের খসড়া কাব্যরূপ যেন এই সনেটগুচ্ছ।
দান্তে ও পেত্রার্ক থেকে শুরু করে ‘সনেট’ নামক কাব্যরূপের এক অদ্বিতীয় বিষয় প্রেম। শেক্সপীয়ারে ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু শেক্সপীয়ারে প্রেমের চরিত্র ও চেহারা সম্পূর্ণ পৃথক। প্রেমিকা পরমেশ্বরীর উদ্দেশ্যে দূর থেকে এক তরফা প্রেমাঞ্জলি নিবেদন শেক্সপীয়ারে সনেটে নেই। সংশয়, সংকট আর আত্মজিজ্ঞাসার জটিল পথ ধরে তার সনেটে এসেছে প্রেমের আনাগোনা। এর পাশাপাশি স্থান পেয়েছে সময়ের ধ্বংস ও নিষ্ঠুরতার প্রসঙ্গ, মৃত্যু ও অমরত্বের প্রসঙ্গ, প্রকৃতি ইত্যাদি নানা বিষয়। আর এ সবের মধ্যে আভাসিত হয়েছে কবি ব্যক্তিত্বের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও অনুভব। নিছক কাব্যিক অনুশীলন না হয়ে শেক্সপীয়ারের সনেটগুচ্ছ হয়েছে এক সংবেদনশীল কবি মানসের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞান। আবার কখনো কখনো ব্যক্তিমনের স্তর অতিক্রম করে সনেটগুলি লাভ করেছে এক সামগ্রিক ও বিশ্বজনীন তাৎপর্য। সে কারণে শেক্সপীয়ারের সনেটগুচ্ছ তাঁর নাটকের মতই হয়ে উঠেছে সহৃদয় সংবেদ্য।
সনেটগুলি আলোচনার কালে কতকগুলি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। প্রথমেই মনে হয় এগুলি নিছক প্রথানুগ কিনা, অথবা এক লেখকের অন্তর্জীবনের কুহেলিকাচ্ছন ইতিহাস কিনা? তারপর মনে জাগে কবির উদ্দীষ্ট বন্ধু ও পৃষ্টপোষকের পরিচয় এতে রয়েছে কিনা? এই ব্যক্তি হয়ত আর্ল অফ সাউদাম্পটন। কৃষ্ণবর্ণা রমণী কে ছিলেন? মেরি ফিটন না অন্য কেউ? প্রতিদ্বন্দ্বি কবি কে? জনসন না চ্যাপম্যান? এসব জটিল প্রশ্নের গবেষণার উত্তর যাই হোক; আমাদের বিচার্য এই সনেটগুলি কবিতা হিসাবে কতদূর সার্থকতা লাভ করেছে।
উচ্চ বংশখ্যাত সুদর্শন যুবা বন্ধুর প্রতি অদম্য অনুরাগ প্রথম পর্বের সনেটগুলির বিষয়। দুই পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের এই নিবিড়তা নবজাগরণের যুগে ইংলন্ডে প্রেম তথা বন্ধুত্বের স্মারক, এই বন্ধু সৌন্দর্যের প্রশংসায়, তাকে অক্ষয় করে রাখার প্রতিশ্রুতিতে, তার চিন্তায় নিজেকে ভুলে যাওর়ার আনন্দে ঝলমল করেছে কবিতাগুলি। এরই.মাঝে কালো মেঘের মতো এসেছে কোনো এক প্রেয়সীকে কেন্দ্র করে ‘যুবাবন্ধুর’ সঙ্গে কবির মান অভিমানের পালা। এসেছে বার্ধক্য ও অকাল মৃত্যুর প্রসঙ্গ। তবু তার অবিসংবাদিত প্রেমকে চিরভাস্বর করে রাখার উদ্দেশ্যে নিরন্তর যুদ্ধ করে গেছেন সর্বগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে।
১ থেকে ১৪ নম্বর সনেট পর্যন্ত কবিতার সুদর্শন যুবাবন্ধুকে অনুরোধ করেছেন পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে তার সৌন্দর্যকে বাঁচিয়ে রাখতে। ১০ নম্বর সনেটের শেষ দুই পংক্তি এ বিষয়ে কবির উৎকষ্ঠাকে প্রকাশ করেছে—
Make thee another selt for love of me.
That beauty still may live in thine or thee.
১৫ নম্বর সনেটে কবির প্রথম সময়ের বিনানী শক্তির বিরদ্ধে যুবাবন্ধুর সৌন্দর্যকে তার কবিতায় চিরকালের করে রাখার সংকল্প ঘোষণা করলেন। জৈবিক প্রক্রিয়ায় উত্তরসূরীর জন্মদানে অমরত্ব সুনিশ্চিত হয় না। সে নিশ্চয়তা কেবলমাত্র কবিতায় সম্ভব, কারণ কবিতা সময়ের সকল চক্রান্তের নাগালের বাইরে । এ কথাই ব্যক্ত হয়েছে ১৮ নম্বর সনেটে।
সময় যখন চূড়ান্তভাবে মানব বিনাশী, তখন কবি সেই প্রেমকে বিনাশের প্রতিদ্বন্দ্বী এক অবিনশ্বর শক্তিরূপে চিহিত করেছেন। ২৯ নম্বর ও ৩০ নম্বর সনেটে সর্বশক্তিমান প্রেমের রূপটিকে জোরালো ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। প্রেম এখানে ধ্রুব আলোকবর্তিকার মতো। শেক্সপীয়ারের পূর্ব সনেটের ইতিহাসে প্রেমের এমন রূপ ব্যাখ্যা আমরা পাইনি।
১২৭ নম্বর সনেট থেকে শেষ পর্যন্ত কবিতাগুলি মূলত কৃষবর্ণা রনণীকে নিয়ে। এই রমণী সুন্দরী না হলেও তার আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য। কবি এই নারীর প্রতি আকৃষ্ট ও তার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। ১৪৭ নম্বর সনেটে শেক্সপীয়ার এই নারীর হাতে প্রতারিত হবার অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছেন এইভাবে—
I have sqorn thee, and thought thee bright,
Who art as black as hell, as dark as night.
আবেগের তীব্রতা, অনুভূতির নিজস্বতা ও বৈচিত্র্য, চিত্রকল্প তথা শব্দানুষঙ্গের স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য, কাব্য শৈলীর বিভিন্নতা ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নাটকের প্রসাদগুণ যা তাঁর সনেটকে দিয়েছে স্বতন্ত্র মর্যাদা।
শেক্সপীয়ারে সনেটের গঠন উল্লেখের দাবী রাখে। পেত্রার্ক প্রবর্তিত প্রথম আট পংক্তির অষ্টক এবং শেষ ছয় পংক্তির ষষ্টক, এই বিভাজন শেক্সপীয়ারে সনেটে নেই। তার পরিবর্তে তিনি চার পংক্তির তিনটি স্তবক ব্যবহার করেছেন এবং শেষে দুই পংক্তির মিল যুক্ত পদ ব্যবহার করেছেন। প্রথম তিনটি স্তবকে Quatrain এবং শেষ দুই পংক্তিকে Couplet। সামগ্রিক গঠন এই ধরনের ক খ ক খ, গ ঘ গ ঘ, ঙ চ ঙ চ, ছ ছ ছ ছ। অষ্টক ষটকের মধ্যেকার কিছুটা যান্ত্রিক ছেদের পরিবর্তে এই সাবলীলতা শেক্সপীয়ারে বিষয়বস্তুর পক্ষে অনেক বেশী সহায়ক হয়েছে। এছাড়া তরল ব্যঞ্জনধ্বনির ব্যবহার, পদ্যের মধ্য ও শেষে মিলের প্রয়োগ, ধ্বন্যাত্মক শব্দের ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে শেক্সপীয়ার ছন্দের সূক্ষ্ম আকর্ষণকে বাড়িয়ে দিয়েছেন।
বানার্ড শ’ দুঃখ করে বলেছিলেন যে, শেক্সপীয়ার যদি নাটক কিছু কম লিখে অন্তত একটা ভূমিকা রচনা করতেন তাহলে শেক্সপীয়ার মানুষটা কেমন ছিলেন, তাঁর জীবনবোধ, চেতনা ইত্যাদি কীরূপ ছিল তা আমরা জানতে পারতাম। এই ভ্রুকুটিকে অস্বীকার করে বলা যায় সনেটগুলির মধ্যে শেক্সপীয়ারে ব্যক্তিস্বরূপ যেন অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শেক্সপীয়ারে এক নৈর্ব্যক্তিক মহামানবের হৃদয় যেন উন্মোচিত হয়েছে এই সনেটগুচ্ছে। সেজন্যই ওয়ার্ডসওয়ার্থ শেক্সপীয়কে সচ্ছন্দে বলেছিলেন—
With this key
Shakespeare unlocked his heart.
সত্যই শেক্সপীয়ারে সনেট মুক্তোর মতো কোনটি অশ্রুতে সিক্ত, বেদনায় স্থির, দীপ্ত আর প্রণয়াবেগে রক্তিম।
শেক্সপীয়ারের সনেট ও বাংলা সনেট
বাংলা সনেটের প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং শ্রেষ্ঠশিল্পী নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মধুসূদন শেক্সপীয়ারকে রূপ বা বিষয়ব্সতুর দিক থেকে বিশেষ অনুসরণ করেননি। চতুর্দশপদী কবিতার মধ্যে কেবল অষ্টকের প্রথম চার পংক্তির ক্ষেত্রে শেক্সপীয়রীয় রীতিকে অনুসরণ করেছেন। কেবল ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতাটির ভাবের গভীরতা ও আন্তরিকতা শেক্সপীয়ারকে স্মরণ করায়। তবে শেক্সপীয়ারের প্রেম বর্ণনার আদর্শকে মধুসূদন ভেঙে দিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ শেক্সপীয়ার ও পেত্রার্ক কারো সনেট রীতিকে মানেননি। পুরাতন চৌদ্দ অক্ষরের পয়ারে তিনি অনেকটা অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবহমানতা এনেছেন। ‘নৈবেদ্য’ কাব্য তার প্রমাণ। ‘পূরবী’তে তিনি আঠারো হরফের সনেটও রচনা করেছেন। বলাবাহুল্য রবীন্দ্রনাথের হাতে সনেট উপভোগ্য হয়েছে।
রবীন্দ্রোত্তর যুগে প্রমথ চৌধুরী, মোহিতলাল মজুমদার, বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত নানাভাবে সনেটকে বিচিত্র ও সমৃদ্ধ করেছেন। এদের রচনায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে শেক্সপীয়ারে প্রভাব লক্ষ করা যায়।
তথ্যসূত্র:
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস | Download |
ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাস – শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় | Download |
ইংরেজি সাহিত্য পরিচয় – অরবিন্দ পোদ্দার | Download |
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস – কুন্তল চট্টোপাধ্যায় | Download |
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ও মূল্যায়ন – বিমলকৃষ্ণ সরকার | Download |
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস – অরুণ ভট্টাচার্য | Download |
Leave a Reply