মহাকবি জন মিলটনের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
মহাকবি জন মিলটন (১৬০৮-১৬৭৪)
ইংল্যান্ডে রানী প্রথম এলিজাবেথের রাজত্ব শেষ হয় ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু তাঁর রাজত্বকাল ইংরেজি সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থেকে যায়। দূরদর্শী ও সুকৌশলী শাসক রানী এলিজাবেথের পৃষ্ঠপোষকতায় তার আমলে উদ্ভব ঘটে স্পেন্সার, মার্লো, শেক্সপিয়ার, জনসন ও বেকনের মতো বহুমুখী প্রতিভার অধিকারীদের। রাণীর অনুগ্রহপুষ্ট হয়ে এবং কাজে স্বাধীনতা পেয়ে ইংরেজি সাহিত্যে নতুন নতুন চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণার উন্মেষ ঘটান এই গুণী প্রতিভাধর সাহিত্যিকগণ। যে নবজাগরণের ঝড় একদিন ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী ইতালীর বুক থেকে উত্থিত হয়ে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল, তা আটলান্টিক পেরিয়ে ইংল্যান্ডের বুকে এসে এক বাস্তব সত্ত্বায় পরিণত হয়। রাণী এলিজাবেথের শাসনকাল শেষ হলেও তাঁর আমলে প্রাপ্ত নতুন ধ্যান-ধারণার হাওয়া পালে লাগিয়েই ইংরেজি সাহিত্য জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেয়।
এলিজাবেথ পরবর্তী যুগের সাহিত্যিকদের মধ্যে সবচেয়ে সেরা বলা যায় জন মিলটনকে (১৬০৮-১৬৭৪)। কবি মানেই একটি যুগের সৃষ্টি। সুতরাং মিলটন মানেই একটি যুগ। ১৬০৮ সালের ৯ ডিসেম্বর লন্ডনের ব্রীড স্ট্রিটে জন্মগ্রহণ করেন মিলটন। বাবা সিনিয়র জন মিলটন ছিলেন উঁচুদরের কেরানী, তার কাজ ছিল দলিল দস্তাবেজ করা। প্রটেস্ট্যান্টিজম গ্রহণ করার কারণে নিজের ক্যাথলিক পিতা কর্তৃক ত্যাজ্য হয়ে লন্ডনে এসে বসতি গড়েছিলেন সিনিয়র মিলটন। মিলটনের মা সারাহ জেফরি ছিলেন পবিত্রতার মূর্ত রূপ।
মিলটনের শৈশবকাল আর পাঁচটা সাধারণ ছেলের মতো ছিল না। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন গম্ভীর প্রকৃতির আর চিন্তাশীল। পড়াশোনার দিকে ছিল তার প্রবল আসক্তি। যেকোনো পাঠের মধ্যে গভীরভাবে ডুব দিয়ে সেখান থেকে কিছু আয়ত্ব করার চেষ্টা করতেন তিনি। বারো বছর বয়সে তাকে দেখা যেতো গভীর রাত জেগে পড়াশোনা করতে। অর্থাৎ এক কথায় মিলটন ছিলেন পড়াপাগল ছেলে।
প্রথমে মিলটনকে সেইন্ট পল স্কুলে ভর্তি করা হয়। এখানে গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন তিনি। তার সাহিত্যকর্মেও গ্রীক ও ল্যাটিনের ক্ল্যাসিক্যাল ছাপ প্রবল। এরপরে কেম্ব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হন মিলটন এবং তারপর কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে। ১৬২৯ সালে কেম্ব্রিজ থেকে স্নাতক লাভ করেন তিনি। সে বছর কেম্ব্রিজের ২৪ জন স্নাতকের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। ১৬৩২ সালে স্নাতকোত্তর লাভ করার পর মিলটনকে কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটির ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কর্মভার গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু মিলটন সে প্রস্তাব গ্রহণ না করে হর্টনে পিতার কাছে চলে যান। উদ্দেশ্য চার্চের পাদ্রী হওয়া। ধর্ম নিয়ে তার অনুরাগ সহজেই অনুমেয়।
এই সময় মিলটন অনেক কবিতা রচনা করেছেন। যৌবনের স্বপ্নীল আবেশে ডুবে দু’চোখ ভরে দেখেছেন লন্ডনের পার্কে নতুন গজিয়ে ওঠা কুঁড়ির মতো তরুণী-তন্বীদের, দেখেছেন বসন্তের প্রগলভতাকে, দেখেছেন নববর্ষের প্রারম্ভে সূর্যালোকে ভরা ফসলকে, দেখেছেন মাটি আর মানুষকে। সুদর্শন মিলটন চাইলে তরুণীদের সাথে ফুর্তি করে, মদের পেয়ালায় রঙিন ক্ষণগুলোকে আরও রঙিনতর করে উপভোগ করতে পারতেন। কিন্তু তার চরিত্রের মন্দিরে কাম-কলুষতার অপদেবতার কোনো স্থান ছিল না। কাম-প্রবৃত্তিতে সিক্ত মানবজীবন তার কাছে কলুষিত মনে হতো। তাই তার রচনার মধ্যেও সস্তা প্রেমের অতিরঞ্জিত উচ্ছ্বাসের কোনো স্থান নেই। গুরু-গম্ভীর বিষয় নির্বাচন করে, মানবজীবনের গভীরতর সত্য অন্বেষায় তিনি ব্রতী হয়েছেন।
এই সময় দেশ ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে অর্জিত জ্ঞানকে পরিণত রুপদানের রেওয়াজ ছিল। মিলটনের মনে আকাঙ্খা ছিল স্বপ্নের দেশ রোম পরিভ্রমণের। ১৬৩৭ সালে মায়ের মৃত্যুর পর তার সাংসারিক বন্ধন আরও শিথিল হয়ে এলো। পিতার অনুমতি নিয়ে তাই বেরিয়ে পড়লেন দেশ ভ্রমণে। দেখলেন প্যারিস, জেনোয়া আর ফ্লোরেন্স। বহু খ্যাতনামা কবি ও সাহিত্যিকের সংস্পর্শে তিনি এলেন আর নিত্য নতুন জ্ঞানসুধা পান করতে থাকলেন।
ফ্লোরেন্স থেকে মিলটন গেলেন রোমে। ল্যাটিন ভাষা ভালোভাবেই আয়ত্ব ছিল তার। রোমে প্রবাসী জীবনের বেশিরভাগ সময় তার কাটে ভ্যাটিকান লাইব্রেরিতে বসে। ক্ল্যাসিক প্রীতি তার চেতনার জগৎকে উদ্ভাসিত করে রেখেছিল। রোমের অতীত সভ্যতা নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে আরও বেশি করে ক্ল্যাসিক সাহিত্যের প্রেমে পড়ে যান তিনি। মিলটন দেখা করেন গ্যালিলিওর সাথে। এই মহান বিজ্ঞানী প্রচলিত ধ্যান-ধারণার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে শুনিয়েছিলেন সত্যের বাণী, আর তাই হয়েছিলেন শাসক শ্রেণীর হাতে কারাবন্দী ও বিচার নামক প্রহসনের শিকার। মিলটনের পরবর্তী জীবনে এই মহতী বিজ্ঞানীর প্রভাব ছিল অপরিসীম। তার বিভিন্ন লেখায় তিনি বারবার গ্যালিলিওর প্রসঙ্গ টেনেছেন। ‘প্যারাডাইস লস্ট’-এ গ্যালিলিওর টেলিস্কোপের উপমা টেনেছেন মিলটন। এরপরে মিলটন নেপলস যান। সেখান থেকে সিসিলি যাবার কথা ছিল তার, কিন্তু ইংল্যান্ডে সে সময় রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে পিউরিটানদের সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে।
পিউরিটানরা ছিল মূলত প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মমতের অনুসারী। তারা চার্চ ও ক্যাথলিকদের ধর্মানুষ্ঠানের সংস্কার ও বিশুদ্ধিকরণ চেয়েছিল। গোঁড়া ক্যাথলিকদের দ্বারা পিউরিটানরা বরাবর অনাচারের শিকারা হতো। তৎকালীন রাজা প্রথম চার্লসও ছিলেন চার্চের শাসনে বিশ্বাসী। বলাই বাহুল্য, সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মূল উৎস হয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান চার্চ পরিণত হয়েছিল দুর্নীতির আখড়ায়। জাতির এই দুর্দিনে মিলটন দূরে থাকতে পারলেন না। ফিরে এলেন স্বদেশে। ১৬৪০ থেকে ১৬৬০ সাল পর্যন্ত, ২০ বছর মিলটন সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে একজন কট্টর বিপ্লবীর ভূমিকা পালন করেন। তার শক্তিশালী লেখনী এবং ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে তার মতামত সেদিন বিপ্লবের শক্তি যুগিয়েছিল। বিপ্লবের প্রচন্ডতায় শেষমেষ রাজশক্তি হার মানলো। রাজা চার্লসের জনসমক্ষে শিরচ্ছেদ করা হলো। ১৬৪৯ সালে রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে মিলটন ল্যাটিন সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত হলেন।
এই সময় মিলটনের জীবনে দুর্ভোগ নেমে এলো। তিনি দৃষ্টিশক্তি হারাতে বসলেন। অবশ্য ছোটবেলা থেকেই তার দৃষ্টিশক্তি একটু করে ক্ষীণ হয়ে আসছিল। চিকিৎসকরা তাকে অবিলম্বে সকল রকম পড়াশোনা ও লেখার কাজ থেকে বিরত হতে বললেন। কিন্তু সৃষ্টি যার রন্ধ্রে, তাকে ইন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধতায় থামায় সাধ্য কার! তিনি নিবৃত হলেন না। ১৬৫২ সালে দৃষ্টি হারিয়ে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেলেন মিলটন।
১৬৬০ সালে ক্রমওয়েলের মৃত্যুর পর প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের অবসান ঘটলো এবং রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। প্রথম চার্লসের পুত্র দ্বিতীয় চার্লস সিংহাসনে বসলেন। মিলটন হলেন পদচ্যুত। তার সমস্ত রচনা আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হলো। অন্ধত্বের জন্য রাজরোষ থেকে কোনোরকমে মুক্তি পেলেন তিনি। লন্ডনের অদূরে এক গ্রামের ছোট্ট কুটিরে পরিবার পরিজন নিয়ে আশ্র্য় নিলেন মিলটন।
দুর্যোগের কাছে আত্মসমর্পণ মিলটনের নীতি ছিল না। সৃষ্টি দিয়ে ধ্বংসের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবার সাহস তার ছিল। তাই অন্ধ অবস্থাতেই এক পর্ণকুটিরে বসে রচনা করলেন দুই কালজয়ী মহাকাব্য ‘প্যারাডাইস লস্ট’ আর ‘প্যারাডাইস রিগেইন্ড’। বৃদ্ধ, অন্ধ মিলটন মুখে বলে যেতেন, আর তার হয়ে লিপিবদ্ধ করতো তার কন্যা দিবোরা। তার অপর দুটি কন্যার অসহযোগিতা ও বিরুপ মনোভাব কবিকে ব্যাথিত করেছিল। ১৬৬৩ সালে ‘প্যারাডাইস লস্ট’ সমাপ্ত করলেন তিনি। ১৬৬৭ সালে প্রকাশিত হয়েই ইংল্যান্ডজুড়ে বিপুলভাবে সমাদৃত হলো এই মহাকাব্য আর আদৃত হলেন মিলটন নিজে। মহাকালের বিস্তৃত বক্ষপটে চিরকালের জন্য নিজের নাম লিখে দিলেন মিলটন।
মিলটনের সমগ্র রচনাগুলিকে মূলত তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করা যেতে পারে। যথা—
গদ্য রচনা
১৬৩৯ থেকে ১৬৬০-এর মধ্যবর্তী বছরগুলিতেই তাঁর সদ্য রচনাগুলির রচিত ও প্রকাশিত হয়েছিল। এই সময় মিলটন প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন তৎকালীন রাজনৈতিক তথা ধর্মীয় বিতর্ক ও সংঘাতের সঙ্গে, ব্যক্তিগত জীবনের কিছু প্রসঙ্গ ও সমকালীন বিতর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এই সময় থেকে রচিত হতে থাকে মিলটনের পুস্তিকাগুলি। সর্বমোট পঁচিশটি পুস্তিকা তিনি প্রণয়ন করেন, তার মধ্যে ইংরেজিতে একুশটি এবং অন্য চারটি লাতিল ভাষায়। তাঁর পুস্তিকা রচনার সূত্রপাত চার্চ সংক্রান্ত বিতর্কের সূত্র ধরে যোশেফ হলের বিরুদ্ধে কয়েকটি শানিত গদ্য রচনা প্রকাশ করেন। তারপর বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ম-নীতি প্রসঙ্গে বেশ কয়েকটি পুস্তিকা রচনা করেন। ‘Tractate of Education’, ‘Areo Pagitica’ নামক পুস্তিকা দুটি এই সময় রচিত। প্রথমটি শিক্ষা বিষয়ক, দ্বিতীয়টি মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক। প্রথম চার্লসের নিধনের পর মিলটন লিখেছিলেন ‘টেনিওর অব কিংস অ্যান্ড ম্যাজিস্ট্রেট’ (Tenure of Kings and Magistrate 1649) নামক একটি পুস্তিকা, ইত্যাদি। অবশ্য এইসব রচনাতে রসবোধ, কল্পনাশক্তি এবং সর্বোপরি সংযমের অভাব আছে।
কবিতা
কবি হিসেবে মিলটনের প্রস্তুতি পর্বের প্রথম ফসল ‘On the Morning of Christ’s Nativity’ নামক বহুখ্যাত ‘Ode’-টি বেথেলহেমের আস্তাবলে জাত জিশু খ্রিস্টের উদ্দেশ্যে প্রাচ্যের তিন জ্ঞানী ব্যক্তির মাত্রা বিবৃত হয়েছে এই কবিতায়। এর পরেই মিলটন রচনা করেন ‘On Shakespeare’ এবং ‘On arri Ning at the Age of Twenty three’ কবিতা দুটি। এর পরবর্তী রচনা ‘লালেগরো’ (L’Allegro) এবং ‘ইল পেনসেরোসো’ (It Penseroso) এই কবিতা দুটি। কবি মনের বিচিত্র সংবেদন, আবেগ ও অনুভূতির সূক্ষ্মতা যথাযথ চিত্রকল্পে বাণীরূপ লাভ করেছে এই যুগ্ম কবিতায়। ১৬৩৩-এ মিলটন রচনা করেন একটি সংক্ষিপ্ত গীতিকবিতা—‘আর্কেডস’ (Arcades) রাখালিয়া মুখোশ নৃত্যগীত-এর আদলে রচিত এই কবিতায় রয়েছে পরী ও মেষপালকদের গান। ‘কোমাস’ (Comus) একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রচনা, এটিও একটি রূপকধর্মী রাখালিয়া কবিতা। মিলটনের কেমব্রিজের সহপাঠী এডওয়ার্ড কিং-এর অকাল মৃত্যুতে ১৬৩৮-এ তিনি একটি শোকগাথার সংকলন প্রকাশ করেন। এই কবিতাগুলির মধ্যে ‘Lycidas’ বন্ধু বিয়োগ উপলক্ষ্যে রাখালিয়া ‘শোকগাথা’ (Pastoral Elegy)-র আকারে লিখিত। এছাড়াও আরও কয়েকটি ছোটো ছোটো কবিতা রচনা করে তিনি কবি প্রতিভার শীর্ষদেশে আরোহণ করেছিলেন।
মহাকাব্য
কেমব্রিজের ছাত্রাবস্থা থেকেই মিলটনের সর্বকালের স্মরণীয় একটি কাব্য, রচনার স্বপ্ন দেখেছিলেন। মহাকাব্যধর্মী এক মহৎ কাব্য রচনার স্বপ্ন। ইংলন্ডের ইতিহাস ও বাইবেল থেকে বিষয়বস্তুর সন্ধানে রত ছিলেন তিনি। অবশেষে ‘বাইবেল’ বর্ণিত মানুষের স্বর্গচ্যুত হওয়ার কাহিনি নির্বাচন করে তিনি রচনা করলেন ‘Paradise Lost’. ১৬৫৮ তে এই মহাকাব্য রচনার সূত্রপাত। যা দশটি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে প্রকাশিত হয় ১৬৬৭-তে। ঠিক এর সাত বছর পর ‘Paradise Lost’ পুনঃপ্রকাশিত হয় বারোটি খণ্ডে সংকলিত অবস্থায়। মানুষের পতনের কাহিনিই ‘প্যারাডাইস লস্টের’ জটিল রূপকল্পের কেন্দ্রবিন্দু। মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক সূত্র এবং খ্রিস্টের ভূমিকার তাৎপর্য মিলটনের রচনার মূল বিচার্য। ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী ও পরে নরকে পতিত শয়তান ও বিদ্রোহী দেবদূতগণ সামগ্রিক বিচারে গৌণ, তারা কেবলমাত্র আদম ও ইভের পতনের ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করেছে এবং শয়তান নয়, আদমই সমগ্র কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র। মূলত ঈশ্বরানুরাগী শুদ্ধবাদী মিলটন তো ঈশ্বরের কার্যাবলিকেই যথার্থ প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে Paradise Lost রচনা করেছিলেন।
১৬৭৬-এ একই বছরে প্রকাশিত হয় মিলটনের সর্বশেষ দুটি রচনা ‘প্যারাডাইস রিগেইন্ড’ (Paradise Regained) ও ‘স্যামসন অ্যাগোনিস্টিস’ (Samson Agonistes)। মিলটনের বন্ধু টমাস এলউড (Thomas Ellwood) প্যারাডাইস লস্টের পাণ্ডুলিপি পড়বার সময় বলেছিলেন “স্বর্গ থেকে অ্যাডাম এবং ঈভ নির্বাসিত হলেন। কিন্তু তাঁরা করে আবার স্বর্গে ফিরে যেতে পারবেন?” এই প্রশ্নের উত্তর প্যারাডাইস রিগেইল্ড, চারটি খণ্ডে এ কাব্যটি রচিত। মিলটনের বহুদিন থেকেই ইচ্ছা ছিল যে প্রাচীন গ্রিক কবিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি এমন একটি ট্র্যাজেডি রচনা করবেন যা গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো বাহুল্য বর্জিত এবং নিরাত্তরস হবে। গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো আগ্রি এবং সুর তিনি নিয়ে এলেন স্যামসন অ্যাগোনিসটিসে। গ্রিক সাহিত্যে সুপণ্ডিত মিলটন অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ ছিলেন। বাইবেল ছিল তার জীবনের ধ্রুবতারা। তিনি বাইবেল থেকে কল্পাংশটুকু গ্রহণ করে রেনেসাঁন্স যুগের গ্রিক সাহিত্যপ্রিয়তা এবং পিউরিটাস যুগের ধর্মভীরুতার এক অপূর্ব সমন্বয় সাধন করেছেন।
রাজার ভাই ডিউক জেমস এলেন বৃদ্ধ অন্ধ কবিকে দেখতে। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলেন, প্রথম চার্লসের বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করেছিলেন বলেই তার এই অন্ধত্ব ঈশ্বরের অভিশাপ কিনা। মিলটন জবাব দিলেন—“আমার উপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছে, তাকে যদি আপনি ঈশ্বরের অভিশাপ মনে করেন, তাহলে রাজার ভাগ্যকে আপনি কী বলে গণ্য করবেন?… আমি চোখ হারিয়েছি, রাজা হারিয়েছে মাথা।”
মিলটনের পারিবারিক জীবনও সুখকর ছিল না। নিজে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হলেও বিয়ে করেছিলেন এক রাজতন্ত্র সমর্থক ধনীর কন্যা মেরী পাওয়েলকে। মিলটনের বয়স তখন ৩৪ আর মেরী তার চেয়ে ১৮ বছরের ছোট। চঞ্চল, লঘু ও অগভীর প্রকৃতির মেরী হয়তো খাপ খাইয়ে উঠতে পারেননি মিলটনের সাথে। এক মাস পরেই তাই তিনি চলে গেলেন বাবার বাড়ি, আর ফিরে এলেন না। ফিরে এলেন তিন বছর পর, মিলটন যখন প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্রের অন্যতম কর্ণধার। কিন্তু নিজের স্বভাবগত কঠোরতা নিয়ে ঠিক মন থেকে ক্ষমা করতে পারেননি মিলটন তাকে। স্ত্রী তাকে চলে যাবার পর সেই সময়টায় মিলটন বিবাহ বিচ্ছেদ সম্বন্ধে দু’টি পুস্তিকা রচনা করেছিলেন। ‘The Doctrine and Discipline of Divorce’ এবং ‘The judgement of Martin Bucer, concerning divorce’। তিনি নিজ অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি মত প্রকাশ করেন যে, স্বামী-স্ত্রীর মানসিক রুচি যদি ভিন্নতর ও পরস্পরবিরোধী হয় তাহলে সেখানে বিবাহ বিচ্ছেদ একান্ত প্রয়োজন।
১৬৫২ সালে মেরী মারা যান। ১৬৫৬ সালে মিলটন এক প্রজাতন্ত্র সমর্থকের কন্যা ক্যাথরিন উডকে বিয়ে করেন। কিন্তু এক বছর না যেতেই তিনিও মারা যান। তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে মিলটন গ্রহণ করেন এলিজাবেথ মিনসেলকে। এলিজাবেথ তেমন উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না। তা সত্ত্বেও প্রয়োজন অনুযায়ী স্বামীর অনেক লেখা লিখে দিতেন। মিলটন তার শেষ রচনাটি এলিজাবেথকে উৎসর্গ করে যান।
১৬৭৪ সালের ৮ নভেম্বর মৃত্যুঞ্জয়ী কবি জন মিলটন পরপারে পাড়ি জমান। লন্ডনেই তিনি সমাহিত হন। বহু বছর পরে তার স্মৃতি রক্ষার্থে ওয়েস্টমিনিস্টারে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপিত হয়। দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে ভালো-খারাপ দু’রকম সময়ই কাটিয়েছেন মিলটন। কিন্তু কখনো সময়ের সাথে আপোষ করেননি। তার জীবন তিন পুরোটা বেঁচেছেন, অবিকৃত ও দ্বিধাহীনভাবে। তার রচিত মহাকাব্যের নিহিত উদ্দেশ্যের মতোই ঈশ্বরের কার্যবিধির ন্যায্যতা প্রতিপাদন করে নিজ জীবনকে এক মহাকাব্যিক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি। আর তাই মহাকালও তাকে ভোলেনি।
তথ্যসূত্র:
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস | Download |
ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাস – শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় | Download |
ইংরেজি সাহিত্য পরিচয় – অরবিন্দ পোদ্দার | Download |
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস – কুন্তল চট্টোপাধ্যায় | Download |
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ও মূল্যায়ন – বিমলকৃষ্ণ সরকার | Download |
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস – অরুণ ভট্টাচার্য | Download |
Leave a Reply