ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে মহাকবি বায়রনের অবদান আলোচনা কর।
মহাকবি লর্ড বায়রন (১৭৮৮-১৮২৪)
রোমান্টিক কবিদের মধ্যে জীবদ্দশায় সব থেকে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন লর্ড বায়রন (১৭৮৮-১৮২৪)। রোমান্টিক কবি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়েও তিনি ছিলেন স্বতন্ত্রপন্থী। তাঁর কবিপ্রতিভার স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ দুটি দিক হোল বাস্তবতাবোধ ও ব্যঙ্গাত্মক মনোভাব। অবশ্য রোমান্টিক কবিসুলভ প্রেম প্রবণতা ও নিসর্গচেতনা তার কাব্যে স্পষ্টভাবে মুদ্রিত। বায়রনের কাব্যে তাঁর আত্মপ্রক্ষেপ সহজেই লক্ষ্যণীয়। তাঁর আত্মস্বরূপ বিদ্রোহে বিক্ষোভে বিদীর্ণ। ফরাসী-বিপ্লব প্রভাবিত বিদ্রোহের সুর তাঁর কাব্যে। বায়রন মুক্তিকামী, স্বপ্নদ্রষ্টা, সমকালীন যুগের বিক্ষোভ বেদনার অন্তরালে অনাগত যুগের উজ্জ্বল চিত্র তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল মানুষের জয় হবে। ফরাসী বিপ্লবের পুরোহিত রুশোকে তিনি বন্দনা জানিয়েছেন এই কারণে যে বিপ্লবের পর মানুষের জয় হবে এই জেনে।
১৮০৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্য ‘আওয়ারস অব আইডড্লনেস’ (Hours of idleness)। একটি পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যের বিরুদ্ধে সমালোচনার উত্তরে কবি এক ব্যঙ্গ কাব্য রচনা করেন। এই কাব্যে তিনি পোপ ডাইড্রেনের আদর্শকে অনুসরণ করেন। এই কাব্যে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ ও শেলী প্রভৃতিকেও তিনি আক্রমণ করেন।
মাত্র বাইশ বৎসর বয়সে তিনি ‘চাইল্ড হ্যারল্ডস পিলগ্রিমেজ’ (Child Harold’s Pilgrimage) নামক কাব্য রচনা করেন এবং রাতারাতি খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেন। তাঁর নিজের ভাষায়— ‘‘I awoke one morning to find myself famous’’। ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি বেরিয়েছিলেন দেশভ্রমণে। ইউরোপ ও প্রাচ্যের অনেক দেশ ভ্রমণ করে মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যে ঐতিহাসিক কীর্তি প্রভৃতি দেখে তিনি যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন এই কাব্যটি তারই ফলশ্রুতি। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে ১ম ও ২য় সর্গ প্রকাশিত হয়, পর্তুগাল, স্পেন, গ্রীস ও আলবেনিয়ার কথা এই অংশে আছে। গ্রীসের অতীত গৌরব স্মরণ করে তার পরাধীনতার জন্য কবি দুঃখপ্রকাশ করেছেন। রচনাটিতে নায়কচরিত্র অনুভূতিপ্রবণ, সংবেদনশীল, সমাজদ্রোহী। সে সমাজ থেকে বিছিন্ন ও নিঃসঙ্গতায় বেদনপীড়িত। আসলে চাইল্ড হ্যারল্ডের মধ্যে বায়রনের ব্যক্তিগত মনোভাবই ব্যক্ত। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তৃতীয় সর্গের পটভূমি বেলজিয়াম রাইন নদীর তীর ও আল্পস পর্বত। প্রসঙ্গক্রমে স্পেনযুদ্ধ, নেপোলিয়ান, ওয়াটার্ল ও রুশোর স্মৃতি। চিত্রধর্মী প্রকৃতির কর্ণনা এই অংশের গৌরব বৃদ্ধি করেছে। ১৮১৮তে প্রকাশিত ৪র্থ সর্গে ইটালির গৌরবগাথা কীর্তিত। ভেনিস, ফ্লোরেন্স প্রভৃতি স্থানের সৌন্দর্যম্বরূপ ও সমুদ্রের ঐশ্বর্যরূপ এই অংশে অংকিত। বায়রন উদ্দাম স্বভাব, আবেগ চঞ্চল কবি। চলিষ্ণুতা, গতিশীলতা তাঁর মানসধর্ম। তাই সমুদ্রবর্ণনায় তিনি উচ্ছ্বসিত আবেগে বলে উঠেন ‘‘Roll on! ‘Thou deep and dark blue ocean roll’’। তৃতীয় সর্গ রচনার পূর্বে পত্নীর সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটে। ইংল্যাণ্ডের জনসাধারণ তাঁকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেন। কবি চিরকালের মত লণ্ডন ত্যাগ করেন। এই সর্গে তাই তার বেদনা যন্ত্রণার প্রকাশ তীব্র হয়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শেষ পর্যন্ত এনে দিয়েছে কবিচিত্তে প্রশান্তির স্বর্গলোক। চাইল্ড হ্যারল্ড আসলে বায়রনেরই প্রতিচ্ছবি। উদ্দাম কবি আত্মার বিক্ষুব্ধসত্তর তীর্থযাত্রা শুরু হয়েছে অজানাকে জানবার কৌতূহল নিয়ে। সংসারপীড়িত মানুষ যেন তীর্থযাত্রায় পায় শাক্তি। প্রকৃতির সৌন্দর্যলোকে কবির বিদ্রোহী চেতনা হয়েছে স্থিতধী। তীর্থযাত্রার শেষে যেমন মানুষ পায় পূর্ণতার পুণ্যস্পর্শ। তেমনি বায়রনও কাব্যের শেষাংশে স্নেহ ও প্রেমপ্রীতির স্নিগ্ধবারিসিঞ্চনে হয়েছেন আত্মতৃপ্ত। কবি স্বীকার করলেন— ‘‘That goodness is no name, and happiness no dream.’’
বায়রনের আর একটি উল্লেখযোগ্য কাব্য ‘ডনজুয়ান’ (Don Juan)। ব্যঙ্গাত্মক মহাকাব্য আখ্যা দেওয়া যেতে পারে এটিকে। ডনজুয়ান বীর প্রণয়ী। তাঁর দুঃসাহসিক কার্যকলাপ ও প্রণয়কাহিনী এই কাব্যের বর্ণিত বিষয়। অবৈধ প্রণয় থেকে জুয়ানকে রক্ষা করবার জন্য তার মা তাকে বিদেশে পাঠায়। সে দেখল প্রেমের মায়াজাল পাতা আছে সর্বত্র। গ্রীক দ্বীপে হেভি, কনস্তান্তিনোপলে সুলতানা, রাশিয়ায় ক্যাথরিন সবাই তাঁর সঙ্গে হৃদয় বিনিময় করতে চায়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে বায়রন কলুষিত প্রেমের উপরেই জোর দিয়েছেন বেশী এবং দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। তথাপি একনিষ্ট প্রেম তার কল্পনা-বহির্ভূত নয়। ইংল্যাণ্ডের সমাজকে ও আপন প্রতিপক্ষকে তিনি ব্যঙ্গের কশাঘাতে জর্জরিত করেছেন। অভিজাত সম্প্রদায়ের নীচতা ও শঠতার উপর তাঁর দৃষ্টি ছিল নিবদ্ধ। রোমান্স, এ্যাডভেঞ্চার, স্যাটায়ারের শাণিত দীপ্তি এই কাব্যে লক্ষ্যণীয়। নিসর্গ প্রীতি, আত্মগত ভাবমূর্চ্ছনা প্রভৃতি বায়রনের কবিপ্রতিভার অন্যদিকগুলিও এখানে বর্তমান। সেই সঙ্গে মিলেছে তাঁর স্বাতন্ত্রের দিক-বাস্তব চেতনা ও ব্যঙ্গপ্রবণ। ডন জুয়ানের রচনারীতিতে বায়রন অসাধারণ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। ছন্দটি যেমন আঁকা বাঁকা নদীর মত বয়ে চলেছে এবং প্রতি মুহূর্তে সেখানে বিদ্রুপ, লঘু কৌতুক, রোমান্স, কারুণ্যের তরঙ্গভঙ্গ। ছন্দটি নিঃসন্দেহে বিষয়ানুগ এবং ভাষারীতিও তাই। কথ্য ভাষার অকৃপণ প্রয়োগ বায়রনের রচনাভঙ্গির অভিনবত্ব।
বায়রনের ‘ইংলিশ বার্ডস অ্যাও স্কচ রিভিউয়ার্স’ (English Bards and Scotch Reviewers, ১৮০৯) – একটি অন্যতম ব্যঙ্গকাব্য। এডিনবরা রিভিয়ুতে প্রকাশিত বায়রনের ‘আওয়ারস অব আইডলনেস’ কবিতাকে ঘিরে তীব্র সমালোচনার উত্তরে এই ব্যঙ্গ কাব্যের জন্ম। এই ব্যঙ্গ কেবল পত্রিকার সম্পাদক জেফ্রিকে নয়, সেই সময়ের বিভিন্ন রোমান্টিক লেখক যেমন সাদী, স্কট, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ প্রভৃতির প্রতি।
‘এ ভিসন অব জাজমেন্ট’ (A vision of Judgement) এ আক্রমণের লক্ষ্য কবি সাদী (Southey)। সাদী বায়রনের ‘কেন’ (cain) নাটকের অত্যন্ত বিরূপ সমাললোচনা করেন। রাজকবি সাদী বায়রনের কাব্যের শয়তানী সকলের প্রধান পাণ্ডা হিসেবে অভিহিত করলে উত্তেজিত ও সদা বিদ্রোহী বায়রন প্রত্যুত্তরে এই ব্যঙ্গ কাব্য রচনা করে তথাকথিত মুখোশধারীদের ভণ্ডামিকে উন্মোচিত করেন অত্যন্ত নিপুণভাবে।
বায়রনের অন্যান্য রচনাগুলির মধ্যে ‘দি গিরয়’, ‘দি ল্যামেন্ট অফ ট্যাসো মাজেপ্পা’, ‘দি প্রিজনার অব শিলন’ প্রভৃতি কাব্য এবং ‘ম্যানফ্রেড’, ‘হেভেন অ্যাণ্ড আর্থ’ প্রভৃতি নাট্যকাব্য উল্লেখ্যযোগ্য।
বায়রনের কাব্য-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য
বায়রন নজরুলের মতোই বিদ্রোহী কবি। এই বিদ্রোহের মূলে ছিল মানবপ্রেম ও প্রকৃতি প্রেম। প্রেম, সুন্দর ও প্রকৃতির পূজারী বায়রন মানুষের স্বপ্ন দেখতেন। তিনি চণ্ডীদাসের মত মনে করতেন সবার উপর মানুষ সত্য। রবীন্দ্রনাথ যেমন- ‘সবুজের অভিযান’ (‘বলাকা’) কবিতায় ‘শিকলদেবীর পূজাবেদা’কে নস্যাৎ করতে চেয়েছিলেন, ‘বিসর্জন’ নাটকে প্রথাসংস্কার ও প্রেমের দ্বন্দ্বে প্রেমের জয় ঘোষণা করেছিলেন; তার বহু আগে বায়রনও তার যুগে বসে প্রাচীনজীর্ণ সংস্কারকে উৎপাটিত করতে চেয়েছিলেন। নজরুল যেমন ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় তাঁর সমকালীন রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, কাব্যনীতি প্রভৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রকাশ করেছিলেন, তেমনি বায়রন তাঁর অনেক পূর্বেই সমকালীন যুগজীবনকে দেখে শুনে তার প্রতি স্বাভাবিক কারণেই বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন।
বায়রনকে ব্যঙ্গের কবি বলা হয় এই কারণে যে, তিনি সমাজজীবনের ভণ্ডামিকে বঙ্গের কশাঘাতে ছিন্নভিন্ন করেছেন। তাই তার ব্যঙ্গ মর্মান্তিক, কারণ তার মধ্যে আছে জ্বালা, তা লক্ষ্যকে ছিন্নভিন্ন করে।
বায়রনের প্রতিভা মূলত গীতিকবির। প্রাণের আবেগে, আন্তরিক সরলতায় আপন মনে তিনি গান ধরেছিলেন। সেই অসাধারণ আবেগ গীতিকাব্যের আশ্রয়ে উচ্ছ্বসিত হয়েছে—
So we’ll go no more a-roving
So late into the night,
Though the heart be still as loving
and the moon be still as bright.
বায়রন ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমিক। তিনি জানতেন যুগের ও ব্যক্তিগত জ্বালা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে গেলে প্রকৃতির কোল হল নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। তাই প্রকৃতির হাত ছানি তাকে উতলা করেছে, অসীমের মধ্যে উন্মুক্ত বিশালতায় তিনি শান্তি খুঁজেছেন কবির বিক্ষুব্ধতা ও হৃদয় দ্বন্দ্ব শান্ত হয়েছে প্রকৃতির মধ্যে এখানেই তিনি যথার্থ রোমান্টিক কবি।
বায়রন ও বাংলা সাহিত্য
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অনেক কবি বায়রনের কোন কোন ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। কবি মধুসূদনকে হিন্দু কলেজের ছাত্ররা ইউরোপিয়ান বায়রন’ই বলতো। কবি নবীনচন্দ্রকেও ‘বাংলার বায়রন’ বলা হত। বায়রনের মত অসংযম উচ্ছ্বাস প্রবণতা ও আত্মম্ভরিতা নবীনচন্দ্রের মধ্যে ছিল, কিন্তু বায়রনের বাস্তবচেতনা ও ব্যঙ্গপ্রবণতা নবীনসেনের কাব্যে দুনিরীক্ষ। অবশ্য নবীনচন্দ্রের অবকাশঞ্জিনী’ বায়রনের প্রথম কাব্যগ্রন্থকে স্মরণ করায়। বিহারীলালের নিসর্গ সন্দর্শন’-এ বায়রনের ‘চাইল্ড হ্যারল্ডে’র সমুদ্র বর্ণনার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় পরবর্তীকালে নজরুলের মধ্যেও বায়রনীয় উদ্দামতা লক্ষ্য করা যায়, তবে নজরুলের নীতিচেতনা বায়রনের স্বভাবের অনেকটা পরিপন্থী। রোমান্টিক যুগে কবিগোষ্ঠীর মধ্যে বায়রন নিঃসন্দেহে স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ। তবে পরবর্তীকালে অন্যদের মত তাঁর খ্যাতি অম্লান থাকেনি। রবীন্দ্রনাথও বায়রনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। ‘দুরন্ত আশা’ কবিতায় ‘চাইল্ড হ্যারল্ডস পিলগ্রিমেজ’ এর প্রভাব লক্ষ করা যায়— ‘‘ইহার চেয়ে হতাম যদি আরব বদুইন চরণতলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন।’’ (তুলনীয় ‘‘Oh! that the desert were my dwelling place’’)
তথ্যসূত্র:
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস | Download |
ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাস – শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় | Download |
ইংরেজি সাহিত্য পরিচয় – অরবিন্দ পোদ্দার | Download |
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস – কুন্তল চট্টোপাধ্যায় | Download |
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ও মূল্যায়ন – বিমলকৃষ্ণ সরকার | Download |
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস – অরুণ ভট্টাচার্য | Download |
Leave a Reply