//
//

ইংরেজি সাহিত্যে জন কীটসের অবদান আলোচনা কর।

জন কীটস্‌ (১৭৯৫-১৮২১)

ইউরোপের রোমান্টিক যুগের সর্বকনিষ্ঠ কবি হলেন জন কীটস্‌ (১৭৯৫-১৮২১)। কবি কীটস্‌ মাত্র ২৬ বছর জীবিত ছিলেন এবং মাত্র ৫-৬ বছর কাব্যচর্চা করেছিলেন, কিন্তু এই ৫-৬ বছরেই তিনি কবিতার ক্ষেত্রে যে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন তাতে আজও সাহিত্যপিপাসু মানুষ তার কবিতা পড়ে আপ্লুত হন। তার সমকালে এবং পরবর্তীকালেও দেশ বিদেশের বহু কবি তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কবিতার চর্চা করেছেন।

স্বল্পায়ু ইংরেজ কবি জন কীটস্‌ ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা থমাস কীটস্‌ একটি ইন (সরাইখানা)-এর ম্যানেজার ছিলেন। থমাস কীটস্‌-এর চার সন্তানের মধ্যে বো ছিলেন জন। জন কীটস্‌ অল্পবয়সে পিতৃহারা হলে তার মা দ্বিতীয় বিবাহ করে অন্যত্র চলে যান। ফলে কবি মামার বাড়িতে ট্রাস্টি অভিভাবকের অধীনে বড় হন। তিনি ক্লার্কের স্কুলে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশুনা করে অভিভাবকের ইচ্ছায় ভাক্তারি পড়তে শুরু করেন। কিন্তু ডাক্তারি তার ভালো লাগত না জন্য তিনি তিনি সাহিত্য চর্চা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং একজন বড়মাপের কবি হয়ে ওঠেন।

ব্যক্তিগত জীবনেও জন কীটস্‌-কে নানা কষ্টভোগ করতে হয়। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে তার বড় ভাই জর্জ অনেক চেষ্টা করেও টমকে বাচাতে পারেননি। এই সময় তিনি হ্যাম্পস্টেডে ফ্যানি ব্রাউন নামে এক সুন্দরী তরুণীর প্রেমে পড়েন। বাগদান হয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত কবির প্রেম প্রত্যাখ্যাত হয়। ভাই টমের সেবা করতে গিয়েই সম্ভবত কবিও ক্ষয়রোগাক্রান্ত হন এবং মাত্র ২৬ বছর বয়সে ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পূর্বে প্রায় একবছর কবি কীটস্‌ সাহিত্যচর্চা করতে পারেননি। মৃত্যুর পর তার সমাধির উপর তারই লেখা সমাধিলিপি উৎকীর্ণ করা— ‘‘Here lies a man whose name was write in water.’’ এ দেখে মনে হয় কবি তার জীবনের সকরুণ পরিসমাপ্তি আগে থেকেই উপলব্ধি করেছিলেন। তবে বিশ্ববাসীর মনে তার নাম জলের অক্ষরে লেখা হয়নি— এখনও আলোর অক্ষরে লেখা আছে।

কীটস্‌-এর জন্মই হয়েছিল কবিতা রচনার জন্য। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে নানা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং বেশ কয়েকজন গুণী বন্ধুর সাহচর্য পেয়েছিলেন। ক্লার্কের স্কুলে পড়ার সময় হেডমাস্টারের ছেলে চার্লস কাউডেন ক্লার্কের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়। আর এই বন্ধুত্বের সূত্রেই লে হ্যান্ডের সাথে তার পরিচয় হয়। এরপর একে একে হ্যাজলিট, শেলি, চিত্রকর হেডেনের সাথেও তিনি পরিচিত হন। হেডেনের গৃহেই তার পরিচয় হয় রোমান্টিক কাব্য আন্দোলনের পুরোধাপুরুষ ওয়ার্ডসওয়ার্থের সাথে। মূলতঃ এদের সাথে পরিচয় হওয়ার পর ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি কবিতা রচনার প্রতি আকৃষ্ট হন। তার প্রথম কবিতা ‘লাইনস্‌ ইন ইমিটেশন অব স্পেনসার’। লে হ্যান্ডের পত্রিকায় তাঁর ‘অন ফার্স্ট অব লুকিং চ্যাপিমানস্‌ হোমার’ প্রকাশিত হয়। এরপর কীটস্‌-এর নানা উল্লেখযোগ্য রচনা প্রকাশিত হয়। এই রচনাগুলি হল— ‘এন্ডিমিয়ন’, ‘হাইপেরিয়ান’, ‘ইভ অব সেন্ট আ্যগনেস’, ‘ইসাবেলা অর দ্য পট অব বাসিল’, ‘লা বেলে ড্যাম স্যানস্‌ মারসি’ এবং ওড জাতীয় ১৮টি কবিতা ও ৬১টিন সনেট।

গ্রীক মিথোলোজি থেকে কাহিনি নিয়ে জন কীটস্‌ তাঁর ‘এন্ডিমিয়ন’ কাব্যটি রচনা করেন। এ কাব্য এন্ডিমিয়ন একজন মেষপালক। নাটমাকব-এ তার বাস। সৌন্দর্যের দেবী সিন্থিয়া তার প্রেমে পড়েছেন এবং তারই কৌলিন্যে তাদের মিলন হয়। এরপরেই এন্ডিমিয়ন অমরত্ব লাভ করেন। এই হল একাব্যের মূল বিষয়। শেক্সপীয়ারের ‘রোমিয় অ্যান্ড জুলিয়েট’-এর অনুসরণে জন কীটস্‌ তাঁর ‘ইভ অব সেন্ট অ্যাগনেস’ কাব্যটি রচনা করেছেন। তবে এই কাব্যটির পরিণতি শেক্সপীয়রের রচনাটির মত বেদনাবিধুর নয়। এখানে কীটস্‌ উষ্ণ প্রেমের রোমাঞ্চকর মিলন দেখিয়েছেন।

বার্টটোমের ‘আ্যানাটমি ওব মেলানকলি’ থেকে গল্প নিয়ে কীটস্‌ তাঁর ‘ল্যামিয়া’  কাব্যটি রচনা করেছেন। একাব্যে কবি মধ্যযুগীয় আলোছায়াময় রহস্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে ল্যামিয়া নামক এক নাগিনী কন্যার কাহিনি পরিবেশন করেছেন। কীটস্‌-এর প্রেম বিষয়ক একটি বিখ্যাত কাব্য ‘ইসাবেলা অর দ্য পট অব বাসিল’। এখানে ইসাবেলার প্রেমিক লরেন্সের তারই ভাতৃদ্বয়ের হাতে মারা যাওয়ার পর ইসাবেলার জীবনে যে দুঃখ নেমে এসেছিল তার করুণ কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। তার ‘লা বেলে ড্যাম সানস্‌ মার্সি’ কাব্যটিতে এক নাইটের ব্যর্থ প্রেমকাহিনি দেখানো হয়েছে। অতিপ্রাকৃত শক্তি সম্পন্না এক কুহকিনী নারীর প্রেমের ছলনায় বহু পুরুষের মত এক পবিত্রচিত্ত খ্রিস্টান নাইটের নিঃস্ব হওয়ার কাহিনি এটি, যে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে এক নির্জন হ্রদের ধারে একাকী ক্ষুণ্নচিত্তে ঘুরে বেড়ায়। মিলটনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’-এর প্রেরণায় রচিত ‘হাইপেরিয়ান’ কীটস্-এর অসমাপ্ত মহাকাব্য। তিনি এই মহাকাব্যটি রচনা করার পরিকল্পনা করলেও শেষ করতে পারেননি। কাব্যের অসমাপ্তিতে কবিচিন্তের একটি অচরিতার্থতার গ্লানি ছিল, যা থেকে তিনি ‘দ্য ফল অব হাইপেরিয়ান: এ ড্রিম’ রচনা করে মুক্তি খুঁজতে চেয়েছিলেন।

উপরিউক্ত কাব্যগুলি ছাড়াও কীটস্‌ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ১৮টি ওড জাতীয় কবিতা রচনা করেন। এগুলিতে তাঁর কবি প্রতিভার অনেক নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। এই ওড জাতীয় কবিতাগুলির মধ্যে ‘ওড টু এ নাইটেঙ্গেল’, ‘ওড অন এ গ্রিসিয়ান আর্ন’, ‘ওড টু সাইকি’, ‘ওড টু মেলানকলি’ প্রভৃতি কাব্যমূল্যে উৎকৃষ্ট মানের রচনা। কীটস্‌ তাঁর স্বল্পায়ু জীবনে অনেকগুলি সনেটও রচনা করেন। এর মধ্যে প্রথম যুগের ৪২টি সনেটে পেত্রার্কীয় রীতি এবং পরের দিকের ১৬টি সনেটে শেক্সপীয়রীয় রীতি অনুসরণ করেছিলেন। তবে কীটস্‌ পেত্রার্কীয় রীতির চেয়ে শেক্সপীয়রীয় রীতিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন।

কীটসের কাব্য-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য

রোমান্টিক যুগের সর্বকনিষ্ঠ কবি ছিলেন কীটস্‌। এযুগের সর্বকনিষ্ঠ কবি হিসাবে যে কাজ তার পক্ষে করা কঠিন ছিল কীটস্‌ তার কাব্যকবিতায় খুব সহজেই সেটা করে দেখিয়েছেন। কীটস্‌এর কবি প্রতিভার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য হল—

প্রকৃতি প্রেম: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রূপময় ও বর্ণময় ছবি কবি কীটসের কবিতায় বড়ো আকর্ষণ। ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো প্রকৃতির বাহারূপের গভীরে কোনো অন্তর্জীবনের সন্ধান করেননি কীট্স; কিংবা বিশ্ব প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যের ঊর্ধ্বে কোনো দর্শন লোকের উদ্দেশ্যে ধাবিত হতে চাননি। শেলীর মতো কীট্সের কাব্য কবিতায় প্রকৃতির চিত্ররূপময় জগৎ নিবিড় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতায় চিত্রিত। এ ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি প্রাচীন গ্রিকদের মতো যাঁরা প্রকৃতির নানাবিধ রূপ ও শক্তিকে মানবীয় সৌন্দর্যের আলোকে দেখেছিলেন।

সৌন্দর্যচেতনা: ‘A thing of beauty if a Joy forever’— লিখেছেন কীটস। কাব্য সাধনায় সৌন্দর্য ছিল কীটসের ধ্রুবতারা, শিল্পে কিংবা প্রকৃতিতে কিংবা প্রেমে তিনি নিরন্তর সন্ধান করেছেন সৌন্দর্যের, রূঢ় বাস্তবের দুর্দশা পীড়নকে বিস্তৃত হতে তিনি কল্পনার আশ্রয় নিতে চেয়েছেন। আশ্রয় নিতে চেয়েছেন মধ্যযুগীয় রোমান্স আর গ্রিক পুরাতত্ত্বের জগতে। ধর্মীয় কিংবা সামাজিক দর্শন চিন্তার মাধ্যমরূপে নয়, কবিতাকে কীটস দেখেছিলেন সৌন্দর্যপ্রীতির প্রকাশ রূপে। কবিতায় প্রচারমুখীনতা ঘোর অপছন্দ ছিল তাঁর।

ইন্দ্রিয় ঘনত্ব: সৌন্দর্যপ্রেমী এই কবি তাঁর কাব্য কবিতায় প্রাকৃতিক তথা মানব সৌন্দর্যের যে সকল ইন্দ্ৰিয়ঘন শব্দচিত্র উপহার দিয়েছেন তা সমগ্র ইংরাজি সাহিত্যে দুর্লভ। দৃশ্য, শব্দ, ঘ্রাণ, স্পর্শ ও স্বাদের জগৎ যেভাবে কীট্সের কাব্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে তা এককথায় অতুলনীয়।

চিত্ররূপময়তা: কীটসের কবিতার জগৎ এক আশ্চর্য চিত্ররূপময় জগৎ। শব্দচিত্রের এমন সুন্দর ও সমৃদ্ধ ভাণ্ডার রোমান্টিক কাব্যে বিরল। শেলীর বিমূর্ততা কীটসের এই সকল ছবিতে নেই। তাঁর চিত্র কল্পগুলি আবেগময়, মূর্ত ও ইন্দ্রিয়ঘন।

কাব্যশৈলীর বিশিষ্টতা: টেনিসনের কবিতায় কীটসের কাব্যশৈলীর বিশিষ্ট প্রভাব লক্ষ করা যায়। প্রাথমিক পর্বে স্পেনসার এবং উত্তর পর্বে শেক্সপীয়ার ও মিলটনের কাব্যের প্রভাবে এক বিস্ময়কর পরিণতি অর্জন করেছিলেন কীটস। গঠন সৌন্দর্যে, রূপক ও চিত্রকল্পের নিবিড়তায় শব্দবন্ধের গীতিমাধুর্যে রোমান্টিক প্রজন্মের সর্বাপেক্ষা শিল্পবোধ সম্পন্ন ও আধুনিক কবিরূপে গণ্য হয়ে থাকেন।

পরিশেষে বলা যায় স্বল্পায়ু হওয়ায় কীটস্‌ মাত্র ৫-৬বছর সাহিত্য চর্চা করে যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তা পৃথিবীর খুব কম সাহিত্যিকের দ্বারাই সম্ভব হয়েছে। পাশ্চাত্য সাহিত্য দীর্ঘদিন তার রচনা দ্বারা প্রভাবিত ছিল। বাঙালি সাহিত্যিকরাও তার প্রভাব থেকে বাদ যাননি। হেমচন্দ্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন গীতিকবি এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও কীটস্‌এর কবিতা দ্বারা প্রভাবিত হন। জীবনানন্দ দাশকে অনেকেই কীটস্‌-এর সাথে তুলনা করেছেন। এজন্যই সাহিত্যের পাঠকদের কাছে জায়গা করে নিয়ে কীটস্‌ আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন।

তথ্যসূত্র:

ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসDownload
ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাস – শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়Download
ইংরেজি সাহিত্য পরিচয় – অরবিন্দ পোদ্দারDownload
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস – কুন্তল চট্টোপাধ্যায়Download
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ও মূল্যায়ন – বিমলকৃষ্ণ সরকারDownload
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস – অরুণ ভট্টাচার্যDownload

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!