//
//

ইংরেজি সাহিত্যে কবি এলিয়টের কৃতিত্ব আলোচনা কর।

টমাস স্টার্নস এলিয়ট (১৮৮৮-১৯৬৫)

বিচিত্র ছন্দ প্রকরণ, অপরূপ প্রতীকদ্যোতনা এবং অভিনব ভাববস্তু নিয়ে এলিয়ট (১৮৮৮-১৯৬৫) জগতে আবির্ভূত হন। ১৯১৭ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রুফ্রক অ্যান্ড আদার অবজারভেশানস’ (Prufrock and other Observations) প্রকাশিত হয়। আধুনিক জীবনের অবক্ষয়ের বেদনা, তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ, কল্পনার অভিনবত্ব, স্টাইলের স্বাতন্ত্র্য, চিত্রকল্পের নিপুণ সমাবেশ তার কাব্যের অন্যতম সম্পদ। এদিক থেকে বাংলা কাব্যের অনন্য সাধারণ কবি জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে প্রভৃতির কথা স্বাভাবিকভাবেই তুলনায় আসতে পারে। তার কাব্য এদিক থেকে যেন বুদ্ধি মথিত ব্যঙ্গ শ্লেষ, অন্যদিকে নানা দার্শনিক আধ্যাত্মিক বিষয়ের উল্লেখে জীবন্ত। একদিকে খণ্ড খণ্ড চিত্রকল্প ও রূপকের ব্যবহার অন্যদিকে খ্রিস্টানদের আধ্যাত্মিক প্রতীকের সুনিপুণ প্রয়োগ—সব মিলিয়ে এক বুদ্ধিদীপ্ত মনের কবি তিনি। তাই তার কাব্য আধুনিক জীবনের বিশ্বস্ত প্রতিচ্ছবি।

এলিয়ট যখন ইংলণ্ডের কাব্য রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হলেন তখন জর্জীয় কবিগণ ভিক্টোরীয় রোমান্টিক আদর্শকে অনুকরণ করে চলেছিলেন। ‘প্রুফুক অ্যাণ্ড আদার অবজারভেশানস’-এ এলিয়ট নতুন যুগের কবিতার ডালি নিয়ে উপস্থিত হলেন। তৎকালীন জর্জীয় কবিতার রোমান্টিক চর্বিত চর্বণের মধ্যে ‘প্রু-ফ্রক’ নামের এক দ্বিধাগ্রস্ত মাঝবয়সী নগরবাসীর এই অভিনব প্রণয়গীতির ভাষায় ও ভঙ্গির অভিনবত্ব ও নাটকীয়তা ইংরেজি কবিতার মরাগাঙে বান ডেকে আনল, চিত্রকল্পের আকর্ষণীয় বৈচিত্র্যে, ছন্দের পরীক্ষামূলক চমকপ্রদ প্রয়োগে, কথ্যরীতির ব্যবহারে এবং সর্বোপরি তির্যক শ্লেষ প্রয়োগে—এই গ্রন্থটি বিশ শতকের ইংরেজি কবিতায় যুগান্তর সূচিত করল। নাগরিক জীবনে কৃত্রিম ভঙ্গি সর্বস্বতা, যৌন স্বেচ্ছাচার ও বিভিন্নতাকে প্রকাশ করলেন এক অভিনব বিদ্রূপ ও শ্লেষের মাধ্যমে।

এলিয়টের দ্বিতীয় কাব্যসংগ্রহ ‘পোয়েম্‌স্‌’ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের ভঙ্গিতে লেখা। এই সংগ্রহের সেরা কবিতা ‘জেনোন্‌শন’, ‘সুইনি ইরেকট’, ‘দি হিপোপটেমাস’ ইত্যাদি। ‘জোরোনেশন’ এক দৃষ্টিহীন, অশক্ত বৃদ্ধের নির্জন আত্মকথা, প্রাক্তন নাবিক এই বৃদ্ধ; এখন অক্ষম শুষ্ক মরুদেশের ভাঙা ঘরের এক অসহায় বাসিন্দা, বৃষ্টির জন্য প্রতীক্ষারত অন্যদিকে ‘সুইনি ইরেকট’ মার্কিন অধ্যাত্মবাদী এমার্সনের ইতিহাস সম্পর্কিত সংজ্ঞার এক শ্লেষাত্মক ভাষ্য।

এলিয়টের প্রতিভার সার্থক পরিচয় হল ‘দি ওয়েস্টল্যান্ড’ (১৯২২)। এলিয়ট আধুনিক সভ্যতাকে ভূমির সঙ্গে উপমিত করে রূপকের মাধ্যমে চিত্রিত করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে প্রথমা পত্নীকে কেন্দ্র করে অশান্তি ছাড়াও এলিয়টের এই মহাকাব্যের পশ্চাৎপটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও নৈরাশ্য সর্ব্বব্যাপী ধ্বংসলীলা। গঠন, চিত্রকল্প, ছন্দ ও ভাষারীতির অভিনবত্বে ‘দি ওয়েস্ট ল্যাণ্ড’ আধুনিক কবিতার এক দিকচিহ্ন। গীতিকবিতা, নাটক, আখ্যানকাব্য ও পুরাণ—সমস্ত কিছুর উপাদান মিলিয়েছেন এলিয়ট তার এই ক্ষুদ্রায়তন মহাকাব্যে। সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন ফ্রি ভার্স, সাধারণ কথোপকথনের ভাষা ও ভঙ্গি তথা কথ্যছন্দকে স্থান দিয়েছেন তাঁর কাব্যে।

কাব্যটি পাঁচটি পর্বে বিভক্ত। আপাতদৃষ্টিতে সেগুলি বিচ্ছিন্ন হলেও এদের অর্ন্তর্নিহিত ভাবসত্যে তা ঐক্যবদ্ধ। এই কাব্যের প্রথম পর্ব ‘The Burial of the Dead’—এখানে কবি বন্ধ্যা অনুর্বর নগরীর চিত্র পরিহাসের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করেছেন। মহাযুদ্ধোত্তর ধ্বংসের সর্বগ্রাসী রূপটি এলিয়টের নৈরাশ্যলাঞ্ছিত মনোভঙ্গীর বিষণ্নতায় করুণ অথচ তীব্র হয়ে ফুটে ওঠে।

দ্বিতীয় পর্ব ‘A Game of Chess’—এতে কবি আধুনিক নগর জীবনের তুচ্ছতা দেখাতে গিয়ে দু ধরনের আধুনিক নারী চরিত্র অঙ্কন করেছেন।

তৃতীয় পর্ব ‘The Fire Semon’—এতে জীবনের বিকৃতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ইঁদুরের পায়ের শব্দ, হাড়ের শব্দ, অপঘাত মৃত্যু তথা নগ্ন শুভ্র মৃতদেহ ইত্যাদির উল্লেখে এক ভয়াবহ শীতার্ত জড়তার ইঙ্গিত দিয়েছেন এলিয়ট।

চতুর্থ পর্ব ‘Death by Water’—এতে মৃত্যু এসেছে জ্বলন্ত বাসনা-কামনা দাহকে নির্বাপিত করতে। আধুনিক শিক্ষিত মানুষের জীবন তৃষ্মার ছবি এই পর্বে রূপলাভ করেছে।

পঞ্চম পর্ব ‘What the Thunder Said’—এতে ইউরোপের আর্থিক অবক্ষয়ের চিত্র চিত্রিত হয়েছে। এক শুষ্ক, প্রাণহীন পাথুরে পার্বত্য ক্ষেত্রে মরুময়তা ও জলের অন্য অপার তৃষ্ণা এলিয়টের রূপক কাব্যের ওয়েস্ট ল্যান্ড–এর শাপগ্রস্ত ভয়াবহতাকে প্রকট করে তুলেছে। এই অভিশপ্ত দেশ, এলিয়টের নিজের ভাষ্য অনুযায়ী, অবক্ষয়িত ও মৃতপ্রায় ইউরোপ। মহাযুদ্ধোত্তর ইউরোপের বন্ধ্যাত্ব ও ধ্বংসের এই অসামান্য রূপক ভাষ্য, অশান্তির এই অভূতপূর্ব মহাকাব্য শেষ হল উপনিষদীয় রীতিতে; লণ্ডনের অব্যাহত বাস্তবতার পরিমণ্ডল উত্তীর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল এক বিস্তৃত বিশ্ব-পরিসরে।

এলিয়ট প্রাচীন সাহিত্য থেকে উপকরণ গ্রহণ করে তাকে মনন-সমৃদ্ধ বুদ্ধি প্ৰকর্ষে উজ্জ্বল করেছেন। তাঁর ‘দি হলোমেন’ (The Hollow Men—১৯২৫) কবিতায় আধুনিক কালের শূন্যগর্ভে মানুষের কথা চিত্রিত হয়েছে। তার মতে আধুনিক মানুষ কৃত্রিম এবং সে কারণেই তারা ব্যর্থ। কেননা তারা চিরন্তন সত্যের স্পর্শ পায়নি। আশাহীন, বিশ্বাসহীন, নিরালোক প্রস্তর এই দেশ নরক যন্ত্রণার অনিবার্যতায় ধূসর। কবিতাটি শেষও হয়েছে ভয়ানক আশাহীনতার ব্যঙ্গে—

This is the way the world ends

This is the way the world ends

This is the way the world ends

Not with a bang but a whimper.

নৈরাশ্যের এই অতল গর্ভ থেকে কবি উত্তীর্ণ হয়েছেন ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসের ভূমিতে। এই মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে ‘অ্যাশ্ অয়েডনেসডে’ এবং ‘এরিয়েল পোয়েমস্’। একঘেঁয়েমি, ভয় পেরিয়ে কবি এখানে পৌঁচেছে প্রশান্ত মহিমায়।

তাঁর কাব্য রচনার শেষদিকের প্রধান কাব্য হল ‘ফোর কোয়াটেস্’-এর অন্তর্গত চারটি কবিতা হল ‘বার্নট নটন’, ‘ইষ্ট কোকার’, ‘দি ড্রাই স্যালভেজেস’ এবং ‘লিট্ল গিডিং’। এগুলি আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা তথা সত্যানুসন্ধানের এক অসামান্য কাব্যরূপ। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সময়প্রবাহে এবং শাশ্বত অনন্তের মধ্যে ঈশ্বরের উপলব্ধি এ কাব্যের মূলকথা। এখানে কবির যাত্রা অনন্ত ও সত্যের অভিমুখে। এখানে কোনও ব্যঙ্গ বিদ্রূপ নেই, আছে শান্ত গভীর এক রূপ। এক প্রশান্ত অনুধাবনের মেজাজ এই কাব্যে।

এলিয়টের অন্যান্য রচনার মধ্যে তার কাব্যনাট্য ‘মার্ডার ইন দি ক্যাথিড্রাল’, ‘সুইনি অ্যাগোনিস্‌’ ইত্যাদি। ভাবের দিক থেকে এইসব কাব্যনাট্য ক্যাথলিকপন্থী। এলিয়টের বিকাশ ধারার প্রমাণ তাতেও প্রায়ই আছে সেই মৃত্যু ও নবজন্মের ভাবের কবিতার মূল সুর। এগুলি তার বিশেষ ছন্দ প্রকরণের নৈপুণ্যে উজ্জ্বল।

প্রবন্ধ রচনাতেও এলিয়ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ‘দি সেক্রেড উড্ এসেস’, ‘দি ইউজ অব পোয়েট্রি’ রচনায় তার বৈদগ্ধ্যের পরিচয় আছে।

এলিয়ট আপাতদৃষ্টিতে দুর্বোধ্য কারণ ওয়ার্ডসওয়ার্থ যেখানে বলেছিলেন কবিতা হল ‘Spontaneous Overflow of Powerful feelings’. যেখানে এলিয়ট বলেছেন ‘Poetry is not the turning loose of emotion’. আর সেজন্য ভাষার লালিত্য ও মাধুর্যের দিকে তার এতটুকু ঝোঁক ছিল না। এলিয়টের মতে কাব্যের উৎকর্ষ নির্ভর করে ব্যক্তি হিসাবে কবির যন্ত্রণা ভোগ এবং নৈর্ব্যক্তিক কবিমানসের মধ্যেকার বিচ্ছেদের ওপর। সে যাই হোক, বর্তমান জটিল এবং বৈচিত্র্যময় যুগের সার্থক প্রতিভূ এলিয়ট গতানুগতিক ভাষা ও অলংকার বর্জন করে নানাবিধ প্রতীকের ব্যবহারে কবিতাকে আধুনিক জীবনের ভাব প্রকাশে যথার্থ বাহন করে তুলেছে।

এলিয়টের কাব্য-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য

নগরচেতনা: আধুনিক জনবহুল মহানগরের বিপর্যস্ত ও অবক্ষয়িত জীবনের রূপকার ছিলেন এলিয়ট। আধুনিক নগরকেন্দ্রিক জীবন ও সংস্কৃতির চমৎকার রূপ উদ্ঘাটিত করেছেন এলিয়ট। বোদলেয়ারের মতোই এলিয়ট হয়ে উঠেছিলেন নাগরিক জীবনের বিপন্নতার ভাষ্যকার।

চিত্রকল্পের ব্যবহার: প্রখর ও নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে এলিয়ট তাঁর কাব্য কবিতায় চিত্রকল্পের এক আশ্চর্য জগৎ নির্মাণ করেছেন।

গীতিময়তা: একজন দক্ষ সংগীত রচনা যেভাবে সুর সৃষ্টি করে থাকেন সেভাবে এলিয়ট যুক্তি সর্বস্বতা ও অর্থের প্রচলিত বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তির পথ নির্দেশ করেছিলেন।

রোমান্টিক কাব্যদলের বিরোধিতা: রোমান্টিকদের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা তথা ‘কল্পনার সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে এক নৈর্ব্যক্তিক বুদ্ধি প্রধান কাব্যাদর্শের প্রবক্তা ছিলেন এলিয়ট।

দুরূহতা: এলিয়টের কবিতা সম্পর্কে পাঠকরা দুর্বোধ্যতার কথা বলে থাকেন। এর কারণ হল প্রকাশভঙ্গির তির্যক শ্লেষ, প্রতীক ও চিত্রকল্পের সুতীব্র অভিঘাত। চিত্রকল্পকে কাব্যভাষায় রূপান্তরিত করা ইত্যাদি।

তথ্যসূত্র:

ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসDownload
ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাস – শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়Download
ইংরেজি সাহিত্য পরিচয় – অরবিন্দ পোদ্দারDownload
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস – কুন্তল চট্টোপাধ্যায়Download
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ও মূল্যায়ন – বিমলকৃষ্ণ সরকারDownload
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস – অরুণ ভট্টাচার্যDownload

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!