ক্যাথারসিস সম্পর্কে আলোচনা কর।
ক্যাথারসিস (Catharsis)
পোয়েটিকস্ গ্রন্থের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে ট্র্যাজেডির সংজ্ঞায় আ্যারিস্টটল বলেছেন— “Through pity and fear effecting the proper purgation of these emotion” মূলত ট্রাজেডি নাটক দর্শনে দর্শকের অন্তরে করুণা ও ভীতি জাগ্রত হয়। নাট্যকারের সেই জাগ্রত করুণা উভয়ের প্রশমন অর্থে ক্যাথারসিস শব্দটি হয়েছে। অ্যারিস্টটল ব্যবহৃত এই ক্যাথারসিস শব্দটি বহুবিতর্কিত।
অ্যারিস্টটলের মতানুসারে ট্র্যাজেডির উদ্দেশ্য ভাব বিমোক্ষণ (Catharsis)। এই ক্যাথারসিস সম্পর্কে ত্যারিস্টটল বিশেষ কিছু বলেননি। তবে পরবর্তীকালে ক্যাথরসিস শব্দটি নিয়ে বহু চর্চা হয়েছে। পোয়েটিকস্ এর অনুবাদকরা ক্যাথরিসিস শব্দের বদলে কেউ কেউ Purgation কেউ বা Purification প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করেছেন। ভাষ্যকার বুচার ক্যাথারসিস শব্দটির বদলে Purgation শব্দটি ব্যবহার করেছেন। বুচারের মতে Purgation ই হল ট্র্যাজেডির মূল উদ্দেশ্য। মিলটন ও এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। পোয়েটিকস্ গ্রন্থে আ্যারিস্টটল বলেছেন—যে ঘটনার সাথে আমি Involved তাই জাগায় Fear যা আমাদের ক্ষতি করতে পারে। Pity এর সাথে আমরা ততোটা Involved নই। জাগতিক নিয়মের বিরুদ্ধে কিছু ঘটলে Pity জাগে। জাগতিক বিধানে বিশ্বাসই Pity জাগায়।
অনেকে আবার ক্যাথারসিস শব্দটিকে চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিভাষায় ‘মানসিক পরিশোধন’ অর্থে ব্যবহার করেছেন, অর্থাৎ ক্যাথারসিস হচ্ছে ট্র্যাজেডির ভয়ানক ও শোচনীয় ঘটনার অনুকরণ দ্বারা আমাদের মনে ভয় ও করুণা জাগায় তথা কু প্রবৃত্তিকে প্রশমিত করে। সেই সঙ্গে সামাজিক ব্য ক্তিদের নৈতিক মান উন্নত করে। অর্থাৎ ভয় ও করুণা যে বিশেষ প্রক্রিয়ায় আনন্দে পরিণত হয় সেই বিশেষ প্রক্রিয়া এটি। অর্থাৎ বলা যায় ক্যাথারসিস একটি শৈল্পিক প্রক্রিয়া যা ভয় ও করুণাকে দূরীভূত করে আনন্দ প্রদান করে।
অ্যারিস্টটল তাঁর পোয়েটিকস্ গ্রন্থে বলেছেন— ‘‘মানুষের মধ্যে কোন একটি আবেগ প্রবল হলে তাকে বের করে দিতে পারলে মানুষ স্বস্তি পাবে।’’ Purgation-বাদীরাও এই মত সমর্থন করেন। তাঁরা বলেন—Pity ও Fear অপসারণে মনে স্বস্তি আসে ফলে ক্যাথারসিস সৃষ্টি হয়। আ্যারিস্টটল ক্যাথারসিস শব্দের দ্বারা আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন তা আজও সুনিশ্চিত ভাবে কেউ বলতে পারেননি। তবে বোঝা যায় যে, তীব্রতর আবেগ তাড়িত মনোভাবের মধ্যে থেকে কতকটা আবেগের অপসরণ ঘটে। ফলে আবেগ তাড়িত মানুষের মনে যে প্রশান্তি তাই হল ‘ক্যাথারসিস’।
উনিশ শতকের রোমান্টিক কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর বক্তব্য অনুযায়ী ক্যাথারসিসের ফলে কবিতা পাঠক বিনীত হয়, মানবিক হয়, মিথ্যা অভিজাত্যের বোধ ও উন্মাসিকতা বোধ থেকে মুক্তি পায়। কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস থেকে ক্যাথারসিস কবিতার পাঠককে মুক্তি দেয়। বিশ শতকের মনস্তাত্ত্বিক সমালোচক আই এ. রিচার্ডস-এর মতানুসারে ক্যাথারসিসই হচ্ছে একমাত্র উপায় যাতে কোন রকম অবদমন ছাড়াই আমাদের জাগ্রত প্রবৃত্তিগুলি বিশ্রান্তির সুযোগ পায়। ক্যাথারসিস সম্পর্কে প্রাচ্য ও প্রতীচ্য আলংকারিক এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টি কোণ থেকে বোবা যায় যে, যে কোন প্রকার রসোত্তীর্ণ রচনাই শোচনার উদ্রেক করে, পরে তা আনন্দের হেতু হয়। তাই বলা যায় ট্র্যাজেডির আনন্দ শুধু বিশুদ্ধ শিল্প সম্ভোগের নয়, নানা কারণেই এই আনন্দলাভ করা যেতে পারে। সহৃদয় দর্শকচিত্তে রসোদ্রেকের ফলে যে আনন্দ তাকে মিথ্যা বলা যায় না।
প্লেটোর মতানুসারে সাহিত্য-শিল্প মানুষকে বিপথগামী করে। এরই প্রতিবাদে অ্যারিস্টটল ক্যাথারসিস শব্দটি প্রয়োগ করে দেখাতে চেয়েছেন যে সৎ সাহিত্য মানুষকে বিপথগামী বা কলুষিত করে না বরং তাঁর মলিনতা দূর করে, তাকে উচ্চমার্গে নিয়ে যায়। তাই বলা যায়—অ্যারিস্টটল ক্যাথারসিস শব্দটিকে মানসিক পরিশোধন, নৈতিক উন্নয়ন চরিত্র সংগঠন বা ভয় ও শোচনার পরিণমন এর কোন অর্থেই ব্যবহার করেননি। রেচন বা উদ্রেক অর্থেই তিনি শব্দটিকে প্রয়োগ করেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন—ভয়ানক ও শোচনীয় ঘটনাকে এমনভাবে উপস্থাপিত করতে হবে যাতে দর্শকদের মনে ভয়ের শিহরণ এবং শোচনার দ্রবন উপস্থাপিত হয়। যাতে “ভয়” “শিহরণের মাত্রায়” এবং “শোচনা’’, “দ্রবীভাবের মাত্রায়” পৌছায়। এই মাত্রায় পৌঁছনোর নামই “Proper purgation of these emotions”-এই হিসাবে ক্যথারসিস শব্দটি রসনিষ্পত্তির মাত্রা নির্দেশ করার জন্যই ব্যবহৃত হয়েছে ক্যথারসিস আসলে ভাবমোক্ষণে
তথ্যসূত্র:
কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্ত | Download |
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাস | Download |
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরী | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাস | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যাল | Download |
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাস | Download |
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত | Download |
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দী | Download |
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যাল | Download |
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেন | Download |
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায় | Download |
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষ | Download |
Leave a Reply