//
//

পাশ্চাত্য নাট্যতত্ত্বে কোরাসের ভূমিকা আলোচনা কর।

কোরাস

অ্যারিস্টটলের ‘পোয়েটিকস্’ গ্রন্থের ১৮-তম পরিচ্ছেদে কোরাসের গুরুত্বের উপর বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে কোরাসকে কেবলমাত্র গানের অংশ হিসেবে নয়, বরং একজন পূর্ণ অভিনেতা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত বলে বলা হয়েছে। অ্যারিস্টটলের মতে, কোরাস নাটকের সঙ্গে যুক্ত একটি অপরিহার্য উপাদান এবং কাহিনীর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকবে, যা তাকে ইউরিপিদিসের নাটকের চেয়ে সফোক্লিসের নাটকের কোরাসের সাথে তুলনা করে আরও গ্রহণযোগ্য করে তোলে। অর্থাৎ, কোরাস নাটকের সঙ্গেই যুক্ত থাকবে এবং ক্রিয়াতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা যায়, কোরাসকে নাটকের স্বতন্ত্র একটি উপাদান হিসাবে বিবেচনা করা উচিত, যা নাটকের সাথে সরাসরি একাত্মতা প্রকাশ করে।

সঙ্গীতের গুরুত্ব
ট্র্যাজেডির আলোচনায় অ্যারিস্টটল সঙ্গীতকে নাটকের অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, সঙ্গীত নাটকের গতিকে তরান্বিত করতে, দর্শকদের অনুভূতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে এবং নাটককে আরো প্রাণবন্ত ও আনন্দদায়ক করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি বলেন, “Melody is the greatest of the Pleasurable accessaries of tragedy,” অর্থাৎ সুর বা সঙ্গীত ট্র্যাজেডির আনন্দময় শৈল্পিক উপাদানগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম। তাই কোরাসকে শুধু গানের জন্য ব্যবহার করা হলেও এর ভূমিকা নাটকের সার্বিক আবহ সৃষ্টি এবং নাট্যকাহিনীর সাথে একীভূত করার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মনে করেছেন।

কোরাসের নাটকীয় ভূমিকা
অ্যারিস্টটল তাঁর আলোচনায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, কোরাস শুধুমাত্র একজন অভিনেতার মতোই কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে এবং নাটকের মূল ক্রিয়ার অংশ হবে। কোরাসকে অপ্রাসঙ্গিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত নয়; বরং কাহিনীর সাথে গভীরভাবে যুক্ত থেকে তাদের মাধ্যমে নাটকের নৈতিক ও নীতিমূলক ভাব প্রকাশ করা উচিত। গ্রীক ট্র্যাজেডির ইতিহাসে কোরাসের উদ্ভব ঘটে, যেখানে কোরাসই মূল নাট্যধারা নির্দেশ করে দিত। প্রাচীন গ্রীক নাটকে কোরাস প্রবেশের মাধ্যমে নাটকের কাহিনীর প্রকাশ ঘটত এবং তারা নৈতিক ও সামাজিক ভাবাদর্শকে তুলে ধরত। তাই কোরাসের ভূমিকা নাটকের সাথে নৈতিক ও ধর্মীয় একাত্মতা প্রদর্শনে অপরিহার্য ছিল।

কোরাসের সামাজিক ও নৈতিক ভূমিকা
কোরাসের দুটি প্রধান কাজ ছিল: প্রথমত, কোরাসের মাধ্যমে নাটকটি একটি ধর্মীয় ও নৈতিক সুষমা লাভ করত। তাদের কণ্ঠে এবং সুরে নাটকের মধ্যকার নৈতিক সত্য ও পবিত্র ভাবধারার প্রকাশ ঘটত। দ্বিতীয়ত, কোরাসের কাব্যময় ভাষা নাটকের অন্যান্য চরিত্রদের কথাবার্তার মাঝে এক ধরনের সারল্য ও অনাড়ম্বরতা নিয়ে আসত, যা নাটকের কাহিনীতে সৌন্দর্য যোগ করত। কোরাসের এই নৈতিক ও কাব্যময় দিকগুলো নাটককে একটি উচ্চতর নন্দন চেতনার দিকে নিয়ে যেত।

কোরাসের সংখ্যা ও উন্নয়ন
গ্রীক নাটকের প্রাথমিক পর্যায়ে কোরাসের সংখ্যা ছিল অনেক বড়। বোলান গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘নাটকের জন্মকথা’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রায় প্রতি নাটকে পঞ্চাশজন করে কোরাস সদস্য থাকত, যারা প্রায়শই নাচের মাধ্যমে নাটকের বিভিন্ন অংশকে জীবন্ত করে তুলত। এই বিশাল কোরাসের জন্য বড়ো মঞ্চের প্রয়োজন হত এবং ত্রিশ হাজার দর্শকের সামনে তারা অভিনয় করত। তবে সময়ের সাথে সাথে কোরাসের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। সফোক্লিসের যুগে কোরাসের সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র পনের জন, যা বর্তমানে এসে এক বা দুই জনে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। এই পরিবর্তন সত্ত্বেও কোরাসের নাট্যগত গুরুত্ব অক্ষুণ্ণ রয়েছে।

তথ্যসূত্র:

কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্তDownload
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাসDownload
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরীDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাসDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যালDownload
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাসDownload
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তDownload
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দীDownload
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যালDownload
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেনDownload
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায়Download
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষDownload

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!