অক্ষরবৃত্ত ছন্দ কাকে বলে? এর বৈশিষ্ট্যগুলি উদাহরণসহ আলোচনা কর।
অক্ষরবৃত্ত বা মিশ্রকলাবৃত্ত
যে ছন্দে শব্দধ্বনির অতিরিক্ত একটা তান বা সুর থাকে, প্রধানত মূলপর্ব ৮ বা ১০ মাত্রায় হয় এবং শোষণ শক্তি থাকে, তাকে অক্ষরবৃত্ত বা মিশ্রবৃত্ত বা মিশ্র কলাবৃত্ত ছন্দ বলে।
মিশ্র কলাবৃত্ত ছন্দের নামবৈচিত্র্য
এই ছন্দের প্রকৃতি বিচার করে বিভিন্ন ছান্দসিক এর বিভিন্ন নাম নির্দেশ করেছেন। ‘অক্ষরবৃত্ত’ নামটি প্রথমে দিয়েছিলেন আচার্য প্রবোধচন্দ্র সেন। কিন্তু তিনিই পরে এই নামকে অবৈজ্ঞানিক বলেন এবং এর নাম দেন ‘মিশ্র কলাবৃত্ত তথা ‘মিশ্রবৃত্ত। কেননা তার মতে এ জাতীয় ছন্দে পদের প্রথমে ও মধ্যে রুদ্ধ দলে দলবৃত্ত/স্বরবৃত্তের লক্ষণ থাকে, কিন্তু পদান্ত্য রুদ্ধদলে কলাবৃত্ত বা মাত্রাবৃত্তের লক্ষণ থাকে, তাই একে মিশ্র কলাবৃত্ত বলা হয়। আচার্য সেনের মতে অক্ষর সংখ্যার দ্বারা ছন্দ প্রকৃতি নির্ধারণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয়; রবীন্দ্রনাথও এই মতের সমর্থক। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, অক্ষরবৃত্ত নামটি দীর্ঘকাল ধরে সুপ্রচলিত। কেননা বাংলায় অক্ষর গুণে গুণে ছন্দের প্রকৃতি নির্ণয়ের পদ্ধতি সুদীর্ঘকালের। আবার অধ্যাপক অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় এই জাতীয় ছন্দকে ‘তানপ্রধান ছন্দ’ বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে এখানে শব্দধ্বনিকে অতিক্রম করে একটি তান বা সুর প্রাধান্য পায়। প্রবোধ সেন এই মতের বিরোধিতা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের মতে এই ছন্দ প্রকৃত ‘সাধু বাংলার ছন্দ’ এবং ‘পয়ার জাতীয় ছন্দ’। প্রবোধচন্দ্র একে ‘জটিল কলামাত্রিক’ বা ‘বিশিষ্ট কলামাত্রিক বা যৌগিক অর্ধ কলাবৃত্ত ইত্যাদি নামেও বর্ণনা করেছেন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে।
প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতি বিচারে এই ছন্দ প্রকৃতই খাটি বাংলা ছন্দ তথা ‘তদ্ভব ছন্দ’। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, ছান্দসিক তারাপদ ভট্টাচার্য প্রমুখ ‘অক্ষরবৃত্ত’ নামটি গ্রহণ করেছেন। এছাড়া মিতাক্ষর, পুরাতন ছন্দ (দ্বিজেন্দ্রলাল), আদ্যা, গাঙ্গিনী তরণ (সত্যেন্দ্রনাথ), নামও পরিচিত নাম। আমাদের আলোচনায় আমরা অক্ষরবৃত্ত ও মিশ্র কলাবৃত্ত নাম দুটিকে গ্রহণ করেছি।
অক্ষরবৃত্ত বা মিশ্ৰ কলাবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য
মিশ্র কলাবৃত্ত বা অক্ষরবৃত্তের বৈশিষ্ট্যগুলিকে সূত্রাকারে লিপিবদ্ধ করা যেতে পারে। যেমন—
- এই ছন্দের মূল পর্ব সাধারণত ৮ বা ১০ মাত্রার হয়ে থাকে।
৮ মাত্রার পর্ব
মরিতে চাহিনা আমি । সুন্দর ভুবনে, ৮+৬
মানবের মাঝে আমি । বাঁচিবারে চাই। ৮+৬
১০ মাত্রার ছন্দ
এ কথা জানিতে তুমি/ভারত ঈশ্বর শাজাহান ৮+১০
কালস্রোতে ভেসে যায়/জীবন যৌবন ধনমান! ৮+১০
- শব্দধ্বনির অতিরিক্ত একটা তান বা সুর থাকে।
- এই ছন্দের লয় ধীর।
ম-রি-তে-চা-হি-না-আ-মি । সু-ন্দ-র-ভু-ব-নে
মা-ন-বের-মা-ঝে-আ-মি । বাঁ-চি-বা-রে-চাই।
- এই ছন্দে পদের আদিতে ও মধ্যে রুদ্ধদল একমাত্রা হয়। তবে পদটি একদল/অক্ষর বিশিষ্ট রুদ্ধ দল হলে তা দু-মাত্রার হয়। মুক্ত দল সর্বত্র এক মাত্রা হয়। একাক্ষর মুক্ত যদি অন্য নিরপেক্ষ হয়ে উচ্চারিত হয় তবে দু মাত্রা হয়। তবে ছন্দের প্রয়োজনে দলগুলির প্রসারণ সংকোচন ঘটলে মাত্রার বৃদ্ধি হ্রাস হয়।
পড়েছে তোমার পরে । প্রদীপ্ত বাসনা ৮+৬
অর্ধেক মানবী তুমি । অর্ধেক কল্পনা। ৮+৬
- সমাসবদ্ধ শব্দের আদিতে রুদ্ধদল থাকলে এবং তা যদি একটি শব্দ হয় তাহলে ৪ মাত্রা হয়।
- যুক্ত ব্যঞ্জনের সংশ্লিষ্ট উচ্চারণ বজায় থাকে।
- এই ছন্দে শোষণ শক্তি থাকে।
একথা জানিতে তুমি ভারত ঈশ্বর শাজাহান। ৮+১০
কাল স্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধনমান। ৮+১০
- এই ছন্দে পর্ব সবসর জোড় মাত্রার হয়ে থাকে। (ব্যতিক্রম ৮+৫, ৭+৭ হতে পারে)
- সাধারণত এই ছন্দে অতি পর্ব থাকে না। (তবে ব্যতিক্রম দেখা যায়)
- যৌগিক অক্ষর/দলের মাত্রা গণনার বৈশিষ্ট্য লক্ষ করার মত। প্রসারিত উচ্চারণ দু’মাত্রা, অপ্রসারিত উচ্চারণে একমাত্রা হয়। অর্থাৎ যৌগিক স্বরান্ত দল রুদ্ধদলের মত ব্যবহার করেও তার মাত্রা ও রুদ্ধদলের মত হয়।
- পর্ব মধ্যস্থ শব্দের অন্তর্গত অন্তঃস্থ ‘ব’–ধ্বনি ‘ওয়’–এর মত উচ্চারিত হয় তাই মাত্রা সংকুচিত হয়।
- অনুস্বর, বিসর্গ, চন্দ্র বিন্দু, খণ্ডত সাধারণত মাত্রা গণনার বাইরে থাকে।
- অক্ষর বৃত্তের নানা রূপভেদ হতে পারে—পয়ার, মহাপয়ার, ত্রিপদী, চৌপদী, অমিত্রাক্ষর, সনেট, দিগরা, একাবলী, ইত্যাদি।
Leave a Reply