//
//

অবয়ববাদ সম্পর্কে আলোচনা কর।

অবয়ববাদ (Structuralism)

অবয়ববাদ বা স্ট্রাকচারালিজম সাহিত্য সমালোচনার একটি বিশিষ্ট শাখা, যা সাহিত্যকর্মের গঠন ও সংগঠনের অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করে। এই তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা তোদেরভ মনে করেন, ‘স্ট্রাকচারাল সমালোচনা’ শব্দটিই এক ধরনের স্ব-বিরোধিতা বহন করে। কেননা, সাধারণভাবে সমালোচকের কাজ হলো রচনার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা, কিন্তু স্ট্রাকচারালিজম এই রচনার অন্তর্লীন কাঠামো ও নিয়মসমূহকে প্রকাশ করে, যা ব্যাখ্যা নয়, বরং অনুসন্ধান ও আবিষ্কার।

স্ট্রাকচারাল সমালোচনা একদিক থেকে রচনার গঠনমূলক নীতির সন্ধান করে, যা প্রকট রূপে প্রকাশিত না হলেও তার সুগভীর প্রভাব বিস্তার করে। এর অর্থ, রচনার সৌন্দর্য বা নান্দনিক অনুভূতি বিচার করা স্ট্রাকচারালিস্টদের মূল লক্ষ্য নয়। তারা ধরে নেন যে সাহিত্যিক মান ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত, এবং এরপর তারা মূলত লেখাটির কাঠামোগত উপাদানগুলি কীভাবে একত্রিত হয়েছে এবং রচনাটি কীভাবে একটি সুনির্দিষ্ট আকার নিয়েছে, তা বোঝার চেষ্টা করেন। তাদের কাজ হলো রচনাটির উপাদানসমূহের মধ্যে সম্পর্ক, বিন্যাস এবং সংস্থান নির্ণয় করা এবং সেখান থেকে একটি কাঠামোগত বিশ্লেষণ দাঁড় করানো।

স্ট্রাকচারালিজমের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রবক্তাদের মধ্যে ক্লদ লেভি-স্ট্রস অন্যতম। তিনি বলেছিলেন যে, কবিতা বা সাহিত্যের নান্দনিক অভিজ্ঞতার ভিত্তি থাকে তার অবয়বিক শৃঙ্খলায়। স্ট্রাকচারালিস্টদের মতে, সাহিত্য হল ভাষার একটি বিশেষ রূপ, যা দৈনন্দিন ভাষার তুলনায় ভিন্ন। দৈনন্দিন ভাষার মূল উদ্দেশ্য হলো ‘জ্ঞাপন’ বা জানানো, যেখানে সাহিত্যিক ভাষার লক্ষ্য হলো ‘প্রকাশ’। সাহিত্যের ভাষা অত্যন্ত সংগঠিত ও সুনির্দিষ্ট। অবয়ববাদীরা সাহিত্যের এই সংগঠন বা গঠনকাঠামোর রহস্য বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন। তারা রচনাটির ধ্বনি, শব্দ, বাক্য এবং স্তবকগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক ও সংগঠনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং কিভাবে এই উপাদানগুলি মিলিত হয়ে একটি সমগ্র রচনা তৈরি করেছে তা বিশ্লেষণ করেন।

একজন শৈলীবিজ্ঞানীর কাজ হল সাহিত্যের ভাষার বিন্যাস ও তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করা। তবে স্ট্রাকচারালিস্টরা সেই নিরাসক্ততা থেকে কাজ করেন না। তাদের মতে, সাহিত্য এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে ভাষা কখনো কখনো বিষয়বস্তুর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তাকে ছাপিয়ে ওঠে। সাহিত্যের ভাষা নিজস্ব একটি শৃঙ্খলা মেনে চলে, তবে তা সাধারণ ভাষার শৃঙ্খলা থেকে কিছুটা বিচ্যুত। কবি বা সাহিত্যিকের কাজ হলো সেই প্রথাগত শৃঙ্খলাকে ছাড়িয়ে গিয়ে একটি নতুন রীতি তৈরি করা, যা পূর্বানুমানিত নীতির বাইরে থাকে।

স্ট্রাকচারালিজমের মতে, যে কোনো সাহিত্যকর্মের মূল কাঠামো বা অবয়বকে আবিষ্কার করাই সমালোচকের কাজ। উদাহরণস্বরূপ, একটি কবিতাকে যদি ‘অঙ্গী’ বলে ধরা হয়, তবে তার স্তবক, পঙক্তি এবং শব্দগুলি সেই অঙ্গীর উপাদান। একজন স্ট্রাকচারাল সমালোচক এই উপাদানগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক খুঁজে বের করেন, এবং দেখেন কিভাবে এই উপাদানগুলি একত্রে একটি সুন্দর এবং সংগঠিত অবয়ব তৈরি করেছে।

শব্দের সম্পর্ক ও তার গঠনমূলক বৈশিষ্ট্য স্ট্রাকচারালিজমের কেন্দ্রীয় চর্চার বিষয়। যেমন, একটি বাক্যের ভেতর শব্দগুলি যেভাবে সাজানো হয়, তা কেবলমাত্র একক শব্দের অর্থ বা তাৎপর্যের উপর নির্ভর করে না। উদাহরণস্বরূপ, ‘‘এক বিন্দু নয়নের জল/কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল/এ তাজমহলে’’— এই তিনটি পঙক্তি একত্রে একটি বিশেষ অনুভূতি প্রকাশ করে। এখানে ‘কালের’ পাশে ‘কপোলতলে’ শব্দের সম্পর্ক এমন একটি চিত্র ফুটিয়ে তোলে, যা অন্য কোনো প্রতিশব্দ ব্যবহার করলে হয়তো তেমনটা প্রকাশ পেত না।

অবয়ববাদীরা এ ধরনের সম্পর্কগুলো বিশ্লেষণ করেন এবং খুঁজে বের করেন কিভাবে এই সম্পর্কগুলি একটি সংগঠিত অর্থবোধ তৈরি করছে। কবিতার ক্ষেত্রেও শব্দগুলির পুনঃব্যবহার বা দ্বিরুক্তি যেমন ‘‘Like a red red rose’’-এ দেখা যায়, সেটি ভুল নয়, বরং এর মধ্যে গভীর রস-রহস্য লুকিয়ে থাকে। শব্দ দুবার ব্যবহৃত হলে তা একটি নতুন মাত্রা পায় এবং পাঠকের মনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। স্ট্রাকচারালিস্টদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ।

তবে অবয়ববাদীরা শুধুমাত্র এ পর্যায়ে থেমে যান না। তারা দেখেন কিভাবে প্রাচীন উপাদানগুলো কৌশলে রূপান্তরিত হয়েছে, কিভাবে পুরনো নিয়ম থেকে বিচ্যুত হয়ে নতুন আকার ধারণ করেছে। একজন কবি বা সাহিত্যিক তার উপাদানগুলিকে কেবলমাত্র সাজিয়ে তোলেন না, বরং সেগুলির মধ্য দিয়ে সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটান। স্ট্রাকচারাল সমালোচকের কাজ হলো এই সৃজনশীলতার অন্তর্নিহিত কাঠামোকে উদ্ঘাটন করা এবং বুঝতে পারা যে, রচনাটির বাইরে থাকা গঠনগুলো কিভাবে আভ্যন্তরীণ রূপ নিয়েছে।

যদিও স্ট্রাকচারালিজম কাব্য ও সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট বিশ্লেষণ পদ্ধতি, তবুও প্রশ্ন উঠেছে: স্ট্রাকচারালিজমের পরে কী আছে? এ কারণে বলা যায়, স্ট্রাকচারালিজমই সাহিত্যের চূড়ান্ত বিচার নয়, বরং এটি আরও বড় একটি চিন্তার ধারার অংশ মাত্র।

তথ্যসূত্র:

কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্তDownload
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাসDownload
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরীDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাসDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যালDownload
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাসDownload
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তDownload
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দীDownload
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যালDownload
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেনDownload
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায়Download
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষDownload

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!