//
//

একাঙ্ক নাটকের সংজ্ঞা, স্বরূপ এবং একটি একাঙ্ক নাটক আলোচনা কর।

একাঙ্ক নাটক

বর্তমান সময়কে নাট্যসৃষ্টির পক্ষে সুসময় অনেকেই মনে করেন না, কারণ গত শতকে এক বর্তমান শতকের একেবারে প্রথম দিকে প্রচুর উল্লেখযোগ্য নাটক রচিত হওয়া সত্ত্বেও সাম্প্রতিককালে মৌলিক নাটকের সংখ্যা খুব কম। একমাত্র একাঙ্ক নাটকের ক্ষেত্রে সে কথা বলা চলে না। একাঙ্ক নাটকের সংখ্যা যেমন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি বৃদ্ধি পাচ্ছে এর জনপ্রিয়তা। পূর্ণাঙ্গ নাটকই যখন প্রায় সর্বস্ব ছিল তখন বড় জোর নাটকের মুখবন্ধ হিসাবে একাঙ্ক নাটক অভিনয়ের কথা ভাবা যেতো। এখন শুধু যে একাঙ্ক নাটক প্রচুর লেখা হয় তাই, তা প্রকাশও হয় খুব বেশি, একাঙ্ক-সংকলনের সাক্ষাৎ আমরা এখন পাই, এমনকি একাঙ্ক বিষয়ক আলোচনার পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থও। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে তো বটেই, ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলেও নিয়মিত একাঙ্ক নাটকের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার এটি একটি বড় প্রমাণ।

একাঙ্ক নাটক বলতে আমরা সাধারণভাবে বুঝি, একটি দৃশ্যে, সীমিত সময়ে—বোধ হয় প্রতিযোগিতার নিয়মের কথা স্মরণে রেখেই, এক ঘণ্টার মধ্যে অভিনয়যোগ্য এক ধরনের নাটক। তবে একাঙ্ক নাটকের গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষণ সম্বন্ধে জানতে হলে এ বিষয়ে যারা বিস্তৃত আলোচনা করেছেন তাদের শরণাপন্ন হতে হবে।

একান্ত নাটকের বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করতে গিয়ে জন হ্যাম্পডেন বলেছেন— “An one-act play deals with a single dominant dramatic situation and aims at producing a single effect…, since the play is to be acted in a short space of time, me greatest artistic unity and economy are essential to success.”

এই ‘Unity and economy’-র কথা সমালোচক হার্ম্যান আউল্ড-ও বলেছেন, তবে সেই সঙ্গে তার বৈচিত্র্যের দিকটাও দেখিয়েছেন—“It may be neat, compact and rigid, bu it may also be way ward, expansive and flexible. So long as it does not conflict with the fundamental principles of drama, it may venture into a hundred different directions and exploit as many themes as the ingenuity and inventiveness of the author can suggest.’’

একাঙ্ক নাটকের বৈশিষ্ট্য

একাঙ্ক নাটকের এইসব লক্ষণনির্দেশ এবং বাংলা একাঙ্ক আলোচনা যারা করেছেন তাদের। আলোচনা স্মরণ রেখে আমরা বলতে পারি, একাঙ্ক নাটকের প্রধান লক্ষণগুলি হল—

  • তীব্র একমুখিনতা
  • সংবদ্ধতা ও বাহুল্য বর্জন
  • ত্রিবিধ ঐক্যের আদর্শ সমন্বয়
  • ঘটনার দ্রুতময়তা এবং
  • নাটকের মৌলিক সত্য অক্ষুণ্ন রেখে প্রচুর স্বাধীনতা।

সুতরাং একাঙ্ক নাটকের একটি দৃশ্যে অভিনয়যোগ্যতার কথা স্মরণ রেখে এই সব লক্ষণের সাহায্য নিয়ে এর একটা সংজ্ঞাও আমরা নিরূপণ করতে পারি এইভাবে—

একাঙ্ক নাটক হল এক দৃশ্যে অভিনয়যোগ্য দ্রুত-সংঘটিত, বাহুল্যবর্জিত এমন এক ধরনের সংবদ্ধ নাটক যার প্রধান বৈশিষ্ট্য তীব্র একমুখিনতা, অথচ নাটকের মৌল লক্ষণ অবিকৃত রেখে যাতে প্রচুর স্বাধীনতা গ্রহণের অবকাশ রয়েছে।

একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে একাঙ্ক নাটকের এই লক্ষণসমূহ এবং তার সংজ্ঞার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মিল আছে ছোটগল্পের। এ বিষয়ে কোনো কোনো সমালোচক আমাদের সচেতনও করেছেন। কিন্তু আপাতত সে প্রসঙ্গ উল্লেখের কারণ একাঙ্ক নাটকের উৎস সম্বন্ধে কিছু মন্তব্য করা। অনেক সমালোচকই একাঙ্ক নাটকের উৎস সন্ধানে যাত্রা করতে গিয়ে বড় দীর্ঘ পথপরিক্রমা করেছেন। সংস্কৃত নাটকে ভাসই প্রথম একাঙ্ক নাটকের সূচনা করেন এমন কথা কেউ কেউ বলেছেন এবং তাঁর ‘মধ্যম ব্যায়োগ’, ‘দূত ঘটোৎকচ’, ‘কর্ণভার’, ‘উরুভঙ্গ’ প্রভৃতি নাটকের উল্লেখ করেছেন। এছাড়া কালিদাসের পূর্বে আবির্ভূত নাট্যকারদের মধ্যে বররুচির ‘উভয়ভিসারিকা’, শূদ্রকের ‘পদ্ম প্রাভৃতক’ প্রভৃতির নামও কারও মনে পড়েছে। পাশ্চাত্য নাটকের ইতিহাসে তেমনি সমালোচকের মনে হয়েছে, পঞ্চাদশ শতাব্দীর ইংরেজি সাহিত্যে একাঙ্কিকার অস্তিত্ব লক্ষ করা সম্ভব। এসব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম গবেষণার ফলে একাঙ্ক নাটকের যে বীজই আবিষ্কার করা সম্ভব হোক, ছোটগল্প যেমন আধুনিক জীবনের সাহিত্যফসল, একাঙ্ক নাটকও তাই।

একটি সার্থক বাংলা একাঙ্ক নাটক

‘রাজপুরী’ মন্মথ রায়ের অন্যতম বিখ্যাত একাঙ্ক নাটক, দেখা যাক সেটি সার্থক একাঙ্ক নাটক হয়ে উঠতে পেরেছে কিনা।

‘রাজপুরী’ নাটকের কাহিনী মন্মথ রায় গ্রহণ করেছেন বৌদ্ধ আখ্যান ‘ভদ্রশালজাতক’ থেকে। এর আখ্যানভাগ মোটামুটি এই রকম। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাছে সম্মান ও প্রতিষ্ঠা লাভ করার জন্য কোশলরাজ প্রসেনজিৎ বিবাহ করেছিলেন শাক্যদুহিতা বাসবক্ষত্রিয়াকে। নাটক শুরু হয় এমন একটি দিনে যেদিন রাজপুরীতে বিরাট উৎসব। একদিকে চৈত্রমাসের বসন্তোৎসব, অন্যদিকে কনিষ্ঠ কুমার রাজশেখরের তৃতীয় বার্ষিক জন্মতিথি পালন—তার ওপর আবার মাতুলালয় থেকে সেদিনই ফিরেছেন ষোল বছরের যুবরাজ বিরূধক, তাকে নিয়ে আসছেন বাসবক্ষত্রিয়ার পূর্বপ্রণয়ী সুগায়ক কবিশেখর। উৎসব উপলক্ষে শান্তার পায়ে আবিরকুঙ্কুম ছুইয়ে এনেছেন রাজা, রাণীকে বলেন প্রজাদের মঙ্গলের জন্য তাদের সেই পবিত্র ধূলি বিতরণ করতে। রাণী কিন্তু কৌশলে সে অনুরোধ এড়িয়ে যান। বাসবক্ষত্রিয়া মান-অভিমানের পর রাজাকে বলেন, তিনি জানেন রাজা তাকে ভালবাসেন না—বিবাহ করছেন শুধু বংশমর্যাদার জন্য। রাজা একথা স্বীকার করলে তিনি ভালবাসার জন্য আর্তি জানান।

এরপর সভাগৃহে কবিশেখরের গান শুরু হবে, রাজা সেখানে যেতে অনুরোধ জানান রাণীকে। রাণী এ প্রস্তাবও এড়িয়ে যান বিরূধকের সঙ্গে আগে দেখা করার অজুহাতে। যেতে হয় অগত্যা রাজাকেই একা। কিছুক্ষণ পরে কবিশেখর এসে দেখা করেন রাণীর সঙ্গে। গুপ্ত বিদ্রোহের খবর পেয়ে রাজা চলে গেছেন দুর্গে, রাতে হয়তো ফিরবেন না। রাণী খুশী হলেন কবিশেখরের সঙ্গ পেয়ে। অতীত স্মৃতিচারণায় দুর্বল রাণী কবিশেখরকে অনুরোধ জানালেন গকে নিয়ে পালানোর জন্য, সম্মত হন না কবিশেখর—চলে যান রাণীকে ছেড়ে।

ক্রুদ্ধ রাণী মূক ক্রীতদাসকে বলেন কবিশেখরের চোখ উপড়ে আনার জন্য। ক্রীতদাস ভুল বোঝে, সে উপড়ে নিতে যায় রাজশেখরের চোখ। জীবন বিপন্ন করে তাকে বাঁচান কবিশেখর এবং রাণীর আদেশ বুঝতে পেরে নিজের চোখ দুটি উপড়ে উপহার পাঠান রাণীকে। যন্ত্রণাদগ্ধ রাণ রাজপুরী ত্যাগ করে চলে যান বুদ্ধের আশ্রমে।

এদিকে চরমতম দুঃসংবাদ দেয় বিরূধক রাজা ফিরে এলে। সে জানায় রাণীর আসল পরিচয়। রাণী মোটেই শাক্যবংশের মেয়ে নয়, রাজার এক নর্তকীর কন্যা—প্রসেনজিৎকে পাবার জন্যই শাক্যরা এই কৌশল করেছে। বিরূধক রাজপুরীতে ফিরেই শাক্যদের রক্তে বন্যা বইয়ে দিতে বলেছে এবং আনতে বলেছে শান্তার ছিন্নমুণ্ড। রাজা রাণীর প্রকৃত পরিচয় শুনে ক্রুদ্ধ ও মর্মাহত। সঙ্গে সঙ্গে তাকে তিনি দেন নির্বাসনদণ্ড, কিন্তু শোনেন, রাণী স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিয়ে চলে গেছেন। এতে রাজা এবং তার পুত্র দুজনেই ব্যথিত হন, দুজনেই ক্ষমা করে দেন রাণীকে এবং সংকল্প করেন তাকে ফিরিয়ে আনবেন। ঠিক সেই সময়ই প্রতিহারী স্বর্ণপাত্রে এক ছিন্ন মুণ্ড নিয়ে আসে বুদ্ধের আশ্রম থেকে। বিরূধক মনে করেন এ মুণ্ড শান্তার—কিন্তু আবরণ উন্মোচন করে দেখা যায় তা রাণীর।

এবার লক্ষণ মিলিয়ে দেখা যেতে পারে সার্থক একাঙ্ক নাটকের পর্যায়ে এটি উন্নীত হয়েছে কিনা। প্রথমত, প্রায় এক ঘণ্টা সময়ে অভিনয়যোগ্য এই একাঙ্ক নাটকটিতে যা শ্রোতাদের মুগ্ধ করবে তা এর উদ্দেশ্যের একমুখিনতা। বলগর্বে দীপ্ত রাজা প্রসেনজিৎ প্রায় জোর করেই শাক্য বংশের মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন নিজের বংশগৌরব বৃদ্ধি করবার জন্য এর পেছনে প্রেম বা করুণার কোনো সম্পর্ক ছিল না, সম্পর্ক ছিল প্রয়োজনের। শাক্য বংশের মানুষও যে তাই এর প্রতিশোধ নিয়েছে, শাক্য রাজকন্যার পরিবর্তে প্রসেনজিতের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে রাজার নাচনেওয়ালীর কন্যার—এই সংবাদটি ষোল বছর ধরে গোপন রেখে এসেছেন রাণী সুকৌশলে। আখ্যানের এই নাটকীয় রহস্য-উন্মোচনই এই নাটকীয় উদ্দেশ্যের একমুখিনতা। অথচ সেই সঙ্গে চরিত্রের গভীর অন্তর্মুখী দ্বন্দ্ব নাটকটিকে উজ্জীবিত করেছে, কারণ দ্বন্দ্বময়তাই নাটকের প্রাণ। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলা দরকার।

রাণী যে শাক্যদুহিতা নন, এই গোপন তথ্যটির ওপর সমগ্র নাটকীয় আখ্যানটি নির্ভরশীল কারণ রাজা প্রসেনজিৎ জানেন তিনি শাক্যদুহিতাকে বিবাহ করে বংশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। সংগত কারণেই নাটক শুরু হয় রাজার বিবাহের দীর্ঘদিন পরে, ষোল বছরের বিরূধক মাতুলালয় থেকে রাজপুরীতে যেদিন ফিরে আসছে সেদিন। নাটকটির নাটকীয় গ্রন্থিমোচন যে অন্যত্র থাকতে পারে, এটা বোঝাবার জন্যই সম্ভবত রাণীর পূর্বপ্রণয়ী কবিশেখরকে বিরূধকের সঙ্গে আমরা দেখতে পাই। সভাগৃহে কবিশেখরের গান শুনতে যাওয়ার ব্যাপারে রাণী অসম্মত অথচ রাজা দুর্গে চলে যাবার পর রাণী যেভাবে কবিশেখরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন—“অসম্ভব! ভুলে যাওয়া সম্পূর্ণ সম্ভব! কেমন করে ভুলি। আমার রক্তমাংসে তুমি জড়িয়ে রয়েছে। আমার এই নগ্ন সত্যকে মিথ্যার আবরণে আর কতদিন ঢেকে রাখতে পারি”?—এরপর আর সন্দেহ থাকে না, রাণীর এই গোপন প্রণয়ই বোধহয় রাজপুরীতে বিপর্যয় ডেকে আনবে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা যে তা নয়, তার প্রথম আভাস নাট্যকার দিয়েছেন মঙ্গলধূলি প্রজাদের বিতরণ করার ব্যাপারে রাণীর অসম্মতি দেখিয়ে। আসলে নীচ বংশের কন্যা হিসাবে রাণীর যে এই মঙ্গলকর্মে কোনও অধিকার নেই, সে কথাটি ইঙ্গিতের দ্বারা এখানে বোঝানো হয়েছে।

নাটকের দ্বিতীয় ইঙ্গিত এর পরেই এসেছে। রাণী রাজাকে প্রশ্নের পর প্রশ্নে উত্ত্যক্ত করেছেন, রাজা তাকে কী জন্য গ্রহণ করেছেন—তার রূপের জন্য অথবা বংশমর্যাদার জন্য। তিনি আকুল হয়ে বলেন—“আমাকে কি তুমি শুধু মানুষ বলে ভাবতে পার না? তুমিও মানুষ আমিও মানুষ-জন্ম আমাদের যা-ই হোক না কেন”।

নাটকের তৃতীয় ইঙ্গিত এই বিগত ঘটনার উন্মোচনে যে, কাশী থেকে আগত এক নর্তকী তাদের সম্মুখে নৃত্য প্রদর্শনকালে বিবসনা হয়ে পড়লে রাণী তাঁর মস্তক মুণ্ডনের আদেশ।

রছিলেন। সাধারণ নর্তকীর কাছে যে আচরণ মোটেই অস্বাভাবিক নয়, তার জন্য রাণীর এই অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া কেন, সচেতন দর্শক সে কথা ভাবতেই পারেন। বিশেষ করে, এই ঘটনা। কারণ করার পরেই রাণী বলেন—“এখন আমার ইচ্ছে হয়, আমিই তার সেই নগ্ন নাচ নাচি— চাহের এই মিথ্যা আবরণ ছিন্নভিন্ন করে ফেলি”—প্রকৃতপক্ষে যিনি রাজনৰ্তকীর কন্যা তিনি কথা বলতেই পারেন এবং নর্তকীর অসৌজন্যে তার পূর্বোক্ত আচরণও অস্বাভাবিক নয়।

নাটকের চতুর্থ ইঙ্গিত, কবিশেখরের প্রত্যাখ্যানে রাণীর উন্মত্তের মতো আচরণ। এইসব আচরণের মূলে যে সত্যটি রয়েছে—সমগ্র নাটকে যে সত্যটি উন্মোচিত হবার জন্য অপেক্ষা করেছে, তা আমরা শুনি বিরূধকের মুখে। এই সত্য জানবার পর রাণীর প্রত্যেকটি আচরণের রহস্য আমাদের কাছে সহজ ও স্পষ্ট হয়ে আসে।

এই সঙ্গেই আমাদের মনে রাখতে হবে এর মধ্যে নাট্যধর্ম যাতে বজায় থাকে সে ব্যাপারে নাট্যকার অতিমাত্রায় সচেতন ছিলেন। বহিরঙ্গ ঘটনা এখানে অনেক ঘটেছে, ঘটবেই কারণ। নাটক বলতে কেবল চরিত্রের সংলাপ আমরা বুঝি না, তার আচরণ বুঝে থাকি; কিন্তু একটু লক্ষ করলেই বোঝা যাবে, বাইরের এই সব দ্বন্দ্বময়তা আসলে প্রতিফলিত করেছে চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্বকেই। অন্তর্দ্বন্দ্বের সূচক হিসাবে চমকিত বাহ্যিক ঘটনাকে গ্রহণ করতে পারলে আমরা নাটকীয় দ্বন্দ্বের স্বরূপ বুঝতে পারবো। রাণী সর্বদা কেন অস্থির, কেন তিনি বিরূধকের সঙ্গে কথা না বলে অন্য কিছু করতে পারেন না, সে আমরা পরে বুঝি। তিনি আশঙ্কিতা পাছে বিরূধক সত্য সংবাদ জানতে পারে। রাণী কবিশেখরের সঙ্গে পালাতে চান ওই মিথ্যার প্রলম্বিত অধ্যায় টানতে পারছেন না বলে। নৃশংস আদেশ দিতে পারেন তিনি নর্তকীর কন্যা বলে, আবার প্রায়শ্চিত্ত করতে পারেন অপরাধবোধের তীব্রতা থেকে। হৃদয়-সমুদ্রের ওপরের তরঙ্গভঙ্গ দেখে বিচার করলে নাটকটির প্রতি অবিচার করা হবে, চোখের আড়ালে কতো আশ্রয় ধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে তার সঠিক অনুভবেই এর প্রকৃত নাটকীয়ত্ব বোঝা যাবে।

দ্বিতীয়ত, নাটকটির সংবদ্ধতা ও বাহুল্য বর্জনক্ষমতা একাঙ্ক নাট্যকারদের আদর্শ হতে পারে। অনেকগুলি কাহিনীর স্রোত একটি দৃশ্যে সংহত করতে হয়েছে মন্মথ রায়কে বিরূধকের রাজপুরীতে প্রত্যাবর্তন, রাজার বসন্ত-উৎসব, রাণীর সঙ্গে কবিশেখরের অবৈধ সম্পর্ক, রাজার বিরুদ্ধে গুপ্ত ষড়যন্ত্র এবং তারপর মূল নাট্যদ্বন্দ্বের বিস্তার। অত্যন্ত দতার সঙ্গে সব কটি স্রোত তিনি নিয়ন্ত্রণ করেছেন, যে ঘটনার ঠিক যতটুকু গুরুত্ব পাওয়া উচিত। তাকে ততটুকুই গুরুত্ব দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘মালিনী’ নাটকটি যেমন চমকিত ঘটনা সত্তেও অতি সংহতভাবে মালিনীর ‘ক্ষম ক্ষেমংকরে’ দিয়ে শেষ হয়েছিল, এখানেও রাণীর ছিন্নমুণ্ড দেখার পর দুটি মাত্র সংলাপ আমরা পাই

দেহরক্ষী—‘আশ্রমের প্রথম হত্যা’

বিরূধক—‘আশ্রমের শেষ হত্যা-মা! মা!”

তৃতীয়ত, একাঙ্ক নাটকের ত্রিবিধ ঐক্যকে নিষ্ঠভাবেই মেনে চলা হয়েছে। রাজপুরীর চৌহদ্দির মধ্যে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এই নাটকের সমগ্র নাট্যক্রিয়া সমাপ্ত হয়েছে। ক্রিয়া বা ঘটনাগত ঐক্যও রক্ষিত হয়েছে এই কারণে বলা যায় যে সর্বক্ষণই একটি টানটান উত্তেজনা এবং রহস্যের মধ্যে নাটক সংঘটিত হয়েছে। সংলাপে ও আচরণে কোথাও নাট্যকার এই। একাগ্রতা নষ্ট হতে দেননি।

চতুর্থত, নাটকটি অত্যন্ত গতিশীল-প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দর্শক কোথাও অনুভবের বা একঘেয়েমিতে আক্রান্ত হবার কোনো সুযোগ পান না।

এইসব কারণেই আমরা আমরা বলতে পারি, সার্থক একাঙ্ক নাটকের লক্ষণ বিচারে রায়ের ‘রাজপুরী’কে একটি রসোত্তীর্ণ ও শিল্পোত্তীর্ণ একাঙ্ক নাটক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।

তথ্যসূত্র:

কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্তDownload
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাসDownload
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরীDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাসDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যালDownload
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাসDownload
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
সাহিত্যের রূপরীতি ও অন্যান্য – কুন্তল চট্টোপাধ্যায়Download
সাহিত্য ও সমালোচনার রূপরীতি – উজ্জ্বলকুমার মজুমদারDownload
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তDownload
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দীDownload
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যালDownload
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেনDownload
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায়Download
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষDownload

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!