বাংলা কবিতার ইতিহাসে অজিত দত্তের অবদান আলোচনা কর।
অজিত দত্ত
বুদ্ধদেব বসুর সহযোগী হিসেবে রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্যে অজিত দত্তের আবির্ভাব। কল্লোল যুগের সাহিত্যিক হয়েও তিনি রবীন্দ্র বিরোধিতায় উচ্চকণ্ঠ নন। নৈরাশ্যের বেদনা কবিকে জীবনবিমুখ না করে জীবনবাদী করে গড়ে তুলেছিল। কাব্যের চিরাচরিত উপাদান তাঁর কাব্যে স্থান লাভ করেছে। কবিদৃষ্টিতে তিনি ছিলেন ভাববাদী ও রোমান্টিক এবং প্রকাশভঙ্গিতে ছিলেন সহজ ও সরল। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ‘কুসুমের মাস’ কাব্যগ্রন্থ নিয়েই কাব্যজগতে তাঁর আবির্ভাব। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল— ‘পাতাল কন্যা’ (১৯৩৮), ‘নষ্টচাঁদ’ (১৯৪৫), ‘পুনর্ণবা’ (১৯৪৭), ‘ছায়ার আলপনা’ (১৯৫১) ইত্যাদি।
অন্যান্য রবীন্দ্রোত্তর কবিদের মতো অজিত দত্তও প্রেমের কবিতা লিখেছেন। প্রেম, সৌন্দর্য ও রোমান্স তাঁর কাব্যের অন্যতম উপাদান। বুদ্ধদেব বসুর ‘কঙ্কাবতী’, জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’-এর মতো অজিত দত্তের ‘মালতী’ তাঁর কাব্যের নায়িকা। এই মালতীকে কেন্দ্র করে রোমান্টিক প্রেম ও সৌন্দর্যের কল্পজগৎ রচনা করেছেন কবি—
তুমি ছাড়া এ জীবনে দুঃখের নাহিক মোর পার।
এ-কথা কহিবো আমি লক্ষ বার আকাশের কানে;
এ-কথা ছড়ায়ে দিবো আজ রাত্রে প্রত্যেক তারায়,
বাতাসে ভাসাবো আমি এই সত্য সমস্ত ধরায়।
তাঁর রচিত সনেটগুলি প্রশংসার দাবি রাখে। বুদ্ধদেব বসু ‘কুসুমের মাস’ কাব্যগ্রন্থের আলোচনা প্রসঙ্গে জানিয়েছেন— “প্রথমেই বলে রাখি, টেকনিকের দিক থেকে অজিতকুমারের সনেটগুলো অনবদ্য, বাঙলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ।” তাঁর মতে এই সনেটগুলো যেন “ভালবাসার বিভিন্নভাবের এক একটি ছবি।… ভাষার মিতব্যয়িতা, ব্যঞ্জনার সংযম, ভাবের কঠোরতা অজিত দত্তের সনেটের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তার সনেটে লক্ষ করা যায়, সমকালীন জীবনের মেঘকৃষ্ণ বন্ধ্যা অন্ধকারের জন্য কবির আক্ষেপ। নৈরাশ্যপীড়িত পৃথিবীতে কবি ক্লান্ত হলেও কবির মনে ছিল রোমান্টিক মনের স্বপ্ন— “সিন্ধুতলে মৎস্যকন্যা, গিরিশিরে গন্ধর্ব-নগরী।”
‘প্রার্থনা’ সনেটে কবির অস্তিত্ববাদী স্বরূপ ও বিশ্বের মঙ্গলময়তার প্রতি কবির বিশ্বাস ধ্বনিত হয়েছে। এই কবিতায় কবি সংকীর্ণ গণ্ডীবদ্ধ জীবন অতিক্রম করে তাকে উন্মুক্ত বৃহত্তর জীবনে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রার্থনা জানিয়েছেন। কোন বিষাদ বা হতাশায় তিনি জর্জরিত হয়ে না থেকে সৃষ্টির আনন্দে নিজেকে পুনরুজ্জীবিত করতে চেয়েছেন কবি। আর এখানেই রবীন্দ্রোত্তর কবিদের মধ্যে তাঁর স্বাতন্ত্র্য উপলব্ধি করা যায়।
Leave a Reply