//
//

ইংরেজি সাহিত্যে কবি চসারের কৃতিত্ব আলোচনা কর।

জিওফ্রে চসার (১৩০৪-১৪০০)

আধুনিক ইংরাজি কবিতার জনক জিওফ্রে চসারের (১৩০৪-১৪০০) আবির্ভাব চতুর্দশ শতাব্দীতে। কালের বিচারে চসার মধ্য যুগের মানুষ হলেও তার মানসিকতা ছিল আধুনিককালের মতো উদার। কেননা তাঁর কাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল জীবনের প্রতি সুগভীর সহানুভূতি ও মানবপ্রেম। সাহিত্যক্ষেত্রে চসারের আবির্ভাব ফরাসী ও ইতালীয় রচনাসমূহের অনুবাদকরূপে হলেও তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা হল ‘ক্যান্টারবেরি টেলস’ (Canterbury Tales)। এই গ্রন্থের জন্য তিনি ইংরাজী সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। তারাশঙ্করের সাহিত্যে যেমন মানুষের প্রতি মমত্ববোধ ও গভীর জীবন প্রত্যয় লক্ষ করা যায় তেমনি মমত্ববোধ ও প্রত্যয় ছিল চসারের—যা তার ‘ক্যান্টারবেরি টেলস’-এর ছত্রে ছত্রে নিহিত রয়েছে।

চসার ছিলেন মাতৃভাষানুরাগী। তাই তিনি মাতৃভাষাকে (Kings English) উন্নত করার চেষ্টা করেন। মধ্য যুগে কোনও স্বপ্ন বা রূপককে অবলম্বন করে সাহিত্য রচিত হত। চসারও প্রথমে এইসব ড্রিম এবং রূপককে (Allegory) অবলম্বন করে সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। প্রেমের রূপকে রচিত তাঁর অনুবাদমূলক গ্রন্থ হল— ‘রোমাউন্ট অব দি রোজ’ (Romaunt of the Rose) এছাড়া তাঁর প্রথম দিককার এই ধরনের রচনা হল ‘দি পার্লামেন্ট অব ফাউলস’, ‘দি লিজেণ্ড অব গুড ওম্যান’। এইসব রচনায় কবি জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সমাজের বাস্তব ছবিকে চিত্রিত করেছেন। সমাজের ত্রুটিগুলিকে হাস্যরসের মাধ্যমে পরিবেশন করতে চেয়েছিলেন চসার। তাই তাঁর সাহিত্যের চরিত্রগুলি হয়ে উঠেছে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্ভূত।

চসারের প্রথম দিকের রচনাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘দি বুক অব দি ডাচেস’ (The Boke of the Duchesse)। ১৩৬৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটি রচিত। চসারের পৃষ্ঠপোষক রাজকুমার জন অব গন্টের প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এই শোকগাথাটি রচিত। এই শোকগাথাটির নাটকীয়তা উল্লেখযোগ্য। এমনকি স্বপ্ন ও রূপকের ধোঁয়াটে আবরণের মধ্যেও মাঝে মাঝে জীবনের বাস্তবতা উকি দিয়ে গেছে। তাছাড়া করুণরসের সুরেলা প্রকাশ গাথাকাব্যটির কাব্যমহিমাকে উজ্জ্বল করে তুলেছে।

দি পার্লামেন্ট অন্ ফাউলস্’ (The Parliament of Fowls) চসারের আর একটি হাস্যরসাত্মক রচনা। এই গ্রন্থে পাখির রূপকে বিভিন্ন দার্শনিক তত্ত্ব আলোচিত হয়েছে। এই গ্রন্থে বিভিন্ন জাতীয় পাখির মধ্যে প্রণয়ের আদর্শ ও স্বরূপ নিয়ে গুরুগম্ভীর দার্শনিক আলোচনা ও তর্কনৈপুণ্য প্রদর্শিত হয়েছে। তবে রচনাটির মধ্যে বৈপরীত্য হাস্যরসসৃষ্টির অনুকূল হয়েছে।

চসারের আর একটি উন্নত কল্পনাময় গ্রন্থ হল ‘দ্য হাউস অব ফেম’ (The House of Fame)। কবি স্বপ্নে ভেনাসের মন্দির থেকে ঈগল পাখির দ্বারা নির্জন স্থানে অবস্থিত খ্যাতির সৌধে উপনীত হয়েছিলেন। সেই সৌধটি ছিল বরফের পর্বতের Tots walau-Writen full of names of Folk that hadden grcte fames. দান্তের কল্পনা চসারের ছিল ঠিকই, কিন্তু সেই কল্পনা এই কাব্যে ঊর্ধ্বচারী না হয়ে তা হয়ে উঠেছে মৃত্তিকাসংলগ্ন।

‘ট্রয়লাস অ্যাণ্ড ক্রেসিডা’ চসারের আর একটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। এটি আটহাজার পঙক্তিতে পূর্ণ। কাব্যটির মূল প্রেরণা ইতালির খ্যাতনামা গল্পলেখক বোকাচ্চিয়োর ‘ইল ফিলোসট্রাটো’ (ill Filostrato’) গ্রন্থ থেকে। তবে আরো অন্যান্য উপাদান থেকেও চসার তাঁর গ্রন্থের উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। একথা ঠিকই যে, একটি পুরনো কাহিনীকে কাব্যের উপাদানস্বরূপ গ্রহণ করে কবি চসার মানবজীবনের অতিপরিচিত রূপটিকে পাঠকের কাছে উপস্থাপিত করেছেন। কেননা, প্রাচীন ও মধ্যযুগের কবিরা যেখানে ক্রেসিডকে বিশ্বাসঘাতিনী প্রেম-পসারিণীরূপে নিন্দা করেছেন ও তার সঙ্গে ট্রয়রাজপুত্র ট্রয়লাসের ভাগ্যবিড়ম্বিত প্রণয়কাহিনীকে মধ্যযুগের প্রক্ষাপটে মূল্যায়ন করেছেন। আসলে চসার এই কাব্যের প্রেমস্বরূপকে কোন আদর্শের দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করে তাকে অঙ্কিত করেছেন মনস্তত্ত্বের আলোকে। সেজন্য ক্রেসিডার জটিল অর্থ কাব্যটিকে মহনীয়তা দান করেছে। সেই সঙ্গে নাটকীয় দ্বন্দ্ব ও সৌন্দর্যের দীপ্তি কাব্যটিকে বিশিষ্টতা দান করেছে। ট্রয়লাস মধ্যযুগের প্রথাবদ্ধ মনোভাবের অসহায় ক্রীড়নক নয়। কেননা ট্রয়লাস ছিলেন স্বাধীনচেতা। অন্যদিকে ট্রয়লাস ও ক্রেসিড এর প্রেমের মধ্যস্থতাকারী প্যাণ্ডারাস বাস্তববাদী চরিত্র। তার কোন ভাববিলাস নেই বরং সে জীবনকে উপলব্ধি করেছে নির্মোহদৃষ্টিতে। এজন্য প্যাণ্ডারাসকে ফলস্টাফের পূর্বসূরী বলা হয়ে থাকে। কাব্যটির গুরুত্ব মূলত ঔপন্যাসিকের মত মনোবিশ্লেষণে ও জীবনরসিকতায়। এই গ্রন্থের প্রভাবে শেকসপীয়র তাঁর ‘ট্রয়লাস অ্যাণ্ড ক্রেসিডা’ (Troilus and Cressida) রচনা করেন।

চসারের ‘ক্যান্টারবেরি টেলস্’ (Canterbury Tales) এক উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ। চসার বোক্কাচিওর ‘ডেকামেরন’ থেকে ছোটগল্পের প্রেরণা পেয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। এই গ্রন্থটি চসারের শিল্পীপ্রতিভার এক অনবদ্য দৃষ্টান্তস্থল।

এই গ্রন্থের মুখবন্ধে (Prologue) চসারের প্রতিভার পরিচয় বেশ স্পষ্ট। কেননা সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তি, উচ্চাঙ্গের পরিহাস এবং সমকালীন সমাজচিত্রের প্রতিফলনে এই অংশটি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই অংশের বিষয় হল ইংলণ্ডের বিভিন্ন শ্রেণী সম্প্রদায় ও ব্যবসায়ের প্রতিনিধিস্থানীয় বত্রিশ জন লোক তীর্থযাত্রীরূপে ক্যান্টারবেরির পবিত্র পীঠ দর্শনে গমনের কাহিনী। এই বত্রিশ জন লোকের বিশেষ বিশেষ পরিচয়গুলি এই অংশে সন্নিবিষ্ট করেছেন চসার।

চসারের কাব্য-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য

  • চসার ইংরেজি সাহিত্যের সংকীর্ণতা ঘুচিয়ে একে ইওরোপীয় ভাবধারার সঙ্গে সংযুক্ত করেছিলেন।
  • মধ্যযুগের কুসংস্কার ও ধর্মীয় গাম্ভীর্য এবং দেবতা ও স্বর্ণযুগের বীরদের। কাহিনী বর্জন করে বাস্তবজীবনকে রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপিত করেছেন।
  • ইংলণ্ডের বিভিন্ন শ্রেণী, সম্প্রদায় ও ব্যবসায়ের প্রতিনিধিস্থানীয় বত্রিশজন মানুষের চরিত্র চিত্রিত করেছেন। অক্সফোর্ডের পণ্ডিত থেকে মদ্যপ মিলওয়ালা কোন চরিত্রই তার লেখনীতে বাদ পড়েনি।
  • উচ্চশ্রেণীর ছোটগল্প রচয়িতার বেশির ভাগ বৈশিষ্ট্যই তাঁর ‘ক্যান্টারবেরি টেলস’-এ বর্তমান।
  • বাস্তবতা চসারের সাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর সাহিত্যের সঙ্গে জীবনের যোগ তাই অবিচ্ছিন্ন।
  • চসারের ‘ক্যান্টারবেরি টেলস’ যেন এক চরিত্রচিত্রশালা। চসার যে তীর্থযাত্রীদের বর্ণনা দিয়েছেন তার সহজ স্বাভাবিকতা আমাদের মুগ্ধ করে। মানবিক আবেদনে, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ বেদনার প্রকাশে চসার আধুনিক যুগের পথপ্রদর্শক।
  • জিওফ্রে চসার নরনারীর প্রাত্যহিক জীবনের অতি তুচ্ছ ঘটনার মধ্যে চসার আবিষ্কার করেছেন এক অপরূপ সত্তাকে—যে সত্তায় জীবন হয়ে ওঠে মধুময়।।
  • সমকালীন সমাজচিত্রণেও চসারের কৃতিত্ব সমধিক। ‘ক্যান্টারবেরি টেলস’-এর মুখবন্ধ অংশে মধ্য যুগের সমাজ যেন জীবন্ত রূপ লাভ করেছে। বিভিন্ন মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ, ভাব-ভঙ্গী, চরিত্র ও ব্যবহারগত পার্থক্যের অপরূপ নিখুঁত বর্ণনা সমকালীন সমাজচিত্রকে উদ্ভাসিত করেছে।
  • তাঁর সূক্ষ্ম পরিহাসরসিকতা গভীর জীবনবোধ সস্তৃত। তাই সমকালীন সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের চরিত্রের অসঙ্গতি ও দুর্বলতার প্রতি কটাক্ষপাত করেছেন চসার। সমাজ সমালোচনার আশ্চর্য শক্তি ছিল বলেই চসার স্বাধীন চিন্তার দ্বারা পরিহাসরসিকতার মাধ্যমে তাকে উপস্থাপিত করতে পেরেছেন এই গল্পগ্রন্থে।
  • চসারের গল্পগ্রন্থে চিত্রিত হয়েছে শাশ্বত কালের মানুষ। যে মানুষের পরিচয় ডেকামেরন কিংবা বাোক্কাচিওর গল্পে পাওয়া যায় না। তাই ব্লেক বলেছেন— “The characters of Chaucer’s pilgrims are the characters which compose all ages and all characters.” এমনকি ড্রাইডেনও বলেছেন— “I see all the pilgrims in the Canterbury Tales, their humors, their features and their very dress as distinctly as if I had supped with them at the Tabard inn Southwark.”
  • আঙ্গিকের অনবদ্যতাও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ছন্দের দিক থেকে ক্যান্টারবেরি টেক্স এর প্রতি পংক্তিতে দশটি ‘সিলেবল’ এবং পাঁচটি অ্যাকসেন্ট’ এবং চরণগুলি যুগ্মরূপে সজ্জিত। যেমন— His eyen twinkled in his heed aright As door the sterres in the frosty night.
  • চসারের অন্তরের গীতপ্রাণতা চিত্ররূপাঙ্কণ দক্ষতা কতখানি ছিল তার প্রমাণ এই গল্পগ্রন্থ। সর্বোপরি তার গল্পের দ্বারা শুধু ইংরাজি সাহিত্য নয়, বাংলা সাহিত্যের বহু গল্পকারও প্রভাবিত হয়েছেন।

তথ্যসূত্র:

ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসDownload
ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাস – শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়Download
ইংরেজি সাহিত্য পরিচয় – অরবিন্দ পোদ্দারDownload
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস – কুন্তল চট্টোপাধ্যায়Download
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ও মূল্যায়ন – বিমলকৃষ্ণ সরকারDownload
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস – অরুণ ভট্টাচার্যDownload

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!