আরাকান রাজসভার কবি দৌলত কাজীর কৃতিত্ব আলোচনা কর।
দৌলত কাজীর সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী
মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্য যখন দেবদেবীর মাহাত্ম্যকীর্তনে মুখরিত হয়েছিল তখন বাংলাদেশের বাইরে আরাকানের বৌদ্ধরাজাদের সভায় বাংলা সাহিত্যচর্চার নিদর্শন হিসেবে কবি দৌলত কাজী ‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী’ কাব্য রচনা করে মানবীয় আখ্যায়িকার ধারা প্রবর্তন করেন। এতদিন পর্যন্ত বাংলা কাব্যে দেবদেবীর প্রশংসাই উপজীব্য ছিল, মানুষের কাহিনি অবলম্বনে কাব্য রচনার কোন প্রয়াসই তখন পরিলক্ষিত হয়নি। মধ্য যুগে ধর্ম সংস্কারমুক্ত ঐহিক কাব্যকথার প্রবর্তন করেন মুসলমান কবিগণ এবং তা আরাকান রাজসভাকে কেন্দ্র করেই রূপায়িত হয়ে ওঠে। একান্ত মানবিক প্রেমাবেদন ঘনিষ্ঠ এসব কাব্য অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এ সময়ের কবিগণের পুরোধা দৌলত কাজী বাংলা রোমান্টিক কাব্যধারার পথিকৃৎ হিসেবে বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
দৌলত কাজী চট্টগ্রামের রাউজান থানার অন্তর্গত সুলতানপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কবির উপদেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষক আরাকানরাজের প্রধান অমাত্য ও লস্কর উজির আশরফ খানের নিবাসও ছিল রাউজানের অদূরবর্তী গ্রাম চারিয়ায়। মধ্য যুগের কবিগণের বৈশিষ্ট্যানুধ্যায়ী তাঁর কাব্যে কবির পৃষ্ঠপোষক সম্পর্কে বিবরণ থাকলেও নিজের পরিচয় সম্পর্কে তেমন কিছুই বলেননি। ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মতানুসারে কবির জীবনকাল আনুমানিক ১৬০০ থেকে ১৬৩৮ সাল পর্যন্ত। কবি সম্পর্কে নানা ধরনের কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। সে সব কিংবদন্তি থেকে জানা যায়, কবি অল্প বয়সে নানা বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। বয়সের স্বল্পতাহেতু নিজ দেশে স্বীকৃতি লাভে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে কবি আরাকান রাজসভায় আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সেখানে যথার্থ মর্যাদা লাভে সমর্থ হন। আরাকানের তৎকালীন অধিপতি থিরি থু ধর্মা বা শ্রীসুধর্মার (রাজত্বকাল ১৬২২-১৬৩৮ সাল) ‘লস্কর উজির’ বা সমর-সচিব আশরফ খানের অনুরোধে দৌলত কাজী ‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী’ কাব্য রচনা করেন। সংক্ষেপে কাব্যটি সতীময়না অথবা লোরচন্দ্রানী নামে পরিচিত। এ কাব্যের সঠিক রচনাকাল জানা যায়নি; অনুমান করা হয় ১৬৩৫ থেকে ১৬৩৮ সালের মধ্যে এ কাব্য রচিত হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত কাব্যটি সমাপ্ত হওয়ার পূর্বেই কবি মৃত্যুমুখে পতিত হন। কবির মৃত্যুর বিশ বৎসর পরে ১৬৫৯ সালে কবি আলাওল কাব্যের শেষাংশ রচনা করে তা সম্পূর্ণ করেন।
‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী’ কাব্যের কাহিনি খুবই প্রাচীন কাল থেকে লোকগাথা হিসেবে ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত ছিল। এই লোকগাথা অবলম্বন করে হিন্দি কবি মিয়া সাধন ‘মৈনাসত’ নামে একটি কাব্য লেখেন। দৌলত কাজী তা অবলম্বন করে ‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী’ কাব্য রচনা করেন। ভিন্ন ভাষা থেকে এ কাব্যের কাহিনি বাংলায় রূপান্তরিত করার জন্য আশরফ খান নির্দেশ দিয়েছিলেন—
ঠেটা চৌপাইয়া দোহা কহিলা সাধনে।
না বুঝে গোহারী ভাষা কোন কোন জনে।।
দেশী ভাষে কহ তাকে পাঞ্চালীর ছন্দে।
সকলে শুনিয়া যেন বুঝয় সানন্দে।।
এতে মনে হয় হিন্দি ঠেট ও গোহারী (গাঁওয়ারী) ভাষায় অর্থাৎ প্রাচীন হিন্দি ভাষায় রচিত কোন কাব্যকাহিনি অবলম্বনে দৌলত কাজী তাঁর কাব্যের পরিকল্পনা করেছিলেন। ‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী’ কাব্যের কথাবস্তুতে হিন্দি প্রণয়কথা থাকলেও রূপে ও ভাবে তা বিদগ্ধ ও বিশুদ্ধ বাংলা কবিতা। কাব্যের প্রথমে কবি আল্লাহ-রসুলের বন্দনা করেছেন। বন্দনার উদার ও সার্বভৌম ভাবটি ধর্মসম্প্রদায়-নির্বিশেষে সর্বজনগ্রাহ্য। তারপর রাজা শ্রীসুধর্মা ও সমরসচিব আশরফ খানের প্রশংসা, রাজার বিহার ও আশরফ খানের দ্বারা কাব্য রচনার নির্দেশের কথা বলে কবি কাব্যের কাহিনি আরম্ভ করেছেন।
সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী কাব্যের কাহিনি
রাজা লোরের মহিষী ময়নামতীর ওপর রাজ্যভার সমর্পণ করে বনবিহারে মগ্ন ছিলেন। সেখানে এক যোগী এসে তাঁকে গোহারী দেশের অপূর্ব সুন্দরী রাজকন্যা চন্দ্রানীর চিত্র দেখান। চন্দ্রানী বিবাহিতা, কিন্তু তার স্বামী বামনবীর ছিল নপুংসক। যোগীকে সঙ্গে নিয়ে রাজা লোর চন্দ্রানীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। গবাক্ষপথে লোরকে দেখে চন্দ্রানী মোহে আত্মহারা হন। ধাইয়ের মধ্যস্থতায় গোপনে তাদের মিলন সংঘটিত হল। স্বচ্ছন্দ মিলনের বাধা দেখে রাজা লোর চন্দ্রানীকে নিয়ে পলায়ন করলেন। চন্দ্রাণীর স্বামী বামন সন্ধান পেয়ে বাধা দিল। দু জনের মধ্যে প্রবল যুদ্ধ হয়; যুদ্ধে বামন নিহত হল । কিন্তু হঠাৎ চন্দ্রানী সর্প দংশনে মারা গেলেন। এক সাধু তাকে পুনরুজ্জীবিত করে দিলেন। গোহারী রাজ্যের রাজা তখন লোর ও চন্দ্রানীকে ফিরিয়ে নিলেন। সেখানে তারা পরম সুখে দিনাতিপাত করতে লাগলেন। এইটুকু কাব্যের প্রথম খণ্ড।
দ্বিতীয় খণ্ডের কাহিনিতে দেখা যায় যে, ময়নামতী স্বামীর কল্যাণের জন্য হরগৌরীর আরাধনায় সর্বদা মগ্ন রয়েছেন। তার অপূর্ব রূপের কথা শুনে ছাতন নামে এক রাজপুত্র ময়নামতীর প্রতি প্রেমে আকৃষ্ট হন এবং তাকে বশ করার জন্য দূতী রত্না মালিনীকে নিযুক্ত করেন। ময়নামতী নিরুদ্দিষ্ট স্বামীর প্রতি আকর্ষণ হেতু ছাতনের দূতীকে মাথা মুড়িয়ে মুখে কাল-হলুদ রং মাখিয়ে গাধার পিঠে চড়িয়ে ঝাঁটাপিটা করে নদীর অপর পাড়ে বিতাড়িত করে দিলেন। কাব্যের দ্বিতীয় খণ্ড এখানেই শেষ। দ্বিতীয় খণ্ডে ময়নামতীর বারমাসী পদের এগার মাসের বর্ণনা পর্যন্ত দৌলত কাজী রচনা করে পরলোকগমন করেন। দ্বাদশ মাস-জ্যৈষ্ঠ মাসের বর্ণনা থেকে কাব্যের শেষাংশ পর্যন্ত কবি আলাওল রচনা করেছিলেন।
কাব্যের তৃতীয় খণ্ড সম্পূর্ণ আলাওলের রচনা। এ খণ্ডে সখীর পরামর্শে ময়নামতী এক ব্রাহ্মণের হাতে শুক-শারি লোরের নিকট পাঠালেন। ব্রাহ্মণের কৌশলের ফলে লোরের মনে পূর্বের কথা উদিত হল। তখন তিনি পুত্রের হাতে রাজ্যভার সমর্পণ করে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং দুই রানীকে নিয়ে সুখে দিনাতিপাত করতে লাগলেন।
তিন খণ্ডে সমাপ্ত এ কাব্যের প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে দৌলত কাজী কবিপ্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ে কবিপ্রতিভার যে অনন্য নিদর্শন দেখিয়ে গেছেন তার মূল্য মহাকবি আলাওলের রচনা পাশে খুব সহজেই স্বীকৃত। তৃতীয় খণ্ডে কবি আলাওল দৌলত কাজীর মত সার্থকতা লাভ করতে পারেননি। আলাওল তৃতীয় খণ্ডে নানা অন্তর গল্পের অবতারণা করেছেন। রতনকলিকা ও মদনমঞ্জরীর প্রসঙ্গ এবং আনন্দ বর্মার গল্প এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
একটি অসমাপ্ত কাব্যের মধ্যে কবি দৌলত কাজী যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন তাতে বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট আসন লাভ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। দৌলত কাজী শুধু বাঙালি মুসলমান কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নন, প্রাচীন বাংলার শক্তিমান কবিদের মধ্যেও তিনি বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। তাঁর কাব্যের আখ্যানভাগ হিন্দি কাব্য থেকে সংগৃহীত বলে হয়ত এ বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ মৌলিকতা দাবি করতে পারেন না, কিন্তু তিনি যে প্রচলিত লোককাহিনিকে একটি রমণীয় রূপকথাধর্মী রোমান্টিক আখ্যায়িকায় পরিণত করেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কাব্যের সর্বত্র তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বিকাশমান। অমর তুলিকার যাদুস্পর্শে ময়নামতীর সতীত্ব, লোরের যৌবন-চাঞ্চল্য ও কামনা, চন্দ্রানীর নটিপনা ও অসংযম, ছাতনের লাম্পট্য, রত্না মালিনীর ধূর্ততা ও চাতুর্য যেভাবে সার্থকতা সহকারে রূপায়িত হয়ে উঠেছে তাতে তাঁর কাব্যে মৌলিকতার সাক্ষ্য বিদ্যমান। কবি দৌলত কাজীর পাণ্ডিত্যের কোন অভাব ছিল না। ইসলাম ধর্মে তার জ্ঞান ও নিষ্ঠা অটুট ছিল। সুফি সাধনা পদ্ধতিতে তার অনুরাগ ছিল গভীর। হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃত সাহিত্যের সঙ্গে তার পরিচয় ঘনিষ্ঠ ছিল এমন নিদর্শনও তাঁর কাব্যে বর্তমান। উপলব্ধির সহজ প্রকাশ তাঁর সাহিত্যসৃষ্টিকে প্রাঞ্জল ও সরল করে তুলেছে। কবির প্রতিভার স্বতোবিকশিত সারল্য ও অনায়াস-সরলতা কাব্যকে লোক-জীবনের সার্থক রোমান্টিক প্রণয়গাথার শিল্পমূল্য দান করেছে।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস দৌলত কাজী ও আলাওলের রচিত অংশের তুলনামূলক আলোচনা করে ‘আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থের লেখকদ্বয় মন্তব্য করেছেন—‘‘কবি আলাওল দৌলত কাজী হইতে পাণ্ডিতে অনেকগুণ শ্রেষ্ঠ ছিলেন; কিন্তু রচনার লালিত্য, ভাষার মাধুর্যে এবং অল্প কথায় বা একটি ক্ষুদ্র উপমায় অধিক ভাব প্রকাশের ক্ষমতায়, হতভাগ্য কবি দৌলত কাজী আলাওল হইতে অনেক গুণে শ্রেষ্ঠ।…আলাওলের রচিত সুংশে পাণ্ডিত্য আছে, শব্দাড়ম্বর আছে, অস্বাভাবিক ও অবান্তর গল্পের সমাবেশ আছে, কিন্তু দৌলত কাজীর রচনায় যে প্রাঞ্জলতা, যে স্বাভাবিকত্ব ও ভাব প্রকাশক অল্পভাষিতার নিদর্শন আছে, আলাওলের রচিত অংশে তাহা পাওয়া যায় না।’’ এই উক্তির সাহায্যে কবি দৌলত কাজীর কবিপ্রতিভার বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করা যায়। ড. আহমদ শরীফ মন্তব্য করেছেন—“আলাওল অকারণে অপ্রাসঙ্গিক ‘আনন্দবর্মা-রতনকলিকা’ কাহিনি জুড়ে নিয়ে কাব্যের রসাভাব ঘটিয়েছেন।’’
কবি আলাওল অসম্পূর্ণ কাব্য সমাপ্ত করতে গিয়ে কবি দৌলত কাজীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেছেন—‘তান সম আমার না হয় পদগাঁথা।’ আসলে কাহিনি গ্রন্থনে অপ্রাসঙ্গিকতার অবতারণা করে এবং রচনা শৈথিলের পরিচয় দিয়ে কবি আলাওল কবি দৌলত কাজীর সুস্থ স্বাভাবিক রচনাদর্শ সম্পূর্ণ বজায় রাখতে পারেননি। দৌলত কাজী সহজ সরল রচনারীতি প্রয়োগ করেছেন। আর কবি আলাওলের কৃত্রিম কাব্যকলার ঐশ্বর্যে স্বাভাবিকতার অবলুপ্তি ঘটেছে।
দৌলত কাজী তাঁর কাব্যের কাহিনি নির্বাচনে এবং তার বিস্তারিত রূপায়ণে গতানুগতিকতাকে অনুসরণ না করে স্বাধীন চিন্তা ও অপূর্ব কলাকৌশলের পরিচয় দিয়েছেন। চরিত্রচিত্রণেও কবি যথেষ্ট কৃতিত্বের নিদর্শন দেখিয়েছেন। ময়না ও চন্দ্রানী চরিত্রের মাধ্যমে কবি আদর্শবাদ ও ভোগবাদ, সংযম ও স্বৈরাচার, সতীত্ব ও নারী, মর্যাদা ও লালসা, ত্যাগ ও ভোগ, ক্ষোভ ও তিতিক্ষা প্রভৃতির দ্বন্দ্ব সুনিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বারমাস্যা রচনায় তাঁর দক্ষতা অতুলনীয়। তার কবিত্বশক্তি ছিল অসাধারণ এবং তার শিল্প ও সৌন্দর্যবোধ ছিল তীক্ষ্ণ ও হৃদয়গ্রাহী। বাংলার সঙ্গে সঙ্গে ব্রজবুলি ভাষায়ও তাঁর বিশেষ ক্ষমতা ছিল। তিনিই বাংলা ভাষার একমাত্র কবি, যিনি হাতে কলমে প্রমাণ করেছেন যে রাধাকৃষ্ণপ্রেমকাহিনি উপজীব্য না করেও ব্রজবুলি ভাষার সার্থক ব্যবহার করা সম্ভব। কাবের লালিত্যবৃদ্ধির জন্য বারমাস্যার কোন কোন পদে ব্রজবুলির আবহ সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে।
কবির ভাষা ও কবিত্বের নিদর্শন—
রাজার কুমারী এক নামে ময়নামতী।
ভুবন বিজয়ী কন্যা জগতে পার্বতী।।
কি কহিব কুমারীর রূপের প্রসঙ্গ।
অঙ্গের লীলায় যেন বান্ধিছে অনঙ্গ।।
কাঞ্চন-কমল মুখ পূর্ণ শশী নিন্দে।
অপমানে জলেতে প্রবেশে অরবিন্দে।।
চঞ্চল যুগল আঁখি নীলোৎপল গঞ্জে।
মৃগাঞ্জন শরে মৃগ পলায় নিকুঞ্জে।।
রচনারীতির দিক থেকে কবি বাণীভঙ্গিমায় ক্লাসিক ও রোমান্টিক রীতির পরিমিত সংমিশ্রণ ঘটিয়ে সীমাহীন কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর বারমাসী রচনায় নায়িকার মানসিক চাঞ্চল্যের পরিবর্তে যে দৃঢ়চিত্ততার সুস্পষ্ট পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে তাতে তিনি গতানুগতিকার ব্যতিক্রম হিসেবে চিহ্নিত। বার বারমাস্যাতে ব্রজবুলির প্রয়োগে তার প্রতিভার বৈচিত্র্যের স্বাক্ষর। তাই কবির অতুলনীয় কবিত্বের কথা স্বীকার করে ‘আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে লেখকদ্বয় মন্তব্য করেছেন—“নিষ্ঠুর কাল বঙ্গীয় কাব্যনিকুঞ্জের এই অর্ধস্ফুট গোলাপ কলিকাটিকে অকালে ঝরিয়া পড়িতে বাধ্য না করিলে, কালে ইহার সৌন্দর্য্যচ্ছটায় দিগমণ্ডল আলোকিত ও মনোরম সুরভিতে চতুর্দিক আমোদিত করিয়া তুলিত, সন্দেহ নাই।’’ ড. ওয়াকিল আহমদ দৌলত কাজীর কাব্যের মূল্যায়ন করে বলেছেন যে, এতে ‘‘কাহিনি পরিকল্পনায়, চরিত্রচিত্রণে এক সচেতন শিল্পপ্রয়াস ক্রিয়া করেছে। হিন্দি কাব্যের অনুবাদ করতে গিয়ে ঘটনার গ্রহণ-বর্জন দ্বারা তিনি কাব্যকে নতুন ভারসে মঞ্জিত করেছেন। হিন্দি কাব্যের অধ্যাত্ম রূপকতাকে মানবিক রসসাহিত্যে রূপান্তরিত করে তিনি নিছক শিল্পমূর্তি গড়েছেন। কাল্পনিক অংশ বাদ দিয়ে গল্পকে রোমান্সমুক্ত বাস্তব ভিত্তি দিয়েছেন। তার চরিত্রগুলো সজীব ও সক্রিয়।’’
কবি দৌলত কাজী তাঁর কাব্যরচনার মাধ্যমে রূপকথাকে পরিণত মনের পাঠোপযোগী রোমান্টিক কাহিনিতে পরিণত করেছিলেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে তার কাব্যটিকে একখানি মূল্যবান মর্তজীবনের অসাম্প্রদায়িক কাব্য বলে বিবেচনা করা যায়। কবি হিন্দুর সামাজিক আচার ব্যবহার, জীবন, আদৰ্শ ও শাস্ত্রসংহিতালব্ধ নানা তথ্য যথাযথ পরিবেশন করে নিজের পাণ্ডিত্য ও বাস্তবতার নিদর্শন রেখেছেন। কবি তার কাব্যে মজীবনের মহিমা উচ্চারণ করেছেন—
নিরঞ্জন-সৃষ্টি নর অমূল্য রতন।
ত্রিভুবনে নাহি কেই তাহার সমান।।
নর বিলে চিন নাহি কিতাব-কোরান।
নর সে পরম দেব তন্ত্র-মন্ত্র-জ্ঞান।।
নর সে পরম দেব নর সে ঈশ্বর।
নর বিনে ভেদ নাহি ঠাকুর কিঙ্কর।।
তারাগণ শোভা দিল আকাশ মণ্ডল।
নরজাতি দিয়া কৈল পৃথিবী উজ্জ্বল।।
প্রবাদের মত গভীর অর্থবহ উক্তি তাঁর কাব্যের সমৃদ্ধি সাধন করেছে। যেমন—
১. মন বিনা তনু যেন মৃত্তিকাপিঞ্জর।
২. কাণ্ডারী বিহীন নৌকা স্রোতে ভঙ্গ হয়।
পুরুষ বিহনে নারী জীবন সংশয়॥
বাংলা সাহিত্যের ওপর হিন্দি সাহিত্যের যে প্রত্যক্ষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তা মুসলমান কবিগণের অনুবাদের মাধ্যমে প্রথমে সূত্রপাত হয়েছিল। এদিক থেকে কবি দৌলত কাজী ও তাঁর কাব্য-‘সতীয়মনা ও লোরচন্দ্রানী’ সবিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। যে স্বভাবজাত ক্ষমতা ও কবিত্বময় প্রাণ নিয়ে কবি দৌলত কাজী জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তা তার সমসাময়িক অন্য কোন কবির মধ্যে যে কেবল দেখা যায় না তা নয়, তার পূর্ব ও পরবর্তী কবিগণের মধ্যেও কদাচিৎ দৃষ্ট হয়।
Leave a Reply