মহিলা কবি মানকুমারী বসুর কৃতিত্ব আলোচনা কর।
মানকুমারী বসু
মানকুমারী বসু (১৮৩৩-১৯৪৩) উনিশ শতকের খ্যাতনামা মহিলাকবি। ইনি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ভ্রাতুষ্পুত্রী। ইনি দীর্ঘজীবনের অধিকারিণী হলেও ব্যন্তিগত জীবনের শোকতাপে যৌবনেইচরম নিঃসঙ্গতা পেয়েছিলেন ও চিরদিনের একাকিনীর জীবনবরণে বাধ্য হয়েছিলেন। এঁর কবিতাবলীতে স্বভাবতই ফুটে উঠেছে এক বেদনা ও বিষাদের সুর, যার মূল অনেকটাই ব্যক্তিজীবনের মধ্যে নিহিত ছিল। পাশাপাশি ছিল উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া কবিপ্রতিভা, মহিলাকবির স্বভাবই অন্তর্মুখিনতার সঙ্গে লিরিক কবিতার রোমান্টিক কবিতার বিষাদচেতন মিলে এঁর কাব্যকবিতাকে এক বিশিষ্ট আস্বাদ দিয়েছে।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধকে আধুনিক বাংলা লিরিকের জন্মলগ্ন বলতে পারি। ইংরেজি সাহিত্য ও সভ্যতার প্রভাবে এই সময় বাঙালি মানসে অন্তর্দ্বন্দ্বের জন্ম হয়। একদিকে ছিল আশাপুরণের বিপুল প্রত্যাশা অন্যদিকে বাসনা বৈকল্যের ব্যর্থতাবোধ ও তীব্র ক্রন্দন। মাইকেল মধুসুদন দত্তের ‘আত্মবিলাপ’ কবিতায় এর বিখ্যাত উদাহরণ আছে—
মুকুতাফলের লোভে, ডুবে রে অতল জলে
যতনে ধীবর,
শতমুক্তাধিক আয়ু কালসিন্ধু জলতলে
ফেলিস, পামর।
ফিরে দিবে হারাধন, কে তোরে, অবোধ মন,
হায় রে, ভুলিবি কত আশার কুহকজালে?
মানকুমারী বসু-র’ ‘একা’ স্বরূপে অন্তর্মুখী গীতিকবিতা, তার সুরটি রোমান্টিক বিষাদের। সেই বিষাদকে পরিপুষ্ট করেছেন জীবনের বাস্তব দুঃখ্যস্ত্রণা। ‘একা’ কবির ১৮৯৩ সালে প্রকাশিত ‘কাব্যকুসুমাঞ্জলী’ কবিতাগ্রন্থের অন্তর্গত। তারও আগে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে বিহারীলাল চক্রবর্তীর ‘বঙ্গসুন্দরী’, ‘নিসর্গসন্দর্শন’, গোবিন্দচন্দ্র দাসের ‘প্রসূন’ প্রভৃতি বই এর ভিতর দিয়ে বাংলা সাহিত্যে গীতিকবিতার সুরটি স্বপ্রতিষ্ঠ হয়।
মানকুমারী বসু-র ‘একা’ কবিতায় রয়েছে স্বপ্নভঙ্গে বেদনা ও ব্যক্তিগত বিচ্ছেদবোধ। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘আত্মবিলাপ’, বিহারীলাল চক্রবর্তীর ‘সহে না আর প্রাণে’ গোবিন্দচন্দ্র দাসের ‘কোথায় যাই’ মানকুমারী বসুর ‘সাধ’, ‘একা’, ‘হতাশে’, ‘এই কি জীবন?’ কামিনী রায়ের ‘দিন চলে যায়’ কবিতাকে বিষাদমূলক গীতিকবিতা বলেই চিহ্নিত করা যায়। বিষাদ ছাড়া একালে প্রেম দেশপ্রেম-গার্হস্থ্যজীবন-প্রকৃতি-তত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়েও গীতিকবিতা লেখা হয়েছিল।
উনিশ শতকের বিষাদ কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য-মহিলা কবিদের কবিতার বিষণ্ন সুর। তাই মহিলা কবিদের রচনার প্রধান সুর। গত শতকের মহিলারচিত কাব্য প্রায় গোটাটাই উৎসারিত হইয়াছে, কোনো শোকবিধুর সান্ধ্য উপত্যকা থেকে। মহিলা কবিদের ব্যন্তিজীবনের ব্যর্থতাই এর মূল। জীবনের শোকতাপ এদের কবিতায় একটা অকপট আন্তরকিতা দান করেছে। রূপকর্মে ও কাব্যপ্রসাধনে দক্ষ না হওয়া সত্ত্বেও আন্তরিকতার জোরেই হৃদয়াবেগকে এরা সফলতার স্তরে উত্তীর্ণ করেছেন
মানকুমারী বসুর কবিতায় একদিকে রয়েছে রোমান্টিক কবিহৃদয়ের স্বাভাবিক বেদনার সুর অন্যদিকে রয়েছে ব্যন্তিগত জীবনের দুঃখের অভিঘাত। নিঃসঙ্গতা শুধু কাব্যিক নয় বাস্তবও। ‘একা’ কবিতায় যে কবিকে আমরা দেখছি তিনি রূপকর্মে ও কাব্যপ্রসাধনে কিছুটা টিলেঢালা। এই প্রবণতাটা উনিশ শতকের অপ্রধান বা গৌণ গীতিকবিদের প্রায় সকলরেই ছিল। অতএব ‘একা’ কবিতার প্রথম স্তবকে যে বিস্তৃতি পাচ্ছি তার মূল্য প্রকাশনৈপুণ্যের জন্য নয় বরং আন্তরিকতার জন্য। মানকুমারী বন্তব্য কিছুটা সাদামাটা, ভাষাও। কিন্তু সব মিলিয়ে একটা অসহায় বিষণ্ন ব্যথিত আবেদন পাঠকের মন স্পর্শ করে। মানবজীবনকে তিনি ট্র্যাজেডি বলেই মনে করতেন। কবির বাণী নিরাভরণ হলেও সরল। যেমন সাধ কবিতায় তিনি বলেছেন—
মানব জীবন ছাই বড়ো বিষাদের
দুটো কতা না কহিতে
দুটি বার না চাহিতে।
আপনি পোহায়ে যায় যামিনী সাধের,
মানবজীবন ছাই বড় বিষাদের।
জীবনের অর্থহীনতা কবির কাছে শুধু দার্শনিক তত্ত্ব হিসেবে নয়, বাস্তব তথ্য হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছে। কবির একাকিত্বের মূলে রোমান্টিক কবিসুলভ জীবনবিষাদের পাশপাশি যুক্ত হয়েছে ব্যন্তিগত জীবনের ট্র্যাজেডি। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ প্রকাশিত ‘সাহিত্যপাঠক রিতমালা’-র অন্তর্গত ‘মানকুমারী বসু’ নামক পুস্তিকাটি পড়লে কবির কবিতায় তাঁর জীবন উপাদান কীভাবে প্রাধান্যবিস্তার করেছে জানা যায়। নবযৌবনাই বৈধব্যবেদনা আক্রান্ত মহিলা কবি তার কবিতার প্রথম স্তবকেই নিজের বিধিবঞ্চিত ভাগ্য ও নিঃসঙ্গতার অশ্রুময় উল্লেখ করেছেন—
একা আমি, চিরদিন একা
সে কেন দু’দিন দিল দেখা ?
আঁধারে ছিলাম ভালো
কেন বা জলিল আলো?
আঁধার বাড়ায় যথা বিজলীর রেখা !
ভুলে ভুলে ভালোবাসা
ভুলে ভুলে সে দুরাশা
ভুলে মুছিল না শুধু কপালের লেখা?
কিন্তু মানকুমারী বসুর বিষাদচেতনা তাঁকে উত্তরণের পথ দেখিয়েছে, তাঁর লেখিকাজীবনের মূল দর্শন তিনি এই নিঃসঙ্গ বিষাদ ও রিক্ত বিড়ম্বনার কাছ থেকেই শিখেছেন। স্মৃতিকেই তিনি অমূল্য সম্পদ বলে আঁকড়ে ধরেছেন। স্মৃতিই হয়েছে তাঁর কবিতার বিষয় এবং জীবনের মূলতত্ত্ব।
Leave a Reply