কবিশেখর কালিদাস রায়ের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
কালিদাস রায়
কবিশেখর কালিদাস রায় (১৮৮৯-১৯৭৫) রবীন্দ্রানুসারী কবি, সমালোচক। ১৮৮৯ সালের ২২ জুন পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কড়ুই গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা যোগেন্দ্রনাথ রায় ছিলেন কাশিমবাজার রাজ এস্টেটের কর্মচারী। বৈষ্ণব কবি লোচনদাস ঠাকুর ছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষ।
কালিদাস কাশিমবাজার আশুতোষ চতুষ্পাঠীতে সংস্কৃত শেখেন এবং পরে কাশিমবাজারের খাগড়া লন্ডন মিশন স্কুলে অধ্যয়ন করেন। ১৯১০ সালে তিনি বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ পাস করে স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শনশাস্ত্রে এমএ শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন; কিন্তু চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আগেই পেশাগত জীবনে প্রবেশ করেন। রংপুরের উলিপুর মহারানী স্বর্ণময়ী হাইস্কুলের সহশিক্ষক (১৯১৩) হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। পরে কিছুদিন (১৯২০-৩১) চবিবশ পরগনার বড়িশা হাইস্কুলে শিক্ষকতা করার পর রায়বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেনের সহায়তায় তিনি কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনের ভবানীপুর শাখায় প্রধান শিক্ষকরূপে যোগদান করেন এবং ১৯৫২ সালে অবসর গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
কালিদাস ‘রসচক্র’ নামে একটি সাহিত্য সংসদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং রবীন্দ্র-ভাবধারায় উজ্জীবিত হয়ে তিনি কাব্যচর্চা শুরু করেন। রোমান্টিকতা, প্রেম, পল্লিজীবন, সমাজ, ঐতিহ্যপ্রীতি এবং বৈষ্ণবভাব তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়। তাঁর মোট কাব্যগ্রন্থ ১৯টি; তন্মধ্যে কুন্দ (১৯০৮) তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্য। এ ছাড়া পর্ণপুট (১৯১৪), ঋতুমঙ্গল (১৯১৬), রসকদম্ব (১৯২৩), হৈমন্তী (১৯৩৪), লাজাঞ্জলি (১৯৪০), বৈকালী (১৯৪০), ব্রজবেণু (১৯১৫), চিত্তচিতা, পূর্ণাহুতি (১৯৬৮) ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। তিনি কালিদাসের শকুন্তলা, কুমারসম্ভব এবং মেঘদূতের অনুবাদ করেন। প্রাচীন বঙ্গ সাহিত্য পরিচয়, প্রাচীন বঙ্গ সাহিত্য, পদাবলী সাহিত্য, শরৎ-সাহিত্য ও সাহিত্য প্রসঙ্গ তাঁর সমালোচনা গ্রন্থ। তাঁর রচিত শিশুতোষ গল্পকাহিনীও আছে। ‘বেতালভট্ট’ ছদ্মনামে রচিত তাঁর রম্যরচনাগুলি পাঠকসমাজে খুবই সমাদৃত হয়েছে।
কবিশেখর কালিদাস রায় কবি ও সমালোচক রূপে সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছেন। রবীন্দ্র সমকালীন কবি হিসাবে তিনি কুমুদরঞ্জনের মতো পল্লী প্রকৃতি ও পল্লীজীবনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তবে উভয়ের মধ্যে পার্থক্ও রয়েছে। সে পার্থক্য উপলব্ধি এবং প্রকাশের ক্ষেত্রে। তাঁর কবিতার প্রধান বিশেষত্ব হল, পল্লীগ্রামের পরিবেশ রচনা, বৈষ্ণব কাব্যসংস্কারকে রূপায়ণ করা এবং গার্হস্থ্য জীবনরসকে উপস্থাপন করা। তাঁর ‘রাঙাচুড়ি’ কবিতায় সেই গার্হস্থ্য জীবনরস পরিবেশিত হয়েছে—
থামে নাকো কোনো মতে তবু খুকী শুয়ে পথে
ফুঁপিয়ে কাদে যে অবিরাম।
ব্যথা কি বুঝিবে তারা সব জিনিসের ধারা
দাম কষে টাকায় আনায়
প্রাণের বাঞ্ছিত যাহা যত তুচ্ছ হোক তাহা
মিলিবে কি সোনায় রূপায়?
পল্লীপ্রীতি প্রগাঢ়, তবে তার মধ্যে রোমান্টিক রং জোরালো। কালিদাস রায় পেশায় ছিলেন শিক্ষক। তাঁর দৃষ্টি ছিল জ্ঞানী পণ্ডিতের। প্রাচীন ভারতবর্ষ কিংবা বৈষ্ণব ভাবুকতাসিক্ত তাঁর কবিতার মধ্যে অতীত-বিহার ও রোমান্টিকতার পরিচয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি বিবরণাত্বক চিত্রাঙ্কনকেই তাঁর কবিতাকলার সহজ গুণ হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর কিছু কাহিনি-প্রধান কবিতাও আছে। কালিদাস রায় তাঁর বিখ্যাত ‘ছাত্রধারা’ কবিতায় কিছু অনুভূতিকে চমৎকার ভাবে প্রতিফলিত করেছেন—
রাজপথে দেখা হলে কেহ যদি গুরু বলে
হাত তুলে করে নমস্কার,
বলি তবে হাসি মুখে ‘বেচে থাক রও সুখে
কি করিছ কাজ-কারবার’
ভাবিতে ভাবিতে যাই, কি নাম মনে ত নাই,
ছাত্র ছিল কতদিন আগে,
দেখি স্মৃতি ধরি টানি, কৈশোরের মুখখানি
মনে মোর জাগে কি না জাগে।
সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ কালিদাস বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। তিনি রংপুর সাহিত্য পরিষদের ‘কবিশেখর’ উপাধি (১৯২০), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ (১৯৫৩) ও ‘সরোজিনী স্বর্ণপদক’, বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ (১৯৬৩) এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি (১৯৭১) লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ অক্টোবর কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।
Leave a Reply