//
//

বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে কোহিনূর থিয়েটারের অবদান আলোচনা কর।

কোহিনূর থিয়েটার

এমারেল্ড থিয়েটার বাড়িতে

প্রতিষ্ঠাতা: শরৎকুমার রায়

প্রতিষ্ঠা: ১১ আগস্ট, ১৯০৭

স্থায়িত্বকাল: ১১ আগস্ট, ১৯০৭ – ২১ জুলাই, ১৯১২

নাটক: চাঁদবিবি (ক্ষীরোদপ্রসাদ)

গোপাল লাল শীল প্রতিষ্ঠিত এমারেল্ড থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেলে সেখানে অমরেন্দ্রনাথ দত্ত ক্লাসিক থিয়েটার খোলেন। এপ্রিল, ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে থিয়েটার প্রকাশ্য নিলামে উঠলে জমিদার শরৎকুমার রায় এক লক্ষ ষাট হাজার টাকায় সেই থিয়েটার বাড়ি কিনে নিয়ে সেখানে কোহিনূর থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন।

অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এখানে সহকারী ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন। তারপরে দুজনে মিলে নতুন দল গঠনে নেমে পড়েন। অন্য রঙ্গমঞ্চগুলি থেকে নামকরা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ভাঙিয়ে আনলেন। এর জন্যে দু’হাতে খরচ করতেও কার্পণ্য করলেন না শরৎকুমার।

ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদকে নাট্যকার হিসেবে আনা হল, স্টার থেকে ভাঙিয়ে। ন্যাশনাল থিয়েটার থেকে এলেন শরৎকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (রাণুবাবু) ও তারাসুন্দরী। মিনার্ভা থেকে আনা হলো সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ (দানীবাবু), মন্মথনাথ পাল (হাদুবাবু), তিনকড়ি, কিরণবালা, ক্ষেত্রমোহন মিত্র প্রমুখ খ্যাতনামা অভিনেতা অভিনেত্রীকে। স্টেজ ম্যানেজার হিসেবে ধর্মদাস সুরকে এনে এমারেল্ড থিয়েটারের পুরনো বাড়িকে নতুন করে সংস্কার করা হলো, মঞ্চকে নতুন করে সাজানো হল এবং নতুন নতুন শোভাসুন্দর দৃশ্যাবলী তৈরি করা হলো। বিজনেস ম্যানেজার হলেন দুর্গাদাস দে। সাজসজ্জা ও নতুন চাকচিক্যময় পোষাক-পরিচ্ছদ তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হলো শিল্পী মহাতাপচন্দ্র ঘোষকে। ঐকতানবাদনের দায়িত্ব অর্পিত হল দক্ষিণারঞ্জন রায়ের ওপর। সর্বোপরি গিরিশচন্দ্রকে কোহিনূর নিয়ে এলো দশ হাজার টাকা বোনাস ও মাস মাইনে পাঁচশো টাকা দিয়ে। তাঁর পুত্র দানীবাবুর জন্য লাগল তিন হাজার এবং অন্য নটনটীদের জন্য এক হাজার টাকা করে।

ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘চাঁদবিবি’ নাটক দিয়ে থিয়েটারের উদ্বোধন হলো— ১১ আগস্ট, ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে। অভিনয় করলেন: তিনকড়ি—যোশিবিবি। তারাসুন্দরী—চাঁদবিবি। মন্মথনাথ পাল—রঘুজী। ক্ষেত্রমোহন মিত্র—ইব্রাহিম।

রঙীন ও জমকালো প্লাকার্ড ও হ্যান্ডবিলের মাধ্যমে থিয়েটারের বিজ্ঞাপন সারা শহরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। দর্শকের ভিড়ে নাট্যশালা উপচে পড়েছিল। প্রখ্যাত নাট্যসমালোচক হেমেন্দ্রকুমার রায় জানিয়েছেন যে, তাকে এক টাকার টিকিট তিন টাকা দিয়ে জোগাড় করতে হয়েছিল। প্রথম রাত্রেই বিক্রি হলো ২২৫০ টাকা।

আহমদনগরের বীরনারী চাঁদবিবি মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তাঁর রাজ্য রক্ষার জন্য আমৃত্যু লড়েছিলেন। এই গৌরবময় লড়াইয়ের কাহিনী বঙ্গভঙ্গের (১৯০৫) অব্যবহিত পরবর্তীকালে বাংলার দর্শকের কাছে খুবই আদৃত হয়েছিল।

চাঁদবিবি নাটকের অভিনয়ে ঐকতানবাদন, নৃত্যগীত, সাজসজ্জা ও দৃশ্যপট এতই উজ্জ্বল ও মননামুগ্ধকর হয়েছিল যে, সমালোচক হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের অভিজ্ঞতায় তা অমরাবতী বলে মনে হয়েছিল। অভিনয়ও খুবই আকর্ষণীয় হয়েছিল।

সময়ের পরিস্থিতিতে এবং অভিনয়ের গুণে ঐতিহাসিক নাটক ‘চাঁদবিবি’ অসম্ভব সাফল্য লাভ করলো। তাতে উৎসাহিত হয়ে কোহিনূর বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনীর নাট্যরূপ অভিনয়ের পরেই মঞ্চস্থ করল আরো দুটি ঐতিহাসিক নাটক। দুটিই গিরিশের ছত্রপতি শিবাজী (১৫-৯-১৯০৭) এবং মীরকাশিম (১৬-১১-১৯০৭)। সেই সময়ে অন্য থিয়েটারগুলিতেও জাতীয় ভাবোদ্দীপক ঐতিহাসিক নাটকের অভিনয় চলছিল। মিনার্ভাতেই চলছিল ছত্রপতি শিবাজী। গিরিশ কোহিনূরে নামালেন এই নাটক। অভিনয় করলেন: শিবাজী—দানীবাবু। আওরঙ্গজেব—গিরিশ। দাদাজী কোণ্ডা—নীলমাধব চক্রবর্তী। তানজী—কার্তিকবাবু। জিজাবাঈ—তিনকড়ি। লক্ষ্মীবাঈ—তারাসুন্দরী। সইবাঈ—কিরণশশী।

দৃশ্যপট, পোষাক-পরিচ্ছদ, মঞ্চসজ্জা এবং অভিনয় খুবই সুন্দর হয়েছিল। শিবাজীর সময়কাল যেন মূর্ত হয়ে উঠেছিল মঞ্চে। সে যুগের সংবাদপত্রের নাট্য-সমালোচকদের কাছে মিনার্ভার চাইতে কোহিনূরের ‘ছত্রপতি শিবাজী’ সবদিক থেকেই অনেক ভালো ছিল বলে মনে হয়েছিল। ‘মীরকাশিম’ অত উচ্চমানের না হলেও দানীবাবুর অভিনয় উচ্চাঙ্গের হয়েছিল।

২৫ ডিসেম্বর ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘দাদা ও দিদি’ মঞ্চস্থ হলো। গিরিশের অসুস্থতার কারণে নাটকটি পরিচালনা করেন দানীবাবু। নাটকটি মোটামুটি জমেছিল। কিন্তু বিপত্তি এলো অন্য দিক দিয়ে। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিনে (৩১ ডিসেম্বর) কোহিনূরের স্বত্ত্বাধিকারী শরৎকুমার রায়ের মৃত্যু হয়। তাঁর ছোট ভাই শিশিরকুমার রায় রিসিভার হিসেবে থিয়েটারের তত্ত্বাবধান করতে থাকেন।

১৯০৮-এর প্রথম ছয় মাসে এখানে কয়েকটি নাটকের অভিনয় হল। ক্ষীরোদপ্রসাদের অশোক, বরুণা, ভুতের বেগার, গিরিশের প্রফুল্ল, বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনী (নাট্যরূপ: গিরিশ) উল্লেখযোগ্য। ‘অশোক’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন—দানীবাবু (অশোক), তিনকড়ি (ধারিণী), প্রমদাসুন্দরী (কুনাল) এবং খুবই প্রশংসা লাভ করেছিলেন।

এই বছরের মাঝামাঝি সময় থেকেই শিশিরকুমার রায়ের সঙ্গে গিরিশের মননামালিন্য শুরু হয়। শিশির রায় তাঁর দাদার দায়িত্ব গ্রহণ করলেও খুব ভালোভাবে থিয়েটার চালানোর যোগ্যতা দেখাতে পারেননি। তাছাড়া আর্থিক ব্যাপারেও তিনি দাদার মতো অত মুক্তহস্ত ছিলেন না। অভিনেতাদের মধ্যে অনেকেই, যেমন, ক্ষেত্রমোহন মিত্র, মন্মথ পাল, মণীন্দ্র মণ্ডল কোহিনূর ছেড়ে চলে গেলেন। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা ও ভাঙনের চিহ্ন দেখা দিল। মালিকের অপ্রীতিকর আচরণে গিরিশ ক্ষুব্ধ হলেন। এদিকে এই অবস্থায় গিরিশের হাঁপানি অসুখ বেড়ে যাওয়াতে তিনি নিয়মিত থিয়েটারে আসতে পারেন না, ফলে নাট্যশিক্ষা দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। শর্তানুযায়ী নতুন নাটকও লিখে দিতে পারছিলেন না। মালিক শিশির রায় গিরিশের বেতন বন্ধ করে দিলেন। গিরিশ তিন মাসের বেতন ও বোনাসের বাকি চার হাজার টাকার জন্য আদালতে মামলা করলেন। বিচারে গিরিশ জিতে গিয়ে সব পাওনা-গণ্ডা বুঝে নিয়ে কোহিনূর ছেড়ে মিনার্ভায় চলে গেলেন (১৮ জুলাই, ১৯০৮), সঙ্গে নিয়ে গেলেন পুত্র দানীবাবুকে।

এখানে উল্লেখযোগ্য একটি খবর হলো, অসুস্থ অবস্থাতেই গিরিশ কোহিনূরের জন্য ‘ঝাঁসীর রানী’ নাটকটি লিখতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশের তরফে তাঁকে এই ধরনের নাটক আর না লিখতে বলা হয়। গিরিশও আর এই নাটক লেখা শেষ করেননি।

গিরিশ চলে গেলে, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি কোহিনূরে যোগ দিলেন ১৯০৮-এর জুলাই মাসে। ছিলেন আগস্ট মাস পর্যন্ত। কোহিনূরে তখন অভিনীত হল সংসার (১৫ জুলাই), জেনানাযুদ্ধ (১৫ জুলাই), আবুহোসেন (২৯ জুলাই), দুর্গেশনন্দিনী (১ আগস্ট), নীলদর্পণ (২ আগস্ট), প্রফুল্ল (৯ আগস্ট), নবীন তপস্বিনী (৯ আগস্ট)। অর্ধেন্দুর উদ্যোগে, পরিশ্রমে ও অভিনয়ে কোহিনূর আবার স্থিতাবস্থায় ফিরে এলো। এখানে নখুড়ো (সংসার), পদ্মলোচন (জেনানাযুদ্ধ), আবুহোসেন (আবুহোসেন), বিদ্যাদিগগজ (দুর্গেশনন্দিনী), তোরাপ (নীলদর্পণ), যোগেশ (প্রফুল্ল), জলধর (নবীন তপস্বিনী) প্রভৃতি চরিত্রাভিনয়ে দর্শকদের আকৃষ্ট করতে লাগলেন। বিশেষ করে আবুহোসেন, বিদ্যাদিগগজ, কিংবা জলধরের চরিত্রে তাঁর অভিনয় সকলকে মুগ্ধ করলো। এখানে অর্ধেন্দু নতুন দুটি চরিত্রে প্রথম অভিনয় করলেন, যেগুলি তিনি এর আগে কখনো করেননি। যেমন তোরাপ ও যোগেশ। যোগেশ চরিত্রে গিরিশ এবং অমৃতলাল মিত্র যেভাবে অভিনয় করতেন, অর্ধেন্দু তাকে পুরো পালটে দিয়ে তাঁর অভিনয়ে নতুন ডাইমেনশান নিয়ে এলেন। বোদ্ধা ও রসিক দর্শকের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করেছিলেন তিনি। তোরাপের অভিনয়ে তোরাপের গোঁয়ার্তুমিকে অর্ধেন্দু কৃষক বিদ্রোহী চরিত্রে রূপান্তরিত করে হাজির করেছিলেন। তোরাপের এই গভীরতা অন্য অভিনেতার অভিনয়ে কখনো পরিস্ফুট হয়নি।

৯ আগস্ট, ১৯০৮-এ এখানে নবীন তপস্বিনী ও প্রফুল্ল নাটকেই অর্ধেন্দুশেখরের শেষ অভিনয়। এর পরেই ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯০৮, তাঁর মৃত্যু হয়।

১৯০৮-এর একেবারে শেষে (১৮ ডিসেম্বর) ‘পাঞ্জাব গৌরব’ নাটক অভিনীত হয়। দ্বিতীয় রাত্রের অভিনয়ে পাঞ্জাবী দর্শকেরা গোলমাল করে অভিনয় বন্ধ করে দেয়। কারণ হচ্ছে, ঠাকুর সিংহের মাতা পান্নারানীর একটি সংলাপ। সেখানে সে নিজেকে পঞ্চনদবাসী সমগ্র খালসাদের জননী বলে ঘোষণা করে। আপত্তির কারণ, একজন বারাঙ্গনা অভিনেত্রী জননী সেজে সমগ্র শিখসমাজের মাতা হতে চায়, এ গর্হিত কাজ চলবে না। অতএব অভিনয় বন্ধ। উপায়ান্তর না দেখে কোহিনূর কর্তৃপক্ষ নাটকটির নাম পালটে ‘বীরপূজা’ নামে অভিনয় করল (৩০ জানুয়ারি, ১৯০৯)। পাঞ্জাবের কাহিনীকে মারাঠাদের কাহিনীতে রূপান্তরিত করে দেওয়া হলো এবং ঠাকুর সিংহের জায়গায় রাজারামের কাহিনী তৈরি করে নেওয়া হলো। অভিনয় করলেন: রাজারাম—অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। গোবর্ধন—মন্মথনাথ পাল। রঙ্গনাথ—ক্ষেত্রমোহন মিত্র। কোহিনূরের একটি উল্লেখযোগ্য অভিনয় হিসেবে বীরপূজার উল্লেখ করা হয়। বিশেষ করে অভিনয়ে মন্মথ পাল হাস্যরসের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন। রঙ্গনাথের অভিনয়ও ভালো হয়েছিল।

১৯০৯-এ আরো অভিনীত হল হরনাথ বসুর ময়ূর সিংহাসন, যোগীন্দ্রনাথ বসুর নেড়া হরিদাস উপন্যাসের নাট্যরূপ প্রতিফল, দুর্গাদাস দে’র সোনার সংসার, হরিপদ মুখোপাধ্যায়ের রাণী দুর্গাবতী। ময়ূর সিংহাসনে অভিনয় করেছিলেন: সাজাহান—পূর্ণচন্দ্র ঘোষ। ঔরঙ্গজেব—ক্ষেত্রমোহন মিত্র। দারা—অপরেশ মুখোপাধ্যায়। মোরাদ—অটলকুমার। জিহনআলি—মন্মথ পাল। রোসেনারা—প্রমদাসুন্দরী। আমিনা—চারুবালা। সিপার—ভুষণ। নাদিরা—কিরণশশী। দুর্গাবতী নাটকের অভিনয়ে নাম-ভূমিকায় প্রমদাসুন্দরীর অনবদ্য অভিনয় সকলকে মুগ্ধ করেছিল।

১৯০৯-এর ৭ জুলাই পর্যন্ত অপরেশচন্দ্র ম্যানেজার ছিলেন। তারপর তিনি ও তারাসুন্দরী কোহিনূর ত্যাগ করেন।

১৯১০-এর ৯ জানুয়ারি রবীন্দ্রনাথের ‘গোড়ায় গলদ’ প্রহসনের অভিনয় হয়। ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভূতের বিয়ে’ নক্সা, গিরিশের ‘চণ্ড’ ও ‘রাজা অশোক’, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের ‘আকবরের স্বপ্ন’ অভিনীত হয়। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সাহায্যার্থে ২০ মার্চ, ‘বেনিফিট নাইট’ করা হয়। সেখানে নাচ গান ও নানা নাটকের খণ্ড খণ্ড অংশ দেখানো হয়েছিল।

১৯১১-তে বেশ কয়েকটি নাটক অভিনীত হলো। ১৯১১-এর ২৭ মে থেকে অতুল মিত্র নাট্যকার এবং কুসুমকুমারী অভিনেত্রী হিসেবে যোগ দিলেন। ‘শখের জলপান’ ও ‘মধুর মিলন’ নামে শৈলেন্দ্রনাথ সরকারের লেখা দুটি কৌতুক নাটক এখানে অভিনীত হলো (৩ জুন)। হরিশচন্দ্র সান্যালের গ্রহের ফের (২১ অক্টোবর), অতুলকৃষ্ণ মিত্রের জেনোরিয়া (২৫ নভেম্বর), প্রাণের টান (২৫ ডিসেম্বর), পরপর অভিনয়েও কোনো সাফল্য এলো না। জেনোরিয়া গীতিনাট্যে বাংলা থিয়েটারে দ্বৈত নৃত্য গীতের বিখ্যাত জুটি কুসুমকুমারী (জেনোরিয়া) এবং নৃপেন বসু (জোজিয়ক) জমাতে পারলেন না। এদের সঙ্গে ফরমাজ চরিত্রে অপরেশ মুখোপাধ্যায় ছিলেন। তিনিও সুবিধে করতে পারলেন না। ‘প্রাণের টান’ নাটিকা মলিয়ের-এর নাটক অবলম্বনে অতুল মিত্র রচনা করেছিলেন, তাতে অভিনয়ে অনেকেই যথেষ্ট পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন, তবুও জমলো না।

১৯১২-তে নানা ধরনের বেশ কয়েকটি নাটক অভিনীত হল। কোহিনূরের অবস্থা তেমন ভালো যাচ্ছিল না। তবুও পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক, নাটকাভিনয়ের মাধ্যমে অবস্থা ফেরাবার চেষ্টা হতে লাগলো। গিরিশের বলিদান, পাণ্ডব গৌরব, শঙ্করাচার্য, ক্ষীরোদপ্রসাদের খাঁজাহান ও পলিন, বঙ্কিমের কপালকুণ্ডলা (নাট্যরূপ গিরিশ), গোল্ডস্মিথের ‘সি স্টপস টু কঙ্কার’ অবলম্বনে অতুল মিত্রের ‘মোহিনী মায়া’ এই বছরের উল্লেখযোগ্য নাটক। মোহিনী মায়ার অভিনয়ে এলান উইলকিস নামে বিখ্যাত একজন ইংরেজ অভিনেতা-পরিচালকের সাহায্য নেওয়া হয়েছিল। তবুও সার্থক হলো না এর অভিনয়। কুসুমকুমারী, অপরেশচন্দ্র কিংবা নাট্যকার অতুল মিত্র, কারো চেষ্টাতেই কোহিনূরের ভাগ্য ফিরল না। দুরবস্থা চরমে উঠতে লাগল। আর্থিক দায়দায়িত্ব ও থিয়েটার পরিচালনা নিয়ে শিশির রায়ের সঙ্গেও তার দাদা শরৎকমার রায়ের বিধবা স্ত্রীর বিবাদ শুরু হলো। কিন্তু কোনো উপায়েই দেনাগ্রস্ত থিয়েটারের ভাগ্য সুপ্রসন্ন করা গেল না।

কোহিনূর থিয়েটারের শেষ অভিনয়: ২১ জুলাই, ১৯১২, নাটক: বিশ্বামিত্র ও পলিন। ২৭ জুলাই, ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে কোহিনূর থিয়েটার দেনার দায়ে নিলামে উঠলে মনোমোহন পাঁড়ে (তখন তিনি মিনার্ভা থিয়েটারেরও মালিক) এক লক্ষ এগারো হাজার টাকায় কিনে নেন। মনোমোহন মিনার্ভার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে মিনার্ভার দলবল নিয়ে কোহিনূরে চলে আসেন এবং সেখানে অভিনয় শুরু করেন।

১৯১২-এর ২৭ আগস্ট মঙ্গলবার গিরিশের স্মৃতিভাণ্ডার নির্মাণকল্পে এখানে বিভিন্ন নাট্যমঞ্চের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সম্মিলিত অভিনয়ের ব্যবস্থা হয়। নাটক, গিরিশচন্দ্রের ‘পাণ্ডবগৌরব’ ও ‘বলিদান’ এবং একাধিক গীতিনাট্য। বলিদানে অভিনয় করেন: অমৃতলাল বসু—করুণাময়। ক্ষেত্রমোহন মিত্র—মোহিত। সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ—দুলাল। মন্মথনাথ পাল—রমানাথ। তারাসুন্দরী—সরস্বতী। সুশীলবালা—জোবি। কিরণবালা—কিরন্ময়ী। চারুবালা—হিরন্ময়ী। পাণ্ডব গৌরবে অভিনয় করেন: অমরেন্দ্রনাথ দত্ত—ভীম। প্রমদাসুন্দরী—উর্বশী। নাটকগুলির পরিচালনা করেন অমৃতলাল বসু। তিনকড়ি অসুস্থতার কারণে অভিনয় করতে পারেননি। সে-রাত্রে টিকিট বিক্রি হয়েছিল ৩৬৩৬ টাকার।

মনোমোহন কোহিনূর থিয়েটার কিনে নিয়ে সেই মঞ্চে মিনার্ভা নাম দিয়ে মিনার্ভা সম্প্রদায়ের দলবল নিয়ে অভিনয় চালিয়ে যেতে থাকেন। এই নিয়ে উপেন্দ্রনাথ মিত্রের সঙ্গে তাঁর মামলা হয়। মনোমোহন হেরে যান। কোর্টের নির্দেশে তিনি ওখানে আর মিনার্ভা নাম ব্যবহার করতে পারবেন না। তাই নাম পালটে কোহিনূর নামেই ওখানে অভিনয় চালিয়ে যান। শেষে ১৯১৫-এর ১ সেপ্টেম্বর কোহিনূর নাম পালটে রাখেন মনোমোহন থিয়েটার। ম্যানেজার করে নিয়ে আসেন দানীবাবুকে।

নীলামে বিক্রয়ের পরই কোহিনূর থিয়েটারের ইতিহাস শেষ হয়ে যায়। কোহিনূর থিয়েটার সর্বমোট পাঁচ বৎসর চলেছিল। গিরিশ, অর্ধেন্দুশেখর থেকে শুরু করে সে-যুগের থিয়েটারের বিখ্যাত প্রায় সব অভিনেতা-অভিনেত্রী এখানে অভিনয় করেছেন। এখানকার বেশ কয়েকটি নাটক খুবই সাড়া ফেলেছিল। নবসজ্জায় সজ্জিত এই রঙ্গমঞ্চ দর্শকের মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু থিয়েটার পরিচালনার এটি মালিকের পারিবারিক কলহ, মালিক ও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মনোমালিন্য প্রভৃতি কারণে কোহিনূর থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়। প্রধান উদ্যোগী ও মালিক শরকুমার রায় থিয়েটার প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যেই মারা যান। ফলে তাঁর পরিকল্পিত থিয়েটারের যাত্রা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি।

এখানে গিরিশচন্দ্রের সাত খানি, ক্ষীরোদপ্রসাদের দশ খানি, অতুলকৃষ্ণ মিত্রের তিন খানি, হরনাথ বসুর তিন খানি, রবীন্দ্রনাথের একটি, দুর্গাদাস দে-র দুই খানি এবং নিত্যবোধ বিদ্যারত্ন, হরিপদ মুখোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিমোহন মুখোপাধ্যায়, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের এক খানি করে নাটক অভিনীত হয়েছিল। সর্বমোট ৪০টি নাটক এই পাঁচ বছরে অভিনীত হয়।

জাঁকজমক ও প্রচুর অর্থব্যয়ে গড়ে তোলা কোহিনূর থিয়েটার পাঁচ বছরেই বন্ধ হয়ে যায়। প্রভূত সম্ভাবনার এই ক্ষণস্থায়িত্ব, থিয়েটার-অনুরাগীদের বিষাদাচ্ছন্ন করে তোলে।

 

 

 

 

 

Publication date:
Author: Admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!