ময়নামতী বা গোপীচন্দ্রের গান সম্পর্কে আলোচনা কর।
ময়নামতী বা গোপীচন্দ্রের গান
ত্রিপুরার অন্তর্গত মেহেরকুলের রাজা মাণিকচন্দ্রের স্ত্রী ময়নামতী ছিলেন গোরক্ষনাথের শিষ্যা এবং মহাজ্ঞানের অধিকারিণী। তিনি স্বামীর অকালমৃত্যুর কথা জেনে তাকে মহাজ্ঞান দিতে চান। কিন্তু রাজা সম্মত না হওয়ায় যমদূতের কবলে পড়ে অকালে মারা গেলেন । যমপুরীতে গিয়ে ময়নামতী মৃত স্বামীর পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করলেন। কিন্তু শিব তাকে নিরস্ত করে বললেন যে রাজা মাণিকচন্দ্র আর ফিরে আসবেন না। তবে ময়নামতী পুত্রবতী হবেন। সে পুত্র যদি হাড়িপার শিষ্য হয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ না করেন তবে তার অকালমৃত্যু ঘটবে। যথাসময়ে পুত্র গোপীচন্দ্রের জন্ম হয়। বয়ঃপ্রাপ্ত হলে ময়নামতী পুত্রকে অনুনা-পদুনা নাম্নী দুই রাজকুমারীর সঙ্গে বিয়ে দিলেন। গোপীচন্দ্র স্ত্রীদের নিয়ে ভোগবিলাসে মগ্ন হয়ে রইলেন। ময়নামতী জানেন পুত্রকে হাড়িপার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সন্ন্যাসী হতে হবে, নইলে তার অকালমৃত্যু ঘটবে। তাই হাড়িপার শিষ্যত্ব গ্রহণের জন্য পুত্রকে পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। কিন্তু তরুণ যৌবনে সন্ন্যাস গ্রহণে গোপীচন্দ্র সম্মত নন। তাঁর স্ত্রীরাও প্রবলভাবে বাধা দিতে লাগলেন। এমন কি তারা ময়নামতীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন। স্ত্রীদের প্ররোচনায় গোপীচন্দ্র মায়ের সতীত্ব সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে বলল যে মায়ের সঙ্গে হাড়িপার অবৈধ সম্পর্ক আছে। তখন ময়নামতী নিজের সতীত্বের প্রমাণ দেওয়ার জন্য কঠোর পরীক্ষা দিলেন এবং তাতে তার সতীত্ব সম্পর্কে সন্দেহ দূর হল। অবশেষে বহু বাধাবিপত্তি কাটিয়ে মায়ের নির্দেশে গোপীচন্দ্র হাড়িপার কাছে মন্ত্র নিয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন। হাড়িপা তাকে নিয়ে সংসার ছেড়ে গেলেন এবং হীরা নটীর গৃহে বাধা দিয়ে চলে এলেন। সেখানে বহু কষ্টে তার দিন কাটতে লাগল। অবশেষে সন্ন্যাস জীবনের সময় অতিবাহিত হলে হাড়িপা তাকে নটীর কবল থেকে উদ্ধার করে আনলেন এবং সাধনার সফলের জন্য মহাজ্ঞান দান করলেন। সন্ন্যাসী গোপীচন্দ্র এরপর গৃহে ফিরে এসে স্ত্রীদের নিয়ে মহাসুখে রাজত্ব করতে লাগলেন। হাড়িপার শিষ্য হয়ে সন্ন্যাশ্রত অবলম্বনের জন্য আর গোপীচন্দ্রের অকালে মৃত্যু ঘটল না। ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই কাহিনি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, যে সমাজের পটভূমিকায় কাহিনিটি বিন্যস্ত হইয়াছে তাহা হিংস্র, কুর, বর্বরোচিত প্রবৃত্তির অমার্জিত উচ্ছ্বাসে অসংবৃত ভোগ-লালসায়, শৈশবসুলভ উদ্ভট কল্পনার আতিশয্যে এবং সমাজ ও পরিবার-জীবনের রুঢ়, সুষমাহীন ছন্দে এক অর্ধসভ্য, অপরিণত সংস্কৃতি ও জীবনবোধেরই পরিচয় বহন করে। এই অশিক্ষিত, আদিম সংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ হইতেও যে এরূপ উন্নত, যথাযথ ভাব প্রকাশক্ষম, সূক্ষ্ম তত্ত্ব পরিস্ফুট করিতে নিপুণ, কাৰ্যগুণসমৃদ্ধ রচনার প্রেরণা আসিয়াছে ইহাই বাঙালি জীবনের এক চিরন্তন বিস্ময়।
Leave a Reply