//
//

থিয়েটারের ইতিহাসে গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটারের অবদান আলোচনা কর।

গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার

৬ নং বিডন স্ট্রিট, কলকাতা

উদ্বোধন: ৩১ ডিসেম্বর, ১৮৭৩                        

স্থায়িত্বকাল: ৩১ ডিসেম্বর, ১৮৭৩ – ৬ অক্টোবর, ১৮৭৭

প্রতিষ্ঠাতা: ভুবনমোহন নিয়োগী

নাটক: কাম্যকানন (অমৃতলাল)

ন্যাশনাল থিয়েটার তার প্রতিষ্ঠার (১৮৭২) কয়েক মাসের মধ্যেই মতান্তর, দলাদলি ইত্যাদি নানা কারণে দুভাগ হয়ে শেষে বন্ধ হয়ে যায়। উদ্যোক্তা ও অভিনেতারা তখন স্টেজবিহীন অবস্থায় অভিনয় থেকে দূরে থেকে ‘দমফাটা’ অবস্থায় রয়েছে। ওদিকে বেঙ্গল থিয়েটার রমরম করে অভিনয় করে চলেছে। ‘মোহান্তের এই কি কাজ! নাটক দেখতে গিয়ে বেঙ্গল থিয়েটারে ভুবনমোহন নিয়োগী ও কয়েকজন ন্যাশনালের অভিনেতা টিকিট না পেয়ে মনঃক্ষুণ্ন হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন। তখন অমৃতলাল বসু, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ধর্মদাস সুর প্রভৃতি অভিনেতারা উদ্যোগী হয়ে এবং ধনী ভুবনমোহন নিয়োগীর অর্থে নতুন থিয়েটার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। ভুবনমোহন ন্যাশনাল থিয়েটারের সময়েও নানাভাবে এদের সাহায্য করেছিলেন। ন্যাশনাল থিয়েটার-এর ঐতিহ্য ধরে রাখবার জন্য ‘ন্যাশনাল’ নামটুকু নিয়ে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করা হলো। বিডন স্ট্রিটে মহেন্দ্রনাথ দাসের জমি (এখন সেখানে মিনার্ভা থিয়েটার) নিয়ে কাঠের থিয়েটার বাড়ি তৈরি করা হয়। তৈরির দায়িত্ব নেন ধর্মদাস সুর। ড্রপসিন এবং আরো দু’চারখানি সিন বিলিতি থিয়েটারের মিঃ গ্যারিককে দিয়ে আঁকানো হয়। ১৮৭৩-এর ২৯ সেপ্টেম্বর নাট্যশালার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলো। তের হাজার টাকা খরচ করে তিন মাসের চেষ্টায় এই থিয়েটার বাড়ি তৈরি শেষ হলো।

১৮৭৩-এর ৩১ ডিসেম্বর থিয়েটারের উদ্বোধন হলো অমৃতলাল বসুর ‘কাম্যকানন’ নাটক দিয়ে। তখন বেঙ্গল থিয়েটারে চলছিল মধুসূদনের ‘মায়াকানন’। সেই নাটকেরই মতো নামকরণ করা হলো, যদিও বিষয়বস্তু আলাদা, কাল্পনিক এক পরীর দেশের কাহিনী, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে প্রথম রাত্রেই কিছুক্ষণ অভিনয় চলার পর সামনের ‘Star light’ থেকে আগুন লেগে থিয়েটার বাড়ির ক্ষতি হয়। অভিনয় বন্ধ হয়ে যায়। দুর্ঘটনার পরের দিনই গ্রেট ন্যাশনাল বেলভেডিয়ারে সখের বাজারে, ‘নীলদর্পণ’ নাটকের অভিনয় করে।

প্রথম অভিনয়ে এইভাবে বাধা পেয়েও এরা ভগ্নোদ্যম হলেন না। নতুন উৎসাহে থিয়েটার বাড়ি পুনর্নির্মাণ করে, ১৮৭৪-এর ১০ জানুয়ারি আবার অভিনয় শুরু করে দিলেন। নাটক ‘বিধবাবিবাহ’, নাট্যকার উমেশচন্দ্র মিত্র। দৃশ্যপটগুলি লুইস অপেরা হাউসের মতো হয়েছিল, কনসার্টও ভালো হয়েছিল। তবে গ্রেট ন্যাশনালে তখনো সব ভালো অভিনেতার সমাগম হয়নি। তাছাড়া নাটক নির্বাচনেও ত্রুটি ছিল। তা সত্ত্বেও ১৮৭৪-এর ১৭ জানুয়ারি প্রণয় পরীক্ষা (মনোমোহন বসু), ২৪ জানুয়ারি কৃষ্ণকুমারী (মধুসূদন), ৭ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি কপালকুণ্ডলা অভিনয় করলেন। বিলিতি থিয়েটারের মতো মঞ্চ, জাঁকজমক, ভালো দৃশ্যসজ্জা, ভালো কনসার্ট—কোন কিছুতেই গ্রেট ন্যাশনাল অভিনয় জমাতে পারলো না। তার একটা বড়ো কারণ, এই সময়ে বেঙ্গল থিয়েটার মঞ্চে অভিনেত্রী দিয়ে অভিনয় করা শুরু করে দিয়েছে। গ্রেট ন্যাশনাল তখনো অভিনেত্রী নেয়নি, পুরুষেরাই নারী চরিত্রে অভিনয় করছে। তাছাড়া বেঙ্গলে শরৎচন্দ্র ঘোষ সাফল্যজনকভাবে অভিনয় চালিয়ে দর্শক আকর্ষণ করে চলেছেন।

তাই বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ এই সময়ে কিছুদিনের জন্য গিরিশচন্দ্রের সাহায্য নিতে বাধ্য হলেন। বঙ্কিমের মৃণালিনী ও বিষবৃক্ষ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়ে গিরিশ নিজে সকলকে অভিনয় শেখালেন। নিজে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করলেন। মৃণালিনীর অভিনয় অসম্ভব সাফল্যলাভ করল। অভিনয় করলেন—

গিরিশচন্দ্র—পশুপতি, অর্ধেন্দুশেখর—হৃষিকেশ, নগেন্দ্রনাথ—হেমচন্দ্র, অমৃতলাল বসু—দিগ্বিজয়, অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়—ব্যোমকেশ। মহেন্দ্রলাল বসু—বক্তিয়ার খিলজি, বসন্তকুমার ঘোষ—মৃণালিনী, আশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়—গিরিজায়া, ক্ষেত্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়—মনোরমা।

২১ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি পরপর মৃণালিনীর অভিনয় হলো, গ্রেট ন্যাশনালের খ্যাতি প্রচারিত হতে থাকলো।

৭ মার্চ করলেন নবাবের নবরত্ন সভা। প্রথম রজনীতে নাটক দেখায় বিফল মনোরথ দর্শকদের দেওয়া প্রতিশ্রুতিমত বিনা টিকিটে অভিনয় করলেন, ১৮ মার্চ, দীনবন্ধুর ‘নবীন তপস্বিনী’। ১৮ এপ্রিল করলেন হেমলতা। হেমলতার অভিনয়ের সময় থেকেই ন্যাশনাল থিয়েটারের অনেকেই গ্রেট ন্যাশনালে এসে যোগ দিয়ে মিলিতভাবে অভিনয় শুরু করলেন। ৩০ মে করলেন কুলীনকন্যা বা কমলিনী নাটক। এইভাবে পুরনো ও নতুন নাটকের অভিনয় চালাতে চালাতে ৩০ মে, ১৮৭৪-এর পর চার মাসের জন্য গ্রেট ন্যাশনাল বন্ধ থাকে।

কলকাতায় অভিনয় বন্ধ থাকলেও গ্রেট ন্যাশনাল এই সময়ে মফঃস্বল বাংলায় অভিনয় করবার জন্য দলবদ্ধভাবে বেরিয়ে পড়ে। সেখানে ইংরেজদের স্টেশন থিয়েটারে হেমলতা, কপালকুণ্ডলা, যেমন কর্ম তেমনি ফল অভিনয় করে। সেখানে হেমলতা প্রশংসা পেলেও কপালকুণ্ডলার অভিনয় নিয়ে নানারূপ বিরূপ মধ্য হতে থাকে পত্র-পত্রিকায়।

আবার কলকাতায় ফিরে অভিনয়ের উদ্যোগ আয়োজন করতে থাকে। এবারে গ্রেট ন্যাশনাল অভিনেত্রী গ্রহণ করলো। এতদিন শুধুমাত্র বেঙ্গল থিয়েটারেই মহিলাদের নেওয়া হয়েছিল। ১৮৭৩-এর আগস্ট মাসে। গ্রেট ন্যাশনাল প্রথম দিকে পুরুষদের দিয়েই নারী ভূমিকা অভিনয় করে আসছিল। এবারে কাদম্বিনী, ক্ষেত্রমণি, যাদুমণি, হরিদাসী ও রাজকুমারী নামে পাঁচজন অভিনেত্রী গ্রহণ করা হলো। অভিনেত্রী সহযোগে এখানে প্রথম অভিনয় হল ‘সতী কি কলঙ্কিনী’ নাটক। নাট্যকার নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৮৭৪। অভিনেত্রী নেওয়ার ফলে অপেরা জাতীয় নাচ-গানে ভরা অভিনয় করার সুযোগ এরা পেল। তাছাড়া ভালো অর্কেস্ট্রা এবং সঙ্গীতাচার্য মদনমোহন বর্মণের সুর ও গান নাটকটিকে জমিয়ে দিল। ২৬ সেপ্টেম্বর আবার অভিনয় হল এই অপেরার। পত্র-পত্রিকায় প্রশংসা হতে থাকে, দর্শকের সংখ্যাও বাড়তে থাকে।

গিরিশ তখন নেই। নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় হয়েছেন ম্যানেজার। আগের ম্যানেজার ধর্মদাস সুরের সঙ্গে ভুবনমোহনের ‘আয় ও অর্থ ঘটিত কিঞ্চিৎ গোলযোগ’ ঘটে এবং তাকে সরিয়ে নগেন্দ্রনাথকে ম্যানেজার করা হয়।

১৮৭৪-এ অভিনয় হলো জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পুরুবিক্রম (৩ অক্টোবর), সতী কি কলঙ্কিনী ও ভারতে যবন (১০ অক্টোবর)। দুর্গাপূজার জন্য কয়েক দিন থিয়েটার বন্ধ থাকে। তারপরে শেক্সপীয়রের ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের বাংলা রূপার ‘রুদ্রপাল’ (হরলাল রায়) অভিনীত হলো (৩১ অক্টোবর)। এরপর আনন্দকানন (লক্ষ্মীজনার্দন চক্রবর্তী), কিঞ্চিৎ জলযোগ (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ)। এই সময়ে অর্ধেন্দুশেখর আবার গ্রেট ন্যাশনালে যোগ দিয়ে ‘আনন্দকাননে’ একটি ভূমিকায় অংশগ্রহণ করেন। গ্রেট ন্যাশনাল সাফল্যের মুখ দেখে। কিন্তু আবার গোলযোগ দেখা দিল। নগেন্দ্রনাথকে ম্যানেজার রাখা নিয়ে আত্মকলহের শুরু। তাছাড়া টাকাপয়সার হিসেব নিয়েও মতান্তর হয়। নগেন্দ্রনাথ গ্রেট ন্যাশনাল ছেড়ে দিলেন, সঙ্গে নিয়ে গেলেন মদনমোহন বর্মণ, কিরণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অমৃতলাল বসু, যাদুমণি, কাদম্বিনীকে। ‘গ্রেট ন্যাশনাল অপেরা কোম্পান’ নাম দিয়ে তারা বিভিন্ন স্থানে অভিনয় করতে করতে শেষে বেঙ্গল থিয়েটারে যোগদান করেন (৬ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭৫)।

নগেন্দ্রনাথের সঙ্গে আরো সব অভিনেতা অভিনেত্রী চলে যাওয়ায় গ্রেট ন্যাশনাল বেশ বিপাকে পড়ে। ধর্মদাস সুরকে আবার ম্যানেজার করা হলো, ১৮৭৫-এর ১৬ জানুয়ারি। আঘাত সামলে নিয়ে গ্রেট ন্যাশনাল আবার অভিনয় শুরু করে। ‘শত্ৰুসংহার’ নাটক দিয়ে। নাটকটি ভট্টনারায়ণের সংস্কৃত ‘বেণীসংহার’ নাটক অবলম্বনে হরলাল রায়ের লেখা। এই অভিনয় সম্বন্ধে উল্লেখযোগ্য খবর হলো, খ্যাতনামা অভিনেত্রী বিনোদিনী এই নাটকে দ্রৌপদীর সখীর এক ছোট্ট ভূমিকায় প্রথম মঞ্চাবতরণ করেন, ১৮৭৪-এর ১২ ডিসেম্বর।

১৮৭৫-এর ২ জানুয়ারি উপেন্দ্রনাথ দাসের শরৎ-সরোজিনী নাটকের প্রথম অভিনয় এখানে হলো। অভিনয়ে: শরৎ—মহেন্দ্রলাল বসু, সরোজিনী—রাজকুমারী, বৈজ্ঞানিক, হরিদাস—গোষ্ঠবিহারী দত্ত, সুকুমারী—গোলাপসুন্দরী। ৯ জানুয়ারি দ্বিতীয় অভিনয়। ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকার বিবরণ (১৪.১.১৮৭৫) থেকে জানা যায় যে, ‘শরৎ সরোজিনী’ নাটকের অভিনয় দেখবার জন্য নগরবাসীদের মধ্যে কৌতূহল ও ব্যগ্রতা জন্মেছিল; স্থানাভাবের জন্য প্রতি রাত্রের অভিনয়ে প্রায় চার-পাঁচ শ’ লোক ফিরে যেতে বাধ্য হতেন। এই নাটকেই অভিনয়ে গোলাপসুন্দরী সুকুমারীর চরিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য ‘সুকুমারী’ নামেই পরিচিত হয়েছিলেন। এরপর রাসলীলা, প্রমথনাথ মিত্রের নগ নলিনী, যেমন কর্ম তেমনি ফল অভিনীত হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘যেমন কর্ম তেমনি ফল’ অভিনয় করে বেথিয়ার রাজা হরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহের বাড়ি, সেখানে ভিজিয়ানা গ্রামের মহারাজা, ব্রহ্মরাজ-দূত, মহীশূর রাজবংশের ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।

১৮৭৫-এর মার্চ মাসের শেষের দিকে গ্রেট ন্যাশনালের একটি দল ধর্মদাস সুরের নেতৃত্বে দিল্লী, আগ্রা, মিরাট, লক্ষ্ণৌ, লাহোর প্রভৃতি জায়গায় অভিনয় করতে যায়। মূলত অর্থ উপার্জনের আশায়। সেই সঙ্গে বাংলা থিয়েটারের মিশনারী অর্ধেন্দুশেখরের ইচ্ছা ছিল বাংলা থিয়েটারের প্রচার ও অভিনয় শিল্পের বিস্তার সারা দেশে করা। এই দলে ছিলেন ধর্মদাস, অর্ধেন্দুশেখর, অবিনাশচন্দ্র কর, বিনোদিনী, ক্ষেত্রমণি প্রভৃতি। দিল্লীতে সাত-আট দিন, লাহোরে বেশ কিছু দিন তারা অভিনয় করে। সেখানে নৃত্যগীতের অভিনয় চলত ভালো। তারপর মিরাট, সেখান থেকে লক্ষ্ণৌ, আগ্রা। লক্ষ্ণৌতে নীলদর্পণের অভিনয়ের সময়ে সাহেব দর্শকরা কীভাবে উত্তেজিত হয়ে মঞ্চে উঠে এসে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের আক্রমণ করতে চেয়েছিল, তার কৌতূহলজনক বর্ণনা বিনোদিনী তার ‘আমার কথায়’ করেছেন।

১৮৭৫-এর সময়ে গ্রেট ন্যাশনালের মূল অংশ কলকাতায় থেকে অভিনয় করে যাচ্ছিল। তখন এখানে অস্থায়ী ম্যানেজার মহেন্দ্রলাল বসু। কলকাতায় তখন অভিনীত হচ্ছিল—সধবার একাদশী (২০ মার্চ), নয়শো রুপেয়া (১০ এপ্রিল), তিলোত্তমা সম্ভব (১৭ এপ্রিল), সাক্ষাৎ দর্পণ (প্রবোধচন্দ্র মজুমদার, ২৪ এপ্রিল), নন্দনকানন (৮ মে)।

ধর্মদাসের ভারতভ্রমণরত দলটি প্রচুর অর্থোপার্জন ও প্রভূত উপহার সামগ্রী নিয়ে কলকাতায় ফিরে এলো ১৮৭৫-এর মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে এবং মূল দলে যোগ দিল। সঙ্গীতজ্ঞ ও বিখ্যাত অর্কেস্ট্রা মাস্টার মদনমোহন বর্মণ মাঝে কিছু দিন এখান থেকে গিয়ে বেঙ্গলে ছিলেন। তিনিও এই সময়ে কাদম্বিনীকে নিয়ে ফিরে এলেন গ্রেট ন্যাশনালে।

১৮৭৫-এর ৩ জুলাই মহেন্দ্রলাল বসুর ‘পদ্মিনী’ নাটকের অভিনয় দিয়ে আবার পূর্ণোদ্যমে গ্রেট ন্যাশনালে অভিনয় শুরু হয়। অভিনয় শেষে অভিনেত্রী যাদুমণির ‘ভারতসঙ্গীত গান’ দর্শকের মনে উদ্দীপনা সঞ্চার করে।

এবারে গ্রেট ন্যাশনালের আবার কিছু পরিবর্তন হলো। পশ্চিম ভারত থেকে ফিরে এসে ধর্মদাস সুর উপার্জিত অর্থ মালিক ভুবনমোহনকে বুঝিয়ে দেননি এবং উপহার সামগ্রীও সমবণ্টন করেননি। ধর্মদাস যৎসামান্য অর্থ ও অকিঞ্চিৎকর উপহার ভুবনমোহনকে দেন। এই সব কারণে এবং থিয়েটারের হিসেবপত্র নিয়েও তিনি ধর্মদাসের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাছাড়া ভুবনমোহন গ্রেট ন্যাশনালের মালিক ও স্বত্বাধিকারী হলেও কাজেকর্মে ধর্মদাস সুরই প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন। ১৮৭৫-এর আগস্ট মাসে ভুবনমোহন ধর্মদাসের হাত থেকে কার্যভার নিয়ে নেন। কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় নামে একজনকে রঙ্গমঞ্চটি ইজারা দেন। ম্যানেজার থেকে যান মহেন্দ্রলাল বসু। ধর্মদাস সুর ও সঙ্গীরা গ্রেট ন্যাশনাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তারা ‘দি নিউ এরিয়ান (লেট ন্যাশনাল) থিয়েটার’ নাম গ্রহণ করে বেঙ্গল থিয়েটারে অভিনয় করতে থাকেন।

কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় ইজারা নিয়ে পুরাতন থিয়েটারের নাম পালটে করেন ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল থিয়েটার’ এবং ম্যানেজার মহেন্দ্রলালকে নিয়ে অভিনয় চালাতে থাকেন।

১৮৭৫-এর আগস্ট মাসেই ‘পদ্মিনী’ নাটক দিয়ে এদের অভিনয় শুরু হয়ে গেল। ১৪ আগস্ট অভিনীত হলো উপেন্দ্রনাথ দাসের শরৎ-সরোজিনী’, ২১ আগস্ট ‘নীলদর্পণ’। এই সময়ে অমৃতলাল বসু বেঙ্গল থেকে এসে এখানে যোগ দেন। তারপরেই অভিনীত হয় অভিনেত্রী সুকুমারী দত্তের লেখা নাটক ‘অপূর্বসতী’। আশু দাসের সহযোগিতায় লেখা এই নাটকটি সুকুমারীর সাহায্য-রজনী হিসেবেই অভিনীত হয় (২৩ আগস্ট)। এরপর ডাক্তারবাবু (ভুবন সরকার), কনকপদ্ম (হরলাল রায়), হেমচন্দ্রের ‘বৃত্রসংহার’ কাব্যের নাট্যরূপ সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে অভিনয় করা হয়।

এইভাবে টানা চার মাস কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় এই নতুন থিয়েটার চালাতে গিয়ে লাভের পরিবর্তে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। থিয়েটার বাড়ির ভাড়াও দিতে পারছিলেন না। তখন ভুবনমোহন বাধ্য হয়ে আবার থিয়েটার নিজের হাতে নিয়ে নেন। আবার পুরনো নামে ‘গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার’ তার অভিনয় চালু করলো। মালিক ভুবনমোহন এবং ম্যানেজার উপেন্দ্রনাথ দাস। ১৮৭৫-এর ২৩ ডিসেম্বরের ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকার বিজ্ঞাপনে দেখা যায় ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল থিয়েটার’ নাম বদলে আবার গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার হয়েছে। ১৮৭৫-এর ২৫ ডিসেম্বর অমৃতলালের লেখা ‘হীরকচূর্ণ’ নাটক দিয়ে এদের অভিনয় শুরু হলো। আগের ‘কাম্যকানন’ নাটক রচনার যৌথ প্রচেষ্টা বাদ দিলে ‘হীরকচূর্ণ’ অমৃতলালের প্রথম নাটক। এর বিষয় বরোদার রাজা গায়কোয়াড়ের সিংহাসনচ্যুতি, এই রাজ্যের ইংরেজ রেসিডেন্টের বিষপানে মৃত্যু হয়। এই নিয়ে সেই সময়ে দেশে খুব সোরগোল পড়ে যায়। ইংরেজ সরকার বরোদার রাজাকে এই অজুহাতে সিংহাসনচ্যুত করেন। তাই নিয়ে দেশ জুড়ে হৈচৈ হয়। ‘হীরকচূর্ণ’ নাটকের বিষয়বস্তু এই ঘটনাকে নিয়েই রচিত। এর কিছু আগেই বেঙ্গল থিয়েটার ‘গুইকোয়ার’ নামে একই বিষয়বস্তুর একটি নাটক নামিয়ে দর্শকদের মধ্যে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। এখানে ১৮৭৫-এর ২৫ ডিসেম্বর অমৃতলালের নাটকটি অভিনীত হলো। তারপরেই ৩১ ডিসেম্বর এখানে উপেন্দ্রনাথ দাসের ‘সুরেন্দ্র-বিনোদিনী’ নাটকের প্রথম অভিনয় হলো। এর আগে ১৮৭৫-এর ১৪ আগস্ট বেঙ্গলমঞ্চে ‘দি নিউ এরিয়ান’ দল সুরেন্দ্র বিননাদিনী প্রথম মঞ্চে অভিনয় করে। তারাই আবার ফিরে এসে গ্রেট ন্যাশনালে যোগ দেয়। এবং সুরেন্দ্র বিনোদিনী আবার গ্রেট ন্যাশনাল মঞ্চে অভিনয় করে। এই নাটকে সুকুমারী বিনোদিনীর ভূমিকায় অভিনয়ে কৃতিত্ব অর্জন করেন। ১৮৭৬-এ প্রকৃত বন্ধু (ব্রজেন্দ্রকুমার রায়), সরোজিনী (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ) এবং বিদ্যাসুন্দরের অভিনয় হয়।

সরোজিনীতে অভিনয় করে: লক্ষ্মণসিংহ—মতিলাল সুর, ভৈরবাচার্য—গোপাল দাস, বিজয় সিংহ—অমৃতলাল বসু, রণবীর সিংহ—মহেন্দ্রলাল বসু, সরোজিনী—বিনোদিনী।

১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দেই গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার তথা বাংলা নাট্যশালার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটতে থাকে। অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ আইন (Dramatic Performances Control Act. 1776) এই ঘটনাগুলির মধ্যে দিয়েই প্রবর্তিত হওয়ার সুযোগ খুঁজে নেয়। পরাধীন জাতির নাট্য-সংস্কৃতির ওপর ব্রিটিশ সরকারের দমননীতি আইনের রূপে দেখা দিল।

ব্রিটিশ যুবরাজ প্রিন্স অফ ওয়েলস (পরবর্তী সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ড) কলকাতায় এসে দেশীয় পুরনারীদের দেখতে চাইলে উকিল জগদানন্দ মুখোপাধ্যায় নিজের বাড়িতে তাকে আহ্বান করেন। যুবরাজ অন্তঃপুরে ঢুকে পুরনারীদের দেখে আসেন। এই নিয়ে তখন কলকাতায় প্রচণ্ড আলোড়ন। এই বিষয় নিয়েই গ্রেট ন্যাশনাল ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’ নামে উপেন্দ্রনাথ দাসের লেখা একটি প্রহসন ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ফেব্রুয়ারি অভিনয় করে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সওজিনী নাটকের সঙ্গে। ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘সতী কি কলঙ্কিনী’র সঙ্গে এই প্রহসনটির দ্বিতীয় অভিনয় হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় দুটি অভিনয়েও প্রচুর দর্শক সমাগম হয়। সেদিন ভিন্ন নামে এটি অভিনীত হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। দ্বিতীয় অভিনয়ের পরেই পুলিশ এর অভিনয় বন্ধ করে দেয়। তখন এটির নাম পালটে ‘হনুমান চরিত্র’ নাম দিয়ে অভিনয় করা হয় (২৬ ফেব্রুয়ারি)। ‘কর্ণাটকুমার’ (সত্যকৃষ্ণ বসু সৰ্বাধিকারী) নাটকের পর। এখানে যুবরাজকে দিল্লীশ্বর হোরঙ্গজেবের পুত্র এবং উকিল গজদানন্দকে ‘হনুমান’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছিল। পুলিশ এরও অভিনয় বন্ধ করে দেয়। তখন পুলিশকে ব্যঙ্গ করে উপেন্দ্রনাথ ‘The Police of Pig and sheep’ প্রহসন লেখেন। সেটি সুরেন্দ্রবিননাদিনীর সঙ্গে অভিনীত হলো (১ মার্চ, ১৮৭৬)। পুলিশ কমিশনার মিঃ হগ এবং পুলিশ সুপার মিঃ ল্যাম্বকে ব্যঙ্গ করেই এই রকম নামকরণ।

ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে বাংলা নাটক ও রঙ্গমঞ্চের এই ভূমিকা গ্রহণে বড়লাট নর্থব্রুক ২৯ ফেব্রুয়ারি এক অর্ডিনান্স জারি করেন তাতে যে কোনো নাটক ‘Scandalous, defamatory, seditious, obscene or otherwise pre-judicial to the public interest—হলে তা বন্ধ করার ক্ষমতা ইংরেজ সরকারের হাতে রইলো। পত্র-পত্রিকায় এই অর্ডিনান্সের পক্ষে ও বিপক্ষে নানা মতবাদ প্রকাশ পেতে থাকে। গ্রেট ন্যাশনাল তখন এই জাতীয় নাটকের অভিনয় বন্ধ করে দিয়ে আবার ‘সতী কি কলঙ্কিনী’ ও ‘উভয় সঙ্কট’ (৪ মার্চ) অভিনয় করতে থাকে। পুলিশ সেই রাতেই থিয়েটারে এসে ডিরেক্টার উপেন্দ্রনাথ দাস, ম্যানেজার অমৃতলাল বসু, অভিনেতা মতিলাল সুর, অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়, শিবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং সঙ্গীতকার রামতারণ সান্যাল প্রমুখ আটজনকে গ্রেপ্তার করে। প্রথম বিচারে এদের মধ্যে উপেন্দ্রনাথ ও অমৃতলালের এক মাস বিনাশ্রম দণ্ড হয় এবং অন্যেরা মুক্তি পায়। আপীল করা হয়। আপীলের রায়ে এরা দুজনেও ছাড়া পেলেন (২০ মার্চ, ১৮৭৬)।

ইংরেজ সরকার এবার নব উদ্যমে অর্ডিনান্সটিকে মার্চ মাসেই ‘Dramatic Performances Conuol Bill’ নামে আইনের খসড়া তৈরি করে কাউন্সিলে পেশ করে এবং ডিসেম্বর মাসেই তা আইনে পরিণত হয়।

গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের অভিনয়ের ধারা এবার প্রচণ্ডরূপে আঘাত পেল। উপেন্দ্রনাথ দাস চলে গেলেন বিলেত। অমৃতলাল বসু ও বিহারীলাল চট্টোপাধ্যায় গেলেন পোর্টব্লেয়ার, চাকরী নিয়ে। সুকুমারী দত্ত অভিনয় থেকে বসে গেলেন। বিনোদিনী গ্রেট ন্যাশনাল ছেড়ে দিলেন। নগেন্দ্রনাথ প্রায় স্বেচ্ছা অবসর নিলেন, অর্ধেন্দুশেখর বেরিয়ে পড়লেন দেশভ্রমণে। আর মামলা মোকদ্দমায় সর্বস্বান্ত হয়ে গেলেন ভুবনমোহন।

তবুও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে লাগল গ্রেট ন্যাশনাল। পুরনো নাটকগুলির পুনরভিনয় চলল। ‘সতী কি কলঙ্কিনী’ ও ‘উভয় সঙ্কট’, সরোজিনী, পদ্মিনী, ভীমসিংহ (ওথেলোর রূপান্তর: তারিণীচরণ পাল) প্রভৃতি নাটকগুলি মামলার সময়ে চলছিল। ১৮৭৬-এর ৮ এপ্রিল থেকে এখানে অভিনয় বন্ধ থাকে। একেবারে নতুন বছরে, ১৮৭৭-এর জানুয়ারিতে দু’তিন বার অভিনয় হলো ‘পারিজাত হরণ’ গীতিনাট্য (নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়)। গীতিনাট্যগুলিই এই দুঃসময়ে চলছিল ভালো। তবুও, তারই মধ্যে আদর্শ সতী, চোরের ওপর বাটপাড়ি, একেই কি বলে সভ্যতা?, সধবার একাদশী প্রভৃতি নাটকগুলিও অভিনীত হয়। ১৮৭৭-এর ৬ অক্টোবর অভিনীত হলো ‘দুর্গাপূজার পঞ্চরং’, ‘আগমনী গান’ ও ‘ইয়ং বেঙ্গল’—তিনটি প্রহসন ও গীতিনাট্য।

১৮৭৭-এর ৬ অক্টোবর গ্রেট ন্যাশনালের শেষ অভিনয়। গ্রেট ন্যাশনাল কোনোরকমে অভিনয় চালাতে চালাতে একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল।

ভুবনমোহন এবার গিরিশচন্দ্রকে গ্রেট ন্যাশনালের ইজারা দেন; গিরিশ এই থিয়েটার-এর দায়িত্ব নিয়ে আবার নামকরণ করেন ন্যাশনাল থিয়েটার, জুলাই, ১৮৭৭। এর অনেক আগে গিরিশের পরিচালনাধীন ন্যাশনাল থিয়েটার ১৮৭৪-এর ১৮ এপ্রিল গ্রেট ন্যাশনালের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এবারে স্বত্বাধিকারী গিরিশের গ্রেট ন্যাশনাল আবার ন্যাশনাল থিয়েটার নাম নিয়ে অভিনয় শুরু করল। ম্যানেজার হলেন অবিনাশচন্দ্র কর।

পরিবারিক কারণে গিরিশ ১৮৭৭-এর ৩০ নভেম্বর এর মালিকানা হস্তান্তরিত করেন। এইরকম নানাজনের মধ্যে হস্তান্তরিত হতে হতে শেষে মূল মালিক ভুবনমোহন দেনার দায়ে এই থিয়েটারটি নীলামে তোলেন। প্রতাপাদ জহুরি এই থিয়েটার নিলামে কিনে নেন, ১৮৮০-তে। সেখানে তিনি নতুন করে ন্যাশনাল থিয়েটার নাম দিয়ে অভিনয় চালাতে থাকেন। এইভাবে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের অস্তিত্ব শেষ হয়ে গেল।

রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের অবদান

গ্রেট ন্যাশনাল দীর্ঘদিন চালু ছিল না। তার স্বল্পকালীন অভিনয়ের ইতিহাসে অন্তত তিনটি কারণে এই থিয়েটার বাংলা নাট্যশালার ইতিহাসে চিরকাল আলোচিত হতে থাকবে—

  • গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার দ্বিতীয় রঙ্গালয় যার নিজস্ব বাড়ি ও মঞ্চ ছিল। এবং ব্যক্তিগত মালিকানায় পরিচালিত হয়েছিল। মূল ন্যাশনাল থিয়েটার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নাটক-পাগল যুবকেরা শুধুমাত্র পৃষ্ঠোষকের অভাবে তাদের অবদমিত নাট্যস্পৃহা নিয়ে বসেছিল। ভুবনমোহন সহযোগিতায় এলেন, নিজের খরচে জমি সংগ্রহ, থিয়েটার বাড়ি ও মঞ্চ নির্মাণ করে নিজস্ব মালিকানায় এই থিয়েটারের সব আর্থিক দায়দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। শরৎচন্দ্র ঘোষের বেঙ্গল থিয়েটারের চার মাসের মধ্যেই কলকাতায় এটি দ্বিতীয় প্রয়াস। সাধারণ রঙ্গালয় তার ব্যক্তি মালিকানায় অব্যাহত গতিবেগ লাভ করলো।
  • বাংলা নাট্যশালায় স্বদেশপ্রেমের উদ্দীপনা ও ব্রিটিশ বিরোধিতা গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের মাধ্যমেই পূর্ণবেগে চালিত হলো। ন্যাশনাল থিয়েটার নীলদর্পণ অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে জাতীয়তাবোধের প্রেরণার যে উন্মেষ ঘটিয়েছিল, গ্রেট ন্যাশনাল সেই ধারাকেই আরো উদ্দীপিত করে তুলল। ব্রিটিশ সহায়তায় জাত ধনী বাঙালির সখের মঞ্চে যা কোনো দিনই সম্ভব হয়নি মধ্যবিত্তের থিয়েটারেই তা সম্ভব হলো। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এদেশীয়দের মনে যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হচ্ছিল এবং জাতীয়তাবোধের উদ্বোধন ঘটে চলেছিল, তারই সহায়ক হিসেবে গ্রেট ন্যাশনাল স্বদেশপ্রেমের এবং ব্রিটিশ বিরোধিতার নাটক অভিনয় করতে লাগলো। নীলদর্পণ, ভারতমাতা, শরৎ-সরোজিনী, সুরেন্দ্র-বিনোদিনী, হেমলতা, বঙ্গের সুখাবসান, হীরকচূর্ণ, পুরুবিক্রম প্রভৃতি নাটকের ধারাবাহিক অভিনয়ের মধ্যে তাদের দেশপ্রেম ও পরাধীনতার জ্বলার রূপ প্রকাশ পাচ্ছিল। হরলাল রায়, অমৃতলাল বসু, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং উপেন্দ্রনাথ দাস—এই চার নাট্যকারের নাটক গ্রেট ন্যাশনালে প্রায়ই অভিনীত হয়েছে এবং জনসম্বর্ধনা লাভ করেছে। ‘নীলদর্পণ’ তো হয়েইছে। তদানীন্তন জাতীয় ভাবধারার উন্মেষের একটা প্রধান সহযোগী হিসেবে গ্রেট ন্যাশনাল তার নাট্যাভিনয়ের মাধ্যমে দেশবাসীকে উজ্জীবিত করে তুলে পরাধীন দেশের রঙ্গালয়ের নাট্যকর্মীর প্রধান দায় ও দায়িত্ব পালন করেছিল।
  • স্বদেশপ্রেম ও ব্রিটিশ বিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গে নাটকে ব্রিটিশের শাসন ও অত্যাচার এবং ভারতবাসীর অসহায়তা বা কখনো প্রতিবাদ—এইসব দৃশ্য তুলে ধরা হচ্ছিল। ‘ভারতমাতা’ গীতিনাট্যে সাহেবদের অত্যাচার এবং এদেশবাসীর ক্ষুধার জন্য হাহাকার চিত্রিত হয়েছিল। নীলদর্পণে তোরাপ তো সাহেবকে ধরে পিটিয়েছিল। সাহেবের নির্মম অত্যাচারও দেখানো হয়েছিল। শরৎস-সরোজিনীতে ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটকে বাঙালি ধরে পেটাচ্ছে—এমন দৃশ্যও রয়েছে। আবার সাহেবের নারী নির্যাতন ও শোষণও দেখানো হচ্ছে। ‘হীরকচূর্ণ’ নাটকে তদানীন্তন বড়লাট নর্থব্রুক ও তার সরকারের বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ আক্রমণ রয়েছে। এইভাবে ব্রিটিশ বিরোধিতা এবং প্রতিবাদ যখন রঙ্গালয়ে ভাযা পাচ্ছিল এবং জনসমর্থন বিস্তৃত হচ্ছিল, তখন শাসক ইংরেজ স্বভাবতই ভীত হয়েছিল এবং রঙ্গালয়ে ব্রিটিশ বিরোধিতা দমনে এগিয়ে আসে। এই সময়েই ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’ সংক্রান্ত ঘটনা ব্রিটিশ সরকারকে আইন প্রবর্তনে বাধ্য ও ত্বরান্বিত করে মাত্র।

গ্রেট ন্যাশনালের অভিনয়ের মধ্যেই ব্রিটিশ রাজশক্তি আশঙ্কার কারণ খুঁজে পেয়েছিল। তাই অচিরাৎ অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ আইন (১৮৭৬) প্রবর্তন করে বাংলা রঙ্গমঞ্চ ও নাটকের কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টা শুরু করে দেয় ইংরেজ।

ব্রিটিশের কুখ্যাত নাটক ও নাট্যাভিনয় বিরোধী আইন চালু হয়েছিল গ্রেট ন্যাশনালের অভিনয়ের কথা মনে রেখেই। বাংলা নাট্যশালার ইতিহাসে এই প্রসঙ্গ সর্বথা উল্লেখযোগ্য।

গ্রেট ন্যাশনালে ব্যক্তি মালিকানা চালু হলেও পুরো পেশাদারি প্রথা, রীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি (Professional attitudle and approach) চালু করতে পারেনি। থিয়েটার চলেছে ভালো, অর্থ উপার্জন হয়েছে ভালো। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মের অভাবে অর্থকে ব্যবহার করা যায়নি। ম্যানেজাররা প্রভুত্ব করেছে, গণ্ডগোল করেছে। ধর্মদাস সুর ম্যানেজার থাকাকালীন মালিক ভুবনমোহনের রঙ্গমঞ্চে প্রবেশাধিকার ছিল না। পাশেই বেঙ্গল থিয়েটার মোটামুটি থিয়েটারকে নিয়ন্ত্রণে রেখে টানা ত্রিশ বছর অভিনয় চালিয়ে গেছে। শুধুই পেশাদারিত্বের অভাবে গ্রেট ন্যাশনাল গৌরবের দিনেও দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

তবে একথা ঠিক, যে স্বল্পকাল গ্রেট ন্যাশনাল ছিল, ছিল পূর্ণ মর্যাদায়। কিছু হাল্কা রং তামাশার নাটক ও গীতিনাট্য অভিনয় করলেও বেশির ভাগই করেছে সীরিয়াস ও তাৎপর্যময় নাটকের অভিনয়। দর্শকের সহযোগিতাও পেয়েছে।

এই থিয়েটারেই অমৃতলাল নাট্যরচনা শুরু করেন। উপেন্দ্রনাথ দাস এখানেই তাঁর নাট্যকার ও নাট্যশিক্ষকের প্রধান দায়িত্ব পালন করেছেন। হরলাল রায়ের নাটকগুলি এখানেই রচিত। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পূর্ণ মর্যাদায় এখানেই স্বীকৃত। একথাগুলিও এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে।

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!