//
//

বাংলার সমাজ-জীবনে চৈতন্যদেবের প্রভাব আলোচনা কর।

বাংলার সমাজ-জীবনে চৈতন্যদেবের প্রভাব

ষোড়শ শতকে নবজাগরণের পুরোধা মানবতার মূর্ত বিগ্রহ চৈতন্যদেবের আবির্ভাব বাংলাদেশে ও বাঙালির সমাজজীবনের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। বাঙালির চিত্তলোক মন্থন করে যে অমৃত উঠেছে চৈতন্যদেব যেন তারই ঘনীভূত নির্যাস।

চৈতন্যের আবির্ভাবকালে রাষ্টিক ও সামাজিক পটভূমি ছিল তমসাচ্ছন্ন। তুর্কী বিজয়ের অভিঘাতে তখন জাতি দিশেহারা ও পর্যুদস্ত। অন্যদিকে ইসলাম ধর্মান্তরীকরণের প্রবল স্রোতে হিন্দু সমাজ বিপন্ন। এই ফাকে বাঙালির জীবনধারা ও সংস্কৃতিতে চলছিল নবজাগরণের এক নীরব প্রস্তুতি। তাই ইতিহাসের অমোঘ নির্দেশে পরাজিত সেনরাজাদের পরিত্যক্ত, হতশ্রী নবদ্বীপই হল নবজাগৃতির পীঠস্থান।

বাংলাদেশ ও বাঙালির সমাজজীবনে যখন এই অস্থিরতা, পরাজয়, অপমান টিকে থাকবার আশায় বিপর্যস্ত ভাব, মানুষের মনুষ্যত্ব যেখানে ভূলুণ্ঠিত, তখন আদ্বিজচণ্ডালে আলিঙ্গন করে কৃষ্ণন্নামে মাতোয়ারা করে জাতিকে নতুনভাবে বাঁচাবার স্বপ্ন দেখালেন যিনি—তিনি হলেন বৃহৎ মানবতার আদর্শস্বরূপ যুগপুরুষ শ্রীচৈতন্য।

শ্রীচৈতন্য কোন অবতার ছিলেন না, তাঁকে যুগ প্রয়োজনে সমাজই অবতার রূপে চিহ্নিত করল। যেখানে শাসক মুসলমানের অত্যাচারে বাঙালি পর্যদস্ত, উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুর মধ্যে ঈর্ষা ও দ্বন্দ্ব, যেখানে— “সকল সংসার মত্ত ব্যবহার রসে।/জগৎ প্রমত্ত মিথ্যা ধনপুত্র রসে।।” সেখানে শুধু উপেক্ষিত বা অবহেলিত মানুষেরা নয়; অদ্বৈত, শ্রীবাস, মুরারি, চন্দ্রশেখর সবাই মিলিত হলেন নবদ্বীপে। এঁরা সকলেই জীব উদ্ধারের কারণে তাঁর অবতার রূপকে মেনে নিলেন। তাই তখনকার সমাজ এরকম একজন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ চাইছিলেন। চৈতন্যদেবও সেই সব সাধারণ মানুষকে বুকে টেনে নিয়ে তাদের বাঞ্ছিত পথকে সুগম করলেন।

তখন হিন্দুদের মধ্যে অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষেরা ছিলেন ঘৃণ্য, অস্পৃশ্য। সেইসব সাধারণ মানুষের সঙ্গে তিনি হৃদ্যতা স্থাপন করলেন। এজন্য জীবনীকাব্যে দেখি তার সঙ্গে আলাপ ছিল ‘খোলাবেচা শ্রীধরের’, ‘গন্ধবণিক উদ্ধরণ দত্তের’, যবন হরিদাসের’—এদেরকে তিনি মানুষের মর্যাদা দিয়েছিলেন। বিভিন্ন অন্ত্যজ পল্লীতে যেতেন তিনি। কারণ চৈতন্যভাগবতে রয়েছে—এক গন্ধবণিক বলেছে ‘আপনি এই গন্ধ নিয়ে যান, মাখুন, ভাল হলে দাম দিয়ে যাবেন।’ এই অন্ত্যজ সম্প্রদায় বর্ণহিন্দুদের কাছে ছিল অস্পৃশ্য। কিন্তু চৈতন্যের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা স্থাপনের পর, তারা চৈতন্যদেবকে অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখল।

চৈতন্যদেবকে ঘিরে সে সময়ে নবদ্বীপে ও বৃন্দাবনে বিভিন্ন বৃত্তির মানুষেরা বসতি স্থাপন করল। বহু সাধারণ বৃত্তিজীবী মানুষ তাদের জীবিকা খুঁজে পেল। শুধু তাই নয়, তৎকালীন রাজনৈতিক আকাশের ঝড় তুফানের মধ্যে শ্রীরাধার ভাবকান্তিময় চৈতন্য জীবনের আওতায় নাম—প্রেমাশ্রয়ী বৈষ্ণবসাধনা ও চৈতন্যসংস্কৃতি, গৌড়বঙ্গ, উৎকল, দ্রাবিড়, মথুরা, বৃন্দাবন, বারাণসী, প্রয়াগ, রাজস্থান-দ্বারবতীর মধ্যে একটি সুবৃহৎ ভাবপরিমণ্ডল সৃষ্টি করেছিল।

ব্রাহ্মণ্যধর্মের সংকীর্ণতা ও অহমিকায় অভিমানী তথাকথিত অন্ত্যজ শ্রেণি আত্মরক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার কারণে দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। বৌদ্ধরাও অনেক ব্রাহ্মণদের নিপীড়নে উত্যক্ত হয়ে একই পন্থা অনুসরণ করে। চৈতন্য-প্রবর্তিত ধর্ম তাদের জন্য একটি নতুন ধর্মের সন্ধান দিল, যে ধর্মে জাতিভেদ নেই, জাতিবিদ্বেষ নেই, মানুষে মানুষে ভেদ নেই, আছে পারস্পরিক প্রীতি এবং অহমিকার পরিবর্তে বিনয়। এই ব্যবস্থা সেদিন সমগ্র বাঙালি সমাজ দ্বিধাহীন ভাবে গ্রহণ করেছিল। চৈতন্য দেখালেন, জন্ম সব নয়, কর্মই আসল। সেজন্য তিনি ‘আপনি আচরি ধর্ম’—এই বিশ্বাসে ব্রতী হলেন—যা সমাজে ব্যাপক প্রভাব ফেলল।

শ্রীচৈতন্য বলতেন, কলিতে হরিনাম নাও, তাতেই মুক্তি। আর বলতেন— “গ্রাম্য বার্তা না শুনিবে, গ্রাম্য কথা না কহিবে; তৃণ হইতে সুনীচ হইবে, তরু হইতে সহিষ্ণু হইবে, অপরকে মানদান করিয়া নিজে মানত্যাগ করিবে।’’ তার এই আদর্শকে সমাজ দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নিয়েছিল।

প্রচলিত নাম সংকীর্তনও ছিল তার সমাজ সংস্কারের একটি বিশেষ দিক। খোল ও মন্দিরার বাদ্য সংযোগে সাধারণ মানুষের মনে এক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে একই প্লাটফর্মে তাদের আনার—এর চেয়ে কোন বিকল্প পন্থা বোধ হয় সেদিন ছিল না। এর প্রতিক্রিয়া কাজী দলনের সময়ও দেখা গিয়েছে। শাসকের রক্তচক্ষু পরাজিত হয়েছে দেবোপম পৌরুষের কাছে। তার প্রেমধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে এর অবদান ছিল। কলিযুগে ধর্ম হয় নাম সংকীর্তন’ এবং ‘প্রেমধন আর্তি চিনে না পাই কৃষ্ণেরে।’ এই প্রেম ধর্মের প্লাবনে বাঙালি সমাজ জীবনে দীর্ঘদিনের জমা ক্লেদ ধুয়ে মুছে যায়। মুসলমান শাসকের অত্যাচারে উৎপীড়িত হিন্দুরা সেদিন চৈতন্যকে উৎপীড়িতের রক্ষাকবচ রূপে গ্রহণ করেছিল।

তিনি হিন্দুধর্মের অবক্ষয় রোধ করেছিলেন ভক্তিধর্মের প্রচারে। নিত্যানন্দকে তিনি বলেছিলেন—

মূর্খ নীচ পতিত দুঃখিত যত জন।

ভক্তি দিয়া কর গিয়া সভার মোচন।।

প্রেমধর্ম প্রচারে বহুদিনের লালিত সামাজিক কুসংস্কার সেদিন নষ্ট হয়েছিল। মানুষকে ভালোবেসে, তাকে কাছে টেনে নিয়েই তার সেবা করা যায়। পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথ এই আদর্শ ও ভাবনার অধিকারী ছিলেন। ভেদাভেদ ত্যাগ করে, সামাজিক সাম্যের দ্বারা মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করবার প্রয়াসই ছিল চৈতন্যের সমাজ-সংস্কারের আসল সাধনা। যার দ্বারা তৎকালীন সমাজ বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছিল।

তারই প্রভাবে বাঙালির প্রাত্যহিক সমাজজীবনে, তাদের আচার-ব্যবহারে, বৈষ্ণবীয় বিনয়, তুলসীর গলকণ্ঠী, পুরোহিতের নামাবলী, দেহে গঙ্গামৃত্তিকার নাম ও পদাঙ্ক ধারণ প্রভৃতি শীল সদাচার সমাজজীবনে প্রবর্তিত হয়। যবন হরিদাসের জীবন সাধনায় হিন্দু মুসলিম সংস্কৃতি সমন্বয়ের সম্ভাবনা ঘটেছিল। ব্রাহ্মণ-প্রধান হিন্দুসমাজে ভেদমূলক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে চৈতন্যদেব সর্বমানবিক প্রেমধর্মের জোয়ার নিয়ে এলেন। ফলে অনেক হিন্দু ও মুসলমান নিজ নিজ সাম্প্রদায়িক ধর্ম ও সামাজিক সংকীর্ণতা ত্যাগ করে এই বিদ্রোহাত্মক আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তার ফলে জাতীয় নবজাগরণ কেশ ত্বরান্বিত হয়েছিল। এইভাবে শ্রীচৈতন্য বিভিন্ন দিক থেকে সমাজে তার কীর্তি ও আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে মানুষের মনে চিরকালের আসনটি লাভ করতে পেরেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!