//
//

বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে চৌরঙ্গী থিয়েটারের অবদান আলোচনা কর।

চৌরঙ্গী থিয়েটার

উদ্বোধন: ২৫ নভেম্বর, ১৮১৩     

স্থায়িত্বকাল: ১৮১৩-১৮৩৯

প্রতিষ্ঠাতা: এমেচার ড্রামাটিক সোসাইটি

নাটক: কাসল্ স্পেক্টার ও সিক্সটি থার্ড লেটার

কলকাতায় বসবাসকারী অভিজাত ও শিক্ষিত ইংরেজরা তাদের মনোমত একটি থিয়েটারের অভাব দীর্ঘদিন ধরে বোধ করছিল। ক্যালকাটা থিয়েটারের পর আর এমন কোনো থিয়েটার তৈরি হলো না, যেখানে মনোমত ভালো ও উচ্চাঙ্গের নাট্যাভিনয় দেখতে পাওয়া যায়। এই অভাববোধ থেকেই কলকাতায় গণ্যমান্য ও বিশিষ্ট কয়েকজন ইংরেজ একটি রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার জন্য এগিয়ে এলেন। নাট্যরসিক ব্যক্তিরা সবাই ছিলেন এমেচার ড্রামাটিক সোসাইটির সভ্য। এই সোসাইটিকে বিফষ্টিক ক্লাবও বলা হতো। এই ক্লাবের সদস্যদের চেষ্টাতেই চৌরঙ্গী থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়। চৌরঙ্গী ও থিয়েটার রোডের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে এটি তৈরি হয়েছিল। গোড়া থেকেই এখানে প্রাইভেট সাবসক্রিপসন বা ব্যক্তিগত সদস্য চাঁদার ওপর রঙ্গালয়টি পরিচালিত হতো। তাই এর আরেক নাম সাবসক্রিপসন থিয়েটার। প্রত্যেক সদস্যই শেয়ার হোল্ডার ছিলেন।

এই থিয়েটারটির সঙ্গে প্রখ্যাত অনেকেই জড়িত ছিলেন। সংস্কৃত পণ্ডিত ও ভারতবিদ এইচ, এইচ. উইলসন থেকে শুরু করে হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন ডি, এল. রিচার্ডসন, উচ্চপদস্থ কর্মচারী হেনরি মেরিডিথ পার্কার, ইংলিশম্যান কাগজের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক জে. এইচ, স্টোকলার প্রভৃতি গণ্যমান্য শিল্পরসিক ব্যক্তিবৃন্দ চৌরঙ্গী থিয়েটারের উদ্যোক্তা ছিলেন।

বাঙালির মধ্যে দ্বারকানাথ ঠাকুর ড্রামাটিক সোসাইটির সভ্য ছিলেন। নানাভাবে তিনি চৌরঙ্গী থিয়েটারের সুদিন-দুর্দিনে চৌরঙ্গী থিয়েটারের সঙ্গে ছিলেন—একেবারে শেষ দিন পর্যন্ত।

রঙ্গালয়টি তাড়াতাড়ি নির্মাণের ফলে এর বাইরের শোভা ভালো ছিল না। তবে ভেতরের অন্য সব ব্যবস্থা খুবই উচ্চাঙ্গের হয়েছিল।

১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের ২৫ নভেম্বর চৌরঙ্গী থিয়েটারের উদ্বোধন হলো। অভিনীত নাটক— ‘কাসল‌ স্পেক্টার’ নামে বিয়োগান্ত নাটক এবং ‘সিক্সটি থার্ড লেটার’ নামে একটি অপেরা। প্রচণ্ড উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে প্রথম শ্রেণীর রঙ্গালয়টির উদ্বোধন হলো। বড়লাট লর্ড ময়রা, তার স্ত্রী এবং নাট্যরসিক শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত হলেন। প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ হয়ে গেল।

এখানে উচ্চমানের নাট্যশিল্পীদের সমাবেশ হয়েছিল। স্টোকলার, পার্কার, মিসেস লীচ সে-যুগের খ্যাতিমান অভিনেতা-অভিনেত্রী। প্রসিদ্ধ গায়ক উইলিয়াম লিন্টন, কর্নেল জে. সি. ডয়েলি, ক্যাপ্টেন উরু, ডি, প্লেফেয়ার প্রমুখরাও এখানে যুক্ত ছিলেন। ফলস্টাফের ভূমিকায় সেকালে প্লে-ফেয়ারের জুড়ি ছিল না। অভিনেত্রীদের মধ্যে মিসেস ফ্রান্সিস, মিসেস গটলিয়েব, মিসেস ব্ল্যান্ড। তাছাড়া ইংলন্ডের থিয়েটার থেকে কিছু বিখ্যাত অভিনেত্রী এখানে আনা হয়েছিল। ডুরিলেন থিয়েটার থেকে মিসেস এটকিনসন, থিয়েটার রয়াল থেকে মিসেস চেস্টার। সঙ্গীতে, নৃত্যে ও অভিনয়ে পারদর্শিনী এই অভিনেত্রীরা চৌরঙ্গী থিয়েটারের অভিনয়কে উচ্চাঙ্গের ও আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন। আর ছিলেন সে সময়ের সবচেয়ে কুশলিনী ও খ্যাতিময়ী অভিনেত্রী মিসেস এসথার লীচ। তাকে এদেশে ‘ইন্ডিয়ান সিডানস্’ নামে অভিহিত করা হতো। মিসেস সিডানস্ ছিলেন ইংলন্ডের চিরকালের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী। ১৮২৬-এর ২৭ জুলাই চৌরঙ্গী রঙ্গালয়ে মিসেস লীচ প্রথম মঞ্চাবতরণ করেন সেরিডানের বিখ্যাত নাটক ‘স্কুল ফর স্ক্যান্ডাল’-এ লেডি টিজেলের ভূমিকায়। ১৮২৬ থেকে ১৮৩৮ পর্যন্ত তিনি এখানে ওথেলো, দি ওয়াইফ, লেডি অফ লায়ন্স, হাঞ্চব্যাক প্রভৃতি নাটকে অভিনয় করে চৌরঙ্গী থিয়েটারের আকর্ষণ দর্শকদের কাছে শতগুণ বাড়িয়ে দেন।

এখানকার অভিনেতা সবাই এমেচার ছিলেন। কিন্তু অভিনেত্রীরা উচ্চহারে মাইনে পেতেন ও রঙ্গালয়ের সংলগ্ন গৃহেই বসবাস করতেন।

উদ্যোক্তা নাট্যরসিক ব্যক্তিদের চেষ্টা, অসম্ভব উজ্জ্বল সব তারকাদের অভিনয় এবং অন্যান্য কলাকুশলীদের সনির্বন্ধ প্রয়াসে চৌরঙ্গী থিয়েটারের নাট্যাভিনয় অতি উচ্চাঙ্গের হয়ে উঠল। এথেনিয়াম ট্রাজেডি নাটক অভিনয়ে ব্যর্থ হয়েছিল। চৌরঙ্গী দেখিয়ে দিল ট্রাজেডি নাটকের মর্যাদা কতোদূর যেতে পারে।

এখানে শেক্সপীয়র থেকে শুরু করে সেরিডান, গোল্ডস্মিথ, কোলম্যান, নোয়েলস, ফ্লেচার প্রভৃতি খ্যাতিমান নাট্যকারদের নাটক অভিনয় হয়েছে। হেনরি দি ফোর্থ, Love A la Mode (প্রহসন), সি স্টপস টু কঙ্কার, স্কুল ফর স্ক্যান্ডাল, কোরিওলেনাস, জেলাস ওয়াইফ, লাভ লাফস এ্যাট কস্মিথ, দি আয়রন চেস্ট, মসিও টেনসন, হানিমুন, কাথেরিন অ্যান্ড পেট্রসিও (শেক্সপীয়রের ‘টেমিং অব দি শ্রু’ নাটকের সংক্ষিপ্ত রূপ। রূপান্তর: ডেভিড গ্যারিক), ম্যাট্রিমনি, বিজি বডি, চার্লস দি সেকেন্ড, দি মেরিমনার্ক, দি এ্যাকট্রেস অব অল ওয়ার্কস (এই নাটকে মিসেস লীচ একাই ছয়টি চরিত্রে নেমেছিলেন) প্রভৃতি নাটকগুলি চৌরঙ্গী থিয়েটারে বিপুল সাফল্য ও সংবর্ধনা লাভ করেছিল।

বিপুল জনসমাদর ও দর্শকানুকূল্য পেলেও রঙ্গালয় পরিচালনার ত্রুটিতে কিছুদিনের মধ্যেই চৌরঙ্গী থিয়েটারের আর্থিক অনটন দেখা দিল। প্রথম বছরেই ১৭ হাজার টাকা দেনা হয়ে যায়। বড়লাটের বাৎসরিক ১৬শ’ টাকার অনুদান কোন কাজেই লাগল না। কখনো ভালো, কখনো খারাপ—এই ভাবে চলতে চলতে অবস্থা চরমে উঠল ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে। কর্তৃপক্ষ রঙ্গালয়টি ভাড়া দিতে বাধ্য হলেন। এক ইতালিয়ান অপেরা কোম্পানীকে ভাড়া দেওয়া হলো। ভাড়া মাসিক এক হাজার টাকা। ভাড়ার টাকা ছাড়াও দৃশ্যপট, আলো, সাজসজ্জা ইত্যাদি আনুষঙ্গিক আরো খরচ চালিয়ে কারো পক্ষেই এখানে থিয়েটার চালানো সম্ভব হলো না। ইতালিয়ান কোম্পানী ছেড়ে দিলে, এলো এক ফরাসী কোম্পানী। তারাও ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল।

এইভাবে দু’বছর চলার পর থিয়েটারের অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে উঠলে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে দেখা গেল দেনা পাহাড় সমান, আয় প্রায় নেই। শেষ পর্যন্ত দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রস্তাব মও পরিচালকমণ্ডলী রঙ্গালয়টি বিক্রি করা মনস্থির করলো। ১৫ আগস্ট, ১৮৩৫ ঋণের দায়ে নিলামে উঠল চৌরঙ্গী থিয়েটার। ত্রিশ হাজার একশো টাকায় নিলাম ডেকে থিয়েটার কিনে নিলেন বাঙালি ধনী দ্বারকানাথ ঠাকুর। কার অ্যান্ড ঠাকুর কোম্পানী পরিচালিত ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক হলো এর ট্রেজারার। দ্বারকানাথ মালিকানার লোভে থিয়েটারটি কেনেননি। দুরবস্থার হাত থেকে বাঁচাবার জন্যই তিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন। নিলামের অর্থে সব দেনা শোধ করা হলো। পার্কার, ক্লার্ক এবং কার এই তিন অভিনেতার হাতে থিয়েটার পরিচালনার ভার দেওয়া হলো। এইভাবে পুনরুজ্জীবন পেয়ে চৌরঙ্গী থিয়েটার আবার ভালোভাবেই চলা শুরু করে। বিলেত থেকে আবার অভিনেত্রী আনা হলো। ড্রুরিলেন থিয়েটার থেকে এলেন মিসেস চেস্টার। বছর চারেক এইভাবে থিয়েটার চলল।

তারপরে মিসেস লীচ অসুস্থ হয়ে চলে গেলেন লন্ডন। রাজকর্মচারী যেসব অভিনেতা এখানে যুক্ত ছিলেন, তাদের অনেকেই কাজের জন্য বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেলেন। দেনা, অবহেলা, অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভাব—সব মিলিয়ে একেবারে শেষ অবস্থা যখন থিয়েটারের, তখন একরাতে প্রচণ্ড আগুন লেগে সব কিছু পুড়ে শেষ হয়ে গেল। ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মে, রাত একটা।

চৌরঙ্গী থিয়েটারের বৈশিষ্ট্য অনেক দিক দিয়েই বলার মতো—

কলকাতায় সাহেবদের থিয়েটারের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল চৌরঙ্গী থিয়েটার। এই রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার মূলে যাঁরা ছিলেন তারা সবাই নাট্যপ্রিয় ও শিল্পরসিক। শুধুমাত্র প্রমোদ এবং স্ফূর্তির জন্য এই রঙ্গালয় নির্মিত হয়নি। এখানে প্রথম থেকেই শেক্সপীয়রের ট্রাজেডি ও কমেডিগুলি অভিনয়ের ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে অন্য প্রখ্যাত নাট্যকারের নাটক অভিনয়ের ব্যবস্থা করা হয়। অসামান্য শিল্পী সমাবেশের ফলে অভিনয়ের মানও উচ্চাঙ্গের হত। বিলেতের শিল্পীরা এখানে এসে অভিনয় করার ফলে তদানীন্তন ইংলন্ডের মঞ্চের অভিনয়ের আদর্শ ও আদল এখানকার দর্শকেরা পেতেন। শিল্পীদের অভিনয় নৈপুণ্য ও বিদগ্ধজনের নাট্যপরিচালনা এই থিয়েটারের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ ছিল।

এই থিয়েটারের সাজসজ্জা ও রূপসজ্জার দিকে প্রখর দৃষ্টির ফলে কোনো চরিত্রই অস্বাভাবিক মনে হতো না। দৃশ্যপট নতুন, উজ্জ্বল ও বর্ণময় ছিল। ভালো চিত্রকর দিয়ে এসব আঁকানো হতো। তাছাড়া নাটকের বিষয়-বৈশিষ্ট্যও এই থিয়েটারের একটি উল্লেখ করার মতো দিক। ২৬ বছর ধরে নানা ভাগ্য বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে অভিনয় চালিয়ে বিদেশি রঙ্গালয়ের ইতিহাসে এই থিয়েটার একটি উজ্জ্বল নাট্যাভিনয়ের পরিচয় রেখে গেছে।

বাঙালি দ্বারকানাথ ঠাকুর এর পরিচালকমণ্ডলীতে ছিলেন, পরে মালিকও (১৮৩৫৩৯) হয়েছিলেন। বিদেশী রাজার লোকেদের থিয়েটারে তার এই গৌরবময় উপস্থিতি ব্রিটিশ পদানত বাঙালির কাছে খুবই গৌরবের ও শ্লাঘার বিষয়।

হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার (১৮১৭) পর থেকে বাঙালি ছাত্ররা কলেজে ইংরেজি নাটক পাঠ এবং চৌরঙ্গী থিয়েটারে নাটক দর্শনে তাদের নাট্যবোধ গড়ে তুলেছিল। রিচার্ডসন ও উইলসন দুজনেই হিন্দু কলেজ ও চৌরঙ্গী থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারাই বাঙালি তরুণ ছাত্রদের বিদেশী থিয়েটারের অভিমুখী করে তুলেছিলেন।

বিদেশী নাটক ও বিদেশী থিয়েটারের আবেষ্টনেই যে আধুনিক বাঙালির নাট্যচর্চা উৎসাহিত ও পরিস্ফুটিত হয়েছে—চৌরঙ্গী থিয়েটার তার মূল ভিত্তিভূমি রূপে কাজ করেছে।

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!