চণ্ডীমঙ্গল কাব্যধারায় দ্বিজমাধবের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
দ্বিজমাধব
চৈতন্যযুগের সার্থক মঙ্গলকাব্য রচয়িতাদের মধ্যে দ্বিজমাধব বা মাধবাচার্য বা দ্বিজমাধবানন্দ অন্যতম। তাঁর কাব্য চট্টগ্রাম ও উত্তরবঙ্গে সুপ্রচলিত। তিনি তাঁর কাব্যের নাম রেখেছিলেন ‘সারদামঙ্গল’ বা ‘সারদা চরিত’। ড. সুধীভূষণ ভট্টাচার্য সম্পাদিত ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত দ্বিজমাধবের গ্রন্থখানির নাম রাখা হয়েছে ‘মঙ্গলচণ্ডীর গীত’।
কবির দেওয়া আত্মপরিচয় থেকে জানা যায় তিনি ব্রাহ্মণ বংশজাত। ত্রিবেণীর কাছে সপ্তগ্রামে তার বাড়ি। আত্মপরিচয় অংশে কবির মাধব আচাৰ্য্য নামের উল্লেখ আছে। কাব্যের মধ্যে সর্বত্রই তিনি দ্বিজমাধব বা মাধবানন্দ নাম ব্যবহার করেছেন। কবির কাব্য রচনার কাল ছিল ১৫০১ শকাব্দ বা ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দ।
দ্বিজমাধবের ‘সারদামঙ্গল’ পাঁচালি ধরনের সংক্ষিপ্ত রচনা। তিনি ছিলেন প্রতিভাধর কবি। রসসৃষ্টি অপেক্ষা তথ্য সংগ্রহের দিকেই তিনি অধিক মনোযোগী ছিলেন। তিনি ছিলেন বাস্তবনিষ্ঠ কবি। ব্যাধজীবনের ক্ষুদ্র ও তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা তাঁর লেখনীতে ফটোগ্রাফির জীবন্ত চিত্র হয়ে ফুটে উঠেছে। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন দ্বিজমাধবের কবিত্বের প্রশংসা করেছেন, তবে কবি মুকুন্দ যেমন বস্তুকে একটা শিল্পরূপের মর্যাদা দিতে পেরেছিলেন, দ্বিজমাধব তা পারেননি।
কবির চরিত্র-চিত্রণের সংগতি ও স্বাভাবিকতা প্রশংসনীয়। যেমন, কালকেতুর চরিত্রের মধ্যে আগাগোড়া সংগতি বজায় রেখেছেন। সর্বপ্রকার বিপদ-আপদের মুখে দ্বিজমাধবের কালকেতু চির উন্নত শির। তাঁর প্রখর বাস্তব অভিজ্ঞতা ও নিপুণ পর্যবেক্ষণ শক্তি ছিল। দরিদ্র কালকেতুর গৃহের বর্ণনায় ভেরেণ্ডার থাম, কুঁড়ে ঘর, হেঁড়া কথা, বাসি মাংসের পসরা ও ব্যাধ বালকদের দুর্গন্ধযুক্ত জীর্ণ পরিধেয় বস্ত্রের বর্ণনায় বাস্তব জীবনের যথার্থ চিত্র উদ্ঘাটিত। অন্যদিকে ভাড়ুদত্তের চরিত্রও জীবন্ত। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন—‘মাধুর ভাড় দত্ত কবিকঙ্কণের ভঁড় দত্ত হইতে শঠতায় প্রবীণ।’ এছাড়া তাঁর ভাষা সহজ ও সাবলীল।
বিষ্ণুপদের সংযোজন দ্বিজমাধবকে অনন্যতায় ভূষিত করেছে। যেমন, মাধবের একটি বিষ্ণুপদে রাধাভাবে ভাবিতা খুল্লনা বলেছে—
মইলু মইলু মুঞি বাঁশীয়ার জ্বালায়।
গৃহধর্ম লোকধৰ্ম রাখন না যায়।
বাঁশের বাঁশী কহে কথা শুনিতে মধুর।
যে জন দিয়াছে ফুক সে জন চতুর।।
সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই উভয় কবির তুলনা করে লিখেছেন— “দ্বিজমাধবের সহিত মুকুন্দরামের গ্রন্থের তুলনা করিলেই মুকুন্দরামের কল্পনায় মৌলিকতা ও প্রসারশীলতার সুস্পষ্ট নিদর্শন পাওয়া যাইবে।”
কবি মুকুন্দ বাস্তবরসের কবি। দ্বিজমাধবের কাব্যেও বাস্তবতার নিদর্শন অল্প নয় কিন্তু দ্বিজমাধব বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনাকে কাব্যস্তরে উন্নীত করতে পারেননি। কবি মুকুন্দ কালকেতুর জীবনকাহিনি বর্ণনায় বর্ণহিন্দু বা ব্রাহ্মণ্য সংস্কার দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন তাই কালকেতুর বিবাহ ও গৌরীর বিবাহকালীন রীতি একই ধরনের। গর্ভাধান, সাধভক্ষণ, ষষ্ঠী পূজা, অন্নপ্রাশন প্রভৃতির বর্ণনায় ব্রাহ্মণ্য সংস্কারকেই তুলে ধরে।
অন্যদিকে দ্বিজমাধবের কাব্যে বাস্তবতার প্রকৃতি স্বাভাবিক হলেও স্থূল। যেমন, কাঠ কুড়োতে গিয়ে নিদয়া বনের মধ্যেই সন্তান প্রসব করেছেন, ধর্মকেতু শিকার করতে গিয়ে সিংহের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন। দরিদ্র ব্যাধপরিবারে জাতসংস্কারের কোনো অনুষ্ঠান পালিত হয়নি। সুতরাং বস্তুসঞ্চয়ের দিক থেকে দ্বিজমাধব কৃতী, কিন্তু বাস্তবরসের পরিবেশন নৈপুণ্যে কবি মুকুন্দের কৃতিত্ব অধিক।
দ্বিজমাধবের কাহিনি ব্রতকথার আদলে রচিত। চরিত্রচিত্ৰণ কবি মুকুন্দের মতো না হলেও ভাড় দত্তের চারিত্রিক বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। ভাড়ুর স্বার্থপরতা, চাতুরি ও বঞ্চনা বেশ উজ্জ্বলবর্ণে চিত্রিত হয়েছে। তাঁর অপরাধের মতো তার শাস্তিকেও গুরুতর ভাবে চিত্রিত করেছেন দ্বিজমাধব। সমালোচক আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন— “দ্বিজমাধবকে যদিও একজন প্রথমশ্রেণীর কবি বলিয়া স্বীকার করিতে পারা যায় না, তথাপি আনুপূর্বিক সঙ্গতি রক্ষা করিয়া পূর্ণাঙ্গ চরিত্র সৃষ্টির এমন মৌলিক প্রয়াস তাহার পূর্বে আর খুব বেশি কবি দেখাইতে পারেন নাই” (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৪৯১)। অন্যদিকে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন—“বর্ণনার স্বাভাবিকতা দ্বিজমাধবের কাব্যে যে নাই তাহা নহে, কিন্তু স্বাভাবিক বর্ণনাকে শিল্পরূপ দিবার জন্য যে ধরনের সৃষ্টিকুশলতা প্রয়োজন, তাহা মুকুন্দরাম ও ভারতচন্দ্রের কাব্যেই মিলিয়াছে।” (বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, দ্বিতীয় খণ্ড—১৯৮৩, পৃষ্ঠা-১৫৩)।
দ্বিজমাধবের বর্ণনায় বাস্তব ঘটনা কল্পনার মণ্ডনে স্বচ্ছন্দ সুন্দর হয়নি। তাঁর কাব্যে হরগৌরীর পারিবারিক জীবন নেই। কিন্তু কবি মুকুন্দ গৃহস্থ ঘরের রসসমৃদ্ধ জীবন্ত রূপটি আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন। কালকেতুর পারিবারিক জীবনের বর্ণনা মাধবের কাব্যে সাধারণ বিবরণ; কিন্তু কবি মুকুন্দ কালকেতুর বাল্যক্রীড়ার অনুপম চিত্র এঁকেছেন এবং স্বাস্থ্যবান সরল যুবকের কুৎসিত শয়ন এবং বিটকাল ভোজন’-এর ছবিটি উপভোগ্য করে তুলেছেন। দ্বিজমাধব সংক্ষিপ্ত দ্রুততায় বাঁটুল দিয়ে পাখি শিকারের শিক্ষানবিশির কথা বলে কালকেতুকে জীবিকার্জনে নিযুক্ত করেছেন। মাধবের কাব্যে কালকেতুর বিবাহ বর্ণনা কবি মুকুন্দের মতো দীর্ঘায়িত সুন্দর নয়, বড়ো সংক্ষিপ্ত। বিবাহে উপস্থিত ব্যাধরমণীদের উৎকট অঙ্গসজ্জা এবং তীব্রকটু দেহগন্ধের উল্লেখ করে কিঞ্চিৎ কৌতুক পরিবেশনের চেষ্টা করলেও জীবনরসরসিকতার অবকাশ সেখানে খুব কম।
কালকেতুর পশুশিকার মাধবের বর্ণনায় গতানুগতিক। মুকুন্দ কিন্তু গুঢ় রূপকের সাহায্যে পশুদের মধ্যে লোকালয়ের আলেখ্য প্রতিফলিত করেছেন। বস্তুত ঘটনা বর্ণনায় মুকুন্দ বাস্তবতার সঙ্গে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে বস্তু বর্ণনাকে রসরচনা করে তুলতে জানতে। কবি মুকুন্দ মুরারি শীল ও বাণ্যানীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যেভাবে চিত্রিত করেছেন, দ্বিজমাধবের কাব্যে তার একান্ত অভাব। এখানে দ্বিজমাধব বণিক সোমদত্তের বর্ণনায় প্রবঞ্চকের একটি প্রাণহীন বস্তুরূপ মাত্র তুলে ধরেছেন। মাধবের বুলান মণ্ডল চণ্ডীদেবীর স্বপ্নাদেশে গুজরাটে এসে কালকেতুর জমি পত্তন নিয়েছে। কবি মুকুন্দ কলিঙ্গদেশকে বানের জলে ভাসিয়ে কৃষকদের গুজরাটে এনেছেন। তারপর নগরপত্তন বর্ণনায় বাস্তবানুগত্য ও সহৃদয়তার সঙ্গে সমাজস্থ বিভিন্ন জাতির জীবনচিত্রের পরিচয় দিয়েছেন। জীবনবোধের এই বিশিষ্টতা দ্বিজমাধবের কাব্যে নেই।
দ্বিজমাধব ও কবি মুকুন্দ দুজনেই পণ্ডিত কবি। উভয়েই একজাতীয় আখ্যান অবলম্বন করেছেন, উভয়েই দেবমাহাত্ম্যকে অতিক্রম করে গার্হস্থ্য রসের প্রাধান্য দিয়েছেন, উভয়ের আখ্যানের মধ্যে বাস্তবতার ছাপ যথেষ্ট। তবুও দুজনের প্রতিভা সমমানের ছিল না। সেজন্য দ্বিজমাধব কয়েকটি স্বাভাবিক চিত্রকে ফটোগ্রাফের মতো পরম্পরায় সাজিয়েছেন, কবি মুকুন্দ চরিত্র ও ঘটনার সংসক্তির মাধ্যমে কাহিনিকে পূর্ণবৃত্ত কাব্য করে তুলেছেন। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাই বলেছেন— “মুকুন্দরাম শুধু দৃষ্টিকেই সৃষ্টি কার্যে নিয়োগ করেন নাই, তাহার সঙ্গে চিত্তবৃত্তিরও সংযোগ সাধন করিয়াছিলেন। মাধবে তাহার বিশেষ অভাব আছে এবং আছে বলিয়াই দ্বিজমাধবের চণ্ডীমঙ্গল ব্ৰত কথার সীমা ছাড়াইয়া কাব্যলোকে উন্নীত হইতে পারে নাই।”
তথ্যসূত্র:
১. বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস: আশুতোষ ভট্টাচার্য
২. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত: অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস: সুকুমার সেন
Leave a Reply