ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনি সংক্ষেপে আলোচনা কর।
ধর্মমঙ্গলের কাহিনি
ধর্মমঙ্গল কাব্যের দুটি কাহিনি— হরিশ্চন্দ্র ও লাউসেনের কাহিনি।
হরিশ্চন্দ্রের কাহিনি
রাজা হরিশ্চন্দ্র ও তার রানী মদনা নিঃসন্তান হওয়ায় সমাজে লোকনিন্দার ভয়ে মনের দুঃখে ঘুরতে ঘুরতে বল্লুকা নদীর তীরে উপস্থিত হয়ে দেখেন সেখানে ধর্মঠাকুরের ভক্তেরা ঘটা করে দেবতার পূজা করছেন। রাজা ও রানী তাদের কাছে ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্য শুনে ধর্মঠাকুরের পূজার্চনা করে শর্তসাপেক্ষে বর লাভ করেন। শর্ত হল এই— তাদের পুত্রকে ধর্মঠাকুরের কাছে বলি দিতে হবে। যথাসময়ে মদনার পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে।
রাজা ও রানি পুত্রকে পেয়ে ধর্মঠাকুরের কাছে বলি দেওয়ার পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভুলে যান। ধর্মঠাকুর ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে একদিন হরিশ্চন্দ্রের কাছে উপস্থিত হন। সেদিন ছিল একাদশীর পালণ; ছদ্মবেশী ব্রাহ্মণ রাজপুত্র লুইধরের মাংস আহার করতে চাইলে রাজা ও রানি পুত্রকে বধ করে তার মাংস রান্না করলেন। রাজা ও রানির এই আনুগত্য ও নিষ্ঠায় সন্তুষ্ট হয়ে ধর্মঠাকুর লুইধরকে জীবিত করে পুনরায় রাজা-রানির কাছে ফিরিয়ে দেন। এরপর রাজা ও রানির প্রচেষ্টায় ধর্মঠাকুরের পূজা মহাসমারোহে আয়োজিত হতে থাকে।
লাউসেনের কাহিনি
নায়ক লাউসেনের জন্ম থেকে স্বর্গ গমন পর্যন্ত কাহিনি অবলম্বনে এই কাব্য রচিত। কাব্যের কাহিনি চব্বিশটি সর্গ বা বারটি পালায় বিভক্ত। মর্ত্যে পূজা প্রচারের জন্য দেবনর্তকী জাম্ববতীকে স্বর্গভ্রষ্ট করিয়ে মর্ত্যে পাঠানো হয়। তার নাম হয় রঞ্জাবতী। তার বড় বোন ছিলেন গৌড়রাজের পত্নী, ভাই মহামদ প্রধান অমাত্য। অন্যদিকে ঢেকুরগড়ের অধিপতি কর্ণসেন ছিলেন গৌড়েশ্বরের অধীনে এক সামন্ত রাজা। ঢেকুরগড়ের বিদ্রোহী রাজা ইছাই ঘোষকে দমন করতে গিয়ে তার ছয় পুত্র যুদ্ধে নিহত হলেন।
এরপর গৌড়েশ্বর তার শ্যালিকা রঞ্জাবতীর সঙ্গে কর্ণসেনের বিয়ে দেন। এই বিয়েতে মহামদের অমত ছিল। তাই সব রাগ গিয়ে পড়ল বোন ও ভগ্নিপতির উপর। নানাভাবে তাদের উপর অত্যাচার শুরু করলেন মহামদ। তারপর বহুদিন পর্যন্ত রঞ্জাবতী নিঃসন্তান ছিলেন কিন্তু ধর্মঠাকুরের কৃপায় কর্ণসেন এক পুত্রসন্তান লাভ করেন এবং তার নাম হয় লাউসেন। লাউসেন ক্ৰমে মস্ত বীর হয়ে ওঠে। এই লাউসেন-এর উপরও রাগ গিয়ে পড়ে মহামদের।
শক্তি পরীক্ষার জন্য লাউসেন একবার গৌড়ে যান। সে সময়ে মাতুল মহামদ লাউসেনকে বন্দি করে। কিন্তু গৌড়েশ্বরের কাছে লাউসেন তার বাহুবলের পারদর্শিতা দেখিয়ে কারামুক্ত হন। এরপর ময়নাগড়ে ফেরার পথে কালু ডোম ও তার স্ত্রী লখাই-এর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ও কালু ডোম সেনাপতির পদ লাভ করেন।
এদিকে মহামদ লাউসেনের অনিষ্ট সাধনের উপায় খুঁজে বেড়াতে লাগলেন। মহামদের পরামর্শে গৌড়েশ্বর লাউসেনকে কামরূপ রাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠান। সেখানেও কামরূপ রাজাকে পরাভূত করেন লাউসেন এবং তার কন্যা কলিঙ্গাকে বিবাহ করে গৌড়ে সগৌরবে প্রত্যাবর্তন করেন।
এরপর ঢেকুররাজ ইছাই ঘোষকে দমন করার জন্য লাউসেনকে পাঠান হল। অজয় নদীর তীরে দুপক্ষে ভীষণ যুদ্ধ বেধে গেল। ধর্মের আশীর্বাদে লাউসেন বিজয়ী হলেন। এত দুরভিসন্ধি করেও মহামদ যখন লাউসেনকে বিপদে ফেলতে পারছেন না তখন তার বিরুদ্ধে এক ভীষণ চক্রান্ত করলেন মহামদ। গৌড়েশ্বর আদেশ দিলেন— লাউসেনকে পশ্চিমদিকে সূর্যোদয় দেখাতে হবে, না পারলে মৃত্যুদণ্ড হবে।
ধর্মের কৃপায় লাউসেন সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখালেন। এদিকে এই অবকাশে মহামদ ময়নাগড় আক্রমণ করেন। তাকে প্রতিরোধ করতে প্রাণ দেন কালু ডোম, ডোমনী লখাই ও প্রথম রানি কলিঙ্গা। এরপর লাউসেন দেশে ফিরে এসে যখন দেখলেন রাজ্য বিধ্বস্ত, তখন তিনি ধর্মের স্তব করতে লাগলেন। ধর্মের অনুগ্রহে সকলে প্রাণ ফিরে পায়। ধর্মের কোপে মহামদের কুষ্ঠ হয়। লাউসেনের দয়ায় তার কুষ্ঠ সারে। সুখে-শান্তিতে দীর্ঘকাল রাজত্ব করার পর পুত্র চিত্রসেনের হাতে রাজ্য সমর্পণ করে সপরিবারে স্বর্গ গমন করেন লাউসেন।
তথ্যসূত্র:
১. বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস: আশুতোষ ভট্টাচার্য
২. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত: অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস: সুকুমার সেন
Leave a Reply