ধ্বনিবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।
ধ্বনিবাদ
ধ্বনিবাদ আসলে কী, কবে কার হাতে প্রথম তার জন্ম সে সম্পর্কে প্রত্যক্ষ কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। ধ্বনিবাদের আলোচনা করতে গিয়ে আচার্য আনন্দবর্ধন ও তাঁর বিখ্যাত ‘ধ্বন্যালোকঃ’ গ্রন্থের কথা আমাদের প্রথমেই মনে আসে। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন যে, আনন্দবর্ধন ধ্বনিবাদের উদ্ভাবক ছিলেন না। এমন কোনো দাবিও আনন্দবর্ধন কখনো করেননি। তিনি ছিলেন সংকলক। তবে নিছক সংকলক বলে তাঁর কৃতিত্বকে খাটো করে দেখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এই তত্ত্বের বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত সূত্রগুলি এতদিন ছড়ানো-ছিটানো ছিল।
আনন্দবর্ধনই সেগুলিকে একত্রিত করে ধ্বনির আলোকে আমাদের আলোকিত করেছেন। ধ্বনিবাদ এমনই এক জোরালো মতবাদ ছিল যে এর প্রভাবে অলংকারবাদ ও রীতিবাদের প্রাধান্য নষ্ট হতে থাকে। ধ্বনিবাদের বিস্তৃত আঙিনায় অলংকার, গুণ, রীতি— এসব কিছুই ঠাঁই করে নেয়। এমনকি ধ্বনিবাদের পরবর্তী রসবাদও তার বিরোধিতা করেনি। ধ্বনিবাদ রসবাদের পরিপূরক হওয়ায় আলংকারিকদের দৃষ্টি ধ্বনিবাদের প্রতি খুব বেশি মাত্রায় পড়েছিল।
‘ধ্বনিরাত্মা কাব্যস্য’ সংস্কৃত আলংকারিক প্রদত্ত এই সূত্রটি ব্যাখ্যা করার আগে ভূমিকা হিসাবে আমাদের কিছু বক্তব্য আছে। ধ্বনির স্বরূপ উপলব্ধি করতে হলে কয়েকটি পারিভাষিক শব্দের সঙ্গে পরিচিত হওয়া একান্ত জরুরি। এটিকে শব্দার্থ শক্তি হিসাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কাব্য হ’ল শব্দময় শিল্প। শব্দ দিয়ে কাব্য শরীর গড়ে ওঠে বলে শব্দ দিয়েই আমরা কাব্যকে ছুঁই। তাই যে কোনো কাব্য রসিকেরই শব্দার্থশক্তি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থাকা জরুরি।
আনন্দবর্ধন প্রমুখ আলংকারিকগণ ব্যাকরণের পদ্ধতি অনুসরণ করে শব্দের চার রকম শক্তির কথা বলেছেন। এগুলি হ’ল— (১) অভিধাশক্তি (২) লক্ষণাশক্তি (৩) তাৎপর্যশক্তি (৪) ব্যঞ্জনাশক্তি।
অভিধাশক্তি
যে শক্তি বলে একটি নির্দিষ্ট শব্দ একটি নির্দিষ্ট অর্থকে বোঝায় তাকে অভিধাশক্তি বলে। এটিকে শব্দের প্রচলিত অর্থ বলা যেতে পারে। যেমন যদি বলা হয়—‘বৃদ্ধ’ তাহলে বয়সের ভারে নুয়ে পড়া একজন পরিণত বয়স্ক মানুষকেই বোঝাবে। বিজ্ঞ বললে আমাদের মনে অল্পবয়স্ক কোনো শিশু কিংবা কিশোরের কথা মনে আসবে না। শব্দ ও অর্থের পারস্পরিক জ্ঞান পূর্ব থেকে না থাকলে অভিধাশক্তির দ্বারা সংকেতিক মুখ্য অর্থের ধারণা করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ যে কোনো দিন বুড়োমানুষ দেখেনি তার কাছে যদি ‘বৃদ্ধ’ শব্দের অর্থ জানতে চাওয়া হয় তাহলে পরিণত বয়স্ক একটি মানুষের কথা তার মনে কখনই আসবে না। শব্দের সঙ্গে অর্থের যে অবিছিন্ন যোগ আছে সেটি মানুষের মনে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এই কারণেই ‘‘গাঁদাফুল’ বললে আমরা সাদা কোনো ফুল ভাবি না কিংবা ‘গাড়ি’ বললে ‘বাড়ি’ ভাবি না। অভিধাশক্তির দ্বারা সংকেতিত অর্থকে অর্থাৎ মুখ্য অর্থকে অভিধেয় অর্থ, বাচ্যার্থ বা শব্দার্থ বলে। যেমন বৃদ্ধ শব্দের অর্থ বয়স্ক বা পরিণত বয়স্ক।
লক্ষণাশক্তি
যে শক্তির বলে একটি শব্দ মুখ্যার্থ বা বাচ্যার্থ বা অভিধেয়ার্থ ছাড়া। মুখ্যার্থের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত আর একটি অর্থ কে বুঝিয়ে থাকে, তাকে লক্ষণা বলে। শব্দের অভিধেয় অর্থ বা মুখ্যার্থ যদি বাক্য বা বাক্যাংশের অর্থ পরিস্ফুটনে অক্ষম হয় তাহলে আমরা লক্ষণার দ্বারস্থ হই। “জীবনানন্দ ভালো করে না পড়লে পরীক্ষায় পাশ করতে পারবে না।”— এখানে মুখ্যার্থ ধরে যদি সমগ্র বাক্যটির অর্থ করতে যাওয়া হয় তাহলে বাক্যটির অর্থ ঠিক বোঝা যাবে না। জীবনানন্দ ছিলেন একজন মানুষ। তাঁকে ভালো করে পাঠ করা সম্ভব নয়।
অর্থাৎ এখানে ব্যক্তি জীবনানন্দকে পাঠ করার কথা বলা হয়নি, তার সাহিত্যকর্মকে বোঝানো হয়েছে। এখানে মুখ্যার্থ গ্রহণে বাধা আছে বলেই আমরা একটি গৌণ অর্থ ধরে বাক্যটির অর্থ করলাম। যখন অভিধাশক্তি শব্দের মুখ্যার্থকে বুঝতে বাধা দেয় তখন যে শক্তির সাহায্যে আমরা অভিধা, বাচ্যার্থ বা মুখ্যার্থের সঙ্গে সম্বন্ধ বিশিষ্ট শব্দটির প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারি তাকেই বলে লক্ষণাশক্তি। এই শক্তির দ্বারা আমরা যে গৌণ অর্থকে বুঝে থাকি তাকে লক্ষ্যার্থ বলে।
এই লক্ষণাকে আবার দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে—(১) রূঢ়ি লক্ষণা (২) প্রয়োজন লক্ষণা। রূঢ়ি শব্দের অর্থ হল লোকপ্রসিদ্ধি। যেমন—‘অসভ্য চীন অসভ্য জাপান তারাও স্বাধীন তারাও মহান’। এই কাব্যপংক্তিটির মুখ্যার্থ ধরে যদি অর্থ করতে যাওয়া হয় তাহলে আমাদের অর্থ বুঝতে অসুবিধা হবে। একটা দেশ কখনো অসভ্য, স্বাধীন কিংবা মহান হতে পারে না। এখানে চীন ও জাপান বলতে ভৌগোলিক ভূখন্ড কে বোঝানো হয়নি।
চীন ও জাপান দেশের মানুষকে বোঝানো হয়েছে। চীন-জাপানবাসীকে বোঝাতে উল্লিখিত পংক্তিতে শুধু ‘চীন ও জাপান’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। অনুরূপ ভাবে যদি বলা হয়, ‘আমি নজরুল পড়তে ভালোবাসি’ তবে নজরুল বলতে নজরুলের রচিত সাহিত্যকেই বোঝাবে। এই উদাহরণ গুলির সবই লোক ব্যবহারে প্রসিদ্ধ বলে এগুলি রূঢ়ি লক্ষণার উদাহরণ।
এখানে চীন, জাপান ও নজরুল হল লক্ষক; আর চীন ও জাপানবাসী এবং নজরুলের সাহিত্য হল লক্ষ্য। উদাহরণ গুলিকে ‘রূঢ়ি’ বলার কারণ এগুলি লোক ব্যবহারে পরিচিত। আমরা ওগুলিকে যে রকম করে বলা হয়েছে ও রকম ভাবে বলতেই অভ্যস্ত। ‘নজরুল’ শব্দটি দিয়ে যখন আমরা কাজ চালাতে পারি মত লোকেও যখন তা বোঝে তখন আর আমরা অনর্থক নজরুলের রচিত সাহিত্য বা কাব্য-এমন ভাবে ভেঙে বলি না।
‘প্রয়োজন লক্ষণা’ই হল প্রকৃতপক্ষে শুদ্ধি লক্ষণ। রূঢ়ি লক্ষণ অপেক্ষা তা অনেক উন্নত স্তরের। যেখানে লক্ষণার মূলে কোনো প্রয়োজন থাকে তাকে প্রয়োজনলক্ষণা বলে। এটি আসলে কি তা ব্যাখ্যাযোগ্য। যেমন–
এমন মানবজমিন রইল পতিত।
আবাদ করলে ফলত সোনা।
এখানে সোনার মুখ্য অর্থ মূল পঙক্তিটির সঙ্গে সংগতি বিধায়ক নয়। তাই শব্দটিকে মুখ্যার্থে গ্রহণ করতেও অসুবিধা হয়। কিন্তু ‘সোনাকে গৌণ অর্থে অর্থাৎ ‘ঐশ্বর্য’ ‘সমৃদ্ধি’ ইত্যাদি অর্থে গ্রহণ করলে পঙক্তিটির মধ্যে অর্থ-সংগতি রচিত হয়। অর্থ-সংগতির পাশাপাশি অর্থের ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্যও ঘটে। ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধি’ কে বোঝানোর প্রয়োজনে ‘সোনা’ শব্দটির ব্যবহার খুবই উপযুক্ত হয়েছে। কিন্তু ‘আমি নজরুল পড়তে ভালোবাসি’— এই উদাহরণে নজরুল শব্দটি কোনো প্রয়োজন সিদ্ধ করেনি।
আমি নজরুলের সাহিত্য পড়তে ভালোবাসি’ বললেও কোনো ক্ষতি ছিল না। কিন্তু ‘সোনা’ শব্দটিকে কবি রামপ্রসাদ যে ভাবে প্রয়োগ করেছেন তাতে নিষ্ফল জীবনকে ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধময় করে তোলার অর্থটি সুন্দর ফুটেছে। বিশেষ সুন্দর করে অর্থ প্রকাশের প্রয়োজনেই ‘সোনা’ শব্দের প্রয়োগ করা হয়েছে। আমাদের তাই মনে হয় ‘সোনা’ শব্দটি ছাড়া ‘ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধি’ কে যেন বোঝানোই যেতো না। সোনা শব্দের সূত্র ধরে আমরা যে ‘ঐশ্বর্য সমৃদ্ধি ইত্যাদি সূক্ষ্ম গোপন অর্থের ইঙ্গিত পেলাম তাকে লক্ষণামূলক ধ্বনি’ বলে অভিহিত করা যেতে পারে। প্রয়োজন লক্ষণার আরও একটি উদাহরণ—
বুকের মধ্যে বাঘ নিয়ে ঘুমিয়েছি কতকাল
এবার জেগেছে সে চরম প্রহরে।
বুকের মধ্যে কোনো মানুষ বাঘ নিয়ে ঘুমোতে পারে না। তাই মুখ্যার্থে ‘বাঘ’ শব্দটিকে গ্রহণ করা যায় না। মুখ্যার্থ এখানে বাধিত। সুতরাং বাঘ বলতে এখানে অন্য কিছু বোঝানো হয়েছে। সেটা হিংস্রতা, প্রতিহিংসা, বিদ্রোহী মনোভাব— এরকম অনেক কিছু হতে পারে। আগের উদাহরণটির মত এটিতেও যেহেতু সূক্ষ্ম গোপন অর্থের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তাই এখানেও লক্ষণামূলকধ্বনি হয়েছে। গোপন সৌন্দর্য লাভের এই অভিপ্রায়কে অভিনব গুপ্ত ‘প্রয়োজন বলেছেন। রূঢ়ি লক্ষণায় যেহেতু আমাদের সেই প্রয়োজন সিদ্ধ হয় না তাই রূঢ়ি লক্ষণা প্রয়োজন লক্ষণার মত উন্নত নয়।
রূঢ়ি এবং প্রয়োজন— উভয় লক্ষণাতেই মুখ্যার্থ বা বাচ্যার্থের সঙ্গে লক্ষ্যার্থের একটি সম্বন্ধ থাকে। তবে রূঢ়ি লক্ষণায় লক্ষ্যার্থের সঙ্গে বাচ্যার্থের সম্বন্ধ অনেক বেশি স্থূল। গোপন সৌন্দর্য সৃষ্টির ক্ষমতা তার নেই। রূঢ়ি লক্ষণা মুখ্যার্থকে ছাড়িয়ে লক্ষার্থের দিকে খুব বেশি দূর যেতে পারে না বলে তার থেকে গভীরতর কোনো অর্থ আবিষ্কৃত হয়। অন্য দিকে প্রয়োজন লক্ষণার গভীরতা অনেক বেশি বলে তা গোপনতম সৌন্দর্য আবিষ্কারে সক্ষম হয়। কাব্য যেহেতু দেহের উপরিতল থেকে আত্মার দিকে পা টেনে নিয়ে যায় তাই কাব্যের ক্ষেত্রে প্রয়োজন লক্ষণার গুরুত্ব অনেক বেশি।
তাৎপর্যশক্তি
ব্যঞ্জনাবাদীদের অনেকেই তাৎপর্য শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার না করলে অভিনবগুপ্তের আলোচনায় তাৎপর্য শক্তির বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। আমরা সকলে জানি যে বহু শব্দ পাশাপাশি বসে একটি বাক্য গঠন করে। বাক্যের অর্ন্তগত প্রতিটি শব্দের পৃথক পৃথক অর্থ থাকে। আবার পাশাপাশি কয়েকটি শব্দ বাক্যের মধ্যে অন্বিত হলে সামগ্রিক একটি অর্থ প্রকাশ করে। পাশাপাশি কয়েকটি শব্দ একত্রে মিলিত হয়ে অন্বয়বোধের দ্বারা যদি একটি অখন্ড অর্থকে প্রকাশ করে তবে তাকে তাৎপর্য শক্তি বলে।
শব্দের চেয়ে বাক্যের অর্থই যেহেতু তাৎপর্য শক্তিতে গুরুত্ব পায় তাই সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত তাঁর ‘কাব্য বিচার’ গ্রন্থে তাৎপর্য শক্তি’কে ‘বাক্যশক্তি’ বলে অভিহিত করেছেন। যেমন আমি ‘ভাত’ ও ‘খাই’ এই তিনটি শব্দের পৃথক পৃথক ভাবে একটি করে অর্থ আছে। কিন্তু এই তিনটি শব্দ যখন পাশাপাশি বসে একটি সামগ্রিক অর্থ প্রকাশ করে তখন বিচ্ছিন্ন শব্দগুলির তুলনায় বাক্যটির অর্থ তাৎপর্যগত ভাবে কিছুটা আলাদা হয়ে যায়। এই সামগ্রিক বা অখণ্ড অর্থটিকে তাৎপর্য বলা যেতে পারে।
শব্দের যে তিন শক্তি নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা করা হল, সেগুলি ধ্বনিবাদ প্রতিষ্ঠার পূর্বেই স্থিরীকৃত হয়েছিল। কিন্তু ধ্বনিবাদীরা আলোচনায় অবতীর্ণ হয়ে দেখালেন যে, শব্দের এই তিন শক্তি আসলে বাচ্যার্থকেই প্রকাশ করে। সার্থক কাব্য বাচ্যার্থকে অতিক্রম করে যে গভীরতর অর্থের প্রকাশ ঘটায় এই তিন শক্তির সাহায্যে তাকে পাওয়া যায়। ধ্বনিবাদীদের মতে, এই তিন শক্তির কাব্যসৌন্দর্য সৃষ্টির ক্ষমতা নেই। অভিধাশক্তির দ্বারা লভ্য অর্থ সবচেয়ে আগে ফুরিয়ে যায়। লক্ষণাশক্তি শব্দের অর্থকে আরও কিছুদূর সম্প্রসারিত করে ঠিকই কিন্তু তারও একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে।
অনুরূপ ভাবে তাৎপর্য শক্তির ক্ষমতাও খুবই সীমিত। কিন্তু শব্দের এমন একটি শক্তি আছে যার ক্ষমতা অসীম। একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার পর তা থেমে যায় না। তা শব্দ ও অর্থের সমস্ত সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে অনেক অনেক বেশি অর্থ প্রকাশে সক্ষম। এই শক্তিকে সংস্কৃত আলংকারিকগণ ‘ব্যঞ্জনা’ নামে অভিহিত করেছেন। ব্যঞ্জনাশক্তির কোনো পরিমাপ করা যায় না— “ব্যঞ্জনং ন তুলাধৃতম”। যে কোন কাব্যে এই ব্যঞ্জনাশক্তিরই প্রাধান্য।
ব্যঞ্জনাশক্তি
যেখানে কাব্যের বাচ্যার্থ কোনো রকম বাধা না পেয়ে নিজ স্বরূপে প্রকাশিত হয় অথচ বাচ্যার্থকে অতিক্রম করে পাঠক পাঠিকার মনে একই সময়ে আরও একটি অর্থ প্রতীয়মান হয়, তখন সেই অর্থটিকে বলা হয় ধ্বনি বা ব্যঞ্জনা। আর যে শক্তির সাহায্যে এই ধ্বনির অর্থকে পাওয়া যায় তাকে ব্যঞ্জনাশক্তি বা ব্যঙ্গ্যশক্তি বলে। ধ্বনি থেকে আমরা যে অর্থ লাভ করি তাকে ব্যঙ্গ্যার্থ বা প্রতীয়মানার্থ বলে। ধ্বনি থেকে প্রাপ্ত অর্থটিকে আমরা ঘন্টাধ্বনির অনুরণনের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। একটি ঘন্টা বেজে উঠেই তার কাজ শেষ করে না।
দীর্ঘক্ষণ ধরে অনুরণনের মাধ্যমে তার ক্রিয়া চলতে থাকে। ঠিক সে রকমই সার্থক কবিতা পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গে সহৃদয় পাঠকদের চিত্তে যে বাচ্যার্থের বোধ জন্মায় তা-ই তাদের নিয়ে যায় বাচার্থকে অতিক্রম করে অনেক দূরে। এই সূত্রে পাঠকদের চিত্তে নূতন একটি অর্থের সূক্ষ্ম-স্পন্দন অনুভূত হতে থাকে। এই নূতন অর্থটি হল ব্যঙ্গ্যার্থ বা প্রতীয়মানার্থ। ‘ধ্বন্যালোক’ গ্রন্থে ‘প্রতীয়মান অর্থ’-কে নারীদেহের লাবণ্যের সঙ্গের তুলনা করা হয়েছে।
নারীদেহের লাবণ্য দেহ কে আশ্রয় করে থাকলেও যেমন দেহকে ছাপিয়ে ওঠে, ঠিক সেই রকমই মহাকবিদের বাণীতে এমন একটি বস্তু থাকে যা কাব্যশরীরকে আশ্রয় করে থেকেও তাকে অতিক্রম করে যায়। কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব কাব্য থেকে একটি চির পরিচিত উদাহরণ দিয়ে ধ্বনির স্বরূপ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। অঙ্গিরা হিমালয়ের কাছে মহাদেবের সঙ্গে পার্বতীর বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে এলে কালিদাস লিখেছেন—
এবং বাদিনি দেবর্ষৌ পার্শ্বে পিতুরধোমুখী।
লীলাকমলপত্রাণি গণয়ামাস পার্বতী৷
এর সুন্দর বঙ্গানুবাদ করেছেন অধ্যাপক শ্যামাপদ চক্রবর্তী—
দেবর্ষি যবে কহিলা একথা
পিতার পার্শ্বে পাৰ্ব্বতী ননাতনী
হেরিতে লাগিল লীলাকমলের
দলগুলি গণি গণি।
এই অংশটির কাব্যত্ব নিয়ে কেউ কখনো প্রশ্ন তুলবে না। কোনো অলংকারের সুষমায় এর কাব্যত্ব নয়, কারণ সে রকম কোনো অলংকারই এখানে নেই। ধ্বনিবাদীরা এর কাব্যত্ব লীলাকমলের পত্রগণনা’র মধ্যে লক্ষ করেছেন। কারণ তা বাচ্যার্থকে ছাড়িয়ে সহৃদয় পাঠককে অন্তরে নিয়ে যায় এবং তার থেকে পূর্বরাগের লজ্জার ব্যঞ্জনা উৎসারিত হয়। অঙ্গিরার বিবাহ-প্রস্তাবে পার্বতীর মনে রতি (প্রেম) উদ্দীপিত হয়েছে। এই উদ্দীপিত রতির স্বাভাবিক ফল হল হর্ষ, যা অবশ্যম্ভাবী ভাবে চোখ মুখে প্রকাশিত হওয়ার কথা।
কিন্তু এই হর্ষজনিত বিকার প্রকাশিত হওয়ার আগেই সামনে গুরুজন থাকায় তার লজ্জা। এসেছে। লজ্জা’ তার অবহিঙ্খ’ নামক গৌণ বাসনাকে জাগিয়ে দেয়। অবহিখা’ সঞ্চারী বা ব্যভিচারী হলেও ভাব। কিন্তু এই ভাব যে জেগেছে তা বোঝা যায় পার্বতীর নতুন বিকারে বা আচরণে। যার প্রমাণ আছে মুখ অবনত করায় ও লীলাপদ্মের পত্র গণনায়।
লক্ষ করলেই দেখা যাবে যে কবি এখানে ব্যঞ্জনায় যে বক্তব্যটি উপস্থাপিত করতে চেয়েছেন তা সরাসরি ভাবে না বলে কিছুটা ইঙ্গিতে বলেছেন। এই ইঙ্গিতটুকু উপলব্ধি করতে পারলে, আমরা এর প্রতীয়মান অর্থটুকু বুঝতে পারবো না। ইংরাজীতে একেই বলে ‘Suggested Sense’। এই ইঙ্গিতের অভাব ঘটলে, অর্থাৎ Flat করে কোনো বক্তব্য উপস্থাপিত হলে, তা আর যাই হোক প্রথম শ্রেণীর কাব্য হবে না। কালিদাসের শ্লোকটিকেই যদি আবরণ না দিয়ে সরাসরি বলা হতো—
বরের কথায় উমার হল পুলকের উদগম
নত মুখে লজ্জা পেয়ে বলল কথা কম
তবে তার কাব্যমহিমা অনেকাংশে ক্ষুণ্ন হত। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘মদনভস্মের পর’ কবিতায় লিখেছিলেন—
পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ এ কি সন্ন্যাসী!
এ বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে।
ব্যাকুলতর বেদনা তার বাতাসে ওঠে নিশ্বাসি
অশ্রু তার আকাশে পড়ে গড়ায়ে।
এখানে লক্ষ করলে দেখা যাবে যে এর বক্তব্য বাচ্যকে ছাড়িয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ এখানে মানবমনের চিরন্তন বিরহ, যা মিলনের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে তারই ইঙ্গিত করেছেন এবং সেখানেই এর কাব্যত্ব।
এবারে আধুনিক কবি জয় গোস্বামীর ‘মাসিপিসি’ কবিতাটি নেওয়া যাক—
ফুল ছুঁয়ে যায় চোখের পাতায় জল ছুঁয়ে যায় ঠোটে
ঘুম পাড়ানী মাসিপিসি রাত থাকতে ওঠে।
শুকতারাটি ছাদের ধারে, চাঁদ থামে তালগাছে।
ঘুম পাড়ানী মাসিপিসি ছাড়া কাপড় কাচে
দু-এক ফোটা শিশির তাকায় ঘাসের থেকে ঘাসে
ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি ট্রেন ধরতে আসে।
ঘুম পাড়ানী মাসিপিসির মস্ত পরিবার–
অনেকগুলো পেট বাড়িতে, একমুঠো রোজগার
ঘুম পাড়ানী মাসিপিসির পোঁটলা পুটলি কোথায়?
রেল বাজারের হোমগার্ডরা সাত ঝামেলা জোটায়
সাল মাহিনার হিসাব তো নেই জষ্টি কি বৈশাখ
মাসিপিসির কোলে কাখে চালের বস্তা থাক
শতবর্ষ এগিয়ে আসে-শতবর্ষ যায়
চাল তোলো গো মাসিপিসি লালগোলা বনগাঁয়
এই কবিতায় বাচ্যার্থকে ছাড়িয়ে উঠেছে তার ব্যঞ্জনা। ব্যাচ্যার্থে মাসিপিসিদের চালের ব্যবসার কথা বলা হলেও ব্যঞ্জনায় যুগ যুগ ধরে অনাহারী, সংগ্রামী মানুষগুলোর পরিবর্তনহীন অবস্থার কথা বলা হয়েছে। সভ্যতার বদল ঘটে, সময় এগিয়ে চলে, শতবর্ষ পার করে নতুন শতবর্ষের সূচনা হয় কিন্তু অনাহারী, অর্ধাহারী, সংগ্রামী মানুষগুলোর জীবনের ট্রাজিডির কোনো বদল ঘটে না। এক বৈচিত্র্যহীন বেঁচে থাকাকে সঙ্গী করে তাদের আজীবন কাটে। যে কোনো সার্থক কবিতার মত এখানেও ব্যাচ্যার্থকে আশ্রয় করে ব্যঞ্জনা সৃষ্ট হয়েছে কিন্তু তা বাচ্যার্থকে অতিক্রম করে গেছে।
এখন পর্যন্ত আমরা কয়েকটি উদাহরণ সহযোগে কবিতার ব্যঙ্গ্যার্থ আসলে কি তা বোঝাতে সচেষ্ট হয়েছি। তবে মনে রাখা দরকার যে কেবল শব্দার্থের জ্ঞান থাকলেই কবিতার ব্যঙ্গ্যার্থকে বোঝা যাবে না। আবার ব্যঙ্গ্য অর্থ বুঝতে গেলে বাচ্যার্থের ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া দরকার। কারণ সহৃদয় পাঠকের মনে যে ব্যঙ্গ্যার্থের জন্ম নেয় তা বাচ্যাথের পথ বয়েই।
যেমন উপযুক্ত আলো পেতে গেলে প্রদীপ শিখার ব্যাপারে যত্নশীল হতে হয় তেমনি বাচ্যার্থের ব্যাপারে যত্নশীল না হলে ব্যঙ্গ্যার্থের প্রতীতি জন্মায় না। প্রদীপ শিখা কম্পিত হলে উপযুক্ত আলো লাভ করা যায় না, অনুরূপভাবে বাচ্যার্থের প্রতীতি না জন্মালে ব্যঙ্গ্যার্থের প্রতীতি জন্মায় না। সন্তান যেমন মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম নিয়ে স্ব-প্রতিভার গুণে মাতাকেই আচ্ছন্ন করে দিতে পারে তেমনি ব্যঙ্গ্যার্থ বাচ্যার্থের মধ্যে থেকে উদ্ভূত হয়ে বাচ্যার্থকে গৌণ করে দেয়।
তথ্যসূত্র:
১. কাব্যজিজ্ঞাসা: অতুলচন্দ্র গুপ্ত
২. কাব্যালোক: সুধীরকুমার দাশগুপ্ত
৩. ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব: অবন্তীকুমার সান্যাল
৪. কাব্যতত্ত্ব সমীক্ষা: অচিন্ত্য বিশ্বাস
Leave a Reply