সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে নাট্যকার কালিদাসের অবদান আলোচনা কর।

নাট্যকার (দৃশ্যকাব্যকার) কালিদাস

জীবনরসিক নাট্যকার কালিদাসের নাট্যভাবনার রূপায়িত বস্তুময় জীবন সংসারে হাসি-অশ্রু, আনন্দ-বেদনা, আশা-নৈরাশ্যের আলেখ্যগুলি হল ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’, ‘বিক্রমোবর্শীয়ম্’, ‘অভিজ্ঞান-শকুন্তলম্’। কালিদাস একাধারে কবি ও নাট্যকার। প্রাচ্যদেশীঁ নাট্যকারদের মধ্যমণি কালিদাস সংস্কৃত নাটকের ক্ষেত্রতো বটেই, প্রাকৃত ভাষায় ও নব্যভাবরতীয় আর্যভাষায় যাঁরা নাটক লিখে যশস্বী হয়েছেন তাঁরা সকলেই অল্পবিস্তর কালিদাসের কাছে ঋণী। কালিদাস তাঁর নাটকে অলংকারশাস্ত্রের নিপুণ প্রয়োগ ঘটিয়েছেন এবং নাট্যকারদের হৃদয়ে চিরকালীন আসন করে নিতে পেরেছেন।

মালবিকাগ্নিমিত্রম্

অনেকের মতে পঞ্চাঙ্ক নাটক ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’ কালিদাসের প্রথম নাটক। নাটকের প্রস্তাবনায় একে নতুনতর রচনা বলা হয়েছে। কালিদাস নিজেও সূত্রধারের মুখে একে নতুন নাটক বলেছেন। কালিদাসের প্রতিভার যোগ্য স্বাক্ষর এই নাটকেও বর্তমান।

নাটকের নায়ক সুঙ্গ বংশের প্রতিষ্ঠাতা অগ্নিমিত্র ঐতিহাসিক চরিত্র। বিদর্ভ রাজ্যের অন্যতম সামন্ত মাধব সেনের ভগ্নী মালবিকাকে পত্নীরূপে লাভ করেছিলেন। এটুকু বর্ণনাই ইতিহাসাশ্রিত। প্রেমের কবি কালিদাস এই নাটকে প্রেমের বিচিত্র গতি ও বিলাসকেই রূপায়িত করেছেন। ঘটনাচক্রে অপরূপ রূপলাবণ্যবতী বিদর্ভকন্যা মালবিকা পাটরাণী ধারিণী্র পরিচারিকারূপে এগ্নিমিত্রের অন্তঃপুরে স্থান লাভ করেন। যাতে মালবিকা রাজার চোখে না পড়ে পাটরাণী সেই উদ্দেশ্যে মালবিকাকে অভিনয় শিক্ষার জন্য অন্যত্র পাঠান। কিন্তু রাজা চিত্রপটে মালবিকার চিত্র এবং মালবিকার অভিনয় দেখে তার প্রতি প্রণয়াসক্ত হন। বিদূষকের চেষ্টায় ও কৌশলে অগ্নিমিত্র এবং মালবিকার মিলন ঘটে।

মালবিকাগ্নিমিত্রমের বৈশিষ্ট্য

  • নাটকটি ঐতিহাসিক পটভূমিকার ওপরে রচিত।
  • মালবিকাগ্নিমিত্রম্ নাটক থেকে কালিদাসের চরিত্রচিত্রণ ক্ষমতা, রাজ অন্তঃপুরের তৎকালীন বিলাস বৈভব এবং অভিনয় প্রয়োগ নৈপুণ্যের বিষয় জানতে পারা যায়। কেন্দ্রীয় চরিত্র অগ্নিমিত্র এবং মালবিকা আপন চরিত্রগুণে উজ্জ্বল।
  • নাটকের আরেকটি চরিত্র হল বুদূষক। মালবিকা এবং অগ্নিমিত্রার মিলন সংগঠনে বিদূষকের অবদান অসামান্য। কালিদাসের অন্য কোনো নাটকে বিদূষকের এমন কৌতুকপ্রিয়তা, এতটা কার্যকারিতা, এমন চাতুর্য, এমন বুদ্ধির খেলা দেখা যায় না।
  • সমকালীন রাজ অন্তঃপুরের চিত্র উদঘাটনে এই নাটকটি উল্লেখযোগ্য।
  • এই নাটক থেকে কালিদাসের কালে অভিনয় শিক্ষা, নাট্য প্রযোজনা ও নাট্যরসাভিব্যক্তির নিগূঢ় রহস্য সম্পর্কে নানা তথ্য জানা যায়। ‘প্রয়োগ প্রধানং হি নাট্যশাস্ত্রম্’— নাটকের রসসিদ্ধি বর্ণনায় নয়, প্রয়োগে।

বিক্রমোবর্শীয়ম্

পাঁচ অঙ্কে বিভক্ত বিক্রমোবর্শীয়ম্ নাটকে পুরূরবা এবং ঊর্বশীর প্রেম কাহিনি বিবৃত হয়েছে। যজুর্বেদে পুরূরবা ও ঊর্বর্শী অগ্নিজনন কাষ্ঠমাত্র। কিন্তু ঋগ্‌বেদে পুরূরবা এবং ঊর্বশী প্রেমিক-প্রেমিকা। পুরূরবা এবং ঊর্বশীর প্রেমকাহিনি পুরাণের নানা স্থানে বর্ণিত হয়েছে। কালিদাস এইসব উৎস থেকে উপাদান সংগ্রহ করেবিক্রমোবর্শী রচনা করেছেন। ঘটনা-বিন্যাস কালিদাসের নিজস্ব। কাহিনিতে দেখা যায় রাজা পুরূরবা একসময় অসুর লাঞ্ছিতা ঊর্বশীকে রক্ষা করতে গিয়ে তার প্রতি প্রণয়াসক্ত হন। দেবরাজ ইন্দ্র ঊর্বশী উদ্ধারের সংবাদ পেয়ে রাজাকে সর্গে ডেকে পাঠান। চিত্রলেখার সঙ্গে ঊর্বশীও সর্গে গমন করেন। এদিকে রাজ্যে ফিরে রাজা পুরূরবা ঊর্বর্শীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েন। এদিকে ঊর্বশী অনুরাগবশে একটি পরীক্ষা করেন এবং শেষপর্যন্ত রাজার কাছে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেন। ঠিক মিলনমুহূর্তে স্বর্গ থেকে খবর আসে, ঊর্বশীকে লক্ষীর ভূংইকায় অভিনয় করতে হবে। অভিনয় চলাকালীন ঊর্বশী ভুল করে পুরুষোত্তমকে পুরূরবা বলে ফেললে ভরতমুনি ঊর্বশীকে স্বর্গ থেকে বহিষ্কার করার অভিশাপ দেন। ইন্দ্র তখন বলেন ঊর্বর্শী মর্ত্যে গিয়ে পুরূরবার সঙ্গে মিলিত হবে এবং রাজার ঔরসজাত পুত্র সন্তান জন্ম দেবে। সেই পুত্রের মুখ দর্শন করে ঊর্বর্শী পুনরায় স্বর্গে ফিরে আসবেন। শেষপর্যন্ত মিলনের মধ্যে দিয়েই নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটে।

বিক্রমোবর্শীয়মের বৈশিষ্ট্য

  • বিক্রমোবর্শীয়ম্ নাটকের চতুর্থ অংক কালিদাসের অসামান্য সৃষ্টি। এটি ত্রোটক জাতীয় নাটক।
  • ঊর্বর্শী বিরহে রাজা পুরূরবার ক্রন্দন যেকোনো হৃদয়কে স্পর্শ করে। পুরূরবা বীর, আদর্শ প্রেমিক ও পুত্র বৎসল পিতা রূপে চিত্রিত।
  • প্রকৃতি বর্ণনাও চমৎকার। বনভূমি সচকিত, সপন্দিত, করুণায় মূর্ছিত—অচেতন প্রকৃতি চেতনায় অধীর।
  • সঙ্গীতগুলিও অতি মধুর ও সময়োপযোগী।
  • পাটমহিষী চরিত্রে সতীত্বের অদ্ভুত আত্মত্যাগ দেখানো হয়েছে। ঊর্বশীর চরিত্র প্রগলভা অপ্সরীরূপে চিত্রিত, মাতৃত্বের গৌরব দেখানো হয়নি।
  • নাটকের চতুর্থ অংক অন্যবদ্য সৃষ্টি। যেমন—ঊর্বশী লতায় পরিণত হলে রাজা ঊর্বশীকে সন্ধান করতে লাগলেন—‘ক্ক নু গতা স্যাৎ, ইতো গতা, কথং ময়া খলু তত্র ভবতী সুচয়িতব্যা’, পরে আবার আনন্দে বলে উঠলেন—হন্ত হন্ত উপলব্ধমুপলক্ষণং’, তারপর আবার বিষাদ।

অভিজ্ঞান-শকুন্তলম্

কালিদাসের অমর সৃষ্টি ও শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘অভিজ্ঞান-শকুন্তলম্’। বিদেশে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম পরিচিতি কালিদাসের শকুন্তলার মাধ্যমে। কালিদাসের লোকাতিশায়িনী প্রজ্ঞা ও বিশ্বতোমুখী প্রতিভার চরম ও পরম সৃষ্টি এই নাটক। নাটকের বিষয়বস্তু সর্বজনস্বীকৃত। মৃগবিহারী রাজা দুষ্যন্ত কণ্বাশ্রমে প্রবেশ করে কুসুমপেলবা শকুন্তলার রূপে মুগ্ধ হয়ে গান্ধর্ব মতে বিবাহ করে রাজধানীতে ফিরে যায়। শকুন্তলার কর্তব্যের অবহেলার শাস্তিস্বরূপ দুর্বাসার অভিশাপ তার ওপর বর্ষিত হয়। এরপর চতুর্থ অংকে পতিমিলনের আকাঙ্ক্ষায় শকুন্তলা দুষ্যন্তের রাজদ্বারে পৌঁছে যায়। কিন্তু রাজা শকুন্তলাকে পরস্ত্রীজ্ঞানে প্রত্যাখ্যান করেন। প্রত্যাখ্যাতা শকুন্তলা মা মেনকার সাহায্যে স্বর্গে মারীচের তপোবনে এসে দুঃখের তপস্যায় আত্মনিয়োগ করে। অবশেষে ঘটনা পরম্পরায় পুত্র সর্বদমনসহ শকুন্তলার সঙ্গে দুষ্যন্তের স্বর্গীয় পরিবেশে পুনর্মিলন ঘটে।

অভিজ্ঞান-শকুন্তলমের বৈশিষ্ট্য

  • নাটকটি সাতটি অংকে বিভক্ত। এরমধ্যে চতুর্থ অংক শ্রেষ্ঠ। তাই বলা হয়—

কাব্যেষু নাটকং রম্যং তত্র রম্যা শকুন্তলা।

তত্রাপি চ চতুর্থোহঙ্কো যত্র যাতি শকুন্তলা।

  • কাহিনি বর্ণনায় মুন্সিয়ানা সর্বজনস্বীকৃত।
  • শকুন্তলা চরিত্রের বিবর্তন পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
  • এই নাটকের দুর্বাসার শাপ, হংসপদিকার গান মৌলিক সৃষ্টি।
  • মহাভারতের শকুন্তলা বহুভাষিণী ও বিষয়-বুদ্ধি-সম্পন্না। কালিদাসের শকুন্তলা চির-আরণ্যক, সরলা, বাক্‌-সংযতা।
  • কালিদাসের শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় রয়েছে এই নাটকে।
  • কালিদাস বহুবল্লভ নায়কের জীবনে প্রেমকে সম্ভোগের বস্তুমাত্র করে রেখেননি, বিরহের অগ্নিস্পর্শে তাকে পরিশুদ্ধ ও উজ্জ্বল করে তুলেছেন।
  • নাটকের প্রকৃতি বর্ণনা অনবদ্য। কালিদাসের প্রকৃতি মানব হৃদয়ের সঙ্গে একান্তভাবে যুক্ত। কালিদাসের প্রকৃতিবর্ণনা ব্যঞ্জনাময়।
  • Goethe শকুন্তলা নাটকের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন আত্মার আনন্দ, উল্লাস ও মহাভোজ। মানবজীবনের ক্রমবিকাশের একটি সুন্দর ধারা আমরা নাটকে খুঁজে পাই।

কালিদাসের নাট্য-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য

  • কালিদাসের নাটকের লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হল তার শিল্পসংযম—যা ইউরোপীয় নাট্যশিল্পে দেখা যায় না।
  • নাট্যবস্তুর উপযোগী করে চরিত্রসৃষ্টি ও চরিত্র বিশ্লেষণে কালদাসের পারদর্শিতা অতুলনীয়।
  • কাহিনির ক্রমিক অগ্রগতি এবং নাটকীয় দ্বন্দ্ব ও ঘাত-প্রতিঘাত কালিদাসের নাটকের অন্যতম সম্পদ।
  • কাব্যধর্মিতা তার নাটকের প্রধান আকর্ষণ। চিত্রকল্পের সঙ্গে ভাষার মাধুর্য সংকেতময় ভাষায় ব্যঞ্জনা সৃষ্টির ক্ষেত্রে কালিদাস অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কল্পনার দীপ্তিতে তিনি নরনারীর হৃদয় গহনে প্রবেশ করেছেন।
  • উপমা চয়নে কালিদাসের চমৎকারিত্ব সর্বজনস্বীকৃত। সেজন্য বলা হয়—উপমা কালিদাসস্য। উপমার সৌন্দর্য নির্ভর করে উপমানের চমৎকারিত্বে। শকুন্তলা নাটকে কালিদার শকুন্তলার রূপ বর্ণনার জন্য প্রতিবস্তুপমা অলংকারে মালিনীছন্দে প্রথম অংকে যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা অনুপম—

সরসিজমনুবিদ্ধং শৈবলেনাপি রম্যং

মলিনমপি হিমাংশোর্লক্ষ্ম লক্ষ্মীং তনোতি।

ইয়মধিকমনোজ্ঞা বল্কলেনাপি তন্বী

কিমিব হি মধুরাণাং মন্ডনং নাকৃতিনাশ্।।(১/১৮)

  • শকুন্তলা নাটকে ভাষার বৈচিত্র্য আকর্ষণীয়। সংস্কৃত, শৌরসেনী, মাগধী, মহারাষ্ট্রী ও প্রাকৃত প্রভৃতি মিশ্রভাষায় নাটকটি রচিত। এই মিশ্রভাষা প্রমাণ করে সমাজের শ্রেণিবিন্যাসের স্বরূপকে। কারণ রাজা, বুদূষক, ধীরব ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলেছেন।
  • কালিদাসের প্রকৃতিদৃষ্টিও উল্লেখযোগ্য। মালিনী নদী, বল্কল শোভিত বৃক্ষ, মধুকর গুঞ্জন, আশ্রমে নির্ভয় বনহরিণের সঞ্চরণ—সবমিলিয়ে শান্তরসাস্পদ আশ্রমের পবিত্রতা ফুটে উঠেছে অভিজ্ঞান-শকুন্তলম্ নাটকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!