//
//

নাথসাহিত্যের কবিগণ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।

নাথসাহিত্যের কবিগণ

নাথধর্ম সংক্রান্ত গল্পকাহিনি নিয়ে যেসব সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে তা দীর্ঘদিন পর্যন্ত লোকচক্ষুর অন্তরালেই ছিল। ১৮৭৮ সালে প্রথমবার স্যার জর্জ গ্ৰীয়ার্সন রংপুর থেকে সংগৃহীত একটি গীতিকা ‘মাণিকচন্দ্র রাজার গান’ নাম দিয়ে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে প্রকাশ করেন।  পরবর্তীকালে উত্তর ও পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ‘ময়নামতীর গান’, ‘গোপীচন্দ্রের গান, গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস’ ইত্যাদি বিভিন্ন নামে একই কাহিনিভিত্তিক পুঁথি আবিষ্কৃত হয়েছে। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ শেখ ফয়জুল্লাকৃত ‘গোরক্ষবিজয়’ কাব্যের পুথি আবিষ্কার করে প্রকাশ করেছেন। ‘গোর্খবিজয়’ নামে অন্য একটি পুঁথি পঞ্চানন মণ্ডল কর্তৃক সম্পাদিত হয়েও প্রকাশিত হয়েছে। এই  সব গ্রন্থ থেকে নাথসাহিত্যের পরিচয় লাভ করা যায়।

গোরক্ষনাথ-মীননাথের কাহিনি অবলম্বনে রচিত যে সব কাব্য সম্পাদিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে সেগুলো হল— ১. আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সম্পাদিত কবি শেখ ফয়জুল্লার ‘গোরক্ষবিজয়’, ২. ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালী সম্পাদিত কবি শ্যামদাস সেনের ‘মীনচেতন’ এবং ৩. ড. পঞ্চানন মণ্ডল সম্পাদিত কবি ভীম সেনের ‘গোর্খবিজয়’। এই তিনটি কাব্যের কবিরা স্বতন্ত্র না একই ব্যক্তি  এসম্পর্কে পণ্ডিতগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। বিভিন্ন নামে প্রকাশিত এ সব ভণিতার মধ্যে কোন ঐক্য নেই। কবীন্দ্র, শেখ  ফয়জুল্লা, ভীমদাস ও শ্যামদাস সেনের ভণিতা বিক্ষিপ্ত ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ড. সুকুমার সেন লিখেছেন—‘‘গোরক্ষবিজয়ের কবি (অথবা প্রাচীন গায়ক) পাইতেছি অন্তত তিনজন—ভীমসেন রায়, শ্যামদাস সেন ও ফয়জুল্লা। শ্যামদাস সেন ও ফয়জুল্লার রচনার মধ্যে ঐক্য এতটা গভীর যে দুজনকে স্বতন্ত্র কবি মনে করা দুরূহ।’’ ড. দীনেশচন্দ্র সেন কবি শেখ ফয়জুলাকে সংকলক মাত্র মনে করেছেন। আবার পঞ্চানন মণ্ডলের মতে ফয়জুল্লা, শ্যামদাস সেন বা ভীমসেন কেউ-ই কাব্যের রচনাকার নন— তারা গোরক্ষগীতিকার গায়কমাত্র ।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বিভিন্ন মতামত পর্যালোচনা করে লিখেছেন—“নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইতেছে যে গোরক্ষবিজয় বা গোর্খবিজয়ের কবি শেখ ফয়জুল্লা ভিন্ন অন্য কেহ হইতে পারে না। এ প্রসঙ্গে ড. মুহম্মদ এনামুল হক ‘মুসলিম বাঙ্গলা সাহিত্য’ গ্রন্থে সকল বিতর্ক অবসানের জন্য যে মন্তব্য করেছেন তা উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছেন—‘‘শেখ ফয়জুল্লার সুপ্রচারিত গ্রন্থের নাম ‘গোর্খবিজয়’ বা ‘গোরক্ষবিজয়। ইহার যে কয়খানি পুঁথি পাওয়া গিয়াছে, তাহার অধিকাংশ গ্রন্থে শ্যামদাস, ভীমদাস ও কবীদাসের দুই একটি ভণিতার সহিত ফয়জুলার ভণিতা থাকায় কেহ কেহ মনে করেন, মূল পুঁথি কবীন্দ্রের রচনা। এই ধারণা ভুল। সমস্ত পুঁথির অধিকাংশ ভণিতা এবং তিন চারিখানা পুঁথির সমুদয় ভণিতা শেখ ফয়জুল্লাহর হওয়ায়, মূল পুথিখানি যে ফয়জুল্লার রচনা, সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করা, অতিরিক্ত পাকামির পরিচায়ক, অথবা মুসলমানের নাম প্রাচীন বাংলা সাহিত্য হইতে বাদ দিবার প্রয়াস মাত্র। শেখ ফয়জুল্লার গোরক্ষবিজয়ের একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ভণিতা এইরূপ—

কবীন্দ্র বচন শুনি ফয়জুল্লাএ ভাবিয়া।

মীননাথ গুরুর চরিত্র দিল বুঝাইয়া।।

ইহা হইতে দেখা যায়, কবীন্দ্রের মুখে গল্প শুনিয়া কবি ফয়জুল্লা তাঁহার কাব্যটি রচনা করিয়াছেন। ভীমদাস ও শ্যামদাস নিশ্চয় এই কাব্যের পরবর্তীকালের অনুলেখক বা গায়ক। নিজেদের নাম কাব্যের সহিত যুক্ত করিয়া রাখার লোভ সংবরণ করিতে না পারিয়া তাহারা মাঝে মাঝে ভণিতায় নিজেদের নাম জুড়িয়া দিয়াছেন।’’

শেখ ফয়জুল্লার কাব্যের নাম সম্পর্কেও সমস্যা আছে। কবি কোথাও উল্লেখ করেছেন— ‘সমাপ্ত হইল জল মীনের চেতন’, কোথাও আছে—গোর্খ বিজয় এ পুস্তক সমাপ্ত, কোথাও উল্লেখিত হয়েছে— ইতি মীননাথ চৈতন্য গোরক্ষবিজয় সমাপ্ত। এতে মনে হয় কাব্যের প্রকৃত নাম ‘মীননাথ চৈতন্য গোরক্ষবিজয়’। তা সংক্ষেপে ‘মীনচেতন’ বা ‘গোরক্ষবিজয়’ নামে প্রচলিত রয়েছে।

শেখ ফয়জুল্লা রচিত পাঁচখানি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। সেগুলো হল— ১. গোরক্ষবিজয়, ২. গাজীবিজয়, ৩. সত্যপীর, ৪. জয়নালের চৌতিশা এবং ৫. রাগনামা। সম্ভবত ১৫৭৫ সালে সত্যপীর রচিত হয়েছিল। গাজীবিজয় রচিত হয়েছিল ১৫৭০ সালের দিকে। গাজীবিজয় ঐতিহাসিক কাহিনিকাব্য । জয়নালের ‘চৌতিশা’ মর্সিয়া শ্রেণির কাব্য। ‘রাগনামা ’সঙ্গীত সম্বন্ধীয় গ্রন্থ। রচনাবৈচিত্র্য সম্পর্কে শেখ ফয়জুল্লা তাঁর ‘গাজীবিজয়’ কাব্যে উল্লেখ করেছেন—

গোর্খবিজয় আদ্যে মুনিসিদ্ধা যত

কহিলাম সব কথা শুনিলাম যত।

খোটাদূরের পীর ইসমাইল গাজী

গাজীর বিজএ সেহ মোক হৈল রাজি।

এবে কহি সত্যপীর অপূর্ব কথন

ধন বাড়ে শুনিলে পাতক খণ্ডন।

মুনি রস বেদ শশী শাকে কহি সন

শেখ ফয়জুল্লাহ ভণে ভাবি দেখ মন।

ড. মুহম্মদ এনামুল হক মনে করেন— ‘‘গোরক্ষবিজয় সত্যপীর কাহিনির পুর্ববর্তী রচনা। শেখ ফয়জুল্লা গোরক্ষবিজয়ের কাহিনি ‘ভারত পাঁচালী’ রচয়িতা কবীন্দ্রের মুখে শুনিয়া পুস্তকাকারে লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন।’’ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ গোরক্ষবিজয়ে ব্যবহৃত আরবি শব্দের কথা উল্লেখ করে একে মুসলমানের রচনা বলে মন্তব্য করেছেন। গোরক্ষবিজয়ের বর্ণিত তত্ত্বকথার নমুনা—

দীপ নিবিলে জ্যোতি কোথা গিয়া রহে?

শরীর বিয়োগে প্রাণী কোথা যাই রহে?

শব্দ উঠিলে ধ্বনি রহে গিয়া কোথা?

কোন নালে আইসে প্রাণ কোন নালে যায়?

কোথায় বৈসে মন, কোথায় পবন?

গোরক্ষবিজয় কাব্যের কাহিনিতে নাথ বিশ্ব-জাত যোগের মহিমা এবং নারী-ব্যভিচার-প্ৰধান সমাজচিত্রের বর্ণনা রূপায়িত হয়েছে। অনেকের মতে, এ কাব্যে শিল্প রচনার উদ্দেশ্য ছাপিয়ে ধর্মীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠার আগ্রহ বেশি ফুটে উঠেছে। তবে কাব্যের শৈল্পিক আবেদন সর্বত্র বিদ্যমান। নাথসাধকেরা ছিলেন মূলত নিরীশ্বরবাদী, নিজের আত্মার মুক্তি নিজের সাধনা দ্বারা সম্ভব বলে তারা বিশ্বাস করতেন। সেজন্য দেবদেবীর প্রতি তাদের শ্রদ্ধা প্রকাশ পায়নি। ‘গোরক্ষবিজয়’ কাব্যে একদিকে সন্ন্যাসী গোরক্ষনাথের মায়ামোহবর্জিত নিস্পৃহ বৈরাগী মন এবং কর্তব্যকর্মে অবিচল নিষ্ঠা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে, আর একদিকে মীননাথের সাংসারিক মায়ামুগ্ধ বিড়ম্বিত চরিত্রটিও সুপরিকল্পিত হয়েছে। দেহের ওপর আত্মার জয় ঘোষণা করা নাথসাধকদের যে উদ্দেশ্য ছিল তা এ কাব্যে ব্যাখ্যাত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে দীনেশচন্দ্র সেন মন্তব্য করেছেন— ‘‘গোরক্ষবিজয়ের মত এরূপ অপূর্ব গ্রন্থ যে বঙ্গসাহিত্যের আদিযুগে রচিত হইয়াছিল, ইহা আমাদের গৌরবের কথা। গোরক্ষযোগীর চরিত্র শরৎ শেফালিকা বা যুথিকার ন্যায় শুভ্র; তাহার চরিত্ৰমাহাত্ম্য বঙ্গ সাহিত্যের আদিযুগের একটি প্রধান দিকনির্দেশক স্তম্ভ। ইহা বৌদ্ধযুগের চরিত্রবল, উচ্চনীতি, গুরুভক্তি প্রভৃতি মহৎ গুণরাশিকে উজ্জ্বল করিয়া দেখাইতেছে। …এই অপূর্ব পুঁথির গ্রাম্যভাষ্য ও রুচি যে পাঠককে শ্রান্ত ও ভগ্নোৎসাহ করিবে, তিনি সাহিত্যের এক মহা খনির পরিচয় লাভে বঞ্চিত হইবেন।’’

চরিত্রচিত্রণে কবিরা বিশিষ্টতার পরিচয় দিয়েছেন। আধুনিক কালের সাহিত্য সমালোচকগণও গোরক্ষনাথের চরিত্রের উচ্চ প্রশংসা করেছেন। অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত কবির স্বভাবপটুত্ব না থাকলে এরূপ আদর্শ চরিত্রের যথার্থ সঙ্গতি রক্ষা করা যেত না। গোরক্ষনাথের চরিত্রে উচ্চতম আদর্শ ও মহত্ত্ব লক্ষ করা যায়। তবে মীননাথের চরিত্রটি বেশি সার্থকতার দাবি করতে পারে। এই চরিত্রে মনস্তত্ত্বসঞ্জাত বিকাশ ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব লক্ষণীয়।

গোরক্ষবিজয়কে লোকসাহিত্য হিসেবে বিবেচনা করা যায় কিনা সে সম্পর্কে মতানৈক্য বিদ্যমান। রচনা কর্কশ, মন ও মেজাজের দিক দিয়ে এতে পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যরূপের চেয়ে লোকসাহিত্যের প্রভাব বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একে উচ্চতর কাব্যকলা ও সাহিত্যগুণের আদর্শে বিচার করা যায় না। লোকমত ও লোকসমাজে প্রচলিত এক ধরনের দেহঘটিত রহস্যবাদী চর্যার পটভূমিকায় এই সব কাহিনি রূপলাভ করেছিল।

রানি ময়নামতী ও তার পুত্র গোপীচন্দ্রের কাহিনি অবলম্বনে রচিত কতিপয় কাব্যের পরিচয় পাওয়া যায়। ময়নামতীর গান বা গোপীচন্দ্রের গীত এক সময় শুধু সমগ্র বাংলাদেশেই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল তা নয় বরং বাংলার বাইরেও ভারতের সর্বত্র প্রচারিত হয়েছিল। গোরক্ষবিজয়ের কাহিনিতে নাথধর্মের রীতিনীতি ও তত্ত্বকথার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপিত হয়েছিল বলে নাথসম্প্রদায়ের কাছেই এর আবেদন বেশি ছিল। কিন্তু ময়নামতী গোপীচন্দ্রের কাহিনিতে মানবরসের প্রাধান্য থাকাতে তা সকল শ্রেণির মানুষের কাছে সমাদৃত হয়। এই কাহিনি অবলম্বনে রচিত গানের প্রথম সংগ্রহ করেন জর্জ গ্ৰীয়ার্সন ১৮৭৮ সালে রংপুর থেকে। এ সংগ্রহের নাম ‘মাণিক রাজার গান।’ ১৯০৭-১৯০৮ সালে বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য রংপুর থেকেই তিন জন যোগীভিখারির কাছ থেকে সমস্ত পালাটি লিখে নেন। ১৯২২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘গোপীচন্দ্রের গান’ প্রথম খণ্ড এবং ১৯২৪ সালে দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়। প্রথম খণ্ডের গাথা লোকসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত; দ্বিতীয় খণ্ডের আখ্যান দুজন কবির রচনা। একজন ভবানীদাস ও অন্যজন শুকুর মহম্মদ। পরে শিবচন্দ্র শীল ‘গোবিন্দচন্দ্রের গীত’ সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন।

‘ময়নামতী বা গোপীচাঁদের গান’ কাব্যের রচয়িতা দুর্লভ মল্লিক। ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালী ঢাকা থেকে ভবানীদাসের ‘ময়নামতীর গান’ এবং শুকুর মহম্মদের ‘গোপীচাদের সন্ন্যাস’ সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। ‘ময়নামতী বা গোপীচাঁদের গান’ কাব্যের রচয়িতাগণের মধ্যে দুর্লভ মল্লিক, ভবানীদাস ও শুকুর মহম্মদের নাম উল্লেখযোগ্য। দুর্লভ মল্লিকের ‘গোবিন্দচন্দ্রের গীত’  নামক কাব্যটিকে ড. সুকুমার সেন সবচেয়ে পুরাতন বলে উল্লেখ করেছেন। এ কাব্যের কাহিনিতে প্রাচীনত্ব আছে, বিশেষত এতে ধর্মপূজার সঙ্গে যোগীসিদ্ধাচার্যদের সাধনার সম্পর্ক যথাযথ রক্ষিত হয়েছে। দুর্লভ মল্লিক সম্ভবত সতের-আঠার শতকের কবি।

কবি ভবানীদাসের ‘ময়নামতীর গান’, নলিনীকান্ত ভট্টশালী ও বৈকুণ্ঠনাথ দত্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল। ভবানীদাসকে, সুকুমার সেন ত্রিপুরা অঞ্চলের লোক মনে করেছেন। লোকমুখে প্রচলিত ছড়া-পাঁচালী অবলম্বনে এই কাব্য রচিত। কাব্যের ভণিতায় চার বার ভবানীদাসের নাম উল্লেখিত হয়েছে। রচনাটি ভবানীদাসের কিনা এ সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন— ‘‘ময়নামতীর গান পড়িয়া হিন্দু ভবানীদাস যে পুস্তকের রচয়িতা নহেন, কিন্তু একজন মুসলমান ইহার রচয়িতা এরূপ সিদ্ধান্ত করিতে আমি বাধ্য হইয়াছি।’’ ভাবের দিক থেকে এ কাব্যে মুসলমানি ভাব, ভাষার দিক থেকে আরবি ফারসি শব্দের প্রয়োগ ইত্যাদি বিবেচনা করে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এই সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে ভবানীদাস গায়েনের নাম কিংবা মুসলমান কবির কল্পিত নাম হতে পারে। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মনে করেন— ‘‘ভবানীদাসের ‘ময়নামতীর গানে’ মুসলমান কবি বিলক্ষণ হাত চালাইয়াছিলেন। এমনও হইতে পারে মূল গান মুসলমানের রচিত। তাহাতে ভবানীদাস নিজের নাম জুড়িয়া দিয়াছেন।’’

শুকুর মহম্মদের কাব্যের নাম  ‘গোপীচাঁদের সন্ন্যাস। ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালীর সম্পাদনায় এটি প্রকাশিত হয়। ড. মুহম্মদ এনামুল হক শুকুর মহম্মদের কাল আনুমানিক ১৬৮৩ থেকে ১৭৫০ সাল বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি তাঁকে ত্রিপুরার কবি মনে করেন এবং তাঁর মতে আঠার শতকের গোড়ার দিকে এ কাব্য রচিত হয়। তার মতে এটি ঐতিহাসিক কাহিনিকাব্য। কবি নিজের নাম সম্পর্কে বলেছেন—

আবদুল শুকুর নাম পিতাএ রাখিল।

শুকুর মোহাম্মদ নাম কিতাবে ঘুষিল।।

ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালী, শুকুর মহম্মদের পুঁথি দিনাজপুর থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। সে পুঁথি শতাধিক বৎসরের পুরাতন। কবির নিবাস বালুরঘাটে সিন্দুর-কুসুম গ্রামে ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। পুরাণ শুনে কবি এ কাব্য রচনা করেন। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি শুকুর মহম্মদের কাব সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছেন—‘‘কবির ভাষা প্রাঞ্জল। কিন্তু নারীর বেশভূষা ও রূপবর্ণনা করিবার সময় তিনি সংস্কৃত শব্দের লোভ ছাড়িতে পারেন নাই। অনেক শব্দের অপপ্রয়োগ করিয়াছেন, বর্ণনাও ব্যর্থ হইয়াছে। তথাপি তাহার রচনায় সংযম আছে; অন্যান্য কবির ন্যায় গ্রাম্যজনসুলভ অশ্লীলতা নাই। ভাষা দেখিলে কবিকে দুই একশত বৎসরের অধিক পুরাতন বোধ হয় না।’’ কবির ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গির উল্লেখযোগ্য নিদর্শন—

কান্দিয়া উদুনা চলে রাজার শদনে।

নারির জৌবন প্রভু স্বামির কারণে॥

স্বামি বিনে নারিলোকের নাহি জাতি কুল।

পতি বিনে নারী ধুতুরার ফুল।

কবির কাব্যে সাংকেতিক তত্ত্বকথাও প্রকাশ পেয়েছে। যেমন—

বাসাতে ছাও নাই সদায় উড়ে পড়ে

নগরেতে মনুষ্য নাই বসতি চালে চলে।

পুকুরেতে পানি নাই পাড় কেন ডোবে

অন্ধযে দোকান দেয় খরিদ করে কাল?

আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া কর্তৃক সম্পাদিত ‘গুপিচন্দ্রের সন্ন্যাস’ ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে।

ময়নামতী-গোপীচন্দ্রের কাহিনি নিয়ে রচিত ‘গোপীচন্দ্র নাটক’ নেপাল থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। ড. সুকুমার সেন এর বিবরণ দিয়েছেন। নাটকটি ১৬২০ থেকে ১৬৫৭ সালের মধ্যে রচিত। নেপালি ভাষায় এ নাটক রচিত হলেও এর প্রধান কাহিনি গানে বিধৃত এবং সে গানের ভাষা বাংলা।

ময়নামতী-গোপীচন্দ্রের কাহিনি যে আমলে রচিত হয়েছিল সে সময় থেকে বহুকাল পরে তা সংগৃহীত হয়েছে। তবে মূল বৈশিষ্ট্য থেকে তা পরিবর্তিত হলেও গল্পাংশের মূল কাঠামোর পরিচয় পেতে অসুবিধা হয় না। গোপীচন্দ্রের গানের কাব্যগত আবেদন হৃদয়গ্রাহী। এদেশে ধর্মচেতনায় যে বৈরাগ্যবোধ সম্পর্কিত তার পরিচয় এতে পাওয়া যায়। গোপীচন্দ্রের জীবনে ত্যাগ-তিতিক্ষাময় সাধন-মহিমার সঙ্গে যৌবনে বিরাগী হওয়ার কারুণ্য যুক্ত হওয়ায় এই কাব্যের আবেদন হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে। প্রচলিত কাব্যধারায় এই আখ্যায়িকামূলক কাব্য কাঠামো একটি নতুনতর রূপবৈচিত্র্য সংযোজন করেছে। সমালোচকের মতে—‘‘কাহিনি-গ্রন্থন, চরিত্র-কল্পনা, কিংবা জীবনদৃষ্টির অভিনবতার বিশেষ কোন কাব্যিক উৎকর্ষ—এই সকল সাহিত্যে এ সবকিছুই প্রত্যাশা করা অন্যায়। তবু দুটি পরিচ্ছন্ন-রূপক কাহিনির মাধ্যমে সেকালের জনজীবন-বেদনাকে উল্লেখ্য মুক্তি দিতে পেরেছে, এইটুকুই এই শ্রেণির রচনার শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব।’’ গোপীচাদের কাহিনিতে বৈরাগ্য ও জীবনস্পৃহার যে বেদনাতুর সমাবেশ ঘটেছে তা অর্বাচীনতার খোলসেও আকর্ষণ হারায়নি। তাই বাংলাদেশের বাইরেও এ কাহিনি সমাদৃত। তৎকালীন লোকজীবনের সার্থকভার প্রতিফলনের জন্যও এর গুরুত্ব কম নয়।

নাথদর্শন যোগীসমাজে জীবন্ত চর্যা ও মোক্ষ সাধনা রূপে প্রচলিত থাকায় গোরক্ষবিজয় ও গোপীচন্দ্রের গানের বাইরেও অনেক পদ, প্রহেলিকা ও রূপক কবিতা প্রচলিত আছে। পরবর্তী পর্যায়ে এ ধরনের কিছু ছড়া-কবিতা সংগৃহীত হয়েছে। ড. পঞ্চানন মণ্ডল এ ধরনের কিছু পদ সংগ্রহ করে তাঁর সম্পাদিত ‘গোরক্ষবিজয়’ কাব্যের পরিশিষ্টে সংযোজন করেছেন। সেগুলোতে আছে— ১. যোগীর গান, ২. যুগীকাচ, ৩. গোর্খ সংহিতা, ৪. যোগচিন্তামণি। এসব সংগ্রহের কোনোটি মুসলিম কবির রচিত বলে তাতে ইসলামি শব্দের বাহুল্য ব্যবহার রয়েছে। কোনো কোনো পদকর্তা রাধাকৃষ্ণের রূপকে এই সাধনপ্রণালী ব্যাখ্যা করেছেন। যোগ সাধনার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত থাকলেও কোথাও কোথাও গোপিনীর বেদনা করুণ হয়ে প্রকাশ পেয়েছে—

যোগীহারা হয়ে আমি সুধাই গো তোমারে।

আমার নীলকান্তমণি রইল কোন সহরে

আমার প্রাণ সদাই কাঁদে যোগীর কারণে।

আমার নীলকান্তমণি রইল কোন স্থানে॥

যোগী আমার প্রাণের, যোগী প্রাণপতি।

পতি বিনে চেয়ে দেখ আমার এ দুর্গতি॥

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘সাধনমাহাত্ম্য’ নামের একখানি গ্রন্থের সন্ধান দিয়েছেন। এই কাব্যের রচয়িতা মকসেদ আলী। এতে গোপীচাঁদের সন্ন্যাস-কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!