//
//

পয়ার কাকে বলে? পয়ারের বৈশিষ্ট্যগুলি উদাহরণসহ আলোচনা কর।

পয়ার

বুদ্ধদেব বসু বলেছেন— “পয়ার আসলে একটি ছন্দ নয়, ছন্দের একটি জাত।” প্রকৃতপক্ষে তাই, পয়ার একটি রূপকল্প বা Pattern (যা তিন রকম ছন্দেই বর্তমান।

মূলতঃ অক্ষরবৃত্তের ভিত্তিতে গঠিত হয় পয়ার। মূলপর্ব—৮ মাত্রা, অপূর্ণ পর্ব—৬ মাত্রা। পয়ার দুটি চরণে গঠিত, প্রতি চরণ হয় ৮+৬ মাত্রার। চরণের শেষে ভাবের পূর্ণ বা আংশিক পরিসমাপ্তি ঘটে ও পূর্ণযতি পড়ে। পয়ার ছন্দের বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে তাকে প্রায় গাঁঠে-গাঁঠে ভাগ করা চলে, এবং প্রত্যেকভাগেই মূল ছন্দের একটা আংশিক রূপ দেখা যায়।” (রবীন্দ্রনাথ)

পয়ারের বৈশিষ্ট্য

পয়ারের কয়েকটি বিশিষ্ট লক্ষণ হল, পয়ারে থাকে—

  • দুটি চরণ, প্রতি চরণে দুটি পর্ব।
  • চরণান্তিক মিল আবশ্যিক শর্ত।
  • প্রতি চরণে ভাবের পূর্ণ বা আংশিক পরিসমাপ্তি হবে।
  • চরণ দুটিতে মাত্রা থাকবে ৮+৬ হিসাবে। ৮ মাত্রার পর হ্রস্বছেদ বা হ্রস্বযতি পড়ে, আর চরণের শেষে পূর্ণতি।
  • লয় হয় ধীর, অতিরিক্ত সুর থাকে।
  • পয়ারে মাত্রা গণনা হয় অক্ষরবৃত্তের নিয়মানুসারে। (তবে ব্যতিক্রমও আছে)।
  • পয়ারে দৃষ্টি গ্রাহ্য অক্ষর সংখ্যা হয় ১৪টি। আট অক্ষরের পর যতি পড়ে।
  • অনেক সময় ৮+৬ পর্বের বদলে ৭+৭ পর্বও দেখা যায় পয়ারে।
  • পয়ারের মাত্রা গণনারীতি = মুক্ত দল ও অপ্রান্ত্য রুদ্ধদল এক মাত্রা। প্রান্ত্য রুদ্ধদল দু-মাত্রা। প্রসারিত/অপ্রসারিত দলে মাত্রা বৈচিত্র্য দেখা যায়।

উদাহরণ:

মহাভারতের কথা অমৃত সমান।। ৮+৬

কাশীরাম দাস কহে | শুনে পুণ্যবান।। ৮+৬

আলোচ্য দৃষ্টান্তটি পয়ারের আদর্শ দৃষ্টান্ত। ৮ ও ৬ মাত্রার পর্বে চরণ দুটি বিভক্ত। মুক্তদল ও অপ্রান্ত্য রুদ্ধদল এক মাত্রা এবং প্রান্ত্য রুদ্ধদল দু-মাত্রা ধরা হয়েছে। দৃষ্টান্তটি দ্বিপদী পয়ারের উদাহরণ।

নানা দৃষ্টিকোণ থেকে পয়ার

(১) “দু’মাত্রার ছড়ার ছন্দ পরিণত রূপ নিয়েছে পয়ারে। বাঙালি বহুকাল ছন্দে গেয়ে এসেছে রামায়ণ-মহাভারত একটানা সুরে। এ ছন্দে প্রবাহিত প্রাদেশিক কাহিনি রাঙিয়েছে বাঙালির হৃদয়কে।…এই কাব্যের পণ্য ভেসেছিল পয়ার ছন্দে। ভাঙা চোরা ছিল এর পদবিন্যাস। ভারতচন্দ্রই প্রথম ছন্দকে সৌষম্যের নিয়মে বেঁধেছিলেন , (রবীন্দ্রনাথ)

(২) “প্রত্যেক চরণ ন্যূনপক্ষে চতুর্দশ অক্ষর এবং অষ্টম ও চতুর্দশ অক্ষরের পর যতি। প্রকৃতপক্ষে পয়ারের অক্ষর সংখ্যা যাহাই হউক না কেন মাত্রা সংখ্যা হইবে আট ও ছয় অর্থাৎ একুনে চৌদ্দ। কিন্তু আদিতে মাত্রা সংখ্যা ছিল ষোল। পরে প্রধানতম অর্থাৎ দ্বিতীয়। যতিতে যে বিরাম তাহাতে দুইমাত্ৰা খাইয়া গিয়া চৌদ্দতে দাঁড়াইয়াছে।” (সুকুমার সেন)

(৩) কিন্তু পয়ার বলতে সত্যিই কোন ছন্দকে বোঝায় না, পয়ার আসলে একটা বন্ধুমাত্র (অর্থাৎ কবিতার পঙক্তি-বিন্যাসের বিশেষ একটা পদ্ধতি)।” কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

(৪) পয়ার একটি ছন্দোবন্ধের (ছন্দ-আকৃতির) নাম, ছন্দোরীতির (ছন্দ-প্রকৃতির) নাম নয়। যে ছন্দ-পঙক্তি অর্ধ যতির দ্বারা যথাক্রমে আট ও ছয় মাত্রার দুই ভাগে অর্থাৎ দুইপদে বিভক্ত, তারই নাম পয়ার।” (প্রবোধচন্দ্র সেন)

(৫) “আট-ছয় আট-ছয় পয়ারের ছাঁদ কয়।” (সত্যেন্দ্রনাথ)

(৬) পয়ারের গঠন সম্বন্ধে সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন—“বিজোড় বিজোড় গাঁথ জোড়ে গাঁথ জোড়, আট-ছয়ে হাঁক ছেড়ে ঘুরে যাও মোড়”।

Publication date:
Author: Admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!