বাংলা প্রবন্ধের ইতিহাসে প্রমথ চৌধুরীর অবদান আলোচনা কর।
প্রমথ চৌধুরী
(১৮৬৮-১৯৪৬)
বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের পর প্রবন্ধ সাহিত্যকে নতুন করে মেজাজ ও ভঙ্গির প্রাধান্য দিয়ে গড়ে তোলার প্রয়াস যিনি একমাত্র করেছিলেন তিনি হলেন ‘সবুজপত্রে’র সম্পাদক প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬)। তিনি প্রবন্ধের মধ্যে মজলিশি আলাপের সুর, খেয়াল-খেলার লীলায়িত ছন্দ, ভারমুক্ত স্বচ্ছন্দ মননের ‘বিসর্পিত’ সঞ্চরণের প্রবর্তন করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধে মাঝেমাঝে হালকা চাল থাকলেও তাঁর আলোচনা গাম্ভীর্যপ্রধান ও গভীর সুরে অনুরণিত। হাসি-তামাসা ও রঙ্গরসের ছদ্মবেশের অন্তরালে তাঁর গভীর হৃদয়াবেগ, ঐকান্তিক আকুতি মর্মস্পর্শী রূপ লাভ করেছে প্রবন্ধের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ কোথাও কোথাও গীতিকবিতার গদ্যরূপ, নিবিড় ভাবাবেগে ও কল্পসৌন্দর্যের সমাবেশে একান্তভাবে কাব্যধর্মী, কোথাও বা ক্ষুরধার যুক্তিপ্রয়োগে শাণিত খঙ্গের মতো দীপ্ত। অন্যদিকে প্রমথ চৌধুরীর তীক্ষ্ণযুক্তি, লঘু কল্পনা ও স্বচ্ছন্দচারী খেয়াল প্রভৃতির মাধ্যমে যে পরিমণ্ডল রচনা করেছেন তা একান্ত প্রমথ চৌধুরীর মতোই।
প্রমথ চৌধুরী স্বভাবে ছিলেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী, মননাশ্রয়ী, প্রাণবাদী। তাঁর পরিচ্ছন্ন চিন্তা ও মননশীলতা, নিবিড় ঐহিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়োজিত ছিল বিংশ শতাব্দীর শিক্ষিত বাঙালি মানসের সর্বাঙ্গীণ মুক্তিযজ্ঞে। বীরবল ছদ্মনামে ‘সবুজপত্র’-র সম্পাদকরূপে তিনি সেই কাজ সম্পন্ন করেছেন। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে বলেছেন— “সব্যসাচী প্রমথ চৌধুরী, ‘সবুজপত্র’ তাঁর গাণ্ডীব। রূপের চেয়ে রুচিকে, রুচির চেয়ে ঋদ্ধিকে বড়ো মনে করতেন তিনিই। তাঁর সাহিত্য প্রতিভায় নাব্যতা ছিলো—ছিলো অনন্যতা।” (“সাহিত্য ও সাহিত্যিক’)।
অন্যান্য মনীষীদের মতো প্রমথ চৌধুরীও সমকালীন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মতো তিনিও পল্লীজীবনের অভাব-অভিযোগ দূর করার জন্য আন্দোলনের সময় পল্লীসংগঠনের কথা চিন্তা করেছিলেন। ‘ভারতী’ পত্রিকা (আশ্বিন ১৩১২) তিনি ‘বয়কট ও স্বদেশীয়তা’ নামক প্রবন্ধ লেখেন। প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন শুধু ভাবের উত্তেজনায় স্বদেশী দ্রব্য আসবে না, এজন্য মানুষের চেতনার প্রয়োজন। সেজন্য তিনি উক্ত প্রবন্ধে লিখলেন— “আমাদের কোটি কোটি ইতর সাধারণ দেশের কথা প্রধানত পেটের কথা। তাদের ক্ষুধা নিবৃত্তির উপায় যদি না করে দিতে পারি তাহলে আমাদের দূরে থাকাই ভাল। যারা পেটের জ্বালায় জ্বলছে তাদের উপরন্তু কথার জ্বালায় জ্বালাবার কোন দরকার নেই।”
প্রমথ চৌধুরী রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সমস্যা নিয়ে যেসব প্রবন্ধ লিখেছেন তার মধ্যে বিচার বুদ্ধি ও সুতীক্ষ্ণ অন্তদৃষ্টির পরিচয় পাই। অজ্ঞতা ও যুক্তিহীনতা যে মানুষের উন্নতির অন্তরায় সে বিষয়ে তিনি মত প্রকাশ করেছে। জাতি যে অন্ধ অনুকরণের নেশায় মত্ত হয়েছিল, তা থেকে মুক্তির উপায় সম্বন্ধে নির্দেশ করে লিখেছেন ‘তেল-নুন-লকড়ি’ (ফাল্গুন-১৩১২) প্রবন্ধ। সাহেবিয়ানার নেশা থেকে মুক্তি পেতে হলে কী প্রয়োজন সে সম্বন্ধে তিনি জানিয়েছেন— “দৈনিক জীবনে আমরা সকলেই অভ্যস্ত, আচার ব্যবহারের অধীন। ভুল করেছি—এই জ্ঞান জন্মানো মাত্র সেই ভুল তৎক্ষণাৎ সংশোধন করা যায় না। কিন্তু মনের স্বাধীনতা একবার লাভ করতে পারলে ব্যবহারেরও অনুরূপ পরিবর্তন শুধু সময়সাপেক্ষ।”
আমাদের সমাজে একশ্রেণির মানুষ কিভাবে সাহেব হল তারা অন্ধ অনুকরণের মোহে জড়িয়ে পড়ল তার চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন প্রাবন্ধিক। ‘তেল-নুনলকড়ি’-তে লিখলেন— “প্রতিজনেই নিজের খুশি কিম্বা সুবিধা অনুসারে নিজের চরিত্র এবং ক্ষমতার উপযোগী হঠাৎ সাহেব হয়ে উঠেছি। ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজে আমরা সবাই স্বাধীন, সবাই প্রধান। স্বদেশী আচার-ব্যবহার ছাড়বার সময় আমরা পুরুষেরা মহিলা সমিতি করিনি, এখন ফিরে ধরবার ইচ্ছেয় আমরা মহিলা সমিতি পর্যন্ত গঠন করেছি।”
রবীন্দ্রনাথের মতো প্রমথ চৌধুরী কামনা করেছিলেন মনুষ্যত্বের জাগরণ। এক্ষেত্রে তিনি ঐতিহ্যের অনুসারী ছিলেন। তাঁর স্বদেশপ্রীতিও ঐতিহ্যবিচ্যুত নয়। সেজন্য তিনি লিখেছিলেন— “আমরা স্বদেশে যাতে বিদেশী না হই, সে বিষয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে। আমাদের তন মন ধন দেশের পায়ে বিকতে হবে, বিদেশের পায়ে নয়।’’ বস্তুত এই চিন্তাধারা আধুনিক জগৎ ও জীবন সম্পর্কে ভাবিত। সেভাবেই তিনি বাঙালির মুক্তি চেয়েছিলেন। বাঙালিকে নিজের ঐতিহ্যে, কর্মে ও চিন্তায় উদ্দীপিত করে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। সবুজপত্রের যুগে তাঁর সেই চিন্তাধারার ব্যাপক প্রতিফলন ঘটেছে।
প্রমথ চৌধুরী চলিত ভাষাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। ‘বীরবলের হালখাতা’ গ্রন্থের ‘কথার কথা’ প্রবন্ধে তিনি তাই লিখেছেন— “ভাষা মানুষের মুখ হতে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ হতে মানুষের মুখে নয়। উল্টোটা চেষ্টা করতে গেলে মুখে শুধু কালি পড়ে।’’ এখানে রয়েছে তির্যক ব্যঙ্গ ও সূক্ষ্ম পরিহাসরসিকতা। রবীন্দ্রনাথ এজন্য তাঁর গদ্যকে বলেছিলেন ‘ইস্পাতের ছুরি’।
বাংলা গদ্যে প্রমথ চৌধুরীর অবদান
- তাঁর প্রবন্ধের গঠনগত প্রধান বৈশিষ্ট্য হল—আঙ্গিকের দৃঢ়বদ্ধতা থেকে প্রবন্ধের মুক্তি।
- তাঁর প্রবন্ধের বাইরের গঠন অপেক্ষা অন্তরের স্বরূপ বেশি বৈচিত্র্যময়। কারণ সাহিত্যের অন্তঃপুরে প্রথম বৈঠকী আলাপের ঢং-কে সাহিত্যিক মর্যাদা দিয়েছে প্রমথ চৌধুরী।
- ফরাসি দেশের সবরকমের মোহমুক্ত, মননঋদ্ধ বাগবৈদগ্ধ্যপূর্ণ, রসিকতাময় মেজাজ বাঙালি সমাজে চালু করেন তিনি।
- তাঁর তির্যক দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে রয়েছে বলিষ্ঠ জীবনাদর্শ।
- রবীন্দ্রনাথের নিকট সান্নিধ্যে এলেও তার দ্বারা প্রমথ চৌধুরী বিশেষ প্রভাবান্বিত হননি। তিনি তাই সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে সংস্কারমুক্ত প্রগতিবাদের পরিচয় দেন।
- তাঁর সমকালীন সাহিত্যিকরা ভাষা বিষয়ে এবং সংস্কার বর্জিত আধুনিক মনোভাবের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। গদ্যের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান হল মুখের কথাকে সাহিত্যিক ভাষার মর্যাদা দান।
- প্রমথ চৌধুরী আধুনিকতা বলতে সংস্কারের দাসত্ব থেকে মনের মুক্তিকে বুঝেছেন।
- যুক্তিনিষ্ঠা, আবেগহীনতা, তির্যক বাগভঙ্গি ও নাগরিক বৈদগ্ধ্য তাঁর ভাষাকে দিয়েছে স্বতন্ত্র মর্যাদা। যেমন— “বইপড়ার শখটা মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ শখ হলেও আমি কাউকে শখ হিসেবে বই পড়তে পরামর্শ দিতে চাইনে। প্রথমত সে পরামর্শ কেউ গ্রাহ্য করবেন না, কেননা আমরা জাত হিসেবে শৌখিন নই; দ্বিতীয়ত অনেকে তা কুপরামর্শ মনে করবেন, কেননা আমাদের এখন ঠিক শখ করবার সময় নয়। আমাদের এই রোগশোক দুঃখদারিদ্র্যের দেশে জীবনধারণ করাই যখন হয়েছে প্রধান সমস্যা, তখন সে জীবনকে সুন্দর করা মহৎ করার প্রস্তাব অনেকের কাছেই নিরর্থক এবং সম্ভবত ও ঠেকবে।” (বইপড়া’ ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ)।
- তাঁর গদ্যরীতির শাণিত দীপ্তি পাঠককে আকর্ষণ করে যাকে বলে বাগ্বৈদগ্ধ্য। যেমন— “মন্ত্র সাপকে মুগ্ধ করতে পারে কিনা জানিনে, কিন্তু মানুষকে যে পারে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ গোটা ভারতবর্ষ।” (সবুজপত্রের মুখপত্র)।
অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন— “যথার্থ মুখের ভাষাকে সাহিত্যকর্মে ব্যবহারের গৌরব হুতোম ও বিবেকানন্দের প্রাপ্য, প্রমথ চৌধুরীর নয়।” তবুও তার ভাষারীতির স্বাতন্ত্র্য আছে, সেই স্বাতন্ত্র কৃত্রিম হলেও তাঁকে সাহিত্যে যথাযথ স্থান করে দেওয়ায়, বাগবৈদগ্ধ্যপূর্ণ ভাষার ব্যবহারে, বাঙালি মনন ও সংস্কৃতিকে কুসংস্কার ও অজ্ঞতা থেকে মুক্তিদান করে; প্রমথ চৌধুরী চলিত রীতির বাংলা গদ্যের যে নতুন সন্ধান দিয়েছেন এবং প্রবন্ধে আঙ্গিকের যে পরিবর্তন এনেছেন সেজন্য প্রাবন্ধিক হিসাবে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
Leave a Reply