বাংলা সাহিত্যে রামায়ণের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা কর।
বাংলা সাহিত্যে রামায়ণের প্রভাব
বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগে বাল্মীকি রামায়ণের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে ফুলিয়ার পণ্ডিতকবি কৃত্তিবাসের উপর। কৃত্তিবাস স্বয়ং বলেছেন—‘বাল্মীকি প্রসাদে রচে রামায়ণ গান’ কিংবা, ‘কৃত্তিবাস রচিল বাল্মীকিমুনি বরে’। রামায়ণের কোন কোন ঘটনা ও বিষয় নিয়ে বাংলা সাহিত্যে পালা কাহিনী রচিত হয়েছে। যেমন—‘অঙ্গদ রায়বার’, ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’, তরণীসেনের যুদ্ধ’, ‘মহীরাবণ বধ’, ‘লবকুশের যুদ্ধ’ প্রভৃতি।
মঙ্গলকাব্যের কবিরা রামায়ণের কোন কোন বিষয় বা প্রসঙ্গকে সংক্ষিপ্ত আকারে গ্রহণ করেছেন। কবিকঙ্কণ মুকুন্দ তাঁর ধনপতি সদাগরের কাহিনীতে সংক্ষেপে রামায়ণ কাহিনী বর্ণনা করেছেন। ধর্মমঙ্গল কাব্যের কবিরা রামকথা শুনিয়েছেন ধর্মের দেউলে অঙ্কিত চিত্রকলায় বা ফলা নির্মাণ পালায় ফলকে ক্ষোদিত বিশ্বকর্মার শিল্পের বর্ণনায়। ভারতচন্দ্র সংক্ষেপে রামায়ণের কথা উপস্থাপন করেছেন ভবানন্দ মজুমদারের মুখে।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রাধা, বিনা দোষে রমণীকে ত্যাগ করলে পুরুষকে সে কষ্ট ভোগ করতে হয়, সেই প্রসঙ্গে বলেছে—
বিনি দোষে কেহ নাহি ত্যজে রমণী।
সীতা রামে দুঃখ পাইল শুন চক্রপাণী।
রামকথা অবলম্বনে বাংলা সাহিত্যে আধুনিক কালে বহু নাটক রচিত হয়েছে। যেমন—
ক) মনোমোহন বসু—রামাভিষেক।
খ) কেদারনাথ গঙ্গোপাধ্যায়—‘সীতার বনবাস’, ‘লক্ষ্মণবর্জন’।
গ) তিনকড়ি বিশ্বাস—‘সীতার বনবাস’, ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’, ‘সীতার পাতাল প্রবেশ’।
ঘ) ব্রজমোহন রায়—‘রামাভিষেক’।
ঙ) মতিলাল রায়—‘সীতাহরণ’, ‘রাবণবধ’।
চ) গিরিশচন্দ্র ঘোষ—‘রাবণবধ’, ‘সীতার বনবাস’, ‘লক্ষ্মণবর্জন’, ‘সীতাহরণ’ প্রভৃতি।
ছ) দ্বিজেন্দ্রলাল রায়—‘পাষাণী’, ‘সীতা’।
বাংলা কাব্য-কবিতায় রামায়ণ প্রসঙ্গ নানাভাবে এসেছে। মধুসূদন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ধারাকে তাঁর কাব্যে সাঙ্গীকৃত করলেও মেঘনাদবধ কাব্যে নব-রামায়ণ রচনা করেছেন। কেননা এই কাব্যের রাবণ ও মেঘনাদ অমেয় ঐশ্বর্য, অপরিমিতমদশক্তি ও বলিষ্ঠ মানবের প্রতীক। মধুসূদন ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র প্রথমে বলেছেন—‘নমি আমি, কবিগুরু, তব পদাম্বুজে বাল্মীকি!’ পঞ্চবটীবনের বর্ণনায়, পঞ্চবটীবনে রামসীতার দাম্পত্য জীবনের চিত্রাঙ্কনে, অশোকবনে সরমার চিত্র রূপায়ণে এবং রাক্ষসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বর্ণনায় মধুসুদন বাল্মীকিরই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। মধুসূদন বীরাঙ্গনা কাব্যে দুটি পত্রিকায় রামায়ণের প্রসঙ্গ গ্রহণ করেছেন—‘দশরথের প্রতি কৈকেয়ী’ এবং ‘লক্ষ্মণের প্রতি শূর্পনখা’ পত্রে।
বিহারীলাল তাঁর সারদামঙ্গল কাব্যে কবিত্ব শক্তির বর্ণনা প্রসঙ্গে বাল্মীকির কবিত্বলাভের ঘটনাকে উপস্থাপন করেছেন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও রামায়ণের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। ‘প্রাচীন সাহিত্য’ গ্রন্থের ‘রামায়ণ’ প্রবন্ধে রামায়ণকে তিনি বহুকোটি নরনারীর অজস্র শান্তি ও শক্তির প্রেরণা বলে ঘোষণা করেছেন, তা ভারতবর্ষের চিরকালের আশা কামনার প্রতীক, ভারতীয় মহৎ আদর্শের প্রতিনিধি, ভারতবাসীর গৃহজীবনের কাব্য। রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন সাহিত্যে লিখেছেন—“পিতার প্রতি পুত্রের বশ্যতা, ভ্রাতার জন্য ভ্রাতার আত্মত্যাগ, পতি-পত্নীর মধ্যে পরস্পরের প্রতি নিষ্ঠা ও প্রজার প্রতি রাজার কর্তব্য কতদূর পর্যন্ত যাইতে পারে রামায়ণ তাহাই দেখাইয়াছে।”
‘সোনার তরী’ কাব্যের ‘পুরস্কার’ কবিতায় রামায়ণের ঘটনাকে স্মরণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ—
সে মহাপ্রাণের মাঝখানটিতে
যে মহারাগিণী আছিল ধ্বনিতে
আজিও সে গীত মহাসঙ্গীতে
বাজে মানবের কানে।
রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মীকি প্রতিভা’-তে রামায়ণের প্রভাব মুদ্রিত রয়েছে। কাহিনী কাব্যগ্রন্থের ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতায় মূল রামায়ণকে অনুসরণ করেছেন। যেমন মূল রামায়ণে ব্রহ্মা বাল্মীকিকে বলেছিলেন—
যচ্চাপ্যবিদিতং সৰ্ব্বং বিদিতং তে ভবিষ্যতি।
ন তে বাগনৃতা কাব্যে কাচিদ ভবিষ্যতি।।
‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতায় নারদ বাল্মীকিকে বলেছেন—
সেই সত্য, যা রচিবে তুমি,
ঘটে যা, তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি
রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।
মানসী কাব্যের ‘অহল্যার প্রতি’ কবিতায় রামায়ণের প্রভাব রয়েছে। শশিভূষণ দাশগুপ্ত বলেছেন— “বাল্মীকির সীতার সহিত রবীন্দ্রনাথের এই অহল্যার সোদরত্ব অতি স্পষ্ট।’’
রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকেও রয়েছে রামায়ণের পরোক্ষ প্রভাব। রামায়ণে কর্ণজীবী ও আকর্ষণজীবী দু-জাতীয় সভ্যতার প্রবল সংকট রূপায়িত হয়েছে ‘রক্তকরবী’ নাটকে। যক্ষপুরীর নিপ্রাণ সম্পদের মধ্যে নারীশক্তি নন্দিনীর আবির্ভাব— লংকার দেবদ্রোহী সমৃদ্ধির মধ্যে মানবকন্যা সীতার আবির্ভাবেরই অনুরূপ। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক ধনতান্ত্রিক যন্ত্রসভ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে নূতন করে রামায়ণের মর্মার্থ আবিষ্কার করে পুরাতত্ত্বের ভিত্তিতে নব উপলব্ধ মানসসত্যকে প্রকাশ করেছেন।
আখ্যায়িকা রচনার ক্ষেত্রেও রামায়ণী কথা প্রভাব বিস্তার করেছে নিবিড়ভাবে। বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে এস ওয়াজেদ আলি পর্যন্ত অনেক লেখকই রামায়ণের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। বিদ্যাসাগর তাঁর ‘সীতার বনবাস’ গ্রন্থে সীতার পাতাল প্রবেশের ঘটনাকে যুগমানসিকতার প্রেক্ষিতে যুক্তিবদ্ধ করে নবমূল্যায়ন করেছেন। এস. ওয়াজেদ আলি রামায়ণ পাঠকে বাঙালির tradition রূপে আখ্যা দিয়েছেন।
লোকসাহিত্যেও রামায়ণী কথা একটি বিশেষ উপাদানরূপে চিত্রিত। বিভিন্ন ছড়া, পাঁচালী, কথকতা ও লোকসঙ্গীতে রামায়ণের বিভিন্ন অংশ রূপায়িত হয়েছে এক গভীর মমতায় ও আকৃতিতে। বিশেষত লোকসঙ্গীতের ক্ষেত্রে ‘সীতার বারমাস্যা’, ‘সীতার বনবাস’ প্রভৃতি বিধৃত হয়ে আছে—এক নিবিড় আসক্তির টানে। বাংলা প্রবাদের ভাণ্ডারে রামায়ণের অনেক প্রবাদ ঠাঁই পেয়েছে। যেমন, ‘রাম না জন্মিতে রামায়ণ’, ‘শাপে বর’, ‘ঘরের শত বিভীষণ’, ‘কুম্ভকর্ণের ঘুম’, ‘রাবণের চিতা’, ‘লঙ্কাকাণ্ড’ প্রভৃতি।
রামায়ণ শুধু বাঙালি বা বাংলা সাহিত্যেরই বিশিষ্ট সম্পদ নয়, সমগ্র ভারতাত্মারই হিরন্ময় বাণীমূর্তি। সমস্ত ভারতবর্ষের ধ্যানধারণা, জীবন ও চৈতন্য যেমন রামায়ণে বিধৃত হয়ে আছে তেমনি রামায়ণও এক নিবিড় মমতা, পবিত্র ভক্তি ও একান্ত অনুরক্তিতে বিস্তৃত হয়ে আছে ভারতবাসীর রক্তের কণায় কণায়।
Leave a Reply