বাংলাদেশের কবি আল মাহমুদের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
আল মাহমুদ
তিরিশের আধুনিক বাংলা কবিতার নাগরিক চেতনার মধ্যেও বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ দৃশ্যপট, নদীনির্ভর জনপদ ও কর্মমুখর জীবনচাঞ্চল্যকে যিনি কবিতায় রূপ দান করেছিলেন তিনি আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯)। ব্যক্তিগত জীবনে উচ্চশিক্ষা লাভ না করলেও স্বীয় কবিত্বশক্তির গুণে যুগমানসকে সম্পূর্ণ করায়ত্ত করেছিলেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি হল— লোক লোকান্তর (১৯৬৩), কালের কলস (১৯৬৬), সোনালি কাবিন (১৯৭৩), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৭৬), বখতিয়ারের ঘোড়া (১৯৮৫), আরব্য রজনীর রাজহাঁস (১৯৮৭), মিথ্যাবাদী রাখাল (১৯৯৩), দোয়েল ও দয়িতা (১৯৯৭)। লোক লোকান্তর কাব্যের কবিতাগুলো রচিত হয়েছে ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়পর্বে। স্বাভাবিকভাবে এই কাব্যের কবিতাগুলিতে সংগ্রামমুখর বাংলাদেশের বিভিন্ন ঘটনা সন্নিবেশিত হয়েছে। সমকালীন শহুরে রুক্ষ্ম পরিবেশ কবির কাম্য নয় তাই তিনি গ্রামজীবনের স্নিগ্ধতার মধ্যে স্বদেশের সমগ্রতাকে খুঁজে পেতে চেয়েছেন। নাম কবিতাতেই দেখেছি কবির চৈতন্য নিবিড়তার প্রত্যাশায় পাখি হয়ে চন্দন গাছের ডালে বসে প্রকৃতির ঘ্রাণ নিতে চেয়েছে। প্রকৃতির নিসর্গ সৌন্দর্য দর্শনে মোহিত কবি যেন সমাজ-সংসারের সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে পাখির মতোই উড়ে যেতে চান। আবার কোনো কোনো কবিতায় কবি গ্রাম জীবনের চিরচেনা পরিবেশকে তুলে ধরেছেন। বলা যায় ‘অরণ্যে ক্লান্তির দিন’ কবিতার কথা। কবির স্মৃতিতে ভেসে ওঠে নান বর্ণময় ছবি। কবি দেখেন মাটির ঘরের মেঝেতে প্রাচীন কবির পদাবলী। কবির মনে পড়ে দরগাতোলার কথা যেখানে নাম না জানা অচেনা মেয়েটি মোমবাতি জ্বেলে প্রার্থনা করে তারপর সবুজ সাড়িতে শরীর ঢেকে হেঁটে যায় আয়েসে। পাহাড়ের ফাঁকে আড়াআড়িভাবে চাঁদ ওঠে। সবন্তের আগমন ঘটে, পাখি আসে, ফুল থেকে ফল হয়। এমনি সব লোক ঐতিহ্যকে গভী্র ভালোবাসায় লিপিবদ্ধ করেন কবি। শহুরে জীবনের কৃত্রিমতা, আড়ষ্টতা কবিকে বেশি করে নিসর্গ প্রেমিক করে তুলেছে। অরণ্যে সবাই স্বাধীন, সুখী হলেও কবি ভুলতে পারেন না নগর জীবনের কথা। তাই তাঁর মনে হয়েছে অরণ্যে সবাই সুখী কেবল কবি অসুখী। আলোচ্য কাব্যের তিতাস কবিতায় তিতাস নদীর তীরবর্তী গ্রামজীবন উঠে এসেছে। তিতাস কবির শৈশবের সঙ্গী। যতবারই কবি হৃদয়ের শান্তি পেতে তিতাসের তীরে এসে বসেছেন ততবারই তিতাসের নির্মল বাতাসে কবির হৃদয় জুড়িয়ে গেছে। ক্লান্ত শরীরে তিতাসের তীরে ঘুমিয়ে কবি স্বপ্ন দেখেন। গ্রাম্যজনপদ চিত্রকল্পের মতো ভেসে ওঠে তাঁর চেতনায়—
মাটির কলসে জল ভরে
ঘরে ফিরে সলিমের বউ তার ভিজে দুটি পায়।
অদূরের বিল থেকে পানকৌড়ি, মাছরাঙা, বক
পাখায় জলের ফোঁটা ফেলে দিয়ে উড়ে যায় দূরে;
জনপদে কি অধীর কোলাহল মায়াবী এ নদী
এনেছে স্রোতের মতো, আমি তার খুঁজিনি কিছুই।
আবার ‘আশ্রয়’ কবিতায় আমরা লক্ষ করি কবির জীবনে এমন একজন ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছে যিনি দিকভ্রান্ত কবির জীবনে আশার আলো জ্বালানোর চেষ্টা করে। কবির আত্মহত্যার রুখতে ঘুমের বড়ি, রজ্জু লুকিয়ে দেয়। কবির বাঁচার আশ্রয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এই ধরনের নিঃস্বার্থ ভালোবনাসা, স্বার্থত্যাগ শহরের নাগরিক জীবনে অকল্পনীয়। এখানে সবাই নিজেকে নিয়ে সদাব্যস্ত। সেজন্য কবির মনে হয়েছে যে যদি তিনি কোথাও তৃপ্তি পয়ে থাকে তো তা গ্রাম জীবনে। যে গ্রামের মানুষ কবিকে ভালোবাসে, কবির জন্য আজীবন প্রতীক্ষা করতেও পারে। তাই কবি বার বার গ্রামে ফেরার আকুতি জানিয়ে বলেছেন—
মানুষের বাসস্থান, লাউ মাচা, নীলাম্বরী নিয়ে
আমরা থাকতে চাই;
সভ্যতার হাত ধরে বিবর্তিত হয় মানুষ, মানুষের চাহিদা, চিন্তাভাবনা। কিন্তু সত্যই কি মৃত্তিকার টান উপেক্ষা করা সম্ভব। তাই কবির ব্যঙ্গ করে জানতে চেয়েছেন মানুষ আজ কতদূর এগিয়েছে। আসলে মানুষ যতই মাটির কাছ থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা করুক তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হয় না। যেমন কবিও পারেন না যেতে। তাই কোমল মাটির বুকে ধানের চারা গেঁথে দিতে গিয়ে কবির মাটিকে মনে হয়েছে ‘প্রিয়তমা কিষাণী’। একে ত্যাগ করা সম্ভব হয় না। বৃষ্টি যেন কবির পিঠে ভিজে হাত রাখে। আর সর্বানুভূতি দিয়ে কবি তাঁর দৃষ্টিকে সজাগ রাখার চেষ্টা করেন—
বুঝিবা স্বপ্নের ঘোরে আইল বাঁধা জমিনের ছক
বৃষ্টির কুয়াশা লেগে অবিশ্বাস্য জাদুমন্ত্রবলে
অকস্মাৎ পাল্টে গেলো। ত্রিকোণ আকারে যেন
ফাঁক হয়ে রয়েছে মৃন্ময়ী।
আর সে জ্যামিতি থেকে
ক্রমাগত উঠে এসে মাছ পাখি পশু আর মানুষের ঝাঁক
আমার চেতনা জুড়ে খুঁটে খায় পরস্পর বিরোধী আহার।
কেবল গ্রাম বাংলার প্রতি কবির ভালোবাসা নয় বাঙালি হওয়ার জন্যও কবি গর্বিত বোধ করেন। তাঁর এই স্বাজাত্যবোধ তথা সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের পরিচয় বিধৃত হয়েছে একাধিক কবিতায়। নিবিড় নিবিষ্টতায় কবি স্বদেশের চিত্র অঙ্কন করেছেন। এক স্বপ্নের ঘোরে কবি দেখছেন নিজের স্বদেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সহকর্মী, প্রতিবেশী, পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এমন পটভূমিতে দাঁড়িয়ে কবি বাঁচার অবলম্বন খুঁজছেন। নিসঙ্গ কবি শহর ত্যাগ করতে পারছেন না কারণ নিজের অজান্তেই কবি শহরকে ভালোবেসে ফেলেছেন। তাই ধ্বংসের মধ্যেই কবি জীবনের সন্ধান করেছেন—
এক লুটিয়ে পড়া মহানগরীর দুমড়ে যাওয়া গলিপথে
ঘুরে ঘুরে ক্ষুধার্ত, নিসঙ্গ ইঁদুরের মতো আমি
কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়ালাম। এখানে ছিল এক বিশাল প্রেক্ষাগৃহ
যা এখন একটি পরিত্যক্ত ইটখোলার মতো ছত্রখান হয়ে ছিটিয়ে পড়েছে।
এই প্রমোদভবনের পূর্বপার্শ্বে যেখানে একটি অতিকায় কামান ছিল,
কালে খাঁর সেই বিশাল কামানটিকে অনড় আর অখণ্ডভাবে দাঁড়িয়ে
থাকতে দেখে, আমি আনন্দে
কেঁদে ফেললাম। আমার স্বজাতির অনন্ত একটি চিহ্ন
এখনও অটুট আছে।
আল মাহমুদ আশাবাদী কবি। প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যে তিনি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর এই ইতিবাচক জীবনভাবনা পাঠককেও অনুপ্রাণিত করে। কুয়াশার মধ্যে কবির যাত্রা শুরু হলেও এক দিগন্তের আলোর ঝলকানিতে কবির যাত্রাপথ উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে তা কবি জানেন। রূপকথায় ভর করে কবির চোখের সামনে এক বিশাল উপত্যকার ছবি আশার দ্যোতক হয়ে ভেসে উঠছে। তাই দুঃখের কশাঘাতে ক্লান্ত না হয়ে কবি আনন্দে আপ্লুত হয়ে স্বপ্নের দিকে রওনা হতে চান—
স্বপ্নের সানুদেশে আমরা শস্যের বীজ ছড়িয়ে দেবো
বামদিকে বয়ে যাবে রুপোলি নদীর জল, ডানে
তীক্ষ্ণ তৃষিত পর্বত।
আল মাহমুদ রাজনীতি সচেতন কবি। তবে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক স্লোগান কিংবা শাসকবিরোধী সংলাপ তাঁর কবিতায় নেই। শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি সমসাময়িক জীবনপ্রবাহকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। অভিজ্ঞতার আলোয় তিনি দেখেছেন পরিবর্তিত সমাজ-ব্যবস্থার স্বরূপ, দেখেছেন বিপর্যস্ত বিবর্তিত সমাজ-পরিবেশ। কবির চোখের সামনে মাটির দেওয়াল ধ্বসে পড়ে, উপড়ে যায় অক্ষয় বটের শিকড়, হুড়মুড়িয়ে বিশ্বাসের মতো ভেঙে পড়ে গ্রামের পুরানো মসজিদ। কালের প্রবাহে এইসব পুরানো স্মারক মুছে যায়। থাকে কেবল কৃত্রিমতার চাকচিক্য, আড়ম্বর—
চড়ুইয়ের বাসা, প্রেম, লতাপাতা, বইয়ের মলাট।
দুমড়ে মুচড়ে খসে পড়ে। মেঘনার জলের কামড়ে
কাঁপতে থাকতে ফসলের আদিগন্ত সবুজ চিৎকার।
ভাসে ঘর, ঘড়া-কলসী, গরুর গোয়াল
বুবুর স্নেহের মতো ডুবে যায় ফুল তোলা পুরানো বালিশ।
বাসস্থান অতঃপর অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।
জলপ্রিয় পাখিগুলো উড়ে উড়ে ঠোঁট থেকে মুছে ফেলে বাতাসের ফেনা।
আল মাহমুদ স্বপ্নচারী কবি। তিনি স্বপ্ন দেখেন কবিতায়। তাঁর কবিতায় সবসময় থাকে গল্পের আখর। গল্প ও কবিতার যোগফলই গড়ে তোলে তাঁর কবিতার শরীর। লোক ঐতিহ্য, নারী, রাজনীতি-সচেতনতা তাঁর কবিতার আবশ্যিক উপাদান। কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি সন্ধান করেন প্রেম, প্রকৃতি, মানুষকে।
Leave a Reply