বাংলাদেশের কবি আহমদ রফিকের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
আহমদ রফিক
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র আহমদ রফিক (১৯২৯-) পঞ্চাশের অন্যতম কবি। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি প্রগতিশীত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। আন্দোলনের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত তিনি ছিলেন এক লড়াকু সৈনিকের ভূমিকায়। তাই বারবার তাঁকে শাসকের রক্তচক্ষুর সামনাসামনি হতে হয়েছে। তিনি একই সঙ্গে কবি, নিরপেক্ষ রাজনৈতিক বিশ্লেষক,এবং ভাষা সংগ্রামী। তাঁর কবিতায় আড়ম্বর নেই, রয়েছে বোধ ও চেতনার শাণিত দ্বীপ্তি। তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে সমাজ-রাষ্ট্রের নানা অসঙ্গতির কথা। জীবনবাদী কবি হিসাবে লেখার মধ্য দিয়ে তিনি বৈষম্যহীন মানবতাবাদী রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি হল—নির্বাসিত নায়ক (১৯৬৬), বাউল মাটিতে মন (১৯৭০), রক্তের নিসর্গে স্বদেশ (১৯৭৯), বিপ্লব ফেরারী, তবু (১৯৮৯), পড়ন্ত রোদ্দুরে (১৯৯৪), ভালোবাসা ভালো নেই (১৯৯৯)। তাঁর প্রথম কাব্যের কবিতাগুলির রচনাকাল ১৯৫০ থেকে ১৯৬০-এর মধ্যবর্তী সময়। কবিতাগুলিতে এই দশকের পূর্ব-পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক পটভূমির ছায়াপাত ঘটেছে। ভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি সমকালীন বন্যা পরিস্থিতি এবং দাঙ্গাও কবির নজর এড়ায়নি। বোঝাই যায় সমাজ-সচেতনভাবেই কবি কবিতা রচনায় অগ্রসর হয়েছেন। নবরাষ্ট্র পাকিস্তান লাভের পর পূর্ব-পাকিস্তানের অধিবাসীরা ভেবেছিল তাদের দুঃখের দিন শেষ হয়েছে। কিন্তু স্বপ্ন দেখার প্রাক-মুহূর্তে শাসকগোষ্ঠীর নজর পড়ে বাংলা ভাষার উপর। একে কবি গ্রহণের সঙ্গে তুলনা করেছেন। গ্রহণ যেমন অশুভের ইঙ্গিত বয়ে আনে তেমনি পাকিস্তানের শাসকরাও সেদিন মাতৃভাষা বাংলার উপর বিষবাস্প বইয়ে দিয়েছিল। লুপ্ত হওয়ার মুখে পড়েছিল বাংলা ভাষা। সেদিনের সেই পরিস্থিতিকে অসামান্য উপমায় তুলে ধরেছেন কবি—
পূর্ণগ্রাসের অশুভ আকর্ষণে
মুছে যায় সব শুদ্ধ রেখার ছবি
রুপালি মেঘের মায়াবী আমন্ত্রণে
ভেঙে পড়ে ভিৎ চেনা মহলের সিঁড়ি।
কেবল ভাষা বিপর্যয় নয় জাতির দুর্দিনে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও কবির চেতনার ভীত নাড়িয়ে দেয়। পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ কেবল রাষ্ট্রের শাসনের শিকার হয়নি বন্যাও তাদের দৈনন্দিন জনজীবনে বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। সেই বিপর্যয়ের মাঝেই জীবন-মৃত্যুর সহাবস্থান লক্ষ করে কবি বলেছেন—
প্রাচীন বটের ডালে অবিকল্প নিবিড় আশ্রয়ে
ব্যথায় পাণ্ডুর নীল অসহায় আসন্ন সম্ভবা
জননীর দেহ চিরে জাতকের কণ্ঠে জাগে সাড়া
প্রাণের সজীব রোল। প্রচণ্ড গর্জনে
কৃষ্ণাভ মৃত্যুর স্রোত ঘূণ্যমান বয়ে চলে নিচে।
১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের ভয়াবহ দাঙ্গা কবির নজর এড়ায়নি। কবি দেখেছেন ভয়াল মৃত্যুর শিখা কিভাবে কোমল আকাশকে ঢেকে দিয়েছে। প্রেতের ডানার মতো শবভুক শকুনির ছায়ায় গলিতে আঁধার নেমেছে, হন্তাকারক দিন রক্তের পিপাসায় রাতের দিকে ছুটে চলেছে। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে রবীন্দ্রনাথের ফটো, শিক্ষার্থীর বই, ধর্ষিতার শব। কিন্তু কবি জীবনের এই কালো দিনকে পিছনে ফেলে আলোর দিকে অগ্রসর হতে চান। নরখাদকদের লোভের লেলিহান শিখাকে পাশ কাটিয়ে কবি প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে চান—
এখন আমিষ লোভী ব্যাধি হতে মুক্তি চায় মন
উজ্জ্বল প্রাণের ছবি প্রজাপতি উড়ে আসে কাছে,
সামান্য আলোর স্পর্শে ফোটে অনন্য আকাশ
পৃথিবী প্রকৃতি মিলে অপরূপ ছবি হয়ে উঠে।
‘বাউল মাটিতে মন’ কাব্যের কবিতাগুলি ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে রচিত হলেও সেই সময়ের আঁচ এই কাব্যের কবিতাগুলিতে সেভাবে পড়েনি। কবি যেন মাটির কাছাকাছি ফিরতে চাইছেন। প্রকৃতির অনুষঙ্গে নিজেকে প্রাসঙ্গিক করতে চাইছেন। তাই প্রাণের আবেগে ফোটা শিমূল কিংবা সবুজের ক্যানভাস জুড়ে লাল কৃষ্ণচূড়ার সারি কবির চেতনায় অবিনাশী শিল্পের আলোয় রাঙিয়ে তোলে। কবির ঘ্রাণের স্পর্শে ধরা দেয় মঞ্জরিত শস্যের সুবাস। কবির অন্তরে জেগে উঠে বাউলের স্মৃতি। চারিদিকে আলোর উৎসবে প্রকৃতির মাঠ, ঘাট, মানুষ বিচিত্র কৌণিক উপস্থিতি নিয়ে হাজির হন। নিসর্গ সঙ্গীতে কবির চৈতন্যের পাঁপড়িগুলো পৃথিবীর শুদ্ধতম দিগন্তের দিকে এগিয়ে যায়—
নরম ছায়ার বুকে মুখ রেখে বারবার
তাই আমি ফিরে আসি মৃত্তিকার উদ্ভিদের
প্রাণের।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক-পটভূমিতে কবি লিখেছেন রক্তের নিসর্গে স্বদেশ কাব্যের কবিতাগুলি। আরক্ত বিশ্বাস আর হৃদয়ের গন্ধ নিয়ে কবির মুক্তির শপথ করেছেন। প্রয়োজনে বলিষ্ঠ হাতের মুঠোয় অতি যন্তে গাঢ় মমতায় রক্তাক্ত হৃদয় ছিঁড়ে তুলে নিয়ে যৌবনের আবেগে কবি বিশ্বাসের উষ্ণপথ পাড়ি দিতে রাজি। শত অত্যাচারেও কবি স্বদেশ ত্যাগ করেননি। ভাই-বোনের শব, ধর্ষিতা মায়ের রক্ত-মাংস-মজ্জা মাখা মাটির মমতা কবিকে পিছু টানে। চোখের জলের কান্নায় তিনি লক্ষ লক্ষ শবের ভাসমান দেহ দেখতে পান। গাছের ডালে ঝুলতে থাকা ছেঁড়া হাত যেন প্রতিরোধের পতাকা হয়ে দুলতে থাকে। রক্ত আর কাদায় মাখা বর্ণমালাকে দেখে কবি নতুন করে শপথ গ্রহণের প্রস্তুতি নেন—
অমোঘ রক্তের ঋণে বেঁধে নিয়ে প্রাণের উত্তাপ
তুলে নেবো প্রতিরোধ তীক্ষ্ণ হাতিয়ার।
কবি দেখেছেন শব্দের শরীর থেকে অবিরত রক্তক্ষরণ রূপসী বাংলাকে রাঙিয়ে দিয়েছে। ব্যথিত পাঁজর ভেদ করে গানের পরিবর্তে উঠে আসছে কান্নার ধ্বনি। কিন্তু রৌদ্রের মধ্যে আলোর পিপাসা দেখে কবির মনে আশা জাগে। তিনি বিশ্বাস করেন অস্থিসার দেহ নিয়েও মানুষ আজও বেঁচে আছে ইচ্ছা শক্তির জোরে। কারণ ভাইয়ের শোক, বোনের দুঃখকে কাটিয়ে তার চোখ এখন আলোর দিকে। মানুষের সংগ্রামময় জীবনকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন কবি। আসলে আহমদ রফিকের পুরো জীবনটাই সংগ্রামময় জীবন। সাম্যবাদী চেতনা তাঁর কবিতাকে দিয়েছে অফুরন্ত প্রাণ শক্তি। কবিতাকে তিনি বহুমাত্রিক দৃষ্টি কোণ থেকে বিচার করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর অভিজ্ঞতা তাঁকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করেছে। এর ফলে তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে বৈচিত্র্যময় ও তাৎপর্যপূর্ণ।
Leave a Reply