বাংলাদেশের কবি রফিক আজাদের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
রফিক আজাদ
ষাটের দশকে সামরিক শাসনের অবক্ষয়িত পরিবেশে যিনি একরাশ ঘৃণা, ক্ষোভ, হতাশা নিয়ে কাব্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি রফিক আজাদ (১৯৪৩-২০১৬)। শৃঙ্খলে আবদ্ধ সময়, সম্ভাবনাহীন জীবন, প্রেম-প্রকৃতিতে অনাস্থা ষাটের চিরপরিচিত রূপ। কবি এইসবকে সামনে রেখেই তাকে শিল্পিত রূপ দিতে উদ্যত হলেন। সংকটময় সময়ে দাড়িয়ে সেদিনের কবিদের কাছে সমাজজীবনের থেকে বড়ো হয়ে উঠেছিল ব্যক্তিসত্তা। রফিক আজাদও সামাজিক পরিবেশ থেকে সাময়িকভাবে মুখ ফিরিয়ে নিজ হৃদয়কে অবলোক করতে চেয়েছিলেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি হল— অসম্ভবের পায়ে (১৯৭৩), সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে (১৯৭৪), চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া (১৯৭৭), সশস্ত্র সুন্দর (১৯৮২), একজীবনে (১৯৮৩), হাতুড়ির নীচে জীবন (১৯৮৪), পরিকীর্ণ পানসালা আমার স্বদেশ (১৯৮৫), অপর অরণ্য (১৯৮৭), ক্ষমা করো বহমান হে উদার অমেয় বাতাস (১৯৯২), করো অশ্রুপাত (১৯৯৪), পাগলাগারদ থেকে প্রেমিকার চিঠি (১৯৯৫), কণ্ঠে তুলে আনতে চাই (১৯৯৭), বিরিশিরি পর্ব (১৯৯৭), হৃদয়ের কী বা দোষ (১৯৯৭), বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে (২০০৫)। প্রথম কাব্যের কবিতাগুলির রচনাকাল ১৯৬৪ থেকে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে। কাব্যজীবনের শুরুতেই শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে চেয়েছেন কবি। তাই নিজের চৈতন্যের কাছে আকুতি জানিয়ে কবি বলেছেন—
দ্বার খোলো, দ্বার খোলো, প্রতিশ্রুতি হে প্রিয় দরোজা,
শৈশবের পরিত্যক্ত ভো-ভো মাঠ থেকে, ধুলো-পায়ে,
এই দ্যাখো কুড়িয়ে এনেছি আমি হারানো বেলুন—
স্মৃতির সহিত সম-পদে; দয়া করো, দ্বার খোলো।
সন্ধ্যে থেকে যোজন দূরে থেকে কবি তাঁর প্রেমিকার কাঙ্খিত ঠোঁটে দেখেছিলেন উৎসবের ঝলমলে আলো, কিন্তু কাছে আসতেই তাঁর মোহভঙ্গ হয়, অন্ধকার কবিকে উপহাস করে, রক্তচক্ষু বাল্ব জ্বলে উঠে কবির প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। যে আশা নিয়ে কবি শিল্পিত জগতে প্রবেশ করতে এসেছিলেন তা ভঙ্গ হওয়ায় কবির চৈতন্যে এক গভীর নৈরাশ্যের জন্ম হয়। শুরু হয় অতীত ও বর্তমানের টানাপোড়েন।
ষাটের কবিতার যে নাগরিক বিকৃতি, পাশবিক উল্লাস, ক্রোধ, ঘৃণা থরে থরে সজ্জিত তা থেকে রফিক আজাদ নিজের কবিতাকে দূরে সরিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তাই কবির প্রাণপাখি নগর ভ্রমণে বেরিয়েছে কাঙ্ক্ষিত মুক্তির সন্ধানে। কিন্তু সেই সন্ধানসূত্রে কবি অনিচ্ছাসত্তেও নাগরিক অবক্ষয়ের সামনাসামনি হন। কবি নিজের শিল্প চৈতন্যকে আলোকিত করার জন্য জ্যোৎস্নার সন্ধানে বেরিয়েছেন। কিন্তু চারিদিকের আঁধারে কবি জ্যোৎস্নার সন্ধান পান না। শেষপর্যন্ত কবির অবচেতন সত্তা এসে জ্যোৎস্নার সংবাদ দেয়, যে সংবাদে মিশে তাকে ভোগবাদী জীবনের কামনা ও পতন—
জ্যোৎস্না আর নেই; সেদিন দুপুর রাতে
তাকে এই মহল্লার ক’জন বিখ্যাত বদমাশ
ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে নগরের বাইরের কোথাও…
স্বাধীন বাংলাদেশে কবি স্বপ্নভঙ্গের শিকার হয়েছেন। যে স্বদেশকে তিনি আপন করে নিতে চেয়েছেন, যাকে অবলম্বন করে বাঁচতে চেয়েছেন সেই স্বদেশ আজ শাসক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই চোখ থেকে রঙিন স্বপ্ন আজ অন্তর্হিত। ন্যূনতম খাদ্যের চাহিদা স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার আজ দিতে পারছে না। যারা রক্তের বিনিময়ে এ দেশকে স্বাধীনতার আলো দেখিয়েছে তাদের অনাহার কবিকে উত্তেজিত করে তোলে। তাই রফিক আজাদের মতো মৃদুভাষী কবিও স্বভাববিরোধী হয়ে বিদ্রোহের বার্তা দেন—
যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য এই দাবি,
তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কান্ড় ঘটে যাবে;
ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, আইন কানুন—
সম্মুখে যা-কিছু পাবো খেয়ে যাবো অবলীলাক্রমে:
থাকবে না কিছু বাকি— চ’লে যাবে হা-ভাতের গ্রাসে।
যদি বা দৈবাৎ সম্মুখে তোমাকে, ধরো, পেয়ে যাই—
রাক্ষুসে ক্ষুধার কাছে উপাদেয় উপচার হবে।
বিশ শতকের যুদ্ধ-দাঙ্গা-মহামারী, নতুন নতুন রাষ্ট্রের পত্তন, পুঁজিবাদী আস্ফালন কবিকে পীড়িত করে। ভোগের বাসনা ও অর্থের জটিলতায় দীর্ণ হয় কবিসত্তা। ভোগবাদী সভ্যতার অসুস্থ বিকার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ব্যাকুল কবিআত্মা বলে ওঠেন—
মন্দভাগ্য ব’লে
অনুন্নত দেশের সন্তান তীব্র মনস্তাপে জ্ব’লে
অবৈধ বাণিজ্যে নয়, তাকে আজ— সম্মুখ সমরে
শত্রুকে পরাস্ত ক’রে— তুলে নেবো শাশ্বতের ঘরে।
‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ কাব্যগ্রন্থ থেকে কবি বিষয় ও প্রকরণ আমুল পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। সুন্দরের আরাধনা, সৌন্দর্যের সন্ধান, মানুষের নিঃসঙ্গতা কবিতার বিষয় হিসাবে উঠে আসছে। কবি সৌন্দর্যের দিকে চোখ রেখে শাশ্বত সত্যের সন্ধান করেছেন। মানবসত্তার অন্বেষণে কবি মৃত্তিকায়, জলের গভীরে প্রবেশ করেছেন। ঐতিহ্যতাড়িত হয়েই কবি সত্য ও সুন্দরের মেলবন্ধন স্থাপনে আগ্রহী হয়েছেন—
সুন্দরের দিকে চোখ রেখে সত্যের সামান্য অংশ
খুঁজে পেতে অনেকেই লাঙলের ফলা আঁকড়ে ধরে—
সত্যের বদলে কিছু উঠে আসে সুন্দরের সীতা!
সত্যে ও সুন্দরে কোনো দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ বাধে না।
রফিক আজাদ এমন এক ধরনের শব্দশিল্পী যিনি কৃষকের মতো পরম মমতায় বীজ রোপণ করে। কিন্তু অন্যের জমির প্রতি কবির কোনো লোভ নেই। আসলে কবি তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য কবির কাব্যের কথা বলেছেন। তাঁর সমকালে অনেকেই কাব্যক্ষেত্রে নতুন নতুন ফসল ফলিয়েছেন কিন্তু তা নিয়ে কবির মাথাব্যথা নেই। নিজের অনুভূতির জগৎ নিয়েই কবি ব্যস্ত—
পরের জমি-জমার দিকে ফিরে
নজর দিই না যে,
একটিমাত্র ক্ষেত্রটিকে ঘিরে’
ব্যস্ত থাকি : কাজে।
চাষের যোগ্য জমিটিরে সদা
ফসল-উপযোগী
রাখাই নিয়ম-গা-গতরে খাটি
সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা সর্বদা।
সন্ন্যাসী নই, গরীব কৃষক : ভোগী;
গুচ্ছ-গুচ্ছ ধানের বাঁধি আঁটি।
ষাটের দশকজুড়ে রফিক আজাদ নিজেকে নির্মাণ করেছেন। নিজের স্বকীয় ভাষা ও প্রকরণকে সার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন কবিতায়। সমাজের সীমাহীন মিথ্যাচার ও কৃত্রিম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তাঁর কলম আজীবন ক্ষুরধার থেকেছে। অসম্ভবের পায়ে পায়ে কাব্যজীবন শুরু করলেও সীমাবদ্ধ জল ও সীমিত সবুজকে অনায়াসে অতিক্রম করে জীবনের সন্ধানে হাতুড়ির নীচে আশ্রয় খুঁজেছেন এবং হঠাৎই পরিকীর্ণ পানশালার মধ্যে নিজের স্বদেশকে আবিষ্কার করেছেন। এইসব নামকরণের মধ্যে দিয়ে তিনি সমকালীন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার রেখাচিত্র আঁকতে চেয়েছেন। সেই অর্থে তিনি বাস্তব জীবনের রূপকার।
Leave a Reply